এমপিওভুক্তি নিয়ে কেন এত গড়িমসি? by শরীফুজ্জামান আগা খান
অবশেষে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
(নিু মাধ্যমিক-মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) এমপিওকরণে
অচলাবস্থা সম্ভবত কাটছে। এমপিওভুক্তির বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক
রুটিন ওয়ার্ক হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দুষ্ট রাজনীতির প্রভাবে বিগত
এক দশকে এক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন
হওয়ার পর মন্ত্রী-এমপিদের তালিকার ভিত্তিতে ২০১০ সালে কেবল একবারই ১ হাজার
৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। এর পর ২০১১ সালে এমপিও দেয়ার নাম
করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিদের কাছ থেকে তিনটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম
নেয়। ওই নামের তালিকা এখনও ঝুলে আছে। আমাদের দেশে ৯৭ শতাংশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যবস্থাপনানির্ভর। সরকারি, এমপিওভুক্ত,
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সিলেবাস, কারিকুলাম,
একাডেমিক ইয়ার এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে। অথচ এ তিন পর্যায়ের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির
ক্ষেত্রে পার্থক্য বিস্তর। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সুবিধাভোগী,
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেকাংশে সুবিধাভোগী, অন্যদিকে
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই সুবিধাবঞ্চিত। আবার
এমপিওভুক্ত নয় বিধায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিল্ডিং, কম্পিউটার,
লাইব্রেরি কিংবা অনুদানের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। ব্যানবেইসের হিসাব
অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ২৬ হাজার ৪৭টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
এমপিওভুক্ত এবং এর বাইরে নানা মানমাত্রায় ১৩ ক্যাটাগরিতে ৮ হাজার ৫৫টি
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। অবশ্য শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এমপিওভুক্তির যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৭৩৩টি।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে ২০০৫ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছেন। সর্বশেষ এ বছর জানুয়ারিতে পক্ষকালব্যাপী আন্দোলনের সময় পুলিশের বিষাক্ত রাসায়নিকের পিপার স্প্রে, টিয়ার শেল, জলকামানের পানি, লাঠিচার্জ এরকম নির্যাতনে বহু শিক্ষক-কর্মচারী আহত হন। পিপার স্প্রের বিষক্রিয়ায় শিক্ষক সেকেন্দার আলী পরে মারা যান। পুলিশ শিক্ষকদের ঢাকা শহরে এমাথা ওমাথা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। দীর্ঘ ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সংগঠনের নেতাদের বৈঠক হলে তিনি তিন মাসের ভেতর এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেন। তার ওই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করেন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধিদের কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাতে তাদের হতাশ হতে হয়।
সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। অগত্যা শিক্ষক-কর্মচারীরা ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে আবার কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন। ঘোষিত কর্মসূচির ভেতর রয়েছে- ১ অক্টোবর থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে জেলায় জেলায় সমাবেশ। ৭ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক-কর্মচারীদের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট। শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্যরাও জাতীয় সংসদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। অবশ্য সংসদ সদস্যরা আগে থেকেই এমপিওভুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়ে আসছেন। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও চায়। সেই সঙ্গে স্বীকৃতির সময় থেকে চাকরির বয়সকাল গণনা এবং এমপিওর ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের দাবি জানায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিনা বেতনে ১০-১২ বছর সময়কাল এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে আর কালবিলম্ব করা সমীচীন নয়। অচিরেই এমপিওভুক্ত না হলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যা একটি বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হবে।
বিনা বেতনে চাকরি করা শিক্ষক-কর্মচারীদের গড় বয়স ৪০ পেরিয়ে গেছে। ১০-১৫ বছরের ভেতর অনেকেই অবসরে যাবেন। চাকরির মেয়াদের সঙ্গে অবসরকালীন অর্থের সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই বিগত চাকরির সময়কার বেতন না পাক, সার্ভিস বুকে ওই সময়ের হিসাবটা যেন থাকে। নইলে একবারে খালি হাতে অবসরে যেতে হবে। তেমনটি ঘটলে মধ্য বয়সের মতো অর্থ সংকটে বৃদ্ধ বয়সও কষ্টকর হয়ে উঠবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সঙ্গে অনিয়ম এবং দুর্নীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নৈতিক দাবিদার। সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। অন্যথায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে গেলে গতবারের মতো এবারও ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতার উদ্ভব হবে। এমপিদের ডিও লেটারে দলীয় কোটারি চিন্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা বড় ধরনের সমস্যা। এরকম পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়গুলো ঘিরে দালালচক্রের সক্রিয় হতে দেখা যায়। ঘুষের অংকের রেট নিলামে ওঠে। ২০১০ সালে এমপিও ছাড়ার প্রাক্কালে এবং ২০১১ সালে এমপিও ছাড়ার সম্ভাবনার কথা শোনা গেলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ৪-৫ লাখ টাকা পাত্রে/অপাত্রে ঘুষ দিয়ে এখন ধরা খেয়ে বসে আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢোকার প্রাক্কালে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ১-২ লাখ টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছে। এর পর ঘর, স্বীকৃতি এরকম খরচেও অংশ নিতে হয়েছে। আগের এমপিওভুক্তির জন্য জোগান দেয়া ঘুষের টাকাও হয়তো ভেস্তে গেছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্তির আগে প্রাথমিক অনুমতিকাল মেয়াদে তিন বছর এবং পরে আরও ৮-১০ বছরকাল বিনা বেতনে অতিবাহিত করছেন। এভাবে অর্থ ও সময় হারিয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিদ্যমান ব্যবস্থা শিক্ষাব্যবস্থা কুলষিত করার অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে অর্থ সংকটকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে সরকার দেখিয়ে থাকে। এখন বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না দিলে অর্থ সংকট তো হবেই। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতি হল- কোনো দেশের জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকবে। সেখানে আমাদের দেশে এ বরাদ্দ মাত্র ২.৬ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর যা সর্বনিু। বিগত কয়েক বছরে মোট বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আনুপাতিক হিসেবে ক্রমাগত নিুমুখী। ব্যানবেইস সূত্রেপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্তরের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পাঠদানে খসড়া হিসাব অনুযায়ী ৮২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ কম হলে কম বেতন নেয়ার প্রস্তাব করি। এমনও প্রস্তাব দিই, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আওতায় এনে ২ কি ৩ অর্থবছরে ধাপে ধাপে বেতন ১০০ ভাগে উন্নীত করা হোক। অনেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও এ প্রস্তাবে আমাদের সঙ্গে একমত। আরেকটি বিকল্প হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা। যেমন- ২০১০ সাল পর্যন্ত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে এমপিওভুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমানে কোনো স্তরেই এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এদের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী একটি প্রতিশ্র“তি ছিল- প্রতি পরিবারে অন্তত একজন সদস্যের চাকরির ব্যবস্থা করা। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিজ যোগ্যতাবলে এক ধরনের কর্মসৃজন করে নিয়েছেন। এখন সরকারের কর্তব্য হবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে সত্যিকার চাকরি কার্যকর করা। রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির একটা গুঞ্জন চলছে। এমনটি করা হলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে এমপিওপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ থাকবে এটা বলা মুশকিল। তবে বড় সংখ্যক এমপিওবঞ্চিতরা সরকারের প্রতি যে বিক্ষুব্ধ হবেন, সে কথা না বললেও চলে।
শরীফুজ্জামান আগা খান : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে ২০০৫ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছেন। সর্বশেষ এ বছর জানুয়ারিতে পক্ষকালব্যাপী আন্দোলনের সময় পুলিশের বিষাক্ত রাসায়নিকের পিপার স্প্রে, টিয়ার শেল, জলকামানের পানি, লাঠিচার্জ এরকম নির্যাতনে বহু শিক্ষক-কর্মচারী আহত হন। পিপার স্প্রের বিষক্রিয়ায় শিক্ষক সেকেন্দার আলী পরে মারা যান। পুলিশ শিক্ষকদের ঢাকা শহরে এমাথা ওমাথা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। দীর্ঘ ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সংগঠনের নেতাদের বৈঠক হলে তিনি তিন মাসের ভেতর এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেন। তার ওই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করেন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধিদের কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাতে তাদের হতাশ হতে হয়।
সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। অগত্যা শিক্ষক-কর্মচারীরা ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে আবার কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন। ঘোষিত কর্মসূচির ভেতর রয়েছে- ১ অক্টোবর থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে জেলায় জেলায় সমাবেশ। ৭ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক-কর্মচারীদের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট। শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্যরাও জাতীয় সংসদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। অবশ্য সংসদ সদস্যরা আগে থেকেই এমপিওভুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়ে আসছেন। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও চায়। সেই সঙ্গে স্বীকৃতির সময় থেকে চাকরির বয়সকাল গণনা এবং এমপিওর ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের দাবি জানায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিনা বেতনে ১০-১২ বছর সময়কাল এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে আর কালবিলম্ব করা সমীচীন নয়। অচিরেই এমপিওভুক্ত না হলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যা একটি বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হবে।
বিনা বেতনে চাকরি করা শিক্ষক-কর্মচারীদের গড় বয়স ৪০ পেরিয়ে গেছে। ১০-১৫ বছরের ভেতর অনেকেই অবসরে যাবেন। চাকরির মেয়াদের সঙ্গে অবসরকালীন অর্থের সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই বিগত চাকরির সময়কার বেতন না পাক, সার্ভিস বুকে ওই সময়ের হিসাবটা যেন থাকে। নইলে একবারে খালি হাতে অবসরে যেতে হবে। তেমনটি ঘটলে মধ্য বয়সের মতো অর্থ সংকটে বৃদ্ধ বয়সও কষ্টকর হয়ে উঠবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সঙ্গে অনিয়ম এবং দুর্নীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নৈতিক দাবিদার। সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। অন্যথায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে গেলে গতবারের মতো এবারও ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতার উদ্ভব হবে। এমপিদের ডিও লেটারে দলীয় কোটারি চিন্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা বড় ধরনের সমস্যা। এরকম পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়গুলো ঘিরে দালালচক্রের সক্রিয় হতে দেখা যায়। ঘুষের অংকের রেট নিলামে ওঠে। ২০১০ সালে এমপিও ছাড়ার প্রাক্কালে এবং ২০১১ সালে এমপিও ছাড়ার সম্ভাবনার কথা শোনা গেলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ৪-৫ লাখ টাকা পাত্রে/অপাত্রে ঘুষ দিয়ে এখন ধরা খেয়ে বসে আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢোকার প্রাক্কালে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ১-২ লাখ টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছে। এর পর ঘর, স্বীকৃতি এরকম খরচেও অংশ নিতে হয়েছে। আগের এমপিওভুক্তির জন্য জোগান দেয়া ঘুষের টাকাও হয়তো ভেস্তে গেছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্তির আগে প্রাথমিক অনুমতিকাল মেয়াদে তিন বছর এবং পরে আরও ৮-১০ বছরকাল বিনা বেতনে অতিবাহিত করছেন। এভাবে অর্থ ও সময় হারিয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিদ্যমান ব্যবস্থা শিক্ষাব্যবস্থা কুলষিত করার অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে অর্থ সংকটকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে সরকার দেখিয়ে থাকে। এখন বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না দিলে অর্থ সংকট তো হবেই। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতি হল- কোনো দেশের জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকবে। সেখানে আমাদের দেশে এ বরাদ্দ মাত্র ২.৬ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর যা সর্বনিু। বিগত কয়েক বছরে মোট বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আনুপাতিক হিসেবে ক্রমাগত নিুমুখী। ব্যানবেইস সূত্রেপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্তরের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পাঠদানে খসড়া হিসাব অনুযায়ী ৮২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ কম হলে কম বেতন নেয়ার প্রস্তাব করি। এমনও প্রস্তাব দিই, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আওতায় এনে ২ কি ৩ অর্থবছরে ধাপে ধাপে বেতন ১০০ ভাগে উন্নীত করা হোক। অনেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও এ প্রস্তাবে আমাদের সঙ্গে একমত। আরেকটি বিকল্প হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা। যেমন- ২০১০ সাল পর্যন্ত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে এমপিওভুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমানে কোনো স্তরেই এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এদের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী একটি প্রতিশ্র“তি ছিল- প্রতি পরিবারে অন্তত একজন সদস্যের চাকরির ব্যবস্থা করা। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিজ যোগ্যতাবলে এক ধরনের কর্মসৃজন করে নিয়েছেন। এখন সরকারের কর্তব্য হবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে সত্যিকার চাকরি কার্যকর করা। রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির একটা গুঞ্জন চলছে। এমনটি করা হলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে এমপিওপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ থাকবে এটা বলা মুশকিল। তবে বড় সংখ্যক এমপিওবঞ্চিতরা সরকারের প্রতি যে বিক্ষুব্ধ হবেন, সে কথা না বললেও চলে।
শরীফুজ্জামান আগা খান : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট
No comments