বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিতা by ফরহাদ মজহার
বাংলাদেশের
বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। এতে যে কোনো নাগরিকই দুঃখিত ও
মর্মাহতই হবেন। আমি ব্যতিক্রম নই। শুধু তা নয়, একইভাবে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও
চিন্তিত। এ পরিস্থিতিতে গত ২৮ অক্টোবর রাতে ইটিভির ‘একুশের রাত’ অনুষ্ঠানে
আমি গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নিজ দায়িত্বে কিছু কথা বলেছি। আর, আমি দায়িত্ব
নিয়েই কথা বলি। সাংবাদিক মনির হায়দার অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। এতে
গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আমার বিশ্লেষণ ও মন্তব্য নিয়ে তর্ক তৈরি হয়েছে। তার
কিছু উত্তর আরেকটি দৈনিকে আমি দিয়েছি। এই তর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিন্ন
কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব। তর্ক-বিতর্ক গণতন্ত্রের মর্ম। কিন্তু
সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা ভঙ্গ করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একাত্তর
টেলিভিশন আমার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক প্রচার শুরু করে। তারা তাদের নিজেদের
একটি টকশো আয়োজন করে। ইটিভির টকশো থেকে বেছে বেছে খণ্ডিত কিছু অংশ পরিবেশন
করে। এমনভাবে তা হাজির করে যাতে ইটিভির টকশোতে আমার মূল বিশ্লেষণই হারিয়ে
যায়। সর্বোপরি কেন আমি সেদিন গণমাধ্যম সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করছি সেই
গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুই বাদ দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সেদিন একাত্তরের টকশোতে যারা
হাজির ছিলেন, তারা বিভ্রান্ত হয় এবং আমাকে ভুল বোঝে। বিচক্ষণ দুই-একজন
আলোচক সেই মুহূর্তে না বুঝলেও পরে ইটিভির টকশোর পুরোটা দেখার পর একাত্তর
টিভির মিথ্যাচার থেকে মুক্ত হয়েছেন। এই প্রত্যাশা আমি করি।
যে মন্তব্য নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আমার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলেছে সেই মন্তব্য সম্পর্কে সেই একই দিনে একই রাতে একই অনুষ্ঠানে আমি এটাও বলেছি যে, ‘আমি স্বভাবতই কখনোই চাইব না কেউ পটকা, নিন্দা বা ঢিলও যেন গণমাধ্যমের ওপর ছুড়ুক। এটা কথার কথা, rhetoric। আলোচনা করার জন্য, যাতে আমরা বুদ্ধিজীবীরা, গণমাধ্যমের কর্মীরা বুঝতে পারি যে, এই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া একমাত্র দায়ী নন। আমরা, আমাদের ভূমিকার কারণে আজকে এই পরিস্থিতি আমরা তৈরি করেছি।’ একাত্তর টিভি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার মন্তব্যের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছে।
এমনকি একাত্তর টিভি আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করেছি, সেটাও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। ডক্টর সলিমুল্লাহ খান এই কথাগুলো বলেছেন। টিভিতে তার মুখভঙ্গির মধ্যে আমাকে রাষ্ট্রের নিপীড়িনমূলক যন্ত্রের দ্বারা শাস্তি দেয়ার জিঘাংসা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। তার চোখে-মুখে যে হিংস্রতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা ফুটে উঠেছে তাতে আমি অবাক না হয়ে পারিনি। যাক, আমাদের দেশে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীর জন্ম হয়েছে, যারা প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দিতে ইচ্ছুক। সত্যিই আমরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। ইতিমধ্যে আমার নামে থানায় দুটি জিডি হয়েছে। ডক্টর সলিমুল্লাহ খান অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল।
যেখানে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, মতভিন্নতা থাকলেও পরস্পরকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, সেখানে তিনি আমাকে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের হাতে নির্যাতনের জন্য তুলে দিতে চাইছেন। এ ধরনের মহৎ কাজ করেছেন বলে আমি তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। প্রকাশ্যে তিনি টেলিভিশন টকশোর বরাতে রাজসাক্ষী হয়েছেন। আমি তার এই উন্নতিতে অভিভূত।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ডক্টর খান আমাকে হত্যাই যদি করতে চান, করতেই পারেন। তবে যার বক্তব্য তিনি পছন্দ করেন না, তার চিন্তার বিরুদ্ধে লড়ার কাজকে এতকাল তিনি গালিগালাজ বলেই বুঝেছেন। এখন আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আমাকে হত্যা করতে চান। এটাই তার বুদ্ধিজীবিতা। এটাই আমরা শেষমেশ জানলাম। তাকে যখন চিনতাম তখন তার মধ্যে এই ধরনের জিঘাংসা কাজ করে সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। নিজের এই অক্ষমতার জন্য আত্মসমালোচনা করা ছাড়া আমার আর উপায় কী!
