হিন্দু ভারত, মুসলমান পাকিস্তান
পাঞ্জাব (লাহোর যার রাজধানী) এখনো পাকিস্তানের মেরুদণ্ড। সিন্ধুতে গোলযোগ চলছে। এর মূল কারণ শিয়া ও সুন্নিদের চিরদিনের কোন্দল। বেলুচিস্তানে চলছে স্বশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন। সম্প্রতি পাঁচ দিন পাকিস্তানে অবস্থানের সময় আমি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে স্বাধীনতার দাবিতে কোয়েটা থেকে ইসলামাবাদে মিছিল করে আসা বেলুচদের ছবি দেখেছি। বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ জিইয়ে রাখতে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তার অভিযোগ করা হয়ে থাকে ভারতের বিরুদ্ধে। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ সীমান্তের ওপারের আফগান তালেবানের সঙ্গে সংঘাতে এতটাই লিপ্ত যে উন্নয়নের পথে এগোবার ফুরসত মিলছে না তাদের। এ অবস্থায় কোন জিনিসটি পাকিস্তানকে এখনো ঐক্যবদ্ধ রেখেছে, সে দেশের এক শীর্ষ আইনজীবীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব ছিল: সেনাবাহিনী। ওই আইনজীবীর কথা সত্যি হতেই পারে। তার পরও আমি মনে করি না, পাকিস্তানে আবার সেনা অভ্যুত্থান হতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকারের প্রক্রিয়া ক্রমেই পোক্ত হচ্ছে। এটা পেছন দিকে ফেরানো অসম্ভব। সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লোকজন পথে নেমে আসবে। এশিয়া কাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান ভারতকে হারানোর দিন আমি লাহোরে ছিলাম। লোকজন ব্যাপক আনন্দ-ফুর্তি করছিল। খুশিতে ফাঁকা গুলি ছুড়ছিল অনেকে। এ উচ্ছ্বাসের কারণ বোধগম্য। ভারতের সাত ভাগের এক ভাগ আয়তনের দেশটি একে অন্তত একটি ক্ষেত্রে পরাস্ত করে অনুপ্রাণিত বোধ করছিল। আমি যে কারণে আশ্চর্য হয়েছিলাম, তা হলো, খেলায় জয় নিয়ে পাকিস্তানিদের আলাপে বারবার উঠে আসছিল ভারতের এখনো পাকিস্তানকে ‘মেনে না নেওয়া’র বিষয়টি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা ভোটারদের ভয় দেখাতেই এ ধুয়া তোলেন। পাকিস্তান তার আত্মপরিচয়ের জন্য কেন ভারতের স্বীকৃতি চাইবে, তা আমার বোধগম্য নয়।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি লাহোর সফর করার সময় আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, পাকিস্তানকে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করার দরকার নেই, স্বাধীন রাষ্ট্রটিই তার পরিচয়। এখনো পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় হিসেবে পরিচিত বাজপেয়ি মিনার-ই-পাকিস্তানেও ঘুরতে গিয়েছিলেন। আমিও তখন সেখানে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়িকে পুনরুক্তি করতে শুনেছিলাম যে ভারতের সংহতি ও অখণ্ডতা নির্ভর করে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার ওপর। এটা খুব দুঃখজনক যে কোনো উগ্রপন্থী সংগঠন বাজপেয়ির সফরের পর মিনার-ই-পাকিস্তানকে ‘পবিত্র’ করার জন্য পানি দিয়ে ধুয়েছিল। পাকিস্তানে রাষ্ট্র পরিচালনায় এখনো সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ভারতকে যে বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন, তা সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া সম্ভব হয়নি। মনে হয়, সেনাবাহিনী একটি ‘লক্ষণরেখা’ টেনে দিয়েছে, যার বাইরে সরকার যেতে পারে না। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। কাশ্মীরে ভারতকে হেনস্তা করার জন্য যা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা-ই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে পাকিস্তানকে ভোগাচ্ছে। আফগানিস্তানের তালেবান পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক উভয় কর্তৃপক্ষকে বেগ দিচ্ছে। তাদের হামলার সঙ্গে যোগ হচ্ছে দেশীয় তালেবান তেহরিক ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) দৌরাত্ম্য। তারা পাকিস্তানের যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে; পারে যাকে ইচ্ছা হত্যা করতে। তবে মোটের ওপর লাহোর তথা পাঞ্জাব নিরাপদ। বলাবলি আছে যে লাহোরের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে টিটিপির কোনো একটা সমঝোতা হয়েছে। পাঞ্জাবকে রেহাই দেওয়ার জন্য তিনি টিটিপিকে ‘পুরস্কৃত’ করে থাকেন। পাকিস্তানের সামনে সমস্যার শেষ নেই। মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান ছায়া এর একটি মাত্র। লাহোরে আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে, তা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে প্রতিবাদের অনুপস্থিতি।
ব্লাসফেমি আইনের বিরোধিতা করার জন্য খুন হওয়া পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরের ব্যাপারে কেউই কথা বলতে চান না। এদিকে ভারতে তখন কী ঘটছে? পাকিস্তানি ক্রিকেট দলকে হর্ষধ্বনি দিয়ে সমর্থন জানানোর জন্য মিরাটের বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ কাশ্মীরি শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। প্রথমে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সমালোচনার ঝড় উঠলে ওই শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। তবে এ ঘটনায় ভারতের বিষয়ে কাশ্মীরিদের মনোভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যে কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কার করেছিল, তারা হয় খুবই গোঁড়া মানসিকতার, অথবা আশা করেছিল, ওই পাকিস্তানবিরোধী ভূমিকার জন্য তারা প্রশংসিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ওই উদ্যাপন আর বহিষ্কারাদেশ—এ দুটি ঘটনা এটাই তুলে ধরে যে দেশ বিভাগের আগের বয়ান (হিন্দু ভারত আর মুসলমান পাকিস্তান) বদলায়নি। চেতনার গভীরে ভাবনাটা একই রয়ে গেছে যে ধর্ম রাষ্ট্রের পরিচায়ক। স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরও ভারত গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমনটা পেরেছে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সে রকম জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আর পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সমস্যা নেই বললেই চলে, কারণ সে দেশে জাতিগত বিশোধন হয়েছে ব্যাপকভাবে। সে কারণে দেশটিতে সাম্প্রদায়িক কলহ শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অমুসলিম ঘোষিত আহমদিয়াদের ওপরই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মূল আঘাতটা লাগছে। কবর খুঁড়ে তাদের মৃতদেহের দেহাবশেষ বাইরে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলতে হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বৈরিতার মাত্রাটা কমে এসেছে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে হূদ্যতা সৃষ্টির আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানে। ভিসার শর্ত শিথিল হলে পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার মানুষ ভারতে আসবেন। এটা ভারতের জন্যও ভালো। এদিকে সমস্যাটা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও হাফিজ সাইদ যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই উগ্রপন্থী প্রান্তিক গোষ্ঠীকেই পাকিস্তানের মূল ভাবধারা মনে করা হয়।
No comments