বিজেপি ক্ষমতায় এলে ভারতের জন্য বিপদ
বিমান বসু। পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআইএম) কেন্দ্রীয় নেতা। জন্ম ১৯৪০ সালের ১ জুলাই, কলকাতায়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনাও করেছেন কলকাতায়। ১৯৫৮ সালে আইনশাস্ত্র পড়ার সময়ই বিমান বসু কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক সদস্যপদ লাভ করেন। এর আগে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) রাজ্য কমিটির সদস্য এবং ২০০৬ সালে সম্পাদক হন। ২০০৫ সাল থেকে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭১ সালে সহায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন এই বামপন্থী নেতা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও অমর সাহা
প্রথম আলো পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট শাসন করার পর ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। গত আড়াই বছরের তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিমান বসু সত্যি কথা বলতে, আমাদের রাজ্যের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকার যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল, পরবর্তী সরকার সেগুলো নস্যাৎ করে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমি ভূমি সংস্কার ও অপারেশন বর্গার কথা বলতে পারি। বামফ্রন্টের এ কর্মসূচি সারা ভারতবর্ষে একটি আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বর্গাচাষি মারা গেলে তার সন্তানেরা সেই জমির ওপর অধিকার ভোগ করত। জমির মালিক জমি বিক্রি করতে চাইলে বর্গাচাষির সঙ্গে কথা বলতে হবে; নতুন মালিক যেন তার অধিকার খর্ব করতে না পারে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, ছোট চাষিদের সহায়তায় বিনা মূল্যে অল্প পরিমাণ বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা হতো। এই যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট কৃষিব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আনল, পরবর্তী সরকারের উচিত ছিল সেটিকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু তারা সেটি না করে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
প্রথম আলো গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বামফ্রন্টের প্রধান অবদান কী ছিল?
বিমান বসু বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পঞ্চায়েতব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ফসল তোলা নিয়ে গ্রামে গ্রামে সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। আমরা সেটা বন্ধ করেছি। গ্রামবাংলায় সুস্থিতি ও সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছি। আমরা যে পঞ্চায়েতব্যবস্থা চালু করেছিলাম, এখন তার ওপরও আমলাতন্ত্রের খবরদারি শুরু হয়েছে। আমাদের সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত হতো, এখন তা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো বিধানসভার পর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বামফ্রন্টের খারাপ করার কারণ কী?
বিমান বসু ৩৪ বছর পর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট হেরে গেল। জয়ী হলো কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। এর প্রভাব জনগণের মধ্যে ভিন্ন মাত্রায় পড়েছে। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে কয়েকটি জেলায় মাওবাদী চরমপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ২০০৯ ও ২০১০ সালেও কয়েকটি জেলায় মাওবাদীদের সঙ্গে নিয়ে তারা আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। সে সময়ে পরিকল্পিতভাবেই তৃণমূলের কর্মীদের মাওবাদী দলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর শাসক দল তাদের নীতি পরিবর্তন করে এবং যাদের মাওবাদী দলে পাঠানো হয়েছিল, তাদের আবার তৃণমূলে ফিরিয়ে আনে। এ অবস্থায়ই পঞ্চায়েত নির্বাচন হলো, যাতে তৃণমূলের সন্ত্রাস-মাস্তানি সত্ত্বেও আমরা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছি।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে তৃণমূল নেত্রী সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য জনগণকে অসম্ভব ও অবাস্তব সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ কিছুটা সময়ের জন্য হলেও তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে, এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না খতিয়ে দেখছেন না। যেমন সরকার গ্রামীণ পুলিশে চাকরি দিয়েছে। কোনো ব্লক থেকে এক-দুজন করে লোক নিলেও বলা হচ্ছে ২০ জন নেওয়া হবে, ছোট ব্লকে ১৫ জন। কিন্তু যখন দেখা যাবে সরকার এই প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারছে না, তখন তৃণমূলের প্রতি জনগণের মোহভঙ্গ হবে।
প্রথম আলো নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে বামফ্রন্টের গৃহীত কর্মসূচি কি ভুল ছিল বলে মনে করেন?
বিমান বসু প্রকল্প নেওয়া ভুল না হলেও তাড়াহুড়ো করা ঠিক হয়নি। মানুষকে বুঝিয়েই সবকিছু করা উচিত ছিল। এখানে বলা প্রয়োজন, নন্দীগ্রামে কিছুই করা হয়নি, এমনকি জরিপও হয়নি। সবই তৎকালীন বিরোধী দলের প্রচারণা ছিল। আর সিঙ্গুরে তাড়াহুড়ো না করে যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিল, তাদেরটা নিয়েই কাজ শুরু করা যেত। সেই জমির পরিমাণ ৬০৪ একর, যা সরকার বুঝে নিয়েছিল। আর যারা জমি দিতে চায়নি, তাদের জমি অধিগ্রহণ না করে বিকল্প ব্যবস্থা করা যেত। সেটা করা হয়নি বলেই সমস্যা তৈরি হলো।
প্রথম আলো বামফ্রন্টের জনসমর্থন পুনরুদ্ধারে আপনারা কী কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?
বিমান বসু বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বামপন্থীদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে, তাতে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গত আড়াই বছরে বামফ্রন্টের ১৩১ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৫৩ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসীর সংখ্যা ৯ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের ৪৮ জন। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে; গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার নেতা-কর্মী; পলাতক জীবন বেছে নিয়েছেন আরও হাজার তিনেক। এ অবস্থায় আমরা কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করছি, অনেককে আইনি সহায়তা দিচ্ছি। একই সঙ্গে সরকারের কথা ও কাজের অমিলের বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরছি।
প্রথম আলো সারা ভারতের রাজনীতিতে এখন বামপন্থীদের অবস্থান কী?
বিমান বসু সত্য কথা বলতে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরালার বাইরে সারা ভারতে বামফ্রন্টের জনভিত্তি তেমন নেই। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, বিহার ও হিমাচলের কিছু এলাকায় ভালো অবস্থান আছে; তবে সারা রাজ্যে নয়।
প্রথম আলো আগামী নির্বাচনে মৌলবাদী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের কোনো বোঝাপড়া হবে কি?
বিমান বসু নির্বাচনী বোঝাপড়া নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী নভেম্বরে পাঁচটি রাজ্যে যে বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচনের ফলাফলেই বোঝা যাবে, আসলে বিজেপি কতটা জায়গা দখল করতে পারল। বিজেপির বিরাট মতলব আছে। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর মানুষ বিজেপিকে বিশ্বাস করে না। যারা সরাসরি রাজনীতি করে না, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস বা আঞ্চলিক কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়—ভারতের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শেই বিশ্বাসী। আমার মনে হয় না তারা বিজেপির রাজনীতি গ্রহণ করবে। তবে অনেক সময় ভুল করেও মানুষ বিষ খায়। সে রকম কিছু হলে সেটি ভারতের জন্য বিপদ হবে।
প্রথম আলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে আসি। বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও দুটি বকেয়া সমস্যা রয়ে গেছে—তিস্তার পানিবণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন। আপনার মন্তব্য কী?
বিমান বসু এটি দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের পানি সমস্যা ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান আগেই হওয়া উচিত ছিল। আমি মনে করি, উভয় দেশের স্বার্থেই সেটা করতে হবে। বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র। অতএব এই বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা ভারত সরকারকে করতে হবে। আমরা সব সময়ই এ দুটি সমস্যা সমাধান করার কথা বলে আসছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা তো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানেন না। তাঁরা যদি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতেন, সবাইকে নিয়ে বসতেন, তাহলে আমরা আমাদের কথা বলতে পারতাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে চুক্তির বিরোধিতা করছে, কিসের ভিত্তিতে? বামফ্রন্ট তো দুই কোটি ভোটারের সমর্থন পেয়েছে। তারা পেয়েছে দুই কোটি ৩০ লাখ ভোটারের সমর্থন, সে ক্ষেত্রে তাদের কেন্দ্রকে বলা উচিত ছিল, আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মতামত নিই; তারপর সিদ্ধান্ত দেব। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে ঢাকা সফল বাতিল করলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গেলেন না। তিনি তো সব দলের নেতাদের নিয়ে বসে, পানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে পারতেন; তা করলেন না।
জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকতে ঠিক এর বিপরীত ভূমিকাই নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের স্বার্থেই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়া উচিত। কেন্দ্রও তাঁর যুক্তি মেনে নিয়ে চুক্তি করেছিল।
প্রথম আলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচির প্রতিবাদে আপনারা ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্ত কি সঠিক বলে মনে করেন?
বিমান বসু যেকোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করার আগে দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রথমে দেখতে হবে। আমরা বলেছিলাম, এই কর্মসূচিতে দুর্ঘটনা ঘটলে মার্কিন কোম্পানিকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভোপাল ট্র্যাজেডিতে ইউনিয়ন কারবাইডের কাছ থেকে আমরা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারিনি। সেখানে বহু মানুষ জীবন দিয়েছে ও পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন হাইকোর্টের রায়ে সেই কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
প্রথম আলো সারা বিশ্বে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী?
বিমান বসু বামপন্থীরা যেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই বৈষম্য যেহেতু রয়ে গেছে, সেহেতু বামপন্থার ভবিষ্যৎ নেই, এ কথা বলা যাবে না। বামপন্থার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। সেখানে তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। নিজেদের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছে। তারা আমেরিকার খবরদারি মেনে নেয়নি। বিশ্বব্যবস্থায় ল্যাটিন আমেরিকার এই ধারা আমাদের জন্য নতুন দিশা দেখাচ্ছে। আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো গিরগিটির মতো বারবার রং বদলালেও তাদের মূল যে বৈশিষ্ট্য শোষণ ও জবরদস্তি, তা থেকে সরে আসছে না। তারা সিরিয়ায় হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল, চীন ও রাশিয়ার জন্য পারেনি। এমনকি আমেরিকার ৭০ শতাংশ মানুষ এ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমেরিকার আসল উদ্দেশ্য ইরানকে কব্জা করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
প্রথম আলো বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আপনার বার্তা কী?
বিমান বসু বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভারতের মতো কৃষিভিত্তিক। যদিও সাম্প্রতিক কালে সেখানে শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে। কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে সংহত করা, ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে। এর পাশাপাশি শিল্পশ্রমিকদের স্বার্থও দেখতে হবে। অবিভক্ত ভারতে বাংলার যে অংশে বাম ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রায় সবটাই বর্তমান বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, হাজং বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের উত্তরাধিকার বহনকারী বাংলাদেশের মানুষ কারও কাছে নতি স্বীকার করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
প্রথম আলো আপনারা কি অতীতের ভুল সংশোধন করে পার্টিকে সামনে এগিয়ে নিতে চান?
বিমান বসু আমাদের কাজে ভুলত্রুটি ছিল স্বীকার করি। নিরন্তর আলোচনা এবং কাজের মাধ্যমেই অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করে সামনে এগোতে হবে। দমন-পীড়ন ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পার্টিতে আসছে—এটি আশার কথা।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
বিমান বসু ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও অমর সাহা
প্রথম আলো পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট শাসন করার পর ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। গত আড়াই বছরের তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিমান বসু সত্যি কথা বলতে, আমাদের রাজ্যের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকার যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল, পরবর্তী সরকার সেগুলো নস্যাৎ করে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমি ভূমি সংস্কার ও অপারেশন বর্গার কথা বলতে পারি। বামফ্রন্টের এ কর্মসূচি সারা ভারতবর্ষে একটি আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বর্গাচাষি মারা গেলে তার সন্তানেরা সেই জমির ওপর অধিকার ভোগ করত। জমির মালিক জমি বিক্রি করতে চাইলে বর্গাচাষির সঙ্গে কথা বলতে হবে; নতুন মালিক যেন তার অধিকার খর্ব করতে না পারে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, ছোট চাষিদের সহায়তায় বিনা মূল্যে অল্প পরিমাণ বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা হতো। এই যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট কৃষিব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আনল, পরবর্তী সরকারের উচিত ছিল সেটিকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু তারা সেটি না করে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
প্রথম আলো গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বামফ্রন্টের প্রধান অবদান কী ছিল?
বিমান বসু বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পঞ্চায়েতব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ফসল তোলা নিয়ে গ্রামে গ্রামে সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। আমরা সেটা বন্ধ করেছি। গ্রামবাংলায় সুস্থিতি ও সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছি। আমরা যে পঞ্চায়েতব্যবস্থা চালু করেছিলাম, এখন তার ওপরও আমলাতন্ত্রের খবরদারি শুরু হয়েছে। আমাদের সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত হতো, এখন তা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো বিধানসভার পর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বামফ্রন্টের খারাপ করার কারণ কী?
বিমান বসু ৩৪ বছর পর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট হেরে গেল। জয়ী হলো কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। এর প্রভাব জনগণের মধ্যে ভিন্ন মাত্রায় পড়েছে। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে কয়েকটি জেলায় মাওবাদী চরমপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ২০০৯ ও ২০১০ সালেও কয়েকটি জেলায় মাওবাদীদের সঙ্গে নিয়ে তারা আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। সে সময়ে পরিকল্পিতভাবেই তৃণমূলের কর্মীদের মাওবাদী দলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর শাসক দল তাদের নীতি পরিবর্তন করে এবং যাদের মাওবাদী দলে পাঠানো হয়েছিল, তাদের আবার তৃণমূলে ফিরিয়ে আনে। এ অবস্থায়ই পঞ্চায়েত নির্বাচন হলো, যাতে তৃণমূলের সন্ত্রাস-মাস্তানি সত্ত্বেও আমরা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছি।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে তৃণমূল নেত্রী সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য জনগণকে অসম্ভব ও অবাস্তব সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ কিছুটা সময়ের জন্য হলেও তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে, এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না খতিয়ে দেখছেন না। যেমন সরকার গ্রামীণ পুলিশে চাকরি দিয়েছে। কোনো ব্লক থেকে এক-দুজন করে লোক নিলেও বলা হচ্ছে ২০ জন নেওয়া হবে, ছোট ব্লকে ১৫ জন। কিন্তু যখন দেখা যাবে সরকার এই প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারছে না, তখন তৃণমূলের প্রতি জনগণের মোহভঙ্গ হবে।
প্রথম আলো নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে বামফ্রন্টের গৃহীত কর্মসূচি কি ভুল ছিল বলে মনে করেন?
বিমান বসু প্রকল্প নেওয়া ভুল না হলেও তাড়াহুড়ো করা ঠিক হয়নি। মানুষকে বুঝিয়েই সবকিছু করা উচিত ছিল। এখানে বলা প্রয়োজন, নন্দীগ্রামে কিছুই করা হয়নি, এমনকি জরিপও হয়নি। সবই তৎকালীন বিরোধী দলের প্রচারণা ছিল। আর সিঙ্গুরে তাড়াহুড়ো না করে যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিল, তাদেরটা নিয়েই কাজ শুরু করা যেত। সেই জমির পরিমাণ ৬০৪ একর, যা সরকার বুঝে নিয়েছিল। আর যারা জমি দিতে চায়নি, তাদের জমি অধিগ্রহণ না করে বিকল্প ব্যবস্থা করা যেত। সেটা করা হয়নি বলেই সমস্যা তৈরি হলো।
প্রথম আলো বামফ্রন্টের জনসমর্থন পুনরুদ্ধারে আপনারা কী কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?
বিমান বসু বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বামপন্থীদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে, তাতে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গত আড়াই বছরে বামফ্রন্টের ১৩১ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৫৩ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসীর সংখ্যা ৯ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের ৪৮ জন। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে; গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার নেতা-কর্মী; পলাতক জীবন বেছে নিয়েছেন আরও হাজার তিনেক। এ অবস্থায় আমরা কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করছি, অনেককে আইনি সহায়তা দিচ্ছি। একই সঙ্গে সরকারের কথা ও কাজের অমিলের বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরছি।
প্রথম আলো সারা ভারতের রাজনীতিতে এখন বামপন্থীদের অবস্থান কী?
বিমান বসু সত্য কথা বলতে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরালার বাইরে সারা ভারতে বামফ্রন্টের জনভিত্তি তেমন নেই। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, বিহার ও হিমাচলের কিছু এলাকায় ভালো অবস্থান আছে; তবে সারা রাজ্যে নয়।
প্রথম আলো আগামী নির্বাচনে মৌলবাদী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের কোনো বোঝাপড়া হবে কি?
বিমান বসু নির্বাচনী বোঝাপড়া নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী নভেম্বরে পাঁচটি রাজ্যে যে বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচনের ফলাফলেই বোঝা যাবে, আসলে বিজেপি কতটা জায়গা দখল করতে পারল। বিজেপির বিরাট মতলব আছে। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর মানুষ বিজেপিকে বিশ্বাস করে না। যারা সরাসরি রাজনীতি করে না, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস বা আঞ্চলিক কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়—ভারতের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শেই বিশ্বাসী। আমার মনে হয় না তারা বিজেপির রাজনীতি গ্রহণ করবে। তবে অনেক সময় ভুল করেও মানুষ বিষ খায়। সে রকম কিছু হলে সেটি ভারতের জন্য বিপদ হবে।
প্রথম আলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে আসি। বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও দুটি বকেয়া সমস্যা রয়ে গেছে—তিস্তার পানিবণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন। আপনার মন্তব্য কী?
বিমান বসু এটি দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের পানি সমস্যা ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান আগেই হওয়া উচিত ছিল। আমি মনে করি, উভয় দেশের স্বার্থেই সেটা করতে হবে। বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র। অতএব এই বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা ভারত সরকারকে করতে হবে। আমরা সব সময়ই এ দুটি সমস্যা সমাধান করার কথা বলে আসছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা তো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানেন না। তাঁরা যদি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতেন, সবাইকে নিয়ে বসতেন, তাহলে আমরা আমাদের কথা বলতে পারতাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে চুক্তির বিরোধিতা করছে, কিসের ভিত্তিতে? বামফ্রন্ট তো দুই কোটি ভোটারের সমর্থন পেয়েছে। তারা পেয়েছে দুই কোটি ৩০ লাখ ভোটারের সমর্থন, সে ক্ষেত্রে তাদের কেন্দ্রকে বলা উচিত ছিল, আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মতামত নিই; তারপর সিদ্ধান্ত দেব। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে ঢাকা সফল বাতিল করলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গেলেন না। তিনি তো সব দলের নেতাদের নিয়ে বসে, পানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে পারতেন; তা করলেন না।
জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকতে ঠিক এর বিপরীত ভূমিকাই নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের স্বার্থেই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়া উচিত। কেন্দ্রও তাঁর যুক্তি মেনে নিয়ে চুক্তি করেছিল।
প্রথম আলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচির প্রতিবাদে আপনারা ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্ত কি সঠিক বলে মনে করেন?
বিমান বসু যেকোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করার আগে দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রথমে দেখতে হবে। আমরা বলেছিলাম, এই কর্মসূচিতে দুর্ঘটনা ঘটলে মার্কিন কোম্পানিকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভোপাল ট্র্যাজেডিতে ইউনিয়ন কারবাইডের কাছ থেকে আমরা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারিনি। সেখানে বহু মানুষ জীবন দিয়েছে ও পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন হাইকোর্টের রায়ে সেই কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
প্রথম আলো সারা বিশ্বে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী?
বিমান বসু বামপন্থীরা যেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই বৈষম্য যেহেতু রয়ে গেছে, সেহেতু বামপন্থার ভবিষ্যৎ নেই, এ কথা বলা যাবে না। বামপন্থার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। সেখানে তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। নিজেদের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছে। তারা আমেরিকার খবরদারি মেনে নেয়নি। বিশ্বব্যবস্থায় ল্যাটিন আমেরিকার এই ধারা আমাদের জন্য নতুন দিশা দেখাচ্ছে। আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো গিরগিটির মতো বারবার রং বদলালেও তাদের মূল যে বৈশিষ্ট্য শোষণ ও জবরদস্তি, তা থেকে সরে আসছে না। তারা সিরিয়ায় হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল, চীন ও রাশিয়ার জন্য পারেনি। এমনকি আমেরিকার ৭০ শতাংশ মানুষ এ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমেরিকার আসল উদ্দেশ্য ইরানকে কব্জা করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
প্রথম আলো বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আপনার বার্তা কী?
বিমান বসু বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভারতের মতো কৃষিভিত্তিক। যদিও সাম্প্রতিক কালে সেখানে শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে। কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে সংহত করা, ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে। এর পাশাপাশি শিল্পশ্রমিকদের স্বার্থও দেখতে হবে। অবিভক্ত ভারতে বাংলার যে অংশে বাম ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রায় সবটাই বর্তমান বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, হাজং বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের উত্তরাধিকার বহনকারী বাংলাদেশের মানুষ কারও কাছে নতি স্বীকার করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
প্রথম আলো আপনারা কি অতীতের ভুল সংশোধন করে পার্টিকে সামনে এগিয়ে নিতে চান?
বিমান বসু আমাদের কাজে ভুলত্রুটি ছিল স্বীকার করি। নিরন্তর আলোচনা এবং কাজের মাধ্যমেই অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করে সামনে এগোতে হবে। দমন-পীড়ন ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পার্টিতে আসছে—এটি আশার কথা।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
বিমান বসু ধন্যবাদ।
No comments