ডক্টর খানের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমার কিছুই বলার নাই। তিনি প্রায়ই আমাকে গালিগালাজ করেন। যার সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ তর্ক-বিতর্কের কোনোই সম্পর্ক নাই। তার গালিগালাজের কোনো উত্তর দেয়া আমি সমীচীন মনে করি না। ইতিমধ্যেই একাত্তর টিভির কল্যাণে ও তার মতো ব্যক্তিদের উস্কানির কারণে নানান স্তরের সন্ত্রাসীরা আমার ক্ষতি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, বিষয়টি থানা, পুলিশ, আইন ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল অবধি নিয়ে গিয়েছে। এ কথাগুলোও বলতে চাইনি। না চাইলেও এখন উপেক্ষা করতে পারছি না।
গণমাধ্যমের সমালোচনা করলে সেটা কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় সেই পাণ্ডিত্য বোঝার ক্ষমতা আমার নাই; এটা সত্য, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, সেটা আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলছি। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কেউ নির্বাচিত হয়ে এলেও সেটা গণতন্ত্র নয়, বরং সেটা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। এই বক্তব্য আজ নয়, নব্বই দশক থেকেই আমি বলে আসছি। বাংলাদেশের সংবিধানের সমালোচনা যখন আমি শুরু করি, তখন কেউই এই গোড়ার গলদ নিয়ে কিছু বলেনি। বাহাত্তরের সংবিধান প্রায় সবার কাছেই ছিল পূতপবিত্র জিনিস। কিভাবে সংবিধান ধর্মগ্রন্থের স্তরে উন্নীত হয় সে এক আজব কাহিনী। নৃতত্ত্ববিদদের দারুণ খোরাক। কিভাবে সেকুলার ধর্মপ্রাণতা ফ্যাসিবাদকে ভিত্তি দেয় তার নানান নজির আমরা বেয়াল্লিশ বছর ধরেই দেখছি।
কিন্তু সেই প্রসঙ্গ এখন থাক। আমরা এখন পঞ্চদশ সংশোধনী সংবলিত সংবিধানের কালপর্বে রয়েছি। মজা হচ্ছে, এই সংবিধানের ভিত্তিতে যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে, সেই রাষ্ট্রের আমি দ্রোহী নই। বরং গণমাধ্যমের সমালোচনার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী। সত্যি চমৎকার। যিনি এই দাবি করছেন, তিনি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাকেই আসলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষার জন্য তারা মরিয়া। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তার যে দুর্দশা ঘটেছে, তার কারণে রাষ্ট্রের এই মহৎ রূপান্তরের পক্ষে তারা প্রকাশ্যে দাঁড়াতে পারছেন না। ক্ষমতাসীন শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা উভয় রক্ষা করা এখন নীতিনৈতিকতার দিক থেকে কঠিন হয়ে পড়েছে। অতএব বলতে হচ্ছে, আমি গণমাধ্যমে বোমা মারতে বলেছি, আমি রাষ্ট্রদ্রোহী। অথচ আমি পরিষ্কার করে কী বলেছি, তা উপরে উদ্ধৃত করেছি। আমি কথার ছলে রেটরিক হিসেবে যা বলেছি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছি।
আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি যে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই নতুনভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ বা কন্সটিটিউট করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাষ্ট্রদর্শনের জায়গা থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিচার করে এ সিদ্ধান্তে আমি অনেক আগেই এসেছি। এছাড়া অন্য কোনো পথ নাই। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রগঠন সভার (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) প্রয়োজন অবশ্যই হবে। আমার এই রাজনৈতিক অবস্থান আমি কখনোই লুকাইনি। এই গোড়ার জায়গা বাদ দিয়ে যারা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে, তারা বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করতে চায়, সে কথাও আমার চেয়ে শক্তভাবে কেউ বলেছে বলে আমার জানা নাই। বিদ্যমান রাষ্ট্রকে বহাল রেখে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার মামলা এটা নয়। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এটা, কোনোভাবেই এক-এগারোর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার প্রয়োগ নয়। এখনকার লড়াই হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই। এ লড়াইয়ে মতাদর্শিক বিভাজন হচ্ছে কারা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে আর কারা তার রূপান্তর কামনা করে। জনগণের মধ্যে নানান মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, বিরোধ ও বিভাজনের সুরাহা করে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের গণতান্ত্রিক কর্তব্য বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া। আমি এই রাজনীতিকেই সঠিক মনে করি। এটাই আমার রাজনীতি। যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা শুধু নয়, সেই রাষ্ট্রের ফাঁসির কাষ্ঠে প্রতিপক্ষকে ঝোলাতে মরিয়া হয়ে যায়, তাদের সঙ্গে এই রাজনীতির পার্থক্য দুস্তর। নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠন নিয়ে অবশ্যই তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। সেখানে কিভাবে ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়া যায় তা নিয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে, নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের জন্য লড়েছি, কোনো বিদেশী প্রভুর নির্দেশ বা কোনো একটি দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নয়। যে কেউই ইচ্ছা করলে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে দেখতে পারেন। এই তিন নীতির ভিত্তিতেই যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এই তিন নীতি কায়েমের জন্য অকাতরে শহীদ হয়েছেন। বেয়াল্লিশ বছর এদেশের জনগণকে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের জনগণকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির অধীনতা ও বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার রাজনীতির চর্চা হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি, কারও পরাধীনতা মেনে নেয়ার জন্য নয়। বেয়াল্লিশ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
খেয়াল করতে হবে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি, একই সঙ্গে ইসলামের নৈতিক ও দার্শনিক আদর্শের সঙ্গেও তা গভীরভাবে যুক্ত। এই তিন নীতির ভিত্তিতেই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। গুরুতপূর্ণ দিক হল, একই সঙ্গে এর ঐতিহাসিক ও আইনি ভিত্তি আছে। ঐতিহাসিক কারণ এই তিন নীতি কায়েমের জন্য আমরা লড়েছি। এর আইনি ভিত্তি আছে, কারণ স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলেই তা ঘোষিত ও সন্নিবেশিত। ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের যে সংঘাত, যার কারণে আমরা বিভক্ত ও জর্জরিত এবং এখন পরস্পরকে ধ্বংস করতে উদ্যত- তা রাজনৈতিকভাবে নিরসনের এটাই সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর পথ। এর ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এর ন্যায্যতা ইতিহাসে, বাংলাদেশের প্রতিটি বড় কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষায় এবং প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষের রূহানি সত্তায়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আমার রাজনীতি। কাউকে গ্রেফতার ও ফাঁসিতে ঝোলানো নয়, এমনকি কটু কথা বলাও নয়।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি অংশের বিবৃতি দেখে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত, বিমূঢ় ও হতবাক। সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ খুবই দুঃখজনক। গণমাধ্যমের ওপর কেন এই ধরনের হামলা হয়, আমি ২৮ অক্টোবর রাতে ‘একুশের রাত’ টকশোতে তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করেছি। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ যেভাবে ব্যাখা করেছেন তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তারা নিজেরা তাদের নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করলেই বুঝবেন। তারা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার করছেন। গণমাধ্যমের ওপর দুঃখজনক হামলার যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমি করেছি, তার সঙ্গে তারা একমত না হলে ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন। একেই বলে বাক, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, একেই বলে গণতন্ত্র চর্চা। কিন্তু সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তা না করে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের দাবিই শুধু করছেন না, আমার কণ্ঠরোধ করতে চাইছেন। তারা এতই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে যে সারা দেশের সাংবাদিকদের ওপর হামলার জন্য আমাকে এককভাবে দায়ী করে আমাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতনের জন্য উস্কানি ও হুমকি দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার যে নজির তারা সৃষ্টি করেছেন, তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে কলংকজনক, নিন্দনীয় ও প্রতিহিংসামূলক অধ্যায় হিসেবে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমি জানি, এই বক্তব্য গণতন্ত্রমনা সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না, এটা পরিষ্কার। গত দুদিন ধরে টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এদেরই কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, মিথ্যাচার ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে, তাতে নাগরিক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন এবং আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করি।
সাংবাদিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ টেলিভিশন টকশোতে আমি কী বলেছিলাম, তা পর্যালোচনা না করে যে অসহনশীল বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন নাগরিকের শুধুমাত্র টেলিভিশনের একটি টকশোতে একটি বিশ্লেষণমূলক বক্তব্যকেই বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সব হামলার কারণ বলে দায়ী করা সাংবাদিক নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে সত্য উদ্ঘাটন করা, কিন্তু তারা নিজেরাই মিথ্যাচার করছেন। গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন, সাধারণত তারা সংবাদ বা গণমাধ্যম কর্মী বলে পরিচিত। কিন্তু সাংবাদিকতা একটা পেশা। যেমন- ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি। প্রত্যেকটি পেশারই নিজস্ব কিছু বিধিবিধান আছে, কিছু পেশাগত নৈতিকতা বা মানদণ্ড আছে, যাতে পেশার ভাবমূর্তি বা পেশাদারিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। সাংবাদিকদেরও আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাই তাদের পেশাদারিত্বের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কিছু লিখিত বা অলিখিত মানদণ্ড অনুসরণ করে। কেউ তা মানছেন কিনা, তার দ্বারা তিনি সেই পেশার আদৌ অন্তর্ভুক্ত কিনা বোঝা যায়। সরকারপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়ন আমাকে গণমাধ্যমের শত্র“ ঘোষণা করেছে। মিথ্যাচার ও অন্যের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটিয়ে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য তৎপর থাকে, নিজেদের তারা গণমাধ্যমের কর্মী দাবি করতে পারে না। এরাই বরং গণমাধ্যমের শত্র“।
যে মন্তব্য নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আমার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলেছে সেই মন্তব্য সম্পর্কে সেই একই দিনে একই রাতে একই অনুষ্ঠানে আমি এটাও বলেছি যে, ‘আমি স্বভাবতই কখনোই চাইব না কেউ পটকা, নিন্দা বা ঢিলও যেন গণমাধ্যমের ওপর ছুড়ুক। এটা কথার কথা, rhetoric। আলোচনা করার জন্য, যাতে আমরা বুদ্ধিজীবীরা, গণমাধ্যমের কর্মীরা বুঝতে পারি যে, এই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া একমাত্র দায়ী নন। আমরা, আমাদের ভূমিকার কারণে আজকে এই পরিস্থিতি আমরা তৈরি করেছি।’ একাত্তর টিভি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার মন্তব্যের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছে।
এমনকি একাত্তর টিভি আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করেছি, সেটাও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। ডক্টর সলিমুল্লাহ খান এই কথাগুলো বলেছেন। টিভিতে তার মুখভঙ্গির মধ্যে আমাকে রাষ্ট্রের নিপীড়িনমূলক যন্ত্রের দ্বারা শাস্তি দেয়ার জিঘাংসা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। তার চোখে-মুখে যে হিংস্রতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা ফুটে উঠেছে তাতে আমি অবাক না হয়ে পারিনি। যাক, আমাদের দেশে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীর জন্ম হয়েছে, যারা প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দিতে ইচ্ছুক। সত্যিই আমরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। ইতিমধ্যে আমার নামে থানায় দুটি জিডি হয়েছে। ডক্টর সলিমুল্লাহ খান অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল।
যেখানে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, মতভিন্নতা থাকলেও পরস্পরকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, সেখানে তিনি আমাকে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের হাতে নির্যাতনের জন্য তুলে দিতে চাইছেন। এ ধরনের মহৎ কাজ করেছেন বলে আমি তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। প্রকাশ্যে তিনি টেলিভিশন টকশোর বরাতে রাজসাক্ষী হয়েছেন। আমি তার এই উন্নতিতে অভিভূত।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ডক্টর খান আমাকে হত্যাই যদি করতে চান, করতেই পারেন। তবে যার বক্তব্য তিনি পছন্দ করেন না, তার চিন্তার বিরুদ্ধে লড়ার কাজকে এতকাল তিনি গালিগালাজ বলেই বুঝেছেন। এখন আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আমাকে হত্যা করতে চান। এটাই তার বুদ্ধিজীবিতা। এটাই আমরা শেষমেশ জানলাম। তাকে যখন চিনতাম তখন তার মধ্যে এই ধরনের জিঘাংসা কাজ করে সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। নিজের এই অক্ষমতার জন্য আত্মসমালোচনা করা ছাড়া আমার আর উপায় কী!
ডক্টর খানের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমার কিছুই বলার নাই। তিনি প্রায়ই আমাকে গালিগালাজ করেন। যার সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ তর্ক-বিতর্কের কোনোই সম্পর্ক নাই। তার গালিগালাজের কোনো উত্তর দেয়া আমি সমীচীন মনে করি না। ইতিমধ্যেই একাত্তর টিভির কল্যাণে ও তার মতো ব্যক্তিদের উস্কানির কারণে নানান স্তরের সন্ত্রাসীরা আমার ক্ষতি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, বিষয়টি থানা, পুলিশ, আইন ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল অবধি নিয়ে গিয়েছে। এ কথাগুলোও বলতে চাইনি। না চাইলেও এখন উপেক্ষা করতে পারছি না।
গণমাধ্যমের সমালোচনা করলে সেটা কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় সেই পাণ্ডিত্য বোঝার ক্ষমতা আমার নাই; এটা সত্য, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, সেটা আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলছি। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কেউ নির্বাচিত হয়ে এলেও সেটা গণতন্ত্র নয়, বরং সেটা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। এই বক্তব্য আজ নয়, নব্বই দশক থেকেই আমি বলে আসছি। বাংলাদেশের সংবিধানের সমালোচনা যখন আমি শুরু করি, তখন কেউই এই গোড়ার গলদ নিয়ে কিছু বলেনি। বাহাত্তরের সংবিধান প্রায় সবার কাছেই ছিল পূতপবিত্র জিনিস। কিভাবে সংবিধান ধর্মগ্রন্থের স্তরে উন্নীত হয় সে এক আজব কাহিনী। নৃতত্ত্ববিদদের দারুণ খোরাক। কিভাবে সেকুলার ধর্মপ্রাণতা ফ্যাসিবাদকে ভিত্তি দেয় তার নানান নজির আমরা বেয়াল্লিশ বছর ধরেই দেখছি।
কিন্তু সেই প্রসঙ্গ এখন থাক। আমরা এখন পঞ্চদশ সংশোধনী সংবলিত সংবিধানের কালপর্বে রয়েছি। মজা হচ্ছে, এই সংবিধানের ভিত্তিতে যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে, সেই রাষ্ট্রের আমি দ্রোহী নই। বরং গণমাধ্যমের সমালোচনার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী। সত্যি চমৎকার। যিনি এই দাবি করছেন, তিনি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাকেই আসলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষার জন্য তারা মরিয়া। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তার যে দুর্দশা ঘটেছে, তার কারণে রাষ্ট্রের এই মহৎ রূপান্তরের পক্ষে তারা প্রকাশ্যে দাঁড়াতে পারছেন না। ক্ষমতাসীন শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা উভয় রক্ষা করা এখন নীতিনৈতিকতার দিক থেকে কঠিন হয়ে পড়েছে। অতএব বলতে হচ্ছে, আমি গণমাধ্যমে বোমা মারতে বলেছি, আমি রাষ্ট্রদ্রোহী। অথচ আমি পরিষ্কার করে কী বলেছি, তা উপরে উদ্ধৃত করেছি। আমি কথার ছলে রেটরিক হিসেবে যা বলেছি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছি।
আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি যে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই নতুনভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ বা কন্সটিটিউট করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাষ্ট্রদর্শনের জায়গা থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিচার করে এ সিদ্ধান্তে আমি অনেক আগেই এসেছি। এছাড়া অন্য কোনো পথ নাই। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রগঠন সভার (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) প্রয়োজন অবশ্যই হবে। আমার এই রাজনৈতিক অবস্থান আমি কখনোই লুকাইনি। এই গোড়ার জায়গা বাদ দিয়ে যারা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে, তারা বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করতে চায়, সে কথাও আমার চেয়ে শক্তভাবে কেউ বলেছে বলে আমার জানা নাই। বিদ্যমান রাষ্ট্রকে বহাল রেখে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার মামলা এটা নয়। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এটা, কোনোভাবেই এক-এগারোর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার প্রয়োগ নয়। এখনকার লড়াই হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই। এ লড়াইয়ে মতাদর্শিক বিভাজন হচ্ছে কারা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে আর কারা তার রূপান্তর কামনা করে। জনগণের মধ্যে নানান মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, বিরোধ ও বিভাজনের সুরাহা করে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের গণতান্ত্রিক কর্তব্য বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া। আমি এই রাজনীতিকেই সঠিক মনে করি। এটাই আমার রাজনীতি। যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা শুধু নয়, সেই রাষ্ট্রের ফাঁসির কাষ্ঠে প্রতিপক্ষকে ঝোলাতে মরিয়া হয়ে যায়, তাদের সঙ্গে এই রাজনীতির পার্থক্য দুস্তর। নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠন নিয়ে অবশ্যই তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। সেখানে কিভাবে ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়া যায় তা নিয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে, নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের জন্য লড়েছি, কোনো বিদেশী প্রভুর নির্দেশ বা কোনো একটি দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নয়। যে কেউই ইচ্ছা করলে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে দেখতে পারেন। এই তিন নীতির ভিত্তিতেই যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এই তিন নীতি কায়েমের জন্য অকাতরে শহীদ হয়েছেন। বেয়াল্লিশ বছর এদেশের জনগণকে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের জনগণকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির অধীনতা ও বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার রাজনীতির চর্চা হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি, কারও পরাধীনতা মেনে নেয়ার জন্য নয়। বেয়াল্লিশ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
খেয়াল করতে হবে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি, একই সঙ্গে ইসলামের নৈতিক ও দার্শনিক আদর্শের সঙ্গেও তা গভীরভাবে যুক্ত। এই তিন নীতির ভিত্তিতেই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। গুরুতপূর্ণ দিক হল, একই সঙ্গে এর ঐতিহাসিক ও আইনি ভিত্তি আছে। ঐতিহাসিক কারণ এই তিন নীতি কায়েমের জন্য আমরা লড়েছি। এর আইনি ভিত্তি আছে, কারণ স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলেই তা ঘোষিত ও সন্নিবেশিত। ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের যে সংঘাত, যার কারণে আমরা বিভক্ত ও জর্জরিত এবং এখন পরস্পরকে ধ্বংস করতে উদ্যত- তা রাজনৈতিকভাবে নিরসনের এটাই সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর পথ। এর ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এর ন্যায্যতা ইতিহাসে, বাংলাদেশের প্রতিটি বড় কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষায় এবং প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষের রূহানি সত্তায়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আমার রাজনীতি। কাউকে গ্রেফতার ও ফাঁসিতে ঝোলানো নয়, এমনকি কটু কথা বলাও নয়।