আগস্টে বেগম মুজিবকে স্মরণ করতেই হবে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর পরিবারে আসেন। আমরা জানি ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এবং যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। এ দীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রামে বেশিরভাগ সময় বঙ্গবন্ধু কারান্তরালে ছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী কেবল সংসারকে আগলে রাখেননি, তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন। কারান্তরালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অন্য সংগঠনের তিনিই ছিলেন প্রধান যোগসূত্র। সে কারণে বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন বেগম মুজিবকে নিয়ে। বিশেষ গবেষণা তেমন হয়নি, তবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রবন্ধে বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে। এখন এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তি-সংগ্রামের সূচনায়ও শেখ মুজিবকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। সে সময় বেগম মুজিব একদিকে যেমন সংসার রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি নজর রাখতেন, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতি যত্ন নিতেন,
পাশাপাশি পারিবারিক সম্পদ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একটা অংশ শেখ মুজিবুরের জন্য পাঠাতেন। ’৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। অবশ্য কিছুদিন পরই তিনি পদত্যাগ করেন। তখন তার পরিবার ঢাকায় অবস্থান করছিল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আÍজীবনীতে দেখা যায়- বাসায় এসে যখন তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, তিনি তখন তা অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৬ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীতে। এ সময়ে তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুনন্নেছা ছিলেন অসুস্থ। তিনি আশা করেছিলেন স্বামী তার কাছে কিছুদিন থাকবেন। সেই দাঙ্গায় বহু পরিবারের জীবন রক্ষার জন্য শেখ মুজিব নিজের জীবন প্রায় বিপন্ন করেছিলেন। বিহারের বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুকে বাংলায় এনে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে কারণে তিনি মুজিবকে বিহারে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। শেখ মুজিব বেগম মুজিবের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি লেখেন, তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিহারে যাও, আমার জন্য ভেবো না। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনায়ই বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা করছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এবং মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি স্বাধিকার আন্দোলনের সনদ ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিব এবং সহযোগীদের হত্যা করার জন্য আগরতলা মামলা পরিচালনা করেন। বেগম মুজিব উৎসাহিত করেছিলেন বিধায় শেখ মুজিবের পক্ষে ছয় দফা আন্দোলন করা এবং এর মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলা সম্ভব হয়েছে। ওই মামলায় সহযোগী অনেকেই এবং তাদের পরিবার-পরিজন ভীত ছিলেন। শেখ মুজিবের সহধর্মিণী সে সময় অভিযুক্ত ও তাদের পরিবার-পরিজনদের উৎসাহিত করতেন, শক্তি জোগাতেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন ভূমিকা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন এবং শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু বেগম মুজিব বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে জনগণের অভিপ্রায় বুঝতে পারেন এবং স্বামী শেখ মুজিবকে প্যারোলো মুক্ত না হওয়ার পরামর্শ দেন এবং বলেন, জনগণই তাকে মুক্ত করে আনবে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। বিজয়ী জনগণ বাংলার আপসহীন নেতা শেখ মুজিবকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু নামে অভিহিত করে। মুক্তি-সংগ্রামের সেই ভয়ংকর অনিশ্চিত বছরগুলোতে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নেপথ্য ভূমিকা কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, এসব ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়।
’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ স্বাধিকারের পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলে গণআন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এবং বলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও ছাত্র-জনতা বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকা তুলে দেন এবং তিনি তা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী জনতার ওপর আক্রমণ চালায় এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এ সময়, বিশেষ করে ৭ মার্চ, ২৩ ও ২৫ মার্চ বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনার মন ও বিবেক যা চায় তাই করুন, পিছিয়ে যাবেন না।
এ অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধুকে আরও দৃঢ়চেতা করেছে। অকুতোভয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রেও শেখ ফজিলাতুন্নেছা উৎসাহিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম মুজিব তার পরিবারের লোকজনসহ ধানমণ্ডির পুরনো ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে বন্দি ছিলেন। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাড়ি ছেড়ে চলে যান। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর সহযোগী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর শেখ জামাল বিএলএফে (মুজিব বাহিনী) যোগ দেন। বিএলএফের জুনিয়র লিডারদের ট্রেনিং হয়েছিল আসামের জাফলংয়ে আর সিনিয়র লিডারদের টানডুয়ায়। এরপর আঞ্চলিক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ ৮৩ সিনিয়র মোস্ট লিডারের ট্রেনিং হয়েছিল দেরাদুনস্থ কালশিতে। সেই ট্রেনিংয়ে আমাদের সঙ্গে শেখ জামালও ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথ কমান্ডের কাছে পাক হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবার বন্দি অবস্থা থেকে অনেক মানসিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার ভোগ করার পর মুক্তিলাভ করেন ১৭ ডিসেম্বর। বিএলএফের আঞ্চলিক কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ,
বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান ও আমি মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা অবতরণ করি। প্রয়াত আবদুর মান্নান টাঙ্গাইলের দিকে চলে যান। আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ আগেই মনস্থির করে রেখেছেন, তারা বেগম মুজিব ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে ১৮ নম্বর বাড়িতে যাবেন। আমিও তাদের সঙ্গী হিসেবে ওই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা রাতে ওই বাড়িতে ছিলাম এবং একত্রে খাবার খেয়েছি। পরদিন সকালে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ অন্যত্র চলে গেলেন, রাজ্জাক ভাই আমাকে বলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলেছে- তুমি জহুরুল হক হলে ওঠো (জগন্নাথ হলসহ কয়েকটি হলে তখন মিত্রবাহিনী অবস্থান করছিল)। এরপরও আমি ১৯ তারিখ অতিবাহিত করে ২০ তারিখ সকালে জহুরুল হক হলে চলে যাই। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমার এ ৩৬ ঘণ্টা জীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় দিন এবং তার পরিবারকে কাছ থেকে দেখার এবং অনুধাবন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল এবং এজন্য আমি সৌভাগ্যবান। বেগম মুজিব সে সময় জানেন না তার স্বামী জীবিত আছেন কিনা এবং ফিরে আসবেন কিনা। সে সময়টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তার বুকে ব্যথা ছিল; কিন্তু জাতির বিজয়ে তিনিও উদ্বেলিত। নেতাকর্মীদের প্রতি তার দরদ ও আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। আমার স্মরণ আছে,
রাতে খাবার টেবিলে আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তিনিও খাবার টেবিলে বসেছিলেন। সেই টেবিলে আমারও তার পাশে বসে খাবার গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার স্মরণ আছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তখন বসেননি। খাবার ও অন্যান্য বিষয়ে দেখাশোনা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে প্রথমে গেলেন তার প্রিয় জনতার মাঝে এবং পরে পরিবার-পরিজনের কাছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন এবং যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। মহীয়সী শেখ ফজিলাতুন্নেছা আগের মতোই স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেছেন। এখানে একটি বিষয়ে উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন না; কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য করেছে, এ কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিমানবন্দরে গিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট স্বামী ও পরিবারের অনেক সদস্যের সঙ্গে তিনিও শহীদ হন- যা ইতিহাসের এক কলংকজনক অধ্যায়। মহীয়সী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসের অংশ, তিনি বঙ্গমাতা। ইতিহাস তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করবে, এটাই আমরা আশা করি।
ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত
ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত
No comments