প্রবাসী কর্মীদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
সম্প্রতি
এক খবরে জানা যায়, প্রবাসী আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
এক্ষেত্রে ভারত ও চীন যথাক্রমে ৭১ ও ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করে প্রথম ও দ্বিতীয়
স্থান ধরে রেখেছে। তার পরেই রয়েছে ২৬, ২২, ২১, ও ২০ বিলিয়ন ডলার উপার্জন
করা যথাক্রমে ফিলিপাইন, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও মিসর। ২০১১-১২ সালে আমাদের
রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার আর এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে
প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে। রাজনৈতিক সংঘাতে পিষ্ট হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে
বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায় যে
ম্যাজিকের কথা বলা হয়েছে, তার একটি হল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তবে
এই প্রবাসী কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা যে তাদের দারুণভাবে
সহায়তা করি, তা নয়। পরিসংখ্যান বলে, একজন স্বল্প দক্ষ কর্মীকে মধ্যপ্রাচ্যে
কাজের জন্য যেতে ব্যয় করতে হয় দুই থেকে চার হাজার ডলার, যা আমাদের
মাথাপিছু জিডিপির আড়াই থেকে পাঁচগুণ এবং যা তার প্রবাসের ১৪ মাসের আয়ের
সমান। পক্ষান্তরে ইন্দোনেশিয়ার অনুরূপ কর্মীর ক্ষেত্রে অভিবাসন ব্যয় হয় তার
প্রবাসের ৫ মাসের আয়ের সমান এবং একজন নেপালির ক্ষেত্রে তা ছয় মাসের আয়। এই
পরিসংখ্যানই বলছে- জীবনের সুখ, পরিবারের সান্নিধ্য ত্যাগ করে নিশ্চিত
নিগ্রহ ও বিড়ম্বনার জীবন বেছে নিয়ে মহাপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে
দেশের অর্থনীতিকে যারা সচল রেখেছেন, তাদের দেখভালের জন্য আমাদের কার্যকর
কোনো উদ্যোগ নেই। প্রয়োজনে অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে তারা দেশে কষ্টলব্ধ টাকা
পাঠায়। অন্যদিকে হতদরিদ্র জনগণের অর্থে যারা বিনাবেতনে দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করে উন্নত দেশগুলোকে সেবা দিয়ে নিজেদের জীবনকে
ধন্য করে, তারা বাংলাদেশকে স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সব
সম্পত্তি বিক্রি করে দেশকে দরিদ্রতর করে বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশের সব
সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ নিয়ে যেসব মানুষের শিক্ষার আলোতে আলোকিত
হওয়ার কথা, তারা দেশের ঋণ পরিশোধ করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। অথচ দেশ
যাদের মানুষের মতো মানুষ হয়ে শ্রেয়তর জীবনের জন্য প্রস্তুত করার সুযোগ
সৃষ্টি করেনি, তারাই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন অনাহারে-অর্ধাহারে
থেকে বিদেশে নিগৃহীত হয়ে। আমার মনে হয়, সরকার এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে
চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারে- শিক্ষিত মানুষেরা আমেরিকা, কানাডা,
অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে কী অবদান রাখে আর অশিক্ষিত
মানুষেরা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা অন্যান্য দেশে গিয়ে কী অবদান রাখে। রাজউক যখন
তার প্লট কিংবা ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়, সেখানেও প্রবাসীদের জন্য একটি সুযোগ
তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে একটু দেখা দরকার, যে প্রবাসী আবেদন করেছে, এর আগে সে
কী পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। নাকি এই প্রথম সে বাংলাদেশকে একটি
ব্যবসাক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। নিশ্চয়ই সরকারের জন্য এই
পরিসংখ্যান/উপাত্ত সংগ্রহ করা খুব কষ্টসাধ্য হবে না। মোটের ওপর অন্যান্য
দেশের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করলে এই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, অদক্ষ
মানুষের জীবন শ্রেয়তর করার জন্য আমাদের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। তাদের জন্য অন্তত
কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১. যেহেতু তারা আমাদের অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, সরকারি (দূতাবাসসহ), স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন ও অন্যান্য সুবিধার অংশবিশেষ তাদের পাঠানো অর্থেই হয়ে থাকে, তাই বিদেশে তাদের যত রকম সহায়তা দেয়া প্রয়োজন, তা দিয়ে যেন আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গর্ববোধ করতে পারে। বিদেশ বিভুঁইয়ে দূতাবাস যেন তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়িত্ব পালন করে। আমাদের দূতাবাসগুলো এই প্রবাসী কর্মীদের কতটা কার্যকরভাবে সহায়তা করছে, তার একটি হিসাব রেখে দূতাবাস কর্মীদের এ কাজে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
২. অনেক ক্ষেত্রে এসব মানুষের শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়নি। তাই পাসপোর্ট, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা সীমিত। বিমানবন্দরে গিয়ে যাতে তাদের নিগৃহীত হতে না হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন, বিমানে আরোহণের কার্ডটি আগেই পূরণ করে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া ইমিগ্রেশনের কাউন্টারেও যাতে তাদের বিড়ম্বিত না হতে হয়, এ সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। প্রতিটি প্রশ্ন, লাইন থেকে সরিয়ে দাঁড় করানো- সবই তাদের অসম্ভব অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
৩. এসব মানুষ বাংলাদেশ থেকে যখন বিদেশে যায়, তখন তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বিদায় জানানোও প্রয়োজন। কারণ তারা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যাচ্ছেন নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে। আবার তারা যখন দেশে ফিরবেন, তখনও তাদের স্বাগত জানানো উচিত এবং বিমানবন্দরে যত কম ঝামেলা হয় ততই তাদের জন্য মঙ্গল। এরকম প্রবাসী প্রত্যেক কর্মীর পাঠানো অর্থের হিসাব রেখে নিয়মিতভাবে তাদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা প্রয়োজন। আমরা যেমন সর্বোচ্চ করদাতাদের পুরস্কৃত করে থাকি। তাদের থেকে দেশের অর্থনীতিতে এদের অবদান মোটেই কম নয়।
৪. যারা প্রবাসে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অধিকতর বেতনের চাকরিতে পাঠানো সম্ভব। এ বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ যেমন বাড়বে, একইভাবে আমাদের দেশের মানুষ অধিকতর দক্ষ কাজে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করতে পারবে। মনে হয়, ভারতীয়রা প্রবাসে শ্রেয়তর কাজে নিযুক্ত হয়, বেশি উপার্জন করে এবং শ্রেয়তর জীবনযাপন করে। আমাদেরও সেই চেষ্টা করতে হবে।
১. যেহেতু তারা আমাদের অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, সরকারি (দূতাবাসসহ), স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন ও অন্যান্য সুবিধার অংশবিশেষ তাদের পাঠানো অর্থেই হয়ে থাকে, তাই বিদেশে তাদের যত রকম সহায়তা দেয়া প্রয়োজন, তা দিয়ে যেন আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গর্ববোধ করতে পারে। বিদেশ বিভুঁইয়ে দূতাবাস যেন তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়িত্ব পালন করে। আমাদের দূতাবাসগুলো এই প্রবাসী কর্মীদের কতটা কার্যকরভাবে সহায়তা করছে, তার একটি হিসাব রেখে দূতাবাস কর্মীদের এ কাজে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
২. অনেক ক্ষেত্রে এসব মানুষের শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়নি। তাই পাসপোর্ট, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা সীমিত। বিমানবন্দরে গিয়ে যাতে তাদের নিগৃহীত হতে না হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন, বিমানে আরোহণের কার্ডটি আগেই পূরণ করে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া ইমিগ্রেশনের কাউন্টারেও যাতে তাদের বিড়ম্বিত না হতে হয়, এ সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। প্রতিটি প্রশ্ন, লাইন থেকে সরিয়ে দাঁড় করানো- সবই তাদের অসম্ভব অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
৩. এসব মানুষ বাংলাদেশ থেকে যখন বিদেশে যায়, তখন তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বিদায় জানানোও প্রয়োজন। কারণ তারা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যাচ্ছেন নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে। আবার তারা যখন দেশে ফিরবেন, তখনও তাদের স্বাগত জানানো উচিত এবং বিমানবন্দরে যত কম ঝামেলা হয় ততই তাদের জন্য মঙ্গল। এরকম প্রবাসী প্রত্যেক কর্মীর পাঠানো অর্থের হিসাব রেখে নিয়মিতভাবে তাদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা প্রয়োজন। আমরা যেমন সর্বোচ্চ করদাতাদের পুরস্কৃত করে থাকি। তাদের থেকে দেশের অর্থনীতিতে এদের অবদান মোটেই কম নয়।
৪. যারা প্রবাসে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অধিকতর বেতনের চাকরিতে পাঠানো সম্ভব। এ বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ যেমন বাড়বে, একইভাবে আমাদের দেশের মানুষ অধিকতর দক্ষ কাজে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করতে পারবে। মনে হয়, ভারতীয়রা প্রবাসে শ্রেয়তর কাজে নিযুক্ত হয়, বেশি উপার্জন করে এবং শ্রেয়তর জীবনযাপন করে। আমাদেরও সেই চেষ্টা করতে হবে।
৫.
প্রবাসে যাওয়ার ব্যয় যৌক্তিক মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে, যাতে তা এক্ষেত্রে
নেপাল কিংবা ইন্দোনেশিয়ার ব্যয়ের অনুরূপ হয়। এছাড়া আমাদের প্রবাসীদের
যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সঠিক
পরিকল্পনা নিয়ে নামলে এ খাত থেকেও বিমানের একটি উল্লেখযোগ্য আয় হতে পারে।
যারা পুত্র-কন্যা, পরিবার, পিতামাতার সান্নিধ্য, মায়া-মমতা ত্যাগ করে
নিশ্চিত কষ্ট, বিড়ম্বনা, অনিশ্চয়তা ও নিগ্রহের জীবন বেছে নিয়ে আমাদের
দুর্বল অর্থনীতির এ দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদের জন্য রইল টুপিখোলা
অভিবাদন।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments