তনু, মিতু, আফসানা: খরচযোগ্য জীবন!
তনু, মিতু ও আফসানা। নিহত হওয়ার পরিস্থিতি আলাদা, খুনিদের পরিচয়ও হয়তো। কিন্তু কী মিল তাঁদের সবার বেলায়। খুনিরা ধরা পড়ে না, তাদের নাম-পরিচয়ও জানা যায় না। পুলিশের ভাষায় তারা ‘অজ্ঞাতনামা’ অপরাধী। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছেও কি তারা অজ্ঞাতনামাই থেকে যাবে? মিতু হত্যা ইস্যুটা এখন বাবুল আক্তার ইস্যু হয়ে গেছে। তিনি পুলিশ বাহিনীতে সসম্মানে থাকতে পারবেন কি পারবেন না, আলোচনা হয় সেটা নিয়ে। মানুষের মনের প্রশ্ন হলো, কে বা কারা মিতুর হত্যাকারী? যদি ঘটনার সঙ্গে বাবুল আক্তারের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে তবে তাঁকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হোক, বিচার শুরু করা হোক। আর যদি তাঁকে অভিযুক্ত করার মতো প্রমাণ না থাকে, তাহলে বলা হোক মিতুকে কে খুন করেছে? বাবুল আক্তার-বিষয়ক ধোঁয়ার আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে এই জরুরি প্রশ্নটাই।
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে। অনেক প্রশ্ন জমে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর খুনি কারা? তনুর খুনি কারা? আর সম্প্রতি আফসানা নামের যে তরুণী ছাত্রী নিহত হলেন, কারা তাঁকে হত্যা করেছিল? শুক্রবার রাতের ঘটনা। রংপুরে পুলিশের মারধরে নুরুন্নবী নামের একজনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে (প্রথম আলো অনলাইন, ২০ আগস্ট)। পুলিশ বলছে, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কে আমাদের নিশ্চিত করবে যে হত্যা নয়, এটি আসলে হৃদ্রোগের কেস। পুলিশি হেফাজতে হৃদ্রোগে মৃত্যুর অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আটককৃত ব্যক্তিদের! ২০১৪ সালে ঢাকার মিরপুরের কালশীতে ঘরে আগুন লাগিয়ে সাতজন আর গুলিতে তিনজনকে হত্যা করা হলো। পরপরই স্ত্রী-সন্তান হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতা রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। এই ১১টি মৃত্যুর সওদাগরের নাম আজও অজানা! চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। চার মাস অতিক্রান্ত, ইস্যুটা মোটামুটি ধামাচাপা।
আরও বেশি উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। এ ধরনের বিস্তর ঘটনা আছে আমাদের চারপাশে। প্রায় প্রতিনিয়তই নিখোঁজ, গুম ও ক্রসফায়ারে লাশ পড়ছে। জানার উপায় নেই, তাদের কতজন অভিযুক্ত আর কতজন পরিস্থিতির শিকার। কিছু মানুষ আবার এগুলো সমর্থনও করেন। কিন্তু আইনের হাতে যে রক্ত লেগে আছে, সেই রক্তাক্ত হাত যে ক্রমেই নিরীহ ব্যক্তিদেরও রক্তাক্ত করছে, এভাবে চললে যে আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না, তা অনেকেই বুঝতে রাজি নন। ‘অপরাধী’ বা জঙ্গি হলেও আইনের বাইরে কাউকে হত্যা করা যায় না। এসব ঘটনা একটা জিনিসই প্রমাণ করে: কিছু জীবন খরচযোগ্য। হতে পারে তারা নারী বা শিশু, হতে পারে সাধারণ নিরীহ পুরুষ। যখন অনেক হত্যার বিচার হয় না, তখন এই ‘অনেকে’ পড়ে যান খরচযোগ্যের তালিকায়। এ ধরনের জীবনকে বলা যায় উদোম জীবন। ইতালীয় রাজনৈতিক দার্শনিক গিওর্গিও আগামবেন বলছেন, ‘উদোম জীবন হলো তছনছ করা জীবন, রাজনৈতিক গুরুত্বহীন জীবন।’ প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এদের বলা হতো হোমো সাসের, যাদের হত্যা করলে শাস্তি হবে না। সহিংসতার সামনে তাদের কোনো রক্ষাকবচ নেই, হত্যার সামনে সম্পূর্ণ উদোম এ মানুষেরা। অপরাধী বা শত্রুশ্রেণির না হলেও তারা একধরনের নিষিদ্ধ মানুষ। প্রায়ই তাদের অবস্থা হয় বধযোগ্য প্রাণীর মতো।
আগামবেন বলছেন, আজকে আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষ দুভাবে বিভক্ত। একদলের জীবন উদোম (bare life), আরেক দল সার্বভৌম ক্ষমতার (sovereign power) অধিকারী। সার্বভৌম যারা, তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। তারা দায়মুক্ত, বিচারের ঊর্ধ্বে তাদের অবস্থান। যেমন দায়মুক্তি ভোগ করতেন আগেকার যুগের রাজা-বাদশাহরা। আগামবেনের সিদ্ধান্ত, সার্বভৌম ক্ষমতা আইনের সীমা পেরিয়ে গেলে নাগরিকদের অনেকেই সহিংসতার সামনে উদোম হয়ে পড়ে। অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী সরকার সমগ্র জনগণকেই হোমো সাসের বানিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণত গণহত্যার মধ্যে এই সর্বময় সহিংসতার দায়মুক্তি দেখা যায়। তবে যুদ্ধ ও গণহত্যা ছাড়াও সাধারণ পরিস্থিতিতেও এ ধরনের দায়মুক্ত হত্যালীলা চলতে পারে।
তনু থেকে আফসানা, ত্বকী থেকে রংপুরের ওই নুরুন্নবী পর্যন্ত তাই আমরা দুটি পক্ষ দেখি: একদল হত্যাযোগ্য, খরচযোগ্য, বিচারহীন হত্যার শিকার এবং আরেক দল বিচারের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষ। খুনির সংখ্যা অল্প, শিকারের সংখ্যাই বেশি। এই খুনিরা যদি কোনো–না-কোনোভাবে ক্ষমতার সিঁড়ির ওপরের দিকের লোক বা প্রতিষ্ঠান হয়, কিংবা হয় তাদের মদদপুষ্ট, তাহলে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় এনে শাস্তি দেওয়া কঠিন। আফসানার পরিবার অভিযোগ করেছে, রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা রবিন ও তাঁর বন্ধুরা এই হত্যায় জড়িত। আফসানার ভাইয়ের অভিযোগ, ‘আমি তাকে (রবিন) আমার বোনকে হত্যার চার দিন পরেও ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখেছি’ (দ্য ডেইলি স্টার, ২০ আগস্ট ২০১৬)। এমনকি তারা আফসানার পরিবারকে ফোন করে হুমকিও দিচ্ছে। পুলিশ এখনো কিছু জানে না, কাউকে গ্রেপ্তারও করে না।
তনু ও মিতুর জন্য এত আন্দোলন হলো, হত্যাকারীদের ঠিকানা পর্যন্ত তদন্তের হাত যেতেই পারল না। একই কথা ত্বকীর খুনিদের জন্যও খাটে। শুধু একটি-দুটি ক্ষেত্রে নয়, খরচের খাতার নামের তালিকা তো লম্বাই হচ্ছে কেবল। বাংলাদেশে বেশি থেকে আরও বেশি মানুষের জীবন উদোম ও অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দায়মুক্তির ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত মানিক সন্ত্রাস করে পার পাওয়ার পর ধর্ষক হয়ে উঠেছিলেন। একইভাবে প্রতিটি দায়মুক্তি খুনিদের দিচ্ছে আরও বেশি খুনের নজরানা। আর ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার নিয়মে খরচযোগ্য জীবনের মালিকের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে। অনেক প্রশ্ন জমে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর খুনি কারা? তনুর খুনি কারা? আর সম্প্রতি আফসানা নামের যে তরুণী ছাত্রী নিহত হলেন, কারা তাঁকে হত্যা করেছিল? শুক্রবার রাতের ঘটনা। রংপুরে পুলিশের মারধরে নুরুন্নবী নামের একজনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে (প্রথম আলো অনলাইন, ২০ আগস্ট)। পুলিশ বলছে, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কে আমাদের নিশ্চিত করবে যে হত্যা নয়, এটি আসলে হৃদ্রোগের কেস। পুলিশি হেফাজতে হৃদ্রোগে মৃত্যুর অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আটককৃত ব্যক্তিদের! ২০১৪ সালে ঢাকার মিরপুরের কালশীতে ঘরে আগুন লাগিয়ে সাতজন আর গুলিতে তিনজনকে হত্যা করা হলো। পরপরই স্ত্রী-সন্তান হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতা রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। এই ১১টি মৃত্যুর সওদাগরের নাম আজও অজানা! চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। চার মাস অতিক্রান্ত, ইস্যুটা মোটামুটি ধামাচাপা।
আরও বেশি উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। এ ধরনের বিস্তর ঘটনা আছে আমাদের চারপাশে। প্রায় প্রতিনিয়তই নিখোঁজ, গুম ও ক্রসফায়ারে লাশ পড়ছে। জানার উপায় নেই, তাদের কতজন অভিযুক্ত আর কতজন পরিস্থিতির শিকার। কিছু মানুষ আবার এগুলো সমর্থনও করেন। কিন্তু আইনের হাতে যে রক্ত লেগে আছে, সেই রক্তাক্ত হাত যে ক্রমেই নিরীহ ব্যক্তিদেরও রক্তাক্ত করছে, এভাবে চললে যে আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না, তা অনেকেই বুঝতে রাজি নন। ‘অপরাধী’ বা জঙ্গি হলেও আইনের বাইরে কাউকে হত্যা করা যায় না। এসব ঘটনা একটা জিনিসই প্রমাণ করে: কিছু জীবন খরচযোগ্য। হতে পারে তারা নারী বা শিশু, হতে পারে সাধারণ নিরীহ পুরুষ। যখন অনেক হত্যার বিচার হয় না, তখন এই ‘অনেকে’ পড়ে যান খরচযোগ্যের তালিকায়। এ ধরনের জীবনকে বলা যায় উদোম জীবন। ইতালীয় রাজনৈতিক দার্শনিক গিওর্গিও আগামবেন বলছেন, ‘উদোম জীবন হলো তছনছ করা জীবন, রাজনৈতিক গুরুত্বহীন জীবন।’ প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এদের বলা হতো হোমো সাসের, যাদের হত্যা করলে শাস্তি হবে না। সহিংসতার সামনে তাদের কোনো রক্ষাকবচ নেই, হত্যার সামনে সম্পূর্ণ উদোম এ মানুষেরা। অপরাধী বা শত্রুশ্রেণির না হলেও তারা একধরনের নিষিদ্ধ মানুষ। প্রায়ই তাদের অবস্থা হয় বধযোগ্য প্রাণীর মতো।
আগামবেন বলছেন, আজকে আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষ দুভাবে বিভক্ত। একদলের জীবন উদোম (bare life), আরেক দল সার্বভৌম ক্ষমতার (sovereign power) অধিকারী। সার্বভৌম যারা, তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। তারা দায়মুক্ত, বিচারের ঊর্ধ্বে তাদের অবস্থান। যেমন দায়মুক্তি ভোগ করতেন আগেকার যুগের রাজা-বাদশাহরা। আগামবেনের সিদ্ধান্ত, সার্বভৌম ক্ষমতা আইনের সীমা পেরিয়ে গেলে নাগরিকদের অনেকেই সহিংসতার সামনে উদোম হয়ে পড়ে। অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী সরকার সমগ্র জনগণকেই হোমো সাসের বানিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণত গণহত্যার মধ্যে এই সর্বময় সহিংসতার দায়মুক্তি দেখা যায়। তবে যুদ্ধ ও গণহত্যা ছাড়াও সাধারণ পরিস্থিতিতেও এ ধরনের দায়মুক্ত হত্যালীলা চলতে পারে।
তনু থেকে আফসানা, ত্বকী থেকে রংপুরের ওই নুরুন্নবী পর্যন্ত তাই আমরা দুটি পক্ষ দেখি: একদল হত্যাযোগ্য, খরচযোগ্য, বিচারহীন হত্যার শিকার এবং আরেক দল বিচারের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষ। খুনির সংখ্যা অল্প, শিকারের সংখ্যাই বেশি। এই খুনিরা যদি কোনো–না-কোনোভাবে ক্ষমতার সিঁড়ির ওপরের দিকের লোক বা প্রতিষ্ঠান হয়, কিংবা হয় তাদের মদদপুষ্ট, তাহলে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় এনে শাস্তি দেওয়া কঠিন। আফসানার পরিবার অভিযোগ করেছে, রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা রবিন ও তাঁর বন্ধুরা এই হত্যায় জড়িত। আফসানার ভাইয়ের অভিযোগ, ‘আমি তাকে (রবিন) আমার বোনকে হত্যার চার দিন পরেও ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখেছি’ (দ্য ডেইলি স্টার, ২০ আগস্ট ২০১৬)। এমনকি তারা আফসানার পরিবারকে ফোন করে হুমকিও দিচ্ছে। পুলিশ এখনো কিছু জানে না, কাউকে গ্রেপ্তারও করে না।
তনু ও মিতুর জন্য এত আন্দোলন হলো, হত্যাকারীদের ঠিকানা পর্যন্ত তদন্তের হাত যেতেই পারল না। একই কথা ত্বকীর খুনিদের জন্যও খাটে। শুধু একটি-দুটি ক্ষেত্রে নয়, খরচের খাতার নামের তালিকা তো লম্বাই হচ্ছে কেবল। বাংলাদেশে বেশি থেকে আরও বেশি মানুষের জীবন উদোম ও অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দায়মুক্তির ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত মানিক সন্ত্রাস করে পার পাওয়ার পর ধর্ষক হয়ে উঠেছিলেন। একইভাবে প্রতিটি দায়মুক্তি খুনিদের দিচ্ছে আরও বেশি খুনের নজরানা। আর ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার নিয়মে খরচযোগ্য জীবনের মালিকের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments