দুধে ভাতে থাকিবে কতো মার সন্তান

কাউন্সিলে প্রচুর মানুষ এলেও তাতে শৃঙ্খলা ছিল
অবশেষে সাঙ্গ হলো আওয়ামী লীগের মিলনমেলা, ২০তম জাতীয় কাউন্সিল সভা। ৬৮ বছরে পা দেওয়া দলটি আজ বয়সে প্রবীণ এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞ। হাজার হাজার সদস্যের ভিড়ে মোটামুটি শৃঙ্খলা বজায় রেখেই দুদিনের সম্মেলন সফলভাবে শেষ হয়েছে। বলা চলে, মধুরেন সমাপয়েৎ।
কমিটি গঠন করা নিয়ে নেতা-কর্মী ও পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ ছিল। কয়েক দিন ধরেই সচেতনভাবে এই আগ্রহ তৈরি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘চমক’ আসছে। তো সেই চমক এল না। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কোনো সাধারণ সম্পাদক অবশ্য একনাগাড়ে দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্বে থাকেননি। কৌতূহল ছিল, তাহলে কে আসছেন। শেষমেশ সাধারণ সম্পাদকের ব্যাটনটি সৈয়দ আশরাফের হাত থেকে ওবায়দুল কাদেরের হাতে গেল, আর দায়িত্বের গাড়ি ঝিকঝিক করে চলে গেল কিশোরগঞ্জ থেকে কোম্পানীগঞ্জ। এতে চমকের কিছু ছিল না। ওবায়দুল কাদের দলের একজন সিনিয়র নেতা। প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। এখন সাধারণ সম্পাদক হয়ে পদাধিকারবলে প্রেসিডিয়ামে থাকবেন। সৈয়দ আশরাফের অবস্থানেও তেমন নড়চড় হয়নি। তিনিও পদাধিকারবলে প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। এখন স্থায়ী সদস্য হলেন। কোনোটাকেই পদোন্নতি বা পদাবনতি বলা যাবে না। তবে সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমের আনুকূল্য পান একটু বেশি। সেটা ওবায়দুল কাদের আগে থেকেই পেয়ে আসছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে ওবায়দুল কাদেরের একটা জনবান্ধব ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা চলেছিল। তিনি হঠাৎ করেই রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েন, পথের ধারে টুলে বসে চা খান, বাসে চলাফেরা করেন—কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বা বসে। সঙ্গে আলোকচিত্রীরা থাকেন। এসব ছবির মাধ্যমে তিনি একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন—আমি তোমাদেরই লোক। কাউন্সিলের আগে থেকেই তরুণ নেতৃত্বের কথা জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছিল। কাউন্সিলে ঘোষিত প্রেসিডিয়াম সদস্যরা সবাই প্রবীণ। ইতিমধ্যে কয়েকজন বিভাগীয় সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা জায়গা করে নিয়েছেন। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের গড়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে দিয়েছিল, রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ সদস্য হতে হবে নারী। ২০২০ সালের মধ্যেই এটা করতে হবে। ইতিমধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে। হুট করে পরে কোনো এক কাউন্সিলে এই ‘কোটা’ পূরণ করা কষ্টকর হবে। দেখা যাক, যেসব পদে এখনো মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, সেখানে নারী প্রতিনিধিত্বের আকার ও প্রকার কেমন হয়।
কাউন্সিল সভাটি ছিল সর্বাঙ্গসুন্দর। কোনো হইচই, ঝগড়াঝাঁটি নেই। পদ-পদবি নিয়ে প্রকাশ্যে কাউকে ক্ষুব্ধ হতে বা হতাশা জানাতে দেখা যায়নি। খাবারের প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল না। সবটাই ছিল শৃঙ্খলার চাদরে মোড়া। দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ তৈরিতে ছিল শিল্পের ছোঁয়া। পুরো ঢাকা শহর মরিচবাতির ছটায় রঙিন হয়ে উঠেছিল। এটা হলো বাইরের দিক। ভেতরে-ভেতরে ছবিটা ছিল অন্য রকম। ঢাকাবাসীকে দুদিন ঘরের মধ্যে আটকে রেখে এই সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে শহরের নাগরিকদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেওয়া হয়েছে। সম্মেলনস্থলটিকে বলা যায় নগরের ফুসফুস।  আশপাশের রাস্তাঘাটে যান চলাচল বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা হয়তো শতভাগ নিশ্চিত করা গেছে। কিন্তু নগরবাসীর প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটেছে অনেক। প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকলে কি এটা করতে পারত? আমি জানি না, পশ্চিমের কোনো দেশে মানুষকে ঘরে আটকে রেখে এ ধরনের কার্নিভালের আয়োজনের চিন্তা কেউ করবেন কি না। বিষয়টা সব দলের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে বলছি। অন্যান্য দলও যদি এই মডেল অনুসরণ করতে চায়, তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
কেউ কেউ বলবেন, তাহলে বিকল্প কী? একটা রাজনৈতিক দল কি তাদের সম্মেলন করবে না? সব স্তরে নেতা-কর্মীদের সমাবেশ ঘটাবে না? কোনো একটা অডিটোরিয়ামে কি এ ধরনের আয়োজন সম্ভব? আমি সবাইকে অনুরোধ করব, বিকল্প জায়গা হিসেবে অন্য কোনো জায়গার সন্ধান করতে। মানুষকে কষ্ট দিয়ে আড়ম্বর দেখানোর মধ্যে বাহাদুরির কিছু নেই। একটা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের নানান দিক আছে। তবে আগ্রহ বেশি থাকে কমিটি করা এবং কর্মসূচি নিয়ে। এবারের সম্মেলনে কমিটির দিকেই সাধারণের নজর ছিল বেশি। কর্মসূচি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে কম। সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে শেখ হাসিনা তাঁর দলের অভীষ্টের কথা বলেছেন। বলেছেন, ২০৪১ সালে তিনি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান। তবে এটা তাঁর বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে কাজ হয়নি, তৈরি হয়নি কোনো ভিশন ডকুমেন্ট। গন্তব্য যদি হয় ২০৪১ সাল, তাহলে আগামী পাঁচ-দশ-বিশ বছরের জন্য লক্ষ্য স্থির করা দরকার। একই সঙ্গে প্রয়োজন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা। আশা করছি, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ শিগগিরই রূপকল্প ২০৪১ বিস্তারিতভাবে তৈরি ও উপস্থাপন করবে।
আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নির্বাচনের কথা ভাবছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আগামী নির্বাচন কেমন হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে নানান কথা হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগও স্বস্তিতে নেই। ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন নিয়ে তাঁদের অনেককেই নানান কথা শুনতে হচ্ছে। ক্লাসে একজন ছাত্র থাকলে সে-ই ফার্স্ট হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রিপোর্ট কার্ডে লেখা হবে সে বিজয়ী। কিন্তু প্রতিযোগিতাহীন এই পরীক্ষায় ওই ছাত্রের মেধা বা সক্ষমতার পরিচয় মেলে না। এটা ওই ছাত্রের দোষ না। অন্য কোনো ছাত্র ওই প্রতিষ্ঠানে কেন ভর্তি হয় না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ দেশে নির্বাচন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে বারবার। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। শেখ হাসিনা অষ্টমবারের মতো দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর উপস্থিতি ও নেতৃত্ব দলে স্থিতি এনেছে, ধারাবাহিকতা দিয়েছে। একে একে পাঁচজন সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। এখন ৬ নম্বরে আসা নতুন সম্পাদককে নিয়ে তিনি কর্মযজ্ঞ শুরু করবেন।
নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমি তাঁকে চিনি। তিনি মুহসীন হলে আমার সতীর্থ, দুই ব্যাচ সিনিয়র। বাহাত্তর সালে ছাত্রলীগ যখন দুই প্যানেল নিয়ে ডাকসু নির্বাচন করেছিল, তখন তিনি মুহসীন হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ গ্রুপের হয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরে তিনি ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ছেড়ে ‘মুজিববাদের’ ক্যাম্পে যোগ দেন এবং এখন পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে তিনি ডাকসুর সহসভাপতি পদে নির্বাচন করতে গিয়ে পরপর দুবার প্রতিপক্ষ জাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে মান্না আওয়ামী লীগে কাদেরের সহযাত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার দলছুট হয়ে যান। কাদের মাটি কামড়ে আওয়ামী লীগেই পড়ে আছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন, কিন্তু দলের প্রতি তাঁর আনুগত্যে ভাটা পড়েনি। এবার সাধারণ সম্পাদক পদটি তিনি তাঁর কাজ ও আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন। শিকড় থেকে পৌঁছেছেন শিখরে। তাঁর প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল। দলের সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা কাউন্সিলরদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে না।
এখানে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং কাদেরের সাংগঠনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে লড়তে চান। নিঃসন্দেহে কাদেরের জন্য এটা একটা বড় দায়িত্ব। মন্ত্রী পদে থেকে এই দায়িত্ব তিনি কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। ভালো হয়, যদি তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি মেনে মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন এবং একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে দলের দায়িত্ব নেন। সরকারের বাইরে থেকে দলকে নির্বাচনে জেতাতে পারলে সেটা হবে পরম শ্লাঘার বিষয়। আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করলে ঘুরেফিরে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ আসবেই। দলে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করলেও সভাপতি পদে তিনি এই অধিকারের জোরে বসেননি। সবাই মিলে ধরে এনে তাঁকে সভাপতি বানিয়েছিলেন। তা না হলে দল আবারও ভাঙত। তিনি দলের সংহতির প্রতীক। এক দিনের জন্যও ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করেননি, পরিবারের এমন সদস্যদের যদি তিনি কমিটিতে ঢোকান, তাহলে সেটা হবে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি। তিনি এই কাউন্সিলে ওই পথে হাঁটেননি। দেশের গরিব মানুষের সংখ্যা অনেক। তাদের অনেকেরই মাথার ওপর ছাউনি নেই, ঘর থাকলেও খাবার নেই, কাজ নেই। তিনি সবার জন্য ঘর আর ভাত-কাপড়ের কথা বলেছেন, বলেছেন ২০৪১ সালে এ দেশে কোনো দরিদ্র লোক থাকবে না। তিনি বাঙালির হতদরিদ্র জীবনের চেহারা তুলে ধরেছেন, উন্নয়নের অঙ্গীকার করেছেন। মঙ্গলকাব্যে ‘ঈশ্বরী পাটনী’র জবানিতে তিনি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার কথা বলেছেন:
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে জোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।।
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান।।
শেখ হাসিনা বরাভয় দিয়েছেন। দুধে ভাতে না হোক, পেট ভরে শাক-ভাত খেতে পারলেই মানুষ বর্তে যাবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গ​েবষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.