পণ্য নয়, মর্যাদায় ধন্য হোন
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাক্জীবীরা (টক শোয় অংশগ্রহণকারী) বিভিন্ন চ্যানেল সরগরম রাখলেন এ দিবসের তাৎপর্য বা করণীয় নিয়ে। সভা, সেমিনার, শোভাযাত্রা, পত্রপত্রিকার অবদানও কম নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, মানসিক অত্যাচার, নারীর নিরাপত্তা নিয়ে অনেক কথা হলো। বিজ্ঞাপনে নারীর অবস্থানকেও আলোচনায় আনা হলো। কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে কেন পণ্য করা হবে, যেমন গাড়ির বিজ্ঞাপনে নারীকে কেন বিশেষ পোশাকে বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে—এসব নিয়ে বাগিবতণ্ডা। বিজ্ঞাপননির্মাতাদের নারীর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে বা নারীকে সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করতে হবে ইত্যাদি। উপস্থাপক প্রশ্ন রাখেন, তাহলে যেসব নারী মডেলকে ও রকম অসম্মানজনক বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়, তাঁরা প্রতিবাদ করেন না কেন? উত্তরে বাক্জীবী বলেন, এটা হয়তো তাঁর পেশা বা জীবিকা। তিনি নির্মাতা যেভাবে বলবেন, সেভাবে না করলে জীবিকা হারাবেন। উচিত, নির্মাতাদেরই সংশোধিত হওয়া। বিখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমিকে এক চিত্রপরিচালক একবার একটি দৃশ্যে স্বামীর পায়ে হাত বোলাতে বলেছিলেন। কাহিনির প্রয়োজনে সে দৃশ্যের খুব একটা দরকার ছিল না। শাবানা সে দৃশ্যে অভিনয় করতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি এ ধরনের মর্যাদাহানিকর অনাবশ্যক দৃশ্যে কেউ অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলেও উচ্চারণ করেছিলেন।
তো আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করতে হবে। একবার প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ফোরামের এক পিকনিকে নামকরা সংগীতশিল্পীদের আনা হয়েছিল গান পরিবেশনের জন্য। নারী শিল্পী প্রথমেই গাইলেন: ‘আমি তোমার বধূ, তুমি আমার স্বামী, খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’। উপস্থিত নারী কর্মকর্তা ও অন্যান্য মর্যাদাসম্পন্ন নারী খুবই বিরক্ত হলেন। দু-একজন পুরুষও উসখুস করলেন। দর্শক কারা, তা বিবেচনায় রেখে গান নির্বাচন করা উচিত বলে অনেকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন। নারীকে নিজেই মর্যাদাবান হতে হবে। ছোটবেলা থেকেই মেয়ে আর ছেলের বৈষম্য নিরসনে পরিবারের বড়দের কর্তব্যের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের মর্যাদাবান হতেও শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষাকে জাতির শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর এক প্রবন্ধে। সত্যিকার শিক্ষিত মানুষ কাউকে অবমাননা করতে পারেন না বা তাঁরা কাউকে অসম্মানের আসনেও বসতে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন না। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, যে ব্যক্তির অধীনে নারীরা কাজ করেন বা যাঁরা নারীদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা কি শিক্ষিত নন? নিশ্চয় তাঁদের উচ্চশিক্ষার সনদ রয়েছে। কিন্তু তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি। তাই যে বাবা-মা সন্তানদের উচ্চমূল্যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন, তাঁরা যে সন্তানদের হাতে খুন বা নিগৃহীত হবেন না, তা কেউ বলতে পারে না।
কারণ, মূল্যবোধ বা মর্যাদাবোধ পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। আচার-ব্যবহারে, আদানে-প্রদানে, চালচলনে ও শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় তা আপনিই হয়ে ওঠে। একসময় আমাদের ভাড়া বাড়ির একদিকে বাস করতেন এক চিকিৎসক পরিবার, অন্যদিকে এক শালকার (ধোপা) পরিবার। ধনী চিকিৎসকের দোতলা থেকে প্রতিরাতে ঝগড়া, জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ির আওয়াজ, দরজা ধাক্কাধাক্কি, কান্নাকাটি নিত্যকার ঘটনা। অন্যদিকে, শালকার পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনেক এবং দারিদ্র্যও প্রকট। কিন্তু তাদের বাসা থেকে কেউ কোনো দিন কাউকে জোরে কথা বলতে শোনেনি। তাদের অভাব ছিল, উচ্চশিক্ষা ছিল না; কিন্তু ধোপদুরস্ত পুরোনো দুর্বল কাপড় পরিহিত তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে দেখলে সবাই সম্মানে নত হতেন। কেন? কারণ তাঁর চালচলন ও চোখে-মুখে এমন কিছু ছিল, যা ওই শিক্ষিত চিকিৎসকের ছিল না। নারীকেও চালচলনে মর্যাদাবান হতে হবে। নারী কারও খেলার পুতুল নয়, তা পরিবার থেকেই জানাতে হবে। পারিবারিক শিক্ষায় আত্মমর্যাদাবোধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারীকে পণ্য করার সাহস যেন কেউ না পায়, সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। সেটাও নির্ভর করে পরিবারের পুরুষেরা নারীদের প্রতি কেমন আচরণ করছেন, তার ওপর। পরিবারের ছেলেশিশুটি যেন না বুঝতে পারে মেয়েরা অধস্তন, পুরুষ শ্রেষ্ঠ, নারী দ্বিতীয় সারির।
তাই এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকাও কম নয়। পরিবারের পুরুষেরা যেসব মেয়েকে বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখেন, সেসব মেয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগে নিজেদের অবস্থানকে উঁচুতে তুলতে পারেন না। তাঁরা ভাবেন, এটাই তাঁদের প্রাপ্য। তখন কর্মক্ষেত্রে তাঁরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। বিজ্ঞাপনে নারী তাঁর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করছেন। তাঁরা সেখানে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। নারীকে পণ্য করার পাঁয়তারা অনুদার ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের থাকবেই। তাদের সে মনোভাবের সহায়ক হবেন না আত্মমর্যাদাবান নারী। রাউলিংয়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘মাদার ইন ম্যানভিল’ পড়েছেন অনেকেই। গল্পের সেই দরিদ্র ছোট্ট কাঠুরে জেরি লেখিকার দয়া বা সহানুভূতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ গল্পটি এখনো উচ্চমাধ্যমিকে পড়ানো হয় কি না, জানি না। আসলে এসব গল্প পাঠ্যপুস্তকে রাখার অর্থ হলো, এ থেকে শুধু আনন্দই সংগ্রহ নয়, শিক্ষাও। সিমন দা বেভোয়ার বলেছেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্মান না, নারী হয়ে ওঠেন।’ কিন্তু নারী কি নিজে নারী হয়ে ওঠেন? পারিপার্শ্বিকতার বলি নারীকে মর্যাদাবান মানুষ হয়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে সবাইকে, নারীর নিজেকেও।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
No comments