সংবিধান সংরক্ষণ, না গণতান্ত্রিক নির্বাচন? by ড. শরীফ মজুমদার
আপাতদৃষ্টিতে
মনে হচ্ছে, সংবিধান সংরক্ষণ এবং সব দলের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক নির্বাচন- এ
দুটি একসঙ্গে আমাদের বাস্তবতায় অন্তত এবারের জন্য আর হয়ে উঠছে না। জনগণের
ভাবনা এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণে এ দুইয়ের মধ্যে কোনটি আমাদের জন্য
এ মুহূর্তে বেশি জরুরি তা-ই এখনকার বিবেচ্য বিষয়। যদি সংবিধান সংরক্ষণ
একেবারেই বাধ্যতামূলক হতো তাহলে সংবিধানে সংশোধনী আনারও সুযোগ থাকত না।
সংবিধানের প্রতিটি সংশোধনীই আনা হয়েছে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা
করে। কারণ সংবিধান জাতির জন্য, সংবিধানের জন্য জাতি নয়। তাই বলে যখন তখন
যদি সংবিধানের বাইরে যেতে হয়, তাহলে সংবিধান থাকার দরকারটা কী? তবে কমবেশি
প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই সংবিধানের বাইরে অনেক কিছুই করতে হয়েছে; বিশেষ
করে যতক্ষণ না সাংবিধানিক কার্যপ্রণালী সবার কাছে সানন্দে গৃহীত হওয়ার মতো
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের
দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়ার মতো ঘটনা কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক
দেশে ঘটেছে, সে ধরনের নজির খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তাদের কাছে
সংবিধানের কিছু কার্যপ্রণালী সংরক্ষণ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন পরিচালনা
করার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে কখনোই বেশি গুরুত্ব পায় না। নিঃসন্দেহে আমাদের
বাস্তবতায়ও গণতন্ত্র রক্ষায় নির্বাচনের গুরুত্ব সংবিধান সংরক্ষণের
গুরুত্বের চেয়ে অনেক বেশি। আর সংবিধানের যে কার্যপ্রণালী দিয়ে সংবিধান
সংরক্ষণের দোহাই উপস্থাপন করা হয় তা যদি বিতর্কিত কার্যপ্রণালী হিসেবে
বিবেচিত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সংবিধান তখনই উপকারে আসে যখন দেশে গণতন্ত্র
থাকে; অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসিত দেশে সংবিধান থাকা না থাকায় তেমন
কোনো পার্থক্য উপলব্ধি করা যায় না। অন্যদিকে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য
নির্বাচনের গুরুত্ব গণতন্ত্র রক্ষায় অপরিসীম এবং শুধু গণতন্ত্র রক্ষা পেলেই
সেই গণতন্ত্রকে কার্যকর গণতন্ত্রে রূপ দিতে গিয়ে সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা
উপলব্ধি করা যায়। এক কথায়, গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতিতে সংবিধানের গুরুত্ব
অনেকটা বর-কনেহীন বাসর ঘরে ফুলশয্যার গুরুত্বের মতোই। অতএব, আগে গণতন্ত্র
রক্ষা করি, পরে সংবিধান সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তা করা যাবে।
গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন বিশ্বজুড়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সময়ের আবর্তনে অগণতান্ত্রিক দেশগুলোও গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে আস্থা আনছে। হয়তো কিছুটা ধীরে কিন্তু গণতান্ত্রিক জাগরণ বিশ্বব্যাপী ‘গণতন্ত্রকে’ স্পষ্টতই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসন ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। অনেকে সমালোচনাও করছে যে চীন যদি গণতন্ত্র ছাড়াই ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে গণতন্ত্রের দরকার কী? তার প্রকৃত উত্তর হচ্ছে এই যে, ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হলেও চীনের নাগরিকরা দেশের নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করে না; যার ফলে তারা নিজভূমে পরবাসের মতো জীবন অতিবাহিত করে এবং প্রচুর অর্থের মালিক হলেও সুযোগ পেলে দেশত্যাগে দ্বিধা করে না। তাই তাদের নিজ দেশে ‘বিলং’ করার ‘সেন্স’ নেই বললেই চলে। এ ‘সেন্স অব বিলংগিং’ একমাত্র গণতন্ত্রেই সম্ভব। মূলত এ ‘সেন্স অব বিলংগিং’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই বহু দেশে আজ চরম অশান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে ‘সেন্স অব বিলংগিং’ রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কোনো বিকল্প আছে এমনটি প্রতীয়মান নয়; বরং সেক্ষেত্রে সংবিধান বা সংবিধানের কিছু কার্যপ্রণালীর সংরক্ষণ কতটা গুরুত্ব বহন করে, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে ‘সেন্স অব বিলংগিং’ থাকে না এবং সেখানে গণতন্ত্রও থাকে না। আর গণতন্ত্র না থাকলে সংবিধান সংরক্ষণের কথা চিন্তা করাটা নিতান্তই অর্থহীন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সর্বস্তরের মতাদর্শের এবং শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া। সুতরাং সংবিধান সংরক্ষণের ব্যাপারটি গুরুত্ব পায় মূলত গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে। মেয়াদ শেষে আবার সর্বস্তরের মতাদর্শের এবং শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততায় নির্বাচন পরিচালনা করতে যদি ক্ষমতাসীন দলের সংশোধিত সংবিধান অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে অবশ্যই কার্যকর গণতন্ত্র কিছুটা হোঁচট খায়। তাছাড়া সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার যদি কোন মতাদর্শ বিতর্কিত আর কোন মতাদর্শ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তা নিজেই নির্ণয় করে ফেলে, তাহলে নির্বাচনে জনগণের নির্ণয়ের জন্য আর থাকেই বা কী? পৃথিবীর বহু দেশেরই বিতর্কিত ইতিহাস আছে, কিন্তু তারা সে ইতিহাস নিয়ে বসে থাকেনি। বিতর্কিত মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে পৌঁছে গেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া কার্যকর গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যে পড়ে না। ভারতের উগ্র ধর্মীয় দল বিজেপি একটি মূলধারার রাজনৈতিক দল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেনি; ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি জার্মানির ক্ষমতাসীন দল, যারা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের ধারণার চেয়েও ধর্মীয় ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু তাতে করে তাদের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়নি। কানাডার গণতান্ত্রিক দলগুলোর শিকড়ও চার্চের বাইরে নয়। আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ইহুদিদের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও আর্থিক সাহায্য ছাড়া ক্ষমতায় আসতে পারেনি, কিন্তু তাদের কেউ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে নীতি কথা শোনায় না। সুতরাং সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে যে নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তা কতটা গণতান্ত্রিক সেটি জনসাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। যদি তা কার্যকর গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় না পড়ে, তাহলে তা স্পষ্টতই গণতন্ত্রকে অকার্যকর করার পথে একটি মাইলফলক।
আমরা সাধারণ মানুষ এমন কোনো নির্বাচন চাই না যাতে প্রধান বিরোধী দল থাকবে না; যাতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার নামে জনগণের একটি বিশাল অংশের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না; যাতে সাবেক সেনাশাসকের অধীনের কোনো মূলধারার গণতান্ত্রিক দল অংশগ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করবে। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসব শ্রেণী-পেশার মানুষকে বাদ দিলে যে প্রতিযোগিতা হবে, তার জন্য নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। আমরা চাই সব মতাদর্শ ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে একটি নির্বাচন; আমরা চাই দেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন মতাদর্শ বিতর্কিত বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে কী পারবে না। তাতে করে যদি সংবিধান কিছুটা অসংরক্ষিতও হয়ে পড়ে তবুও সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণ তা নিয়ে পরে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। আইয়ুব খানও বেসিক ডেমোক্রেসির নামে শুধু নিজস্ব প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে প্রহসনের নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্পৃহা বেশি দিন দমিয়ে রাখতে পারেননি। বাংলাদেশেও সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের প্রহসনের নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি বরং সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এখন যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে বস্তুত সেই প্রতিহিংসার প্রহসনের নির্বাচন করাটাই সরকারের লক্ষ্য বা বিবেচ্য বিষয় তাহলে বলতে হবে, এ জাতির কপালে দুঃখ আছে। সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই যদি জাতিকে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে তা সবচেয়ে অবমাননাকর হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্যই। কারণ তিনি নিজেকে এক সময় গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে পরিচয় দিতেন; গণতন্ত্রের স্বার্থেই দেশে-বিদেশে ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের কথা বলতেন; গণতন্ত্র সুসংহত রাখতে আপস সমঝোতার কথা বলতেন। ৯০ দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সহিংসতার জন্ম দেবে, না সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দেয়া আপস সমঝোতাহীন একদলীয় নির্বাচন দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতার জন্ম দেবে- সে সিদ্ধান্তটিতে প্রধানমন্ত্রীকেই উপনীত হতে হবে। তাকে একদলীয় নির্বাচনী চিন্তাভাবনার বাইরে আসতে হবে। সংবিধান সংরক্ষণের কথা আপাতত ভুলে গিয়ে কিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন করা যায়, তা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ চাই না, কেউ এ সভ্য দেশে আবার কোনো অসভ্য চিন্তা করুক। আমরা চাই না, কেউ গণতন্ত্রে বিশ্বাস হারিয়ে লগি-বৈঠায় বিশ্বাস খুঁজুক বা গণতন্ত্রে শ্রদ্ধা হারিয়ে ২১ আগস্টের মতো নিকৃষ্ট অধ্যায়ের ভাবনায় ফিরে যাক। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের চারপাশ কতটা ভয়ংকর; আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো দেখলে আমাদের প্রতিবেশীরা সত্যিই দুঃখ পাবে, না খুশি হবে- তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এ পরিস্থিতিতে সবার অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, তাতে সংবিধান সংরক্ষিত থাকল কী থাকল না, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো স্বস্তি বিরাজ করবে না।
নির্বাচন সারা দেশে একটি আনন্দঘন অধ্যায়ের সূচনা করবে, সেটাই গণতান্ত্রিকভাবে কাম্য। বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পুরো জাতি নির্বাচনপূর্ব আমোদে মেতে ওঠে, সেখানে সহিংসতার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। সংবিধানের কিছু বিতর্কিত সংশোধনী কিছুটা অসংরক্ষিত হলেও যদি পুরো জাতি একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার পায়, তা কি জাতির জন্য কল্যাণকর নয়? আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে জাতি সহিংসতায় মেতে উঠবে- এ গুজব যতটা না মানুষকে নির্বাচন সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত করছে, তার চেয়ে বেশি সুযোগ সন্ধানী করে তুলছে একটি বিশেষ মহলকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের শুধরে নিয়ে জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ার দাবি রাখে, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের শুধরে নিয়ে জাতিকে আরও ভালো ৯০ দিন উপহার দিতে পারবে না- এমনটি ভাবার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা(!) এ বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন এবং জাতিকে আনন্দঘন গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার দেবেন, সেটাই সবার আশা। জাতি কখনোই আপনাকে সংবিধান সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করবে না- এটুকু বিশ্বাস জাতির ওপর আপনি রাখতে পারেন। কোনো পরিস্থিতিতেই আনন্দহীন নির্বাচন কাম্য নয়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন বিশ্বজুড়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সময়ের আবর্তনে অগণতান্ত্রিক দেশগুলোও গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে আস্থা আনছে। হয়তো কিছুটা ধীরে কিন্তু গণতান্ত্রিক জাগরণ বিশ্বব্যাপী ‘গণতন্ত্রকে’ স্পষ্টতই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসন ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। অনেকে সমালোচনাও করছে যে চীন যদি গণতন্ত্র ছাড়াই ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে গণতন্ত্রের দরকার কী? তার প্রকৃত উত্তর হচ্ছে এই যে, ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হলেও চীনের নাগরিকরা দেশের নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করে না; যার ফলে তারা নিজভূমে পরবাসের মতো জীবন অতিবাহিত করে এবং প্রচুর অর্থের মালিক হলেও সুযোগ পেলে দেশত্যাগে দ্বিধা করে না। তাই তাদের নিজ দেশে ‘বিলং’ করার ‘সেন্স’ নেই বললেই চলে। এ ‘সেন্স অব বিলংগিং’ একমাত্র গণতন্ত্রেই সম্ভব। মূলত এ ‘সেন্স অব বিলংগিং’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই বহু দেশে আজ চরম অশান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে ‘সেন্স অব বিলংগিং’ রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কোনো বিকল্প আছে এমনটি প্রতীয়মান নয়; বরং সেক্ষেত্রে সংবিধান বা সংবিধানের কিছু কার্যপ্রণালীর সংরক্ষণ কতটা গুরুত্ব বহন করে, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে ‘সেন্স অব বিলংগিং’ থাকে না এবং সেখানে গণতন্ত্রও থাকে না। আর গণতন্ত্র না থাকলে সংবিধান সংরক্ষণের কথা চিন্তা করাটা নিতান্তই অর্থহীন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সর্বস্তরের মতাদর্শের এবং শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া। সুতরাং সংবিধান সংরক্ষণের ব্যাপারটি গুরুত্ব পায় মূলত গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে। মেয়াদ শেষে আবার সর্বস্তরের মতাদর্শের এবং শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততায় নির্বাচন পরিচালনা করতে যদি ক্ষমতাসীন দলের সংশোধিত সংবিধান অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে অবশ্যই কার্যকর গণতন্ত্র কিছুটা হোঁচট খায়। তাছাড়া সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার যদি কোন মতাদর্শ বিতর্কিত আর কোন মতাদর্শ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তা নিজেই নির্ণয় করে ফেলে, তাহলে নির্বাচনে জনগণের নির্ণয়ের জন্য আর থাকেই বা কী? পৃথিবীর বহু দেশেরই বিতর্কিত ইতিহাস আছে, কিন্তু তারা সে ইতিহাস নিয়ে বসে থাকেনি। বিতর্কিত মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে পৌঁছে গেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া কার্যকর গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যে পড়ে না। ভারতের উগ্র ধর্মীয় দল বিজেপি একটি মূলধারার রাজনৈতিক দল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেনি; ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি জার্মানির ক্ষমতাসীন দল, যারা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের ধারণার চেয়েও ধর্মীয় ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু তাতে করে তাদের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়নি। কানাডার গণতান্ত্রিক দলগুলোর শিকড়ও চার্চের বাইরে নয়। আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ইহুদিদের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও আর্থিক সাহায্য ছাড়া ক্ষমতায় আসতে পারেনি, কিন্তু তাদের কেউ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে নীতি কথা শোনায় না। সুতরাং সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে যে নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তা কতটা গণতান্ত্রিক সেটি জনসাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। যদি তা কার্যকর গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় না পড়ে, তাহলে তা স্পষ্টতই গণতন্ত্রকে অকার্যকর করার পথে একটি মাইলফলক।
আমরা সাধারণ মানুষ এমন কোনো নির্বাচন চাই না যাতে প্রধান বিরোধী দল থাকবে না; যাতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার নামে জনগণের একটি বিশাল অংশের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না; যাতে সাবেক সেনাশাসকের অধীনের কোনো মূলধারার গণতান্ত্রিক দল অংশগ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করবে। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসব শ্রেণী-পেশার মানুষকে বাদ দিলে যে প্রতিযোগিতা হবে, তার জন্য নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। আমরা চাই সব মতাদর্শ ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে একটি নির্বাচন; আমরা চাই দেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন মতাদর্শ বিতর্কিত বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে কী পারবে না। তাতে করে যদি সংবিধান কিছুটা অসংরক্ষিতও হয়ে পড়ে তবুও সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণ তা নিয়ে পরে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। আইয়ুব খানও বেসিক ডেমোক্রেসির নামে শুধু নিজস্ব প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে প্রহসনের নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্পৃহা বেশি দিন দমিয়ে রাখতে পারেননি। বাংলাদেশেও সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের প্রহসনের নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি বরং সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এখন যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে বস্তুত সেই প্রতিহিংসার প্রহসনের নির্বাচন করাটাই সরকারের লক্ষ্য বা বিবেচ্য বিষয় তাহলে বলতে হবে, এ জাতির কপালে দুঃখ আছে। সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই যদি জাতিকে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে তা সবচেয়ে অবমাননাকর হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্যই। কারণ তিনি নিজেকে এক সময় গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে পরিচয় দিতেন; গণতন্ত্রের স্বার্থেই দেশে-বিদেশে ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের কথা বলতেন; গণতন্ত্র সুসংহত রাখতে আপস সমঝোতার কথা বলতেন। ৯০ দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সহিংসতার জন্ম দেবে, না সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দেয়া আপস সমঝোতাহীন একদলীয় নির্বাচন দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতার জন্ম দেবে- সে সিদ্ধান্তটিতে প্রধানমন্ত্রীকেই উপনীত হতে হবে। তাকে একদলীয় নির্বাচনী চিন্তাভাবনার বাইরে আসতে হবে। সংবিধান সংরক্ষণের কথা আপাতত ভুলে গিয়ে কিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন করা যায়, তা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ চাই না, কেউ এ সভ্য দেশে আবার কোনো অসভ্য চিন্তা করুক। আমরা চাই না, কেউ গণতন্ত্রে বিশ্বাস হারিয়ে লগি-বৈঠায় বিশ্বাস খুঁজুক বা গণতন্ত্রে শ্রদ্ধা হারিয়ে ২১ আগস্টের মতো নিকৃষ্ট অধ্যায়ের ভাবনায় ফিরে যাক। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের চারপাশ কতটা ভয়ংকর; আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো দেখলে আমাদের প্রতিবেশীরা সত্যিই দুঃখ পাবে, না খুশি হবে- তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এ পরিস্থিতিতে সবার অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, তাতে সংবিধান সংরক্ষিত থাকল কী থাকল না, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো স্বস্তি বিরাজ করবে না।
নির্বাচন সারা দেশে একটি আনন্দঘন অধ্যায়ের সূচনা করবে, সেটাই গণতান্ত্রিকভাবে কাম্য। বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পুরো জাতি নির্বাচনপূর্ব আমোদে মেতে ওঠে, সেখানে সহিংসতার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। সংবিধানের কিছু বিতর্কিত সংশোধনী কিছুটা অসংরক্ষিত হলেও যদি পুরো জাতি একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার পায়, তা কি জাতির জন্য কল্যাণকর নয়? আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে জাতি সহিংসতায় মেতে উঠবে- এ গুজব যতটা না মানুষকে নির্বাচন সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত করছে, তার চেয়ে বেশি সুযোগ সন্ধানী করে তুলছে একটি বিশেষ মহলকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের শুধরে নিয়ে জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ার দাবি রাখে, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের শুধরে নিয়ে জাতিকে আরও ভালো ৯০ দিন উপহার দিতে পারবে না- এমনটি ভাবার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা(!) এ বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন এবং জাতিকে আনন্দঘন গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার দেবেন, সেটাই সবার আশা। জাতি কখনোই আপনাকে সংবিধান সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করবে না- এটুকু বিশ্বাস জাতির ওপর আপনি রাখতে পারেন। কোনো পরিস্থিতিতেই আনন্দহীন নির্বাচন কাম্য নয়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments