নগরবাসী শোন তবে- অচিরেই তোমরা বধির হবে by মোকাম্মেল হোসেন
নিজেকে
হাঁসের বাচ্চা মনে হচ্ছে। হাঁসের বাচ্চা যেভাবে খাবারের উদ্দেশে দৌড় দেয়,
আমিও টেম্পোতে ওঠার জন্য সেভাবে দৌড় দিচ্ছি। তবে এতে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে
না। একটা টেম্পোতে সর্বোচ্চ ১৪ জনের বসার ব্যবস্থা আছে। বিপরীত দিক থেকে
কোনো খালি টেম্পো এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্তত ৩৪ জন সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ছে। সময় যত গড়াচ্ছে, ঘরমুখো মানুষের ভিড় তত বাড়ছে। সবার মধ্যেই একটা
যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। তারা সবাই একবার যুদ্ধ করতে করতে অফিসে এসেছে। এখন আবার
যুদ্ধ করতে করতে বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।
দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে দম নেয়ার জন্য ফুটপাতের একটা দোকানের সামনে গিয়ে বসলাম। বসে বসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি, হঠাৎ দেখি মাথায় হেলমেট নিয়ে এক লোক টেম্পো যুদ্ধে শামিল হয়েছে। লোকটার জন্য খুব মায়া হল। আহা রে, বেচারা! মোটরবাইকটা খারাপ না হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে বাসায় পৌঁছে যেত! একেই বলে ভাগ্য। অনেকেই যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তারপরও ভাগ্য তাদের যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
একটা টেম্পোতে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর মি. হেলমেট ঘুরে দাঁড়াতেই আমি তাকে চিনতে পারলাম। এ হচ্ছে শ্রীপুরের জয়নাল। আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় জয়নাল আমার সহপাঠী ছিল। সেসময় গাছগাছড়া দিয়ে তৈরি শ্রীপুরের ন্যাংটা বড়ির খুব নামডাক। কলেজে জয়নালের নাম হয়ে গেল ন্যাংটা জয়নাল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের কুয়াশা অস্তিত্ব হারালেও গাছের শাখায়, পাতায় পাতায় তার স্মৃতিটুকু থেকে যায়। জীবনের ট্রেনে যাত্রী হওয়ার পর যাদের বন্ধু বলে চিনেছি, সুহৃদ বলে জেনেছি- একেকজন একেক স্টেশনে নেমে গেলেও হৃদয়ে তাদের স্মৃতি অমলিন। জয়নালকে দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই সে ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের আয়নায় স্মৃতির বরফ ভাঙার দৃশ্য দেখতে দেখতে বললাম-
: চিনতে পারছ?
জয়নাল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল-
: পারছি, পারছি! চিনতে না পারার কোনো কারণ নাই!
জয়নালকে নিয়ে আবার ফুটপাতের সেই দোকানের সামনে গিয়ে বসলাম। চা-পানের ফাঁকে দুজন দুজনের বর্তমান অবস্থান ও ঠিকানা অদল-বদল করলাম। ওঠা দরকার। তারপরও উঠতে ইচ্ছা করছে না। মেঘের পাঁজর থেকে নেমে আসা শীতল বাতাস মরুযাত্রীর শরীরে যেরকম ভালো লাগার পরশ বুলিয়ে দেয়, সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। কথাবার্তার এক ফাঁকে জয়নালকে বললাম-
: মোটরসাইকেল যে গ্যারেজে দিছ, হেলমেটটাও সেইখানে রাইখ্যা আসলেই পারতা! খামাখা মাথায় লইয়া ঘুরতেছ কী জন্য?
জয়নাল আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠে বলল-
: মোটরসাইকেল থাকলে তো গ্যারেজে রাখব!
-তাইলে হেলমেট মাথায় দিছো কী জন্য!
: তার আগে তুমি বল- রাস্তায় যে ট্রাফিক পুলিশ থাকে, তারা কি মোটরসাইকেল চালানোর জন্য মাথায় হেলমেট দেয়?
-না!
: কিসের জন্য দেয়?
-শব্দ দূষণের হাত থেইক্যা রক্ষা পাওয়ার জন্য।
: আমিও সেই একই কারণে মাথায় হেলমেট পইরা চলাফেরা করি।
একজন মানুষ মাথায় হেলমেট পরছে অথচ মোটরসাইকেলে না চড়ে বাসে-টেম্পোতে চড়ছে, ফুটপাতে হাঁটছে- বিষয়টি আমার কাছে শুধু অভিনবই নয়, আশ্চর্যজনকও বটে! জয়নালকে বললাম-
: এই যে তুমি হেলমেট মাথায় দিয়ে চলাফেরা কর- লোকজন হাসাহাসি করে না!
-লোকের কথায় কী আসে যায়! সমস্যাটা আমার, তাই এর সমাধানটাও আমি আমার মতো কইরাই বাইছ্যা লইছি।
: শব্দ দূষণের হাত থেইক্যা বাঁচার জন্য তোমার মতো অন্যরাও যদি এভাবে সমাধানের পথ বাইছ্যা লয়, তাইলে ঢাকা শহর তো হেলমেটধারীদের শহরে পরিণত হবে!
-হইলে অবাক হওয়ার কিছু নাই। এই শহর হইল জংলিদের শহর। জংলিরা ফুটপাতের ওপর ওয়েল্ডিংয়ের দোকান খুইল্যা বসছে, যেখানে গাড়ির হর্ন বাজানোর কোনো প্রয়োজন নাই, সেখানে কমপক্ষে দশবার উচ্চশব্দের হর্ণ বাজাইতেছে...
হর্ন বাজানোর কথা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ল। আম্মাকে নিয়ে ডায়াবেটিস হাসপাতালে যাচ্ছি। শাহবাগ মোড়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে এক জোড়া মোটরসাইকেল বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে যাওয়ার সময় এক ভদ্রলোক আরোহীদের উদ্দেশে একটা গালি উচ্চারণ করলেন। আরোহীরা সংখ্যায় ছিল ছয়জন। বয়সে সবাই তরুণ। গালি শুনে তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে ভদ্রলোককে ঘিরে ফেলল। অবস্থা দেখে ভদ্রলোক ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। বিপদ বুঝতে পেরে আমি ভদ্রলোকের হাত ধরলাম। তারপর যুবকদের উদ্দেশে বললাম-
: আপনেরা হেলমেট পইরা মোটরসাইকেল চালান, তাই বুঝতে পারেন না এর হর্ন কতটা মারাত্মক। উনি হার্টের রোগী। আপনাদের বাজানো হর্ন শুইন্যা উনি এইখানে মারাও যাইতে পারতেন। তখন এর দায়-দায়িত্ব কে নিত? ফুটপাতের ওপর মোটরসাইকেল চালানোর ব্যাপারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। আর এইরকম হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোও নিষিদ্ধ। আপনেরা একসঙ্গে দুইটা আইন ভঙ্গ করার পরও কিছু হইতেছে না- কারণ দেশটা বাংলাদেশ। এই মোটরসাইকেল যে দেশে তৈরি হইছে, আমদানিকারকের মাধ্যমে একবার খোঁজ লইয়া দেখেন তো- সেখানে এই ধরনের হর্ন কেউ ভুলেও বাজায় কিনা!
আমার কথা শুনে যুবকরা কিছুক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চলে যাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
: ভাই, বাঁচাইলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বললাম-
: বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। আপনে শুধু একটা কথা মনে রাখবেন। বলা হয়- নারী জাতির হৃদয় হইল সমুদ্রের মতো গভীর। এই দেশে বাস করতে হইলে আপনের-আমার মতো মানুষের হৃদয়ও নারী জাতির হৃদয়ের মতো গভীর সমুদ্রে রূপান্তরিত করণ লাগব, যাতে সেই গভীরতা ভেদ কইরা কোনো কথা প্রকাশ না পায়...
আমাকে চুপ থাকতে দেখে জয়নাল বলল-
: তুমি আমার এই বেশভূষা দেইখ্যা খুব আবাক হইছ, তাই না?
- হুঁ, তা হইছি।
: শোন, আমি দেশের একজন সেরা নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পেশেন্ট ছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন আমার কান লইয়া ঘষামাজা করলেন--নানা প্রকার ওষুধ খাইতে দিলেন। শেষে বললেন- অতিরিক্ত শব্দ হয় এমন জায়গায় না যাওয়ার জন্য। সেরকম পরিবেশ কি এই শহরে আছে? রাস্তাঘাটে হাজার ধরনের শব্দ। বাড়িতে যাওয়ার পরও শব্দের হাত থেইক্যা নিস্তার নাই। লোডশেডিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাই পাওয়ারের জেনারেটর ডাইনে গর্জন দিয়া উঠে, বামে গর্জন দিয়া উঠে...
জয়নালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরদিন রাস্তায় বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার কানব্যথা শুরু হয়ে গেল। তবে প্রতিবিধান হিসেবে জয়নালের মতো আমি মাথায় হেলমেট পরলাম না- দুই কানে তুলা গুজে রাস্তায় চলাচল করতে লাগলাম। একদিন বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পর কান থেকে তুলা বের করতে দেখে লবণ বেগম অবাক হয়ে বলল-
: তুমি কানে তুলা দিছ কী জন্য!
- শব্দ দূষণ থেইক্যা বাঁচার জন্য।
: কি! আমি শব্দ দূষণ করি?
- আরে! কী যন্ত্রণা! তুমি শব্দ দূষণ করবা কিভাবে? তুমি বাস-ট্রাক, না পলিটিশিয়ান?
জয়নালের উদাহরণ দিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরও লবণ বেগমের সংশয় কাটছে না দেখে তাকে কম্পিউটারের সামনে টেনে নিয়ে বললাম-
: তোমারে একটা ওয়েবসাইট বাইর কইরা দিতেছি। পইড়া দেখ- শব্দ দূষণ সম্পর্কে সেখানে কী লেখছে!
ওয়েবসাইটে ঢাকা শহরের শব্দ দূষণ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেল তা এক কথায় ভয়াবহ। সেখানে বলা হয়েছে, ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে দিতে পারে। আর শব্দের মাত্রা যদি ১০০ ডেসিবল হয় তবে তার প্রভাবে মানুষ সম্পূর্ণরূপে বধির হয়ে যাবে। ঢাকা শহরে চলাচলকারী ট্রাক ও বাস থেকে সৃষ্টি হওয়া শব্দের মাত্রা ৯২ থেকে ৯৪ ডেসিবল। মোটরবাইক থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৮৭ থেকে ৯২ ডেসিবল। এর বাইরে অন্যান্য যানবাহন থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৯৫ ডেসিবল। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- দেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখের অবস্থা মারাত্মক।
ওয়েবে লসএঞ্জেলেসের শব্দবিজ্ঞানী ডা. ভার্ন ও নুভসেনের অভিমত দেখতে পেলাম। তারা বলেছেন-
: ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি।
জীবনের যাত্রা শুরু হয় শব্দের মধ্য দিয়ে। মানুষ শব্দের মাধ্যমেই রাগ-অনুরাগ, আদর-আবদার, উপদেশ-নির্দেশ ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়। টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ, সমুদ্রের গর্জন আর পাখির কিচির-মিচির শব্দ ছাড়াও যে নারী কোনো পুরুষের মুখ থেকে অথবা যে পুরুষ কোনো নারীর মুখ থেকে চির পুরাতন অথচ চির নতুন- ভালোবাসি এ কথাটা শুনতে পায় না, তার মতো হতভাগ্য বা হতভাগিনী এই পৃথিবীতে আর কে আছে!
শব্দহীনতা কখনোই কাম্য নয়। শব্দহীন জীবন মানে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া। অথচ এ শব্দই আজ দানবের রূপ ধরে আমাদের গ্রাস করতে চাচ্ছে। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব, আর অন্য একজন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে আমার শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেবে অথচ এ জন্য তার কোনো শাস্তি হবে না- এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
জয়নালকে একদিন ফোন করলাম-
: দোস্ত, আইজ বনানী যাব। সুযোগ পাইলে তোমার অফিসে একবার ঢুঁ মারতে পারি।
- আমি তো বাড়িতে।
: বাড়িতে তুমি কী কর?
- চাষাবাদ করি।
: চাকরি?
- চাকরি ছাইড়া দিছি।
এর কিছু দিন পর সকালে জামালপুর কমিউটার ট্রেনে চড়ে ঢাকায় আসছিলাম। শ্রীপুর স্টেশনে এসে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। কী করি- কী করি, শেষে জয়নালকে ফোন করলাম-
: জয়নাল, তোমাদের শ্রীপুরে আইসা তো ট্রেনের ইঞ্জিন বইট মারল।
- তুমি এখন কোন জায়গায়?
: স্টেশনে।
- একটু অপেক্ষা কর। আমি আসতেছি...
ভেবেছিলাম জয়নালের সঙ্গে দেখা করে ওখান থেকে বাসে ঢাকায় ফিরব। জয়নাল সে কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ না করার হুমকি দিয়ে বলল-
: যাওয়ার নাম মুখে আনবা না!
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিতে নিতে জয়নালকে জিজ্ঞেস করলাম-
: হঠাৎ চাকরি ছাড়লা কী জন্য?
- সে এক বিরাট ইতিহাস।
: কী রকম!
- বিরোধী দলের হরতাল চলাকালে একদিন অফিসে যাইতেছি, পুলিশ আটকাইল। বলল-
: আপনি হেলমেট পরছেন কেন?
হেলমেট পরার কারণ বললাম। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না। একজন চিৎকার করে বলল-
: মাথায় হেলমেট দিয়া পুলিশের গাড়িতে যারা আগুন দেয় ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করে- তুই তাদের দলের সদস্য। তোর নিস্তার নাই।
থানা হাজতে থাকা অবস্থায়ই এলাকার এমপি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমার সম্পর্কে জানতেন। তাই বিষয়টি বেশিদূর গড়ায়নি। আমি আর হেলমেট পরব না- এই মুচলেকা দেওয়ার পর ছাড়া পাইলাম। এরপর আমি ভাইব্যা দেখলাম- চাকরির জন্য জীবন না, জীবনের জন্যই চাকরি। যে চাকরি আমার জীবনকে অনিরাপদ করে তোলে- সে চাকরি কেন আমি করব? তাই থানা থেইক্যা বাইর হইয়া সোজা উত্তরের পথ ধরছি।
দেখলাম- জয়নাল কৃষিকাজ আর হাঁস-মুরগি ও মাছের খামার নিয়ে ভালোই আছে। ফেরার সময় জয়নাল আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল-
: শব্দ দূষণ সম্পর্কে একটা গান লিখছি আমি। আজকাইল তো বিভিন্ন রোগব্যাধি ও সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য রেডিও-টেলিভিশনে গানবাজনা প্রচার করা হয়। এই গানটা প্রচার করা যায় কিনা- দেইখ্য তো...
আমি কাগজটার ওপর চোখ রাখলাম। মোট ১২ লাইনের একটি গান। এর মধ্যে দুটি লাইন হচ্ছে এরকম-
নগরবাসী শোন তবে- অচিরেই তোমরা বধির হবে।
বধির হবে, বধির হবে, বধির হবে॥
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে দম নেয়ার জন্য ফুটপাতের একটা দোকানের সামনে গিয়ে বসলাম। বসে বসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি, হঠাৎ দেখি মাথায় হেলমেট নিয়ে এক লোক টেম্পো যুদ্ধে শামিল হয়েছে। লোকটার জন্য খুব মায়া হল। আহা রে, বেচারা! মোটরবাইকটা খারাপ না হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে বাসায় পৌঁছে যেত! একেই বলে ভাগ্য। অনেকেই যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তারপরও ভাগ্য তাদের যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
একটা টেম্পোতে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর মি. হেলমেট ঘুরে দাঁড়াতেই আমি তাকে চিনতে পারলাম। এ হচ্ছে শ্রীপুরের জয়নাল। আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় জয়নাল আমার সহপাঠী ছিল। সেসময় গাছগাছড়া দিয়ে তৈরি শ্রীপুরের ন্যাংটা বড়ির খুব নামডাক। কলেজে জয়নালের নাম হয়ে গেল ন্যাংটা জয়নাল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের কুয়াশা অস্তিত্ব হারালেও গাছের শাখায়, পাতায় পাতায় তার স্মৃতিটুকু থেকে যায়। জীবনের ট্রেনে যাত্রী হওয়ার পর যাদের বন্ধু বলে চিনেছি, সুহৃদ বলে জেনেছি- একেকজন একেক স্টেশনে নেমে গেলেও হৃদয়ে তাদের স্মৃতি অমলিন। জয়নালকে দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই সে ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের আয়নায় স্মৃতির বরফ ভাঙার দৃশ্য দেখতে দেখতে বললাম-
: চিনতে পারছ?
জয়নাল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল-
: পারছি, পারছি! চিনতে না পারার কোনো কারণ নাই!
জয়নালকে নিয়ে আবার ফুটপাতের সেই দোকানের সামনে গিয়ে বসলাম। চা-পানের ফাঁকে দুজন দুজনের বর্তমান অবস্থান ও ঠিকানা অদল-বদল করলাম। ওঠা দরকার। তারপরও উঠতে ইচ্ছা করছে না। মেঘের পাঁজর থেকে নেমে আসা শীতল বাতাস মরুযাত্রীর শরীরে যেরকম ভালো লাগার পরশ বুলিয়ে দেয়, সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। কথাবার্তার এক ফাঁকে জয়নালকে বললাম-
: মোটরসাইকেল যে গ্যারেজে দিছ, হেলমেটটাও সেইখানে রাইখ্যা আসলেই পারতা! খামাখা মাথায় লইয়া ঘুরতেছ কী জন্য?
জয়নাল আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠে বলল-
: মোটরসাইকেল থাকলে তো গ্যারেজে রাখব!
-তাইলে হেলমেট মাথায় দিছো কী জন্য!
: তার আগে তুমি বল- রাস্তায় যে ট্রাফিক পুলিশ থাকে, তারা কি মোটরসাইকেল চালানোর জন্য মাথায় হেলমেট দেয়?
-না!
: কিসের জন্য দেয়?
-শব্দ দূষণের হাত থেইক্যা রক্ষা পাওয়ার জন্য।
: আমিও সেই একই কারণে মাথায় হেলমেট পইরা চলাফেরা করি।
একজন মানুষ মাথায় হেলমেট পরছে অথচ মোটরসাইকেলে না চড়ে বাসে-টেম্পোতে চড়ছে, ফুটপাতে হাঁটছে- বিষয়টি আমার কাছে শুধু অভিনবই নয়, আশ্চর্যজনকও বটে! জয়নালকে বললাম-
: এই যে তুমি হেলমেট মাথায় দিয়ে চলাফেরা কর- লোকজন হাসাহাসি করে না!
-লোকের কথায় কী আসে যায়! সমস্যাটা আমার, তাই এর সমাধানটাও আমি আমার মতো কইরাই বাইছ্যা লইছি।
: শব্দ দূষণের হাত থেইক্যা বাঁচার জন্য তোমার মতো অন্যরাও যদি এভাবে সমাধানের পথ বাইছ্যা লয়, তাইলে ঢাকা শহর তো হেলমেটধারীদের শহরে পরিণত হবে!
-হইলে অবাক হওয়ার কিছু নাই। এই শহর হইল জংলিদের শহর। জংলিরা ফুটপাতের ওপর ওয়েল্ডিংয়ের দোকান খুইল্যা বসছে, যেখানে গাড়ির হর্ন বাজানোর কোনো প্রয়োজন নাই, সেখানে কমপক্ষে দশবার উচ্চশব্দের হর্ণ বাজাইতেছে...
হর্ন বাজানোর কথা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ল। আম্মাকে নিয়ে ডায়াবেটিস হাসপাতালে যাচ্ছি। শাহবাগ মোড়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে এক জোড়া মোটরসাইকেল বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে যাওয়ার সময় এক ভদ্রলোক আরোহীদের উদ্দেশে একটা গালি উচ্চারণ করলেন। আরোহীরা সংখ্যায় ছিল ছয়জন। বয়সে সবাই তরুণ। গালি শুনে তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে ভদ্রলোককে ঘিরে ফেলল। অবস্থা দেখে ভদ্রলোক ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। বিপদ বুঝতে পেরে আমি ভদ্রলোকের হাত ধরলাম। তারপর যুবকদের উদ্দেশে বললাম-
: আপনেরা হেলমেট পইরা মোটরসাইকেল চালান, তাই বুঝতে পারেন না এর হর্ন কতটা মারাত্মক। উনি হার্টের রোগী। আপনাদের বাজানো হর্ন শুইন্যা উনি এইখানে মারাও যাইতে পারতেন। তখন এর দায়-দায়িত্ব কে নিত? ফুটপাতের ওপর মোটরসাইকেল চালানোর ব্যাপারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। আর এইরকম হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোও নিষিদ্ধ। আপনেরা একসঙ্গে দুইটা আইন ভঙ্গ করার পরও কিছু হইতেছে না- কারণ দেশটা বাংলাদেশ। এই মোটরসাইকেল যে দেশে তৈরি হইছে, আমদানিকারকের মাধ্যমে একবার খোঁজ লইয়া দেখেন তো- সেখানে এই ধরনের হর্ন কেউ ভুলেও বাজায় কিনা!
আমার কথা শুনে যুবকরা কিছুক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চলে যাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
: ভাই, বাঁচাইলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বললাম-
: বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। আপনে শুধু একটা কথা মনে রাখবেন। বলা হয়- নারী জাতির হৃদয় হইল সমুদ্রের মতো গভীর। এই দেশে বাস করতে হইলে আপনের-আমার মতো মানুষের হৃদয়ও নারী জাতির হৃদয়ের মতো গভীর সমুদ্রে রূপান্তরিত করণ লাগব, যাতে সেই গভীরতা ভেদ কইরা কোনো কথা প্রকাশ না পায়...
আমাকে চুপ থাকতে দেখে জয়নাল বলল-
: তুমি আমার এই বেশভূষা দেইখ্যা খুব আবাক হইছ, তাই না?
- হুঁ, তা হইছি।
: শোন, আমি দেশের একজন সেরা নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পেশেন্ট ছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন আমার কান লইয়া ঘষামাজা করলেন--নানা প্রকার ওষুধ খাইতে দিলেন। শেষে বললেন- অতিরিক্ত শব্দ হয় এমন জায়গায় না যাওয়ার জন্য। সেরকম পরিবেশ কি এই শহরে আছে? রাস্তাঘাটে হাজার ধরনের শব্দ। বাড়িতে যাওয়ার পরও শব্দের হাত থেইক্যা নিস্তার নাই। লোডশেডিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাই পাওয়ারের জেনারেটর ডাইনে গর্জন দিয়া উঠে, বামে গর্জন দিয়া উঠে...
জয়নালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরদিন রাস্তায় বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার কানব্যথা শুরু হয়ে গেল। তবে প্রতিবিধান হিসেবে জয়নালের মতো আমি মাথায় হেলমেট পরলাম না- দুই কানে তুলা গুজে রাস্তায় চলাচল করতে লাগলাম। একদিন বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পর কান থেকে তুলা বের করতে দেখে লবণ বেগম অবাক হয়ে বলল-
: তুমি কানে তুলা দিছ কী জন্য!
- শব্দ দূষণ থেইক্যা বাঁচার জন্য।
: কি! আমি শব্দ দূষণ করি?
- আরে! কী যন্ত্রণা! তুমি শব্দ দূষণ করবা কিভাবে? তুমি বাস-ট্রাক, না পলিটিশিয়ান?
জয়নালের উদাহরণ দিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরও লবণ বেগমের সংশয় কাটছে না দেখে তাকে কম্পিউটারের সামনে টেনে নিয়ে বললাম-
: তোমারে একটা ওয়েবসাইট বাইর কইরা দিতেছি। পইড়া দেখ- শব্দ দূষণ সম্পর্কে সেখানে কী লেখছে!
ওয়েবসাইটে ঢাকা শহরের শব্দ দূষণ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেল তা এক কথায় ভয়াবহ। সেখানে বলা হয়েছে, ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে দিতে পারে। আর শব্দের মাত্রা যদি ১০০ ডেসিবল হয় তবে তার প্রভাবে মানুষ সম্পূর্ণরূপে বধির হয়ে যাবে। ঢাকা শহরে চলাচলকারী ট্রাক ও বাস থেকে সৃষ্টি হওয়া শব্দের মাত্রা ৯২ থেকে ৯৪ ডেসিবল। মোটরবাইক থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৮৭ থেকে ৯২ ডেসিবল। এর বাইরে অন্যান্য যানবাহন থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৯৫ ডেসিবল। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- দেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখের অবস্থা মারাত্মক।
ওয়েবে লসএঞ্জেলেসের শব্দবিজ্ঞানী ডা. ভার্ন ও নুভসেনের অভিমত দেখতে পেলাম। তারা বলেছেন-
: ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি।
জীবনের যাত্রা শুরু হয় শব্দের মধ্য দিয়ে। মানুষ শব্দের মাধ্যমেই রাগ-অনুরাগ, আদর-আবদার, উপদেশ-নির্দেশ ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়। টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ, সমুদ্রের গর্জন আর পাখির কিচির-মিচির শব্দ ছাড়াও যে নারী কোনো পুরুষের মুখ থেকে অথবা যে পুরুষ কোনো নারীর মুখ থেকে চির পুরাতন অথচ চির নতুন- ভালোবাসি এ কথাটা শুনতে পায় না, তার মতো হতভাগ্য বা হতভাগিনী এই পৃথিবীতে আর কে আছে!
শব্দহীনতা কখনোই কাম্য নয়। শব্দহীন জীবন মানে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া। অথচ এ শব্দই আজ দানবের রূপ ধরে আমাদের গ্রাস করতে চাচ্ছে। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব, আর অন্য একজন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে আমার শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেবে অথচ এ জন্য তার কোনো শাস্তি হবে না- এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
জয়নালকে একদিন ফোন করলাম-
: দোস্ত, আইজ বনানী যাব। সুযোগ পাইলে তোমার অফিসে একবার ঢুঁ মারতে পারি।
- আমি তো বাড়িতে।
: বাড়িতে তুমি কী কর?
- চাষাবাদ করি।
: চাকরি?
- চাকরি ছাইড়া দিছি।
এর কিছু দিন পর সকালে জামালপুর কমিউটার ট্রেনে চড়ে ঢাকায় আসছিলাম। শ্রীপুর স্টেশনে এসে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। কী করি- কী করি, শেষে জয়নালকে ফোন করলাম-
: জয়নাল, তোমাদের শ্রীপুরে আইসা তো ট্রেনের ইঞ্জিন বইট মারল।
- তুমি এখন কোন জায়গায়?
: স্টেশনে।
- একটু অপেক্ষা কর। আমি আসতেছি...
ভেবেছিলাম জয়নালের সঙ্গে দেখা করে ওখান থেকে বাসে ঢাকায় ফিরব। জয়নাল সে কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ না করার হুমকি দিয়ে বলল-
: যাওয়ার নাম মুখে আনবা না!
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিতে নিতে জয়নালকে জিজ্ঞেস করলাম-
: হঠাৎ চাকরি ছাড়লা কী জন্য?
- সে এক বিরাট ইতিহাস।
: কী রকম!
- বিরোধী দলের হরতাল চলাকালে একদিন অফিসে যাইতেছি, পুলিশ আটকাইল। বলল-
: আপনি হেলমেট পরছেন কেন?
হেলমেট পরার কারণ বললাম। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না। একজন চিৎকার করে বলল-
: মাথায় হেলমেট দিয়া পুলিশের গাড়িতে যারা আগুন দেয় ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করে- তুই তাদের দলের সদস্য। তোর নিস্তার নাই।
থানা হাজতে থাকা অবস্থায়ই এলাকার এমপি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমার সম্পর্কে জানতেন। তাই বিষয়টি বেশিদূর গড়ায়নি। আমি আর হেলমেট পরব না- এই মুচলেকা দেওয়ার পর ছাড়া পাইলাম। এরপর আমি ভাইব্যা দেখলাম- চাকরির জন্য জীবন না, জীবনের জন্যই চাকরি। যে চাকরি আমার জীবনকে অনিরাপদ করে তোলে- সে চাকরি কেন আমি করব? তাই থানা থেইক্যা বাইর হইয়া সোজা উত্তরের পথ ধরছি।
দেখলাম- জয়নাল কৃষিকাজ আর হাঁস-মুরগি ও মাছের খামার নিয়ে ভালোই আছে। ফেরার সময় জয়নাল আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল-
: শব্দ দূষণ সম্পর্কে একটা গান লিখছি আমি। আজকাইল তো বিভিন্ন রোগব্যাধি ও সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য রেডিও-টেলিভিশনে গানবাজনা প্রচার করা হয়। এই গানটা প্রচার করা যায় কিনা- দেইখ্য তো...
আমি কাগজটার ওপর চোখ রাখলাম। মোট ১২ লাইনের একটি গান। এর মধ্যে দুটি লাইন হচ্ছে এরকম-
নগরবাসী শোন তবে- অচিরেই তোমরা বধির হবে।
বধির হবে, বধির হবে, বধির হবে॥
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments