তারেক রহমানের অভিনব ‘রাষ্ট্রপতিতত্ত্ব’

ইতিহাস যাঁরা নির্মাণ করেন, তাঁরা কখনোই ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করেন না। করার প্রয়োজনও হয় না। ইতিহাস নিয়ে তাঁরাই অহেতুক বিতর্ক করেন, ইতিহাসে যাঁদের অবদান রাখার ন্যূনতম সামর্থ্য ও সাহস নেই। কথাটি মনে পড়ল বৃহস্পতিবার পত্রিকায় লন্ডনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তৃতাটি পড়ে। সেখানে বিএনপি আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের সেমিনারে তিনি বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক।’ তাঁর দাবি, ‘এটি ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা আছে।’ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এটি জিয়া-তনয়ের আবিষ্কারই বটে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন সাড়ে পাঁচ বছর, খালেদা জিয়া ছিলেন ১০ বছরের বেশি। এ দীর্ঘ সময়ে বিএনপির কোনো নেতা-নেত্রী কিংবা সমর্থক বুদ্ধিজীবীও দাবি করেননি যে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এখন তারেক রহমান বলছেন, তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপতি। এ ব্যাপারে সম্ভবত তিনি বিএনপির আমলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘সংশোধিত’ ইতিহাসকে সাক্ষ্য মানবেন।প্রত্যুত্তরে আমরা জিয়াউর রহমান আমলের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করছি। দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি এবং জিয়াউর রহমানের দুটি ঘোষণা ছাপা হয়েছে। প্রথম ঘোষণায় শেখ মুজিব বলেছেন, ....‘এটি আমার শেষ বার্তা হতে পারে, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে আপনারা যেখানে এবং যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ চালিয়ে যান।
বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানের শেষ সেনাটি বিদায় না হওয়া এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে হবে।’ জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণায়ও নিজে সরকার গঠনের দাবি করেননি। এমনকি বেঁচে থাকতে তিনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেও প্রচার করেননি। কেবল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর ঘোষিত বার্তাটি যে কলমে লেখা হয়েছিল, সেটির খবর তিনি জানেন কি না। ২৭ মার্চ প্রচারিত ঘোষণায় জিয়া বলেছেন, ‘আমি জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী কমান্ডার ইন চিফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন ও আইনানুগ সরকার গঠন করেছি, যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ২৪ বছর পর ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে জিয়ার একটি নতুন বার্তা যোগ করে এবং বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি গায়েব করে দেয়। এটি নিয়ে আইনি লড়াইয়েও তাঁরা হেরে গেছেন। এখন সেই ‘সংশোধিত’ ইতিহাসের অস্তিত্ব নেই। তারেক রহমান বলেছেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ২৭ মার্চ তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নিজে অস্থায়ী কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে দেশবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নানও একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এসব ঘোষণার আগেই দেশের মানুষ যার যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ শুরু করেছিল। ২৫ মার্চ রাতে পিলখানায় ইপিআরের জওয়ানরা এবং রাজারবাগে পুলিশ সদস্যরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা কারও ঘোষণা বা নির্দেশের অপেক্ষা না করেই।
তারেক রহমানের পর খালেদা জিয়াও ২৭ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই প্রথম রাষ্ট্রপতি।’ গতকাল দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া তাঁর আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে প্রবাসী সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত কার সরকার ছিল? দিশেহারা জাতিকে পথ প্রদর্শন করেছেন জিয়াউর রহমান, তা প্রমাণ করে সে সময় তিনি দেশের মূল ভূমিকা পালন করে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া বা করা বা চালাতে হয়েছে, সে ব্যবস্থায় তিনি তা করেছেন। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮ মার্চ ২০১৪) বিএনপির এই নেতা বলতে চেয়েছেন, ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত জিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তার মানে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামেরা প্রবাসী সরকার গঠন করেছেন জিয়ার নেতৃত্বে এবং তাঁর নির্দেশেই। সেনাবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী এবং অন্য সেক্টর কমান্ডাররাও যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জিয়ার নির্দেশেই। অদ্ভুত ও উদ্ভট যুক্তি। জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হতে হলে তাঁকে একটি সরকার গঠন করতে হতো। সেটি করার ম্যান্ডেট কি তাঁর ছিল? যদি না থাকে, তাহলে তিনি কী করে প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন? কয়েক বছর আগে এই লেখকের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেছিলেন, স্বাধীনতা তাঁরাই ঘোষণা করতে পারেন, জনগণ যাঁদের ম্যান্ডেট দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে তিনি এ-ও বলেছিলেন, আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কর্নেল পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তা স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার কারণে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
কেননা, স্বাধীনতা ঘোষণার এখতিয়ার তাঁর ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। কিন্তু সেই ম্যান্ডেট অনুযায়ী পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ায় স্বাধীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। সত্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকেই একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঘোষণা আসে এবং ছয় সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সেই ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে দুটি দেশেরই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।’ ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়, যার রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানীর অধীনে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারের মতো জিয়াউর রহমানও একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি জিয়া ফোর্সের প্রধান হন। তারেক রহমানের ভাষায় লাল অক্ষরে লেখা এই ইতিহাস থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে একাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে সরকার গঠিত হয়, তার নেতৃত্ব ও আনুগত্য মেনে নিয়েই জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কেবল তারেক রহমান প্রবাসে বসে এ ঘোষণাটি দিলে তা তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে মানা যেত। কিন্তু এক দিন পর তাঁর মা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশেও একই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধার দল নয়, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।’ তবে বিএনপির চেয়ারপারসন এটি বলেননি যে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। সেটি তিনি বলবেন না।
কেননা, বললে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবদানকে স্বীকার করা হয়। আমাদের রাজনীতিতে এখন চলছে অস্বীকারের সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক যেসব প্রতিক্রিয়া আশা করা গিয়েছিল, তার চেয়ে কম কেউ দেননি। দলের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, তারেক রহমান যা বলেছেন, তা সংবিধান পরিপন্থী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাইতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন, তাঁরা (বিএনপি) এত দিন বলেছেন জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক, এখন বলছেন প্রথম রাষ্ট্রপতি। ...এখন ফর্মুলা পাল্টেছে, কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ইয়াহিয়া খান তাঁকে গ্রেপ্তার করল না কেন? তিনি জিয়াকে নামেই মুক্তিযোদ্ধা বলে উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের দুটি দিক আছে। প্রথমত, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে উল্লেখ করেছেন। এটি ঐতিহাসিক সত্য। এ সত্য কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। অতীতে অনেকে চেষ্টা করে সফল হননি। ভবিষ্যতেও তাঁরা সফল হবেন না। কিন্তু এ-ও সত্য যে আওয়ামী লীগ একাই মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আরও অনেক দল এমনকি দলের বাইরের মানুষ এ যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। ইতিহাসের ভাগাভাগিতে আমরা যেন তাঁদের কথা ভুলে না যাই। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষণীয় যে তাঁরা নিজেদের ছাড়া অন্য কারও অবদান স্বীকার করতে চান না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জিয়াউর রহমান নামেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এর মাধ্যমে কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরই শুধু খাটো করলেন না, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী যে সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিল, তাকেও অসম্মান করলেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এসেও আমরা কে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক, কে প্রথম রাষ্ট্র্পতি ছিলেন এসব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করছি। সামনে তাকাচ্ছি না। এ দীর্ঘ সময়ে আমরা কেন শিক্ষার হার ৬০ শতাংশের ওপরে নিতে পারলাম না, কেন এখনো ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, কেন ৩৭ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার, সে প্রশ্ন করছি না। কেন আমাদের দেশ প্রতিবেশীদের চেয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, সে নিয়েও রাজনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ নেই। তাঁরা কেবল ইতিহাসে বন্দী হয়ে আছেন। মাত্র দুই দিন আগে আমরা স্বাধীনতা দিবসে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে জাতিকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলাম। আর দুই দিন পরই বিভেদ ও বিদ্বেষে পরস্পরকে বিদ্ধ করে চলেছি। এই আত্মঘাতী ইতিহাস চর্চা থেকে জাতিকে রক্ষা করবে কে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.