বদলে যাচ্ছে মিয়ানমার by সোহরাব হাসান

ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে নেমেই অবাক হলাম। লৌহযবনিকার দেশ বলে পরিচিত মিয়ানমারে আসা অতিথিদের বেশির ভাগই পর্যটক। এসেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। আছেন এশীয় দেশগুলোর ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশাজীবীও। পর্যটকেরা যে দেশটি দেখতে আসেন, সেই দেশটির সঙ্গে তাঁদের একধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক ও হার্দিক বিনিময় হয়। ২০১১ সালে মিয়ানমারের বন্ধ দরজা খোলার পর থেকেই প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসতে শুরু করেন। ২০১৩ সালে পর্যটক বেড়েছে ৩৬ শতাংশ।

বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন লাউঞ্জটি বেশ সাজানো-গোছানো। শান্ত পরিবেশ। ইমিগ্রেশন ডেস্কের নারী কর্মীরা কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে কিছুটা ভড়কে যান। পাশের সহকর্মীর সহায়তা নেন। কিন্তু কারও চোখে-মুখে বিরক্তি নেই। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সু চিকে পছন্দ করেন কি না? মৃদু হাসলেন। ইমিগ্রেশন লাউঞ্জ পার হয়ে বহির্গমনে এসে দেখি, সারি সারি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জের বুথ। ১০০ মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে পাওয়া গেল নয় হাজার ৭০০ কিয়েত (মিয়ানমারের মুদ্রা)।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সবে ঢাকা-ইয়াঙ্গুন ফ্লাইট আবার চালু করেছে। আগে ইয়াঙ্গুন যেতে হতো ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর ঘুরে। কখনো কখনো ৫০ মিনিটের উড়ালপথ পার হতে পুরো দিন কেটে যেত। ২০০২ সালে এই বিমানেই ব্যাংকক থেকে ঢাকায় ফিরতে ইয়াঙ্গুনে যাত্রাবিরতি করেছিলাম। তখন শহরটিকে মনে হয়েছিল নিষপ্রাণ। এবার আলোয় ঝলমল করছে। বদলে যাচ্ছে মিয়ানমার।
বিমানবন্দরে বিভিন্ন ট্যাক্সি কোম্পানির লোকজনের ভিড়। তবে ঢাকা বিমানবন্দরের মতো হই-হুল্লোড় বা টানাটানি নেই। আমরা বাংলাদেশের চার যাত্রী শেষমেশ আর্নল্ড সু নামের এক চালকের ট্যাক্সিতে উঠলাম। ভাড়া ১০ ডলার। ভারতের তেলেগু বংশোদ্ভূত আর্নল্ডরা কয়েক পুরুষ ধরে মিয়ানমারে আছেন।
রাতের ইয়াঙ্গুন কেবল ছিমছাম নয়, আলোকোজ্জ্বল। প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন মার্কেট। নির্মাণাধীন উঁচু ভবন। আমরা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তার পাশেই ইন্ডিয়া লেক, লেকের ওপারে অং সান সু চির বাড়ি। খুবই সাধারণ। মনে পড়ে, আর্মির কড়াকড়ির মধ্যে এক মার্কিন সাংবাদিক সু চির সঙ্গে দেখা করতে লেক সাঁতরে গিয়েছিলেন। পরে সেনা সরকার এটিকেই সু চির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। কিন্তু এখন ওই বাড়িতে অবাধেই যাওয়া যায়।
ঘণ্টা খানেকের কম সময়ের মধ্যে পান্ডা হোটেলে পৌঁছাই। ভাড়া শোধ করে আলাপ করি আর্নল্ডের সঙ্গে। তিনি তাঁর স্ত্রীর একটি কার্ড দিলেন। তাঁর মণিরত্নের (স্টোন) ব্যবসা আছে। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন বিদেশে পড়েন, দ্বিতীয়জন ইয়াঙ্গুনের বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর ছোটটি কলেজে। ইয়াঙ্গুনের সব ট্যাক্সিচালক আর্নল্ডের মতো সচ্ছল নন। তবে সবার চেহারাতেই একধরনের স্বস্তি লক্ষ করা যায়।
মিয়ানমারের দোকান, মার্কেটের প্রায় পুরোটা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে। ছেলেরা ট্যাক্সি চালান বা অফিসে কারখানায় কাজ করেন। শহরের ভেতরে ট্যাক্সির ন্যূনতম ভাড়া এক হাজার ৫০০ কিয়েত।
ধারণা ছিল, মিয়ানমার এ অঞ্চলের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। মানুষগুলো হতদরিদ্র। কিন্তু পোশাক-চেহারা দেখে তা মনে হলো না, তারা অতটা খারাপ অবস্থায় আছে। যেকোনো দেশের উন্নতির অন্যতম প্রধান শর্ত শিক্ষা। মিয়ানমারের বয়স্ক শিক্ষার হার ৯২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যুব শিক্ষার হার ৯৬ দশমিক ১০। প্রতিটি শিশুই বিদ্যালয়ে যায়। বর্তমান জনসংখ্যা ছয় কোটি। মানসম্মত পানীয় জল ও পয়োনিষ্কাশন-সুবিধা পায় যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ১০ ও ৭৭ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ। দুটিই আমাদের চেয়ে বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দশমিক ৮৫ শতাংশ, আমাদের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। মিয়ানমারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৮০ দশমিক ১৩ জন। বাংলাদেশে এক হাজারের বেশি। জনপ্রতি বার্ষিক আয়ও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১ দশমিক ৪৪ ডলারে। তবে এ আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈষম্যও বেড়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান সমান। ছেলেমেয়ের গড় বিয়ের বয়স যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৬০ বছর ও ২৬ দশমিক ১০ বছর বয়স। ৬৭ শতাংশ মা-ই মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন। বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায় ২০ বছরের আগে।
তবে দেশটির দারিদ্র্য অবস্থার কারণ পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ২৫০ সদস্যের বিশাল সেনাবাহিনী। তাদের পেছনে রাষ্ট্রকে গুনতে হয় প্রচুর অর্থ। ২০১১ সালে মিয়ানমার আমদানি করে ৩০ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের অস্ত্র। মিয়ানমার কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না। তাহলে এ অস্ত্র তারা কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে? সব উন্নয়নশীল দেশের শাসকেরাই অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতায় নামেন। আর তার জন্য খেসারত দিতে হয় নিরীহ জনগণকে। তাদের কষ্ট ও শ্রমের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় অপ্রয়োজনীয় সামরিক খাতে।
গত তিন বছরে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। চীন ও ভারত ছাড়া ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি এখন মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার (এডিবি, আইডিবি ও জাইকা ধরলে ১৮০ কোটি ডলার) ঋণ নিয়ে কত কাণ্ড ঘটল। আর মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে বিশ্ব সংস্থাগুলো মুখিয়ে আছে।
১ মার্চ সিনহুয়া জানায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম ১১ মাসে মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি ডলার (মার্চেই ওদের অর্থবছর শেষ হয়)। এ বিনিয়োগের মধ্যে ৫০ শতাংশ নির্মাণ খাতে, ২০ শতাংশ টেলিযোগাযোগ খাতে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১৪০ কোটি ডলার। মিয়ানমার বিনিয়োগ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৮ সাল থেকে মিয়ানমারে যে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশই করেছে চীন; চার হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মধ্যে এক হাজার ৪১৯ কোটি ডলার। বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে এক হাজার ৯০০ কোটি করা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, তেল ও গ্যাস খাতে বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার ৩৬৩ কোটি ডলার।
দেশটিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে, মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধা পায়। টেলিযোগাযোগ সুবিধাও অপ্রতুল। ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় টেলিফোন কলের জন্য খরচ প্রতি মিনিটে চার ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ৩২০ টাকা। লোকাল কলও মিনিটপ্রতি ১০০ কিয়েত, বাংলাদেশি ১২-১৩ টাকা। অবশ্য এটি মাঝামাঝি মানের একটি হোটেলের হিসাব। একটি সিম কার্ডের দাম ১০০ ডলার। রাস্তায় টেলিফোনের দোকান তেমন চোখে পড়েনি। আশার কথা, টেলিযোগাযোগ খাতে দ্রুত নতুন বিনিয়োগ আসছে। নরওয়ের টেলিনর ও আবুধাবির ওয়ারিদ চুক্তি করেছে। আরও অনেক কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহী।
ইইউ বাণিজ্য কমিশনার কারেল দা গুচ বলেছেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করব, কেননা আমরা তাদের অনেক প্রস্তাব দিয়েছি। মিয়ানমারের মতো দেশের জন্য আমরা বড় বিনিয়োগদাতা। আমাদের বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিতে হবে, একই সঙ্গে এটি মিয়ানমারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তারা সেটি করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরাও আসবে না।’
মিয়ানমারে এই বিদেশি বিনিয়োগের কারণ কী? এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কার একটি ভূমিকা রেখেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তার চেয়েও বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে দেশটির অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ, স্বল্প মজুরি, বৃহৎ কৃষি খামার এবং পর্যটনকেন্দ্র।
মিয়ানমারের রপ্তানিপণ্যের তালিকার শীর্ষে আছে গ্যাস, মোট রপ্তানির ৩৭ শতাংশ। এরপর আছে পাথর, কাঠ, রাবার, চাল ইত্যাদি। সর্বোচ্চ আমদানিকারক দেশ থাইল্যান্ড, এরপর চীন, ভারত ও জাপান।
আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসলেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ছয়ের ওপরে ওঠাতে পারিনি। কিন্তু মিয়ানমারের ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, আগামী অর্থবছরে এটি দাঁড়াবে ৭ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতির হারও আমাদের চেয়ে কম, ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
ইয়াঙ্গুনে প্রায় প্রতিদিন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে হলো বিমসটেকের সরকার
ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন। দ্বিতীয় সপ্তাহে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সেনাপ্রধানদের বৈঠক। ৯-১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মেলন। প্রতিটি আয়োজনে স্বাগতিকদের দক্ষতা ও শৃঙ্খলার ছাপ রয়েছে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.