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি অংশের বিবৃতি দেখে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত, বিমূঢ় ও হতবাক। সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ খুবই দুঃখজনক। গণমাধ্যমের ওপর কেন এই ধরনের হামলা হয়, আমি ২৮ অক্টোবর রাতে ‘একুশের রাত’ টকশোতে তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করেছি। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ যেভাবে ব্যাখা করেছেন তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তারা নিজেরা তাদের নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করলেই বুঝবেন। তারা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার করছেন। গণমাধ্যমের ওপর দুঃখজনক হামলার যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমি করেছি, তার সঙ্গে তারা একমত না হলে ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন। একেই বলে বাক, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, একেই বলে গণতন্ত্র চর্চা। কিন্তু সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তা না করে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের দাবিই শুধু করছেন না, আমার কণ্ঠরোধ করতে চাইছেন। তারা এতই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে যে সারা দেশের সাংবাদিকদের ওপর হামলার জন্য আমাকে এককভাবে দায়ী করে আমাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতনের জন্য উস্কানি ও হুমকি দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার যে নজির তারা সৃষ্টি করেছেন, তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে কলংকজনক, নিন্দনীয় ও প্রতিহিংসামূলক অধ্যায় হিসেবে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমি জানি, এই বক্তব্য গণতন্ত্রমনা সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না, এটা পরিষ্কার। গত দুদিন ধরে টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এদেরই কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, মিথ্যাচার ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে, তাতে নাগরিক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন এবং আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করি।
সাংবাদিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ টেলিভিশন টকশোতে আমি কী বলেছিলাম, তা পর্যালোচনা না করে যে অসহনশীল বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন নাগরিকের শুধুমাত্র টেলিভিশনের একটি টকশোতে একটি বিশ্লেষণমূলক বক্তব্যকেই বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সব হামলার কারণ বলে দায়ী করা সাংবাদিক নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে সত্য উদ্ঘাটন করা, কিন্তু তারা নিজেরাই মিথ্যাচার করছেন। গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন, সাধারণত তারা সংবাদ বা গণমাধ্যম কর্মী বলে পরিচিত। কিন্তু সাংবাদিকতা একটা পেশা। যেমন- ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি। প্রত্যেকটি পেশারই নিজস্ব কিছু বিধিবিধান আছে, কিছু পেশাগত নৈতিকতা বা মানদণ্ড আছে, যাতে পেশার ভাবমূর্তি বা পেশাদারিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। সাংবাদিকদেরও আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাই তাদের পেশাদারিত্বের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কিছু লিখিত বা অলিখিত মানদণ্ড অনুসরণ করে। কেউ তা মানছেন কিনা, তার দ্বারা তিনি সেই পেশার আদৌ অন্তর্ভুক্ত কিনা বোঝা যায়। সরকারপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়ন আমাকে গণমাধ্যমের শত্র“ ঘোষণা করেছে। মিথ্যাচার ও অন্যের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটিয়ে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য তৎপর থাকে, নিজেদের তারা গণমাধ্যমের কর্মী দাবি করতে পারে না। এরাই বরং গণমাধ্যমের শত্র“।
No comments