সংকটে বিআরটিসি

সম্প্রতি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমাদের সরকারি গণপরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) আর্থিক দৈন্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন এসেছে। প্রতিবেদনের ভিত্তি সংস্থার প্রকাশিত আর্থিক বিবরণী। এসব থেকে জানা যায়, তাদের প্রতিটি বাস থেকে দৈনিক মুনাফার পরিমাণ ২০০ টাকারও কম।
অথচ তাদের বাসবহরে রয়েছে ১ হাজার ৫৩৯টি বাস। এর মাঝে চালু আছে ১ হাজার ১৮টি। সংস্থাটির মতে, তাদের প্রায় সব বাস পুরোনো। তাই সচল রাখতে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় জ্বালানি, মেরামত আর কর্মচারীদের বেতন দিতে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের জন্য হয় অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়। কর্মচারীদের বেতন বাড়ায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তদুপরি ৩ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ৩০০ জন বার্ধক্যের কারণে কোনো কাজ করতে পারছেন না। একই অবস্থা চলছে তাদের ১৪৬টি ট্রাকের বহরেও। এগুলোর মাঝে ২০১৫-২০১৬ সালে চালু ছিল ৯৮টি। এই ট্রাকগুলো প্রতিটি থেকে দৈনিক গড় মুনাফা থাকে ৭৫ থেকে ৪০০ টাকার মতো। বলা হচ্ছে, এসব গাড়ি লাভজনক মেরামতের আওতার বাইরে চলে গেছে। এ চিত্রটি অভিনব কিছু নয় আর শুধু সরকারের এ সংস্থার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এ ধরনের প্রায় সবই অনুরূপ ব্যাধিতে আক্রান্ত। ১৯৬১ সালে বেসরকারি সড়ক পরিবহনের একচেটিয়া কর্তৃত্বের বিপরীতে সরকারের একটি সংস্থা হিসেবে তদানীন্তন ইপিআরটিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই উত্তরসূরি সংস্থা আজকের বিআরটিসি। সে সময়কার বেসরকারি সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় বাস–ট্রাকের সংখ্যার তুলনায় এখন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তা ক্রমবিকাশমানও বটে। এটি সরকারের সেবা খাতে প্রবৃদ্ধিতে অবদানও রাখছে। তবে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। মালিক ও চালকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা একরকম কঠিনই হয়ে পড়েছে। তাঁদের সংগঠনগুলোর প্রতি রয়েছে সরকারের কারও কারও সমর্থন। আর তা ছিল সব সরকারের সময়েই। এগুলোর বিপরীতে বিআরটিসির সামর্থ্য এখন তুলনাতেই আসে না।
বিআরটিসির জন্য সরকার বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি আমদানি করেছে। আর এগুলোর মেরামত কিংবা প্রতিস্থাপন তো হওয়ার কথা চলমানগুলোর আয়ের মুনাফা থেকে। বেসরকারি খাতে তো তা-ই হয়। সরকারি খাতে বেতন বৃদ্ধি একটি বাস্তবতা। আর চালক ও হেলপাররা বিআরটিসিতে যে বেতন-ভাতা পান, বেসরকারি খাতে তার চেয়ে কম পান না। বেসরকারি খাত লাভ করছে। করে চলেছে। আর বিআরটিসি ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ছে নিষ্প্রাণ। আর  ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০০ কর্মচারী বার্ধক্যের কারণে সেবা দিতে অক্ষম। তাঁদের অবসরসুবিধা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান তো রয়েছে। উল্লেখ্য, সংস্থাটির অনেক জমি ও সম্পদ আছে। আছে মেরামত কারখানা এবং ড্রাইভিং শিক্ষাকেন্দ্র। তাহলে এটিকে একটি কোম্পানি করে কন্ট্রোলিং শেয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকিটা পুঁজিবাজারে ছাড়লে অনেক টাকা আসার কথা। আর সে টাকায় জোগান হবে নতুন মূলধন। সংযোজন হবে বাস ও ট্রাক। আর এখন যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের চাকরির শর্তাবলি অপরিবর্তিত রেখেও তা করা যায়। নতুনেরা কোম্পানিতে যোগ দেবেন। সে কোম্পানি বোর্ডে ব্যক্তি খাতে কেনা শেয়ার মালিকদের প্রতিনিধি থাকার কথা। তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে সরকারি কর্মকর্তারা অধিকতর তৎপর হতে পারেন। এটি ধারণামাত্র। বিকল্প কিছুও ভাবনায় আসতে পারে। তবে আমাদের প্রায় সব সরকারি খাতেরই একই হাল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। সরকার থেকে প্রায়ই তাদের মূলধন জোগান দিতে হয়। অথচ ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করা হয়েছিল শেয়ারের একটি অংশ বাজারে ছাড়ার জন্যই। একই অবস্থানে বাংলাদেশ বিমান। প্রবাসে এক কোটি বাঙালি। তার সিংহভাগ মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায়। শুধু এসব যাত্রী আনা-নেওয়ার সুবন্দোবস্ত করতে পারলে বাংলাদেশ বিমান স্বর্ণ প্রসবিণী হতে পারে। অথচ টিকিটের অভাবে আমাদের যাত্রীরা প্রায়ই হাঙ্গামায় পড়েন। বস্তুতপক্ষে, তাঁরা বাংলাদেশ বিমানে চলাচল করতেই বোধ করেন স্বাচ্ছন্দ্য।
কিন্তু বিমানের ফ্লাইটের সংখ্যা কম, শিডিউল অনিয়মিত ইত্যাদি কারণে সে যাত্রীরা বেছে নেন ভিন্ন বিমান সংস্থা। সেসব সংস্থা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। আমরা দিন দিন গুটিয়ে পড়ছি। বাংলাদেশ রেলের হালচাল তো দেশের সব শ্রেণির মানুষের জানা। যাত্রায় সবার প্রথম পছন্দ ট্রেন। অথচ টিকিট নেই সে ট্রেনের। আবার ‘কোনোক্রমে’ টিকিট জোগাড় করে ট্রেনে উঠে দেখা যায় অর্ধেক খালি। বলা হচ্ছে এখন কম্পিউটারে এসব ব্যবস্থাপনা হচ্ছে। কারচুপির সুযোগ নেই। তবে কম্পিউটার চালায় মানুষ, এটাও আমাদের জানা। রেলওয়ের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ চলছে নিয়মিত। বাংলাদেশ রেলের দুটো মূল্যবান ওয়ার্কশপও আছে। আছে প্রচুর জমি। অবশ্য অনেক বেহাত হয়ে গেছে। ট্রেন চলাচলের সময়সূচি একটি থাকে বটে, তবে এটা মানার বাধ্যবাধকতা চিন্তাতেই নেই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় শুধু কনটেইনার পরিবহন করে রেলওয়ে তার অবস্থান ফেরাতে পারে। এমন কথা অনেক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। অথচ বন্দরে আগত ঢাকামুখী কনটেইনারের  ৫ শতাংশও রেলওয়ে টানতে পারছে না। একই হালচাল শিপিং করপোরেশন, আইডব্লিউটিসিসহ এ ধরনের সর্বত্র। তাহলে প্রশ্ন থাকবে, সবকিছুই কি বেসরকারীকরণ করা হবে? সহজ উত্তর, সেবামূলক কাজের বেশ কিছু সরকারের মালিকানাতেই থাকতে হবে। আমাদের বেসরকারি খাত দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে বটে। তবে এগুলো যথাযথভাবে নিয়মনীতি মানছে কি না, এসব বিষয় দেখার উপযুক্ত রেগুলেটরের সংকটে আমরা ভুগছি। এর কারণ দ্বিবিধ। কেউ সে বিষয়ে দক্ষ নন আর কেউবা বেসরকারি খাতের অনুগত সেবক। এ অবস্থায় সবকিছু শুধু বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়ার অবস্থায় আমরা এখনো আসিনি। আর তা সব খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমাদের অতি স্পর্শকাতর কিছু খাত সরকারের হাতেই রাখতে হবে। যেমন গণখাতে খাদ্যশস্য সংগ্রহ, মজুত ও বিপণন। জ্বালানি তেলে ইদানীং বেসরকারি খাত যুক্ত হচ্ছে। তেমনি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিপণনব্যবস্থায়ও তারা ক্ষেত্রবিশেষে অংশীদার। সড়ক পরিবহন তো বলতে গেলে বেসরকারি সংস্থারই একচেটিয়া কর্তৃত্বে। অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল এবং সমুদ্রগামী জাহাজও তাদেরই কর্তৃত্বে। তাহলে এ ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের ধুঁকে ধুঁকে চলা সংস্থাগুলো কীভাবে চালাব? কী হবে বিমান আর রেলওয়ের? এগুলোতে লোকসানি অবস্থা স্থায়ীভাবে চালিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নেই। রেল চলাচলে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকাই নেই।
তবে কোম্পানি করলে বাজারে শেয়ার ছেড়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংশ্লিষ্ট করার সুযোগ রয়েছে। যে সংস্থাগুলোর বিষয়ে এখানে আলোচিত হলো সেগুলোর, এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রচুর সম্পদ রয়েছে। তাই শেয়ার ভালো প্রিমিয়াম নিয়েই বিক্রি করা যাবে। এর ভিন্ন ধরনের প্রস্তাবও থাকতে পারে। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর পক্ষ থেকে কোম্পানি সম্পর্কে একটি সংশয় রয়েছে। সেখানে বিকল্প প্রস্তাব আসতেই পারে। সরকার আকস্মিকভাবে এগুলো থেকে সরে আসতে পারবে না। আবার এদের দৈন্যদশাও এভাবে চলতে পারে না। তবে নতুনভাবে বিনিয়োগে কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। উল্লেখ করা যায়, এ লোকসান যাচ্ছে করদাতা জনগণের ওপর। এটা ব্যাহত করছে আমাদের প্রবৃদ্ধি। দুর্নীতি আর রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে লোকসান আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রবৃদ্ধির হারও বেড়ে যাবে—এটা অনস্বীকার্য। আর এর জন্য আমরা দীর্ঘকাল হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। উল্লেখ করা হয়েছে, সেবামূলক কিছু কৌশলগত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে হলেও থাকতে হবে। তবে বেশ কিছু খাত থেকে সরে আসারও সময় এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে চাল, তেল, চিনি এমনকি কেরোসিনও রেশনে বিক্রি করতে হয়েছে। আবার সময়ে এর ইতিও ঘটানো হয়েছে। সে সময়ে হেচ বার্নওয়েল নামক একজন ব্রিটিশ আইসিএস কর্মকর্তা অবিভক্ত বাংলার সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ দেশে তাঁর চাকরিকালীন স্মৃতিচারণাসংক্রান্ত বইটিতেও তিনি এ ধরনের কথাই বলেছেন। একটি বাংলা প্রবাদ বাক্য দিয়ে তিনি অধ্যায়টির ইতি ঘটিয়েছেন। সে বাক্যটি হলো ‘রাজা ব্যাপারী, প্রজা ভিখারি’।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.