রাজনীতির জন্য অবসর নেওয়া রাজনীতিক by কামাল আহমেদ
সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে খ্যাত
ওয়েস্টমিনস্টারে ফিরে আসার জন্য প্রায় অর্ধশতক আগে যিনি প্রায় অসম্ভবকে
সম্ভব করেছিলেন, সেই রাজনীতিকের নিথর দেহ শেষবারের মতো ওয়েস্টমিনস্টার ঘুরে
গেছে ২৭ মার্চ। ইউরোপের বামপন্থী রাজনীতির কিংবদন্তি ও যুদ্ধবিরোধী শান্তি
আন্দোলনের নেতা টোনি বেন হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাসে দ্বিতীয়
ব্যক্তি, যাঁর মরদেহ পার্লামেন্টের চ্যাপেলে বিশেষ মর্যাদায় শায়িত রাখা
হয়েছিল। অন্য যে ব্রিটিশ রাজনীতিক মরণোত্তর এই অনন্য সম্মান পেয়েছেন, তিনি
হলেন ডানপন্থী রক্ষণশীল রাজনীতিক লৌহমানবী হিসেবে খ্যাত সাবেক
প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। মার্গারেট ব্রিটেনের প্রথম নারী
প্রধানমন্ত্রী এবং ফকল্যান্ডের যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু টোনি
বেন তাঁর দল লেবার পার্টি ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় দলের নেতৃত্বের
নির্বাচনে মধ্যপন্থী নেতা ডেনিস হিলির কাছে হেরে গেছেন। তার পরও ব্রিটিশ
রাজনীতির মূলধারায় তাঁর প্রভাব অন্যদের ছাপিয়ে গেছে।
ব্রিটেনে তিনিই প্রথম, যিনি রাজনীতিতে বংশগত অধিকারের ধারায় নিজের দাবি প্রত্যাখ্যান করে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। ব্রিটেনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে একসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই ছিলেন বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের প্রতিভূ। কালে কালে তার কিছুটা সংস্কার হয়ে এখন বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার হিসেবে সেখানে আসা সদস্যের সংখ্যা পাঁচ ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। এসব সংস্কারের কৃতিত্ব প্রধানত বামপন্থী ও উদারপন্থী লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের। টোনি বেন হাউস অব কমন্সে নির্বাচিত হন লেবার পার্টির টিকিটে ১৯৫০ সালে, আর তাঁর বাবা ছিলেন হাউস অব লর্ডসের সদস্য। তখনকার আইন অনুযায়ী ১৯৬০ সালে বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর যাওয়ার কথা ছিল হাউস অব লর্ডসে এবং হাউস অব কমন্সের জন্য তিনি তখন অযোগ্য হয়ে পড়েন। কিন্তু টোনি বেন বংশানুক্রমিক আভিজাত্যের পোশাকি মর্যাদার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে বরং জনমানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি পার্লামেন্ট সদস্যের পদটিই বেছে নিতে চাইলেন। ফলে তাঁকে শুরু করতে হয় এক কঠিন সংগ্রাম। সেই আইনি লড়াইয়ের পরিণতিতে ১৯৬৩ সালের ৩১ জুলাই সংশোধিত হয় ব্রিটেনের কয়েক শ বছরের পুরোনো আইন এবং লর্ডসভার বংশানুক্রমিক সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান আইনসিদ্ধ করা হয়। তিনি ফিরে আসেন হাউস অব কমন্সে এবং পরে হ্যারল্ড উইলসন ও জেমস কালাহানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন। তিনি ১৬ বারে প্রায় ৫০ বছর মন্ত্রী ছিলেন, যে রেকর্ড লেবার পার্টিতে আর কারও নেই।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আদর্শবাদিতা আরও দৃঢ়তর হয় পরের দশকগুলোয়। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থার প্রতিফলন তাঁর রচিত কমনসেন্স: আ নিউ কনস্টিটিউশন ফর ব্রিটেন বইটি। এটি মূলত ১৯৯১ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর জন্য তাঁর উত্থাপিত ‘কমনওয়েলথ অব ব্রিটেন বিল’-এর বিশদ ব্যাখ্যা। এতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তিনি ব্রিটেনকে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন, যার একটি লিখিত সংবিধান থাকবে। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অবসান চেয়েছিলেন যে বামপন্থী রাজনীতিক, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করতেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ওয়েস্টমিনস্টারের চ্যাপেল অব সেন্ট মেরি আন্ডারক্রফট খুলে দেওয়ার অনুমতি দেন। ওয়েস্টমিনস্টার চত্বরে ওই প্রার্থনালয়ের মালিক রানি। স্পিকারের অনুরোধে রানি এই অনুমতি দেন।
২০০১ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য পদ থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন এবং হাউস অব কমন্সে তাঁর শেষ বক্তৃতায় তিনি পার্লামেন্টের ভূমিকা এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, তা যে রাজনীতিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যবিবরণীর রেকর্ড (হানসার্ড) অনুযায়ী টোনি বেন বলেন, ‘আমার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য আমি পাঁচটি সামান্য প্রশ্ন তৈরি করেছি। অ্যাডলফ হিটলার, জোসেফ স্টালিন কিংবা বিল গেটসের মতো ক্ষমতাধর কারও সঙ্গে দেখা হলে তাঁদের যে প্রশ্নগুলো করা যায়: আপনার কী ক্ষমতা আছে? এই ক্ষমতার উৎস কী? কার স্বার্থে আপনি এসব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন? আপনি কার কাছে জবাবদিহি করেন? এবং আমরা আপনাকে কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারব?’ এসব প্রশ্ন উত্থাপনের পর তিনি বলেন, ‘যাঁরা আপনাদের শাসন করেন, তাঁদের ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনো পথ যদি না থাকে, তাহলে আপনি যে ব্যবস্থায় বাস করছেন, তা গণতন্ত্র নয়।’ এসব প্রশ্ন প্রয়োগ করা হলে তৃতীয় বিশ্বের খুব বেশি দেশকে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাতারে ফেলা যাবে, তা মনে হয় না।
ম্যাগি থ্যাচারের মুক্তবাজার সংস্কার ও ট্রেড ইউনিয়ন দমনের পদক্ষেপগুলোর বিরোধিতার মতোই নিজের দল লেবার পার্টির নেতা টোনি ব্লেয়ারের সংস্কারগুলোর বিরোধিতাতেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি। ‘নিউ লেবার’ নামে টোনি ব্লেয়ারের বাজারমুখী সংস্কারনীতির বিরুদ্ধে লেবার পার্টিকে শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থতা তাঁকে পীড়িত করেছে। সম্ভবত সে কারণেই আক্ষেপের সুরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখানে পুঁজিবাদের ব্যবস্থাপনার জন্য আসিনি, সমাজটাকে বদলে দেওয়ার জন্য এসেছি।’ আড়াগোড়া তিনি ছিলেন একজন র্যাডিক্যাল। তাঁর এসব আদর্শবাদী ও কট্টর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর দিনলিপি বা ডায়েরিতে। ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন তিনি এবং এগুলোর আটটি খণ্ড তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে প্রায় অর্ধডজন বই।
পার্লামেন্ট সদস্য জীবন থেকে অবসর নেওয়ার সময় করা তাঁর আরও একটি মন্তব্য ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন আরও স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার জন্য। তিনি করেছেনও তা-ই। পার্লামেন্টারি রাজনীতি থেকে অবসরের পরও ব্রিটিশ রাজনীতিতে তাঁর পদচারণ ডান-বামনির্বিশেষে সবাই অনুভব করেছেন। টোরি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে শুরু করে ডানপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই অকপটে স্বীকার করেছেন যে তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও তাঁর নৈতিক অবস্থানকে শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই। অবসরজীবনে যেখানেই ডাক পড়েছে, সেখানেই ছুটে গেছেন তিনি, বিশেষ করে শ্রমজীবীদের পাশে। টোরি ও লিবারেল জোটের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের এক বক্তৃতায় তাঁর মন্তব্য ছিল: ‘মানুষ হত্যার (যুদ্ধের) জন্য খরচ জোগাড় করা গেলে মানুষকে সাহায্যের জন্যও তা জোগাড় করা সম্ভব।’
মৃত্যুর আগে শেষ সাক্ষাৎকারেও (রুশ টেলিভিশন—আরটিভি) তিনি টোনি ব্লেয়ারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের কথা বলেছেন। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালেও তিনি হাজির হয়েছিলেন বাগদাদে এবং সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে দেখা করে আটক বিদেশি জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ফকল্যান্ড নিয়ে আর্জেন্টিনার সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়েও তিনি ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মত দিয়েছিলেন যে বিরোধটি নিষ্পত্তির উপায় যুদ্ধ নয়, জাতিসংঘ ফোরামে আলোচনা। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত মোকাবিলায় সামরিক কৌশল অনুসরণের বিরোধিতা করে তিনি নিষিদ্ধ রিপাবলিকান গোষ্ঠী শিন ফেনের নেতা জেরি অ্যাডামসের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। নাইন-ইলেভেন নিউইয়র্কে আল-কায়েদার বিমান হামলার জবাবে প্রেসিডেন্ট বুশ আফগানিস্তানে যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন, টোনি বেন তার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়: ‘স্টিলথ জঙ্গি বিমান থেকে বোমা ফেলে যারা মানুষ হত্যা করে, তাদের সঙ্গে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর নৈতিক অবস্থানের কোনোই পার্থক্য নেই। তারা উভয়ই রাজনৈতিক কারণে মানুষ হত্যা করে।’
ইরাকে বুশ-ব্লেয়ারের যৌথ অভিযানের প্রাক্কালে লন্ডনে যে ১০ লক্ষাধিক মানুষ যুদ্ধবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিল, সেই আন্দোলনে স্টপ দ্য ওয়ার কোয়ালিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের সময় যুদ্ধাহত ফিলিস্তিনিদের জন্য তহবিল সংগ্রহের আবেদন প্রচারে বিবিসিসহ ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম অস্বীকৃতি জানানোর পর বিবিসির সরাসরি প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই আবেদন তুলে ধরে সাহায্যের অঙ্গীকার জানানোর টেলিফোন নম্বরটিও বলে দেন।
রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার পর টোনি ব্লেয়ারের মতো নেতারা যখন বিভিন্ন বহুজাতিক করপোরেশনের পরামর্শক বনে গিয়ে কোটি কোটি ডলার আয় করেন, তখন শুধু আদর্শবাদিতাকে আঁকড়ে থেকে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছেন টোনি বেন। ১৪ মার্চ তাঁর মৃত্যুর পর তাই কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম যে তাঁকে বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির এক মহামানব বলে বর্ণনা করেছে, সেই মর্যাদা তো সত্যিই তাঁর প্রাপ্য।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments