প্রধানমন্ত্রী যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন by একেএম শাহনাওয়াজ
মানতেই
হবে এবার আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির অনেকটাই বাস্তবায়ন
করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে সাফল্যের হারও কম নয়। মানবতাবিরোধী
অপরাধীদের বিচার চলছে আন্তরিকতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্যও
সম্পন্ন হয়েছে। অনেকটাই উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার। শিক্ষা ক্ষেত্রে
বিশেষ করে নিুমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সঠিক সময়ে বিন্যামূল্যে বই
শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া সরকারের একটি যুগান্তকারী সাফল্য। কৃষি
ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার তৈরি করে ঢাকা শহরের যাতায়াত
সমস্যার কিছুটা হলেও সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক
অবস্থা অনেকটা শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। এসবের পরও একে একে পাঁচটি সিটি
কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা যখন করুণভাবে হেরে
যেতে থাকেন, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতেই পারেন! তিনি
অনেক মঞ্চে উত্তর খুঁজে ফিরছেন। বলছেন, এত কাজ করার পরও মানুষ কেন আওয়ামী
লীগকে ভোট দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নের মধ্যে একটি সরলতা আছে
সন্দেহ নেই। তবে স্পষ্ট যে, এখানে চিন্তার গভীরতা নেই। অথবা কঠিন সত্যকে
জোর করে অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের ভোলার কথা
নয় ২০০১-এর নির্বাচনে তারা কেন খারাপ ফলাফল করেছিলেন। ১৯৯৬-তে ক্ষমতায় এসে
আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নমূলক কাজে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু
চূড়ান্তভাবে সব গুবলেট করে দেয় দলীয় সন্ত্রাস। দেশের কয়েকটি জেলায়
সন্ত্রাসী গডফাদারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের অপকীর্তি ক্ষুব্ধ করে
তুলেছিল সাধারণ মানুষকে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনে আসুরিক দাপট যখন মানুষের
সুখ কেড়ে নেয়, তখন সরকারের অন্যসব অর্জন ফিকে হয়ে যায়। সরকার সন্ত্রাসীদের
রাশ টানতে পারেনি। অধিকন্তু আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং বিশেষ করে মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীও কখনও কখনও প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন সন্ত্রাসী
গডফাদারদের। সাধারণ মানুষ এর ক্ষুব্ধ জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দিয়েছিল।
এ দেশের আশাবাদী মানুষের প্রত্যাশা ছিল, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা আÍসমালোচনা করবেন। একই ভুল করবেন না। চেষ্টা করবেন দলীয় সন্ত্রাস যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে পথে হাঁটেননি কেউ। রাজনীতিতে টিকে থাকতে পেশিশক্তিকেই বড় মনে করেছেন। ২০০১-এর বিএনপির শাসন দুঃশাসনে পরিণত হয়েছিল। দুর্নীতির প্রতীক হয়ে পড়েছিল হাওয়া ভবন। দলীয় সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। ছাত্রদলের তাণ্ডবে অশান্ত হয়ে পড়েছিল ক্যাম্পাস। ছাত্রদল-যুবদলের অত্যাচার, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তার জবাবও দেয়া হয়েছিল ব্যালটে। কিন্তু ক্ষমতায় বসে অতীত ভুলে যাওয়াটা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এ দেশের রাজনীতিকদের। আমাদের বিবেচনায় এমনটি হয়েছে নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার অভাবে। ফলে একমাত্র পাঁচ বছর অন্তে ভোটারের ব্যালট প্রয়োগের আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে মূর্খ ও নির্বীর্য ভাবতেই অভ্যস্ত ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা। মোটা দাগে বুঝতে হবে, মানুষের কষ্ট কী? কী চায় মানুষ? অথবা অগ্রাধিকার পাবে কোন কাজটি? যদি সাধারণ মানুষকে বলা হয়, তোমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারদলীয় ছাত্রসহ কোনো পক্ষ সন্ত্রাস করবে না; সন্ত্রাসকারীকে কঠোর হাতে দমন করা হবে; টেন্ডারবাজ-দখলদারদের দলীয় প্রশ্রয় দেয়া হবে না; আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী খুন, রাহাজানি, ছিনতাই থেকে মানুষকে রক্ষা করবে; দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে; বিনিময়ে ৩ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং মানতে হবে- মানুষ নিশ্চয়ই তা মেনে নিত। অর্থাৎ এসব অন্যায় আর নৈরাজ্য বহাল রেখে বড় বড় উন্নয়ন হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে খুব কাজে দেয় না। আর কে না জানে কষ্টদায়ক মন্দ বিষয় ভালো কর্মকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ঢেকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোট যখন সরকার গঠন করে, তখন দলটির কাছে মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দিন বদলের স্লোগানটিকে বিশ্বাস করেছিল সাধারণ মানুষ। এর বড় কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ঝাঁকুনি। রাজনীতির চোর-বাটপার আর দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে টেনে আনতে পেরেছিল এ বিশেষ সরকার। বিশাল প্রভাবশালীরা বুঝতে পেরেছিল একসময় না একসময় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়। এ কারণে আশাবাদী মানুষ বিশ্বাস করতে চেয়েছিল, নির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা এসব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আসবেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতে আওয়ামী লীগ দিন বদলের লোভ দেখিয়েছিল। এ কারণেই মানুষ ভেবে বসেছিল, সরকারের ও দলের কঠোর শাসনে এবার আমরা পরিশুদ্ধ ছাত্রলীগ পাব। ক্যাম্পাস রাজনীতি ফিরে যাবে আবার তার পরিশুদ্ধ অতীতে। এভাবে ছাত্র রাজনীতির চলমান চরিত্র বদলে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন এ সময়ের আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা। দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, দখলদারিত্ব নির্বাসিত হয়ে তা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। বদলে যাওয়া দিনের কারণে প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে খর্গহস্ত হবে সরকার। দলীয়করণের অচলায়তন এবার ভেঙে ফেলা হবে। দলীয় পরিচয়ে নয়, যোগ্যতার বিচারে গুণী সম্মান পাবেন, পদাধিকারী হবেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশবাসীর, মানুষের দেয়া আস্থার সম্মান তেমনভাবে রক্ষা করতে পারলেন না আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। গণমানুষের সরকার না হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার তৈরি করে ফেললেন তারা। দিন বদলালো না। সরকারের যাত্রা শুরু থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ বুভুক্ষু দশায় হামলে পড়ল যেন। তারা দেশব্যাপী শিক্ষাঙ্গনে এতটাই বেপরোয়া ও হার্মাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল যে একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু এর সুফল মিলল না। রাজনীতির কূট দর্শনেরই জয় হল। পুরনো দিনের মতোই ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা ছাত্রদল-যুবদলের মতো ছাত্রলীগ-যুবলীগ চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও অস্ত্রবাজ হিসেবে আবির্ভূত হল। সন্ত্রাস ছড়াতে লাগল। খুনোখুনিতে জড়িয়ে গেল। পরাস্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রলীগ এতটাই বেপরোয়া হয়েছে যে, যখন নির্বাচনের মাঠে কিছুটা ব্যাকফুটে থেকে আওয়ামী লীগ নিজেকে গোছাতে চেষ্টা করছে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার পুত্র জয় নির্বাচনী বক্তৃতায় জনমত গঠনে ব্যস্ত, তখন সব অর্জন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে সিলেটে ছাত্রলীগ সিপিবির মঞ্চে হামলা করল। সিপিবি নেতা প্রবীণ রাজনীতিক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেকে আহত হলেন। পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় আক্রমণের কারণ। মঞ্চের বক্তারা এ সময় বক্তৃতায় সরকারের সমালোচনা করছিলেন, যা সহ্য করতে পারল না আওয়ামী লীগের পেশিশক্তি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ। গণতন্ত্রী নেতারা সমালোচনাকে স্বাগত জানান। কারণ এ থেকে নিজেদের শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি করা দলগুলোয় কি গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে? ছাত্রলীগ বিরুদ্ধ মত কী করে সহ্য করবে? তার নেতা-নেত্রীরা কি সহ্য করেন? হরহামেশাই তো তারা সমালোচকদের নিন্দা করেন। টকশোতে যাওয়া বক্তারা নিন্দিত হন, মধ্যরাতের সিঁধেল চোরের অভিধা পান। কলাম লেখকরা গুণগান না করলে ক্ষুব্ধ হন সরকারপ্রধান পর্যন্ত। আর অন্যায় করে মামলায় জড়িয়ে পড়া দলীয় সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক বিবেচনার পুরনো প্রথায় মুক্তি পেতে থাকেন। এভাবে দিন বদলের বেলুন ফুটো হয়ে চুপসে যেতে থাকে। এ অবস্থা সাধারণ মানুষকে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ করছে। বিগত নির্বাচনে দেয়া ভোটের এহেন অমর্যাদায় হতাশায় ডুবে যায় জাতি।
মানুষ আশা করেছিল, দিনবদলের কাণ্ডারিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। দেশকে সম্মানিত করবেন বিশ্বের দরবারে। শেয়ারবাজার কেলেংকারির পথঘাট কেমন তা পূর্ব অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জানা। তারপর একদিনে নয়, দিনে দিনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা মানুষ সর্বস্বান্ত হতে থাকে, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রতিবিধান পাওয়া যায় না। দলীয় ক্ষমতাবানরা ফেঁসে যাবে বলে তদন্ত রিপোর্টের নির্দেশনা মুখ থুবড়ে পড়ে। পদ্মা সেতু কেলেংকারি নিয়ে কম তো হল না। সরকার যা বোঝাতে চায় বোঝাতে পারে, তবে ভোটারের যেটুকু বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ যেখানে বড়, সেখানে কোনো যুক্তি কাজে লাগে না। পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি- সরকারের এই সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয়, তবে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে মানুষের ভেতরকার ধোঁয়াশা মোচন করা সরকারেরই কর্তব্য।
ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকার পক্ষের যত নিন্দাই থাক, সাধারণ মানুষ এই নোবেল বিজয়ীকে ত্যাগ করেনি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বাঙালির অহংকার করার মতো অনেক ঘটনা ছিল। ঔপনিবেশিক যুগ এবং পাকিস্তান শাসনামলে গৌরব করার মতো অনেক বাঙালি নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা ধারাবাহিক গৌরবের পতাকা বহন করেছিলেন। এর পরই গ্রাস করল ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতার রাজনীতি। এ প্রজন্ম চারপাশ থেকে যখন গৌরব খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি তাদের নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল। ইউনূস কোন পথে নোবেল পেলেন, তার কী কী সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে তো ঈর্ষাকাতর অন্য কোনো দেশ গবেষণা করবে। আমরা আমাদের গৌরবের অংশটুকু ধারণ করতে চাই। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ লক্ষ্য করল এ নোবেল বিজয়ী কীভাবে সরকারি দল ও সরকারের রোষানলে পড়লেন। সরকারি এসব অভব্য আচরণ ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। এত কিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধøাত এ দেশের মুক্ত বিবেকের মানুষ চাইবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থানে থাকুক। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হবে, এখন এটাই আমাদের ভাবনা। কারণ আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতকিছুর পরও বক্তৃতায় যখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট না দেয়ার কারণ বুঝতে পারেন না, তখন আমরা হতাশা বোধ করি। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি বরাবর আশাবাদী। তাই বলব, আওয়ামী লীগ সবকিছু হারিয়ে ফেলেনি। তার প্রতিপক্ষরাও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। আওয়ামী লীগ এখনও যদি ভুল শুধরে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক সৎ রাজনীতির পথে হাঁটতে পারে, তবে ভোটারদের আস্থায় ফিরে আসতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ দেশের আশাবাদী মানুষের প্রত্যাশা ছিল, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা আÍসমালোচনা করবেন। একই ভুল করবেন না। চেষ্টা করবেন দলীয় সন্ত্রাস যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে পথে হাঁটেননি কেউ। রাজনীতিতে টিকে থাকতে পেশিশক্তিকেই বড় মনে করেছেন। ২০০১-এর বিএনপির শাসন দুঃশাসনে পরিণত হয়েছিল। দুর্নীতির প্রতীক হয়ে পড়েছিল হাওয়া ভবন। দলীয় সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। ছাত্রদলের তাণ্ডবে অশান্ত হয়ে পড়েছিল ক্যাম্পাস। ছাত্রদল-যুবদলের অত্যাচার, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তার জবাবও দেয়া হয়েছিল ব্যালটে। কিন্তু ক্ষমতায় বসে অতীত ভুলে যাওয়াটা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এ দেশের রাজনীতিকদের। আমাদের বিবেচনায় এমনটি হয়েছে নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার অভাবে। ফলে একমাত্র পাঁচ বছর অন্তে ভোটারের ব্যালট প্রয়োগের আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে মূর্খ ও নির্বীর্য ভাবতেই অভ্যস্ত ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা। মোটা দাগে বুঝতে হবে, মানুষের কষ্ট কী? কী চায় মানুষ? অথবা অগ্রাধিকার পাবে কোন কাজটি? যদি সাধারণ মানুষকে বলা হয়, তোমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারদলীয় ছাত্রসহ কোনো পক্ষ সন্ত্রাস করবে না; সন্ত্রাসকারীকে কঠোর হাতে দমন করা হবে; টেন্ডারবাজ-দখলদারদের দলীয় প্রশ্রয় দেয়া হবে না; আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী খুন, রাহাজানি, ছিনতাই থেকে মানুষকে রক্ষা করবে; দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে; বিনিময়ে ৩ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং মানতে হবে- মানুষ নিশ্চয়ই তা মেনে নিত। অর্থাৎ এসব অন্যায় আর নৈরাজ্য বহাল রেখে বড় বড় উন্নয়ন হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে খুব কাজে দেয় না। আর কে না জানে কষ্টদায়ক মন্দ বিষয় ভালো কর্মকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ঢেকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোট যখন সরকার গঠন করে, তখন দলটির কাছে মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দিন বদলের স্লোগানটিকে বিশ্বাস করেছিল সাধারণ মানুষ। এর বড় কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ঝাঁকুনি। রাজনীতির চোর-বাটপার আর দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে টেনে আনতে পেরেছিল এ বিশেষ সরকার। বিশাল প্রভাবশালীরা বুঝতে পেরেছিল একসময় না একসময় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়। এ কারণে আশাবাদী মানুষ বিশ্বাস করতে চেয়েছিল, নির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা এসব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আসবেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতে আওয়ামী লীগ দিন বদলের লোভ দেখিয়েছিল। এ কারণেই মানুষ ভেবে বসেছিল, সরকারের ও দলের কঠোর শাসনে এবার আমরা পরিশুদ্ধ ছাত্রলীগ পাব। ক্যাম্পাস রাজনীতি ফিরে যাবে আবার তার পরিশুদ্ধ অতীতে। এভাবে ছাত্র রাজনীতির চলমান চরিত্র বদলে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন এ সময়ের আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা। দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, দখলদারিত্ব নির্বাসিত হয়ে তা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। বদলে যাওয়া দিনের কারণে প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে খর্গহস্ত হবে সরকার। দলীয়করণের অচলায়তন এবার ভেঙে ফেলা হবে। দলীয় পরিচয়ে নয়, যোগ্যতার বিচারে গুণী সম্মান পাবেন, পদাধিকারী হবেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশবাসীর, মানুষের দেয়া আস্থার সম্মান তেমনভাবে রক্ষা করতে পারলেন না আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। গণমানুষের সরকার না হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার তৈরি করে ফেললেন তারা। দিন বদলালো না। সরকারের যাত্রা শুরু থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ বুভুক্ষু দশায় হামলে পড়ল যেন। তারা দেশব্যাপী শিক্ষাঙ্গনে এতটাই বেপরোয়া ও হার্মাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল যে একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু এর সুফল মিলল না। রাজনীতির কূট দর্শনেরই জয় হল। পুরনো দিনের মতোই ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা ছাত্রদল-যুবদলের মতো ছাত্রলীগ-যুবলীগ চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও অস্ত্রবাজ হিসেবে আবির্ভূত হল। সন্ত্রাস ছড়াতে লাগল। খুনোখুনিতে জড়িয়ে গেল। পরাস্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রলীগ এতটাই বেপরোয়া হয়েছে যে, যখন নির্বাচনের মাঠে কিছুটা ব্যাকফুটে থেকে আওয়ামী লীগ নিজেকে গোছাতে চেষ্টা করছে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার পুত্র জয় নির্বাচনী বক্তৃতায় জনমত গঠনে ব্যস্ত, তখন সব অর্জন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে সিলেটে ছাত্রলীগ সিপিবির মঞ্চে হামলা করল। সিপিবি নেতা প্রবীণ রাজনীতিক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেকে আহত হলেন। পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় আক্রমণের কারণ। মঞ্চের বক্তারা এ সময় বক্তৃতায় সরকারের সমালোচনা করছিলেন, যা সহ্য করতে পারল না আওয়ামী লীগের পেশিশক্তি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ। গণতন্ত্রী নেতারা সমালোচনাকে স্বাগত জানান। কারণ এ থেকে নিজেদের শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি করা দলগুলোয় কি গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে? ছাত্রলীগ বিরুদ্ধ মত কী করে সহ্য করবে? তার নেতা-নেত্রীরা কি সহ্য করেন? হরহামেশাই তো তারা সমালোচকদের নিন্দা করেন। টকশোতে যাওয়া বক্তারা নিন্দিত হন, মধ্যরাতের সিঁধেল চোরের অভিধা পান। কলাম লেখকরা গুণগান না করলে ক্ষুব্ধ হন সরকারপ্রধান পর্যন্ত। আর অন্যায় করে মামলায় জড়িয়ে পড়া দলীয় সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক বিবেচনার পুরনো প্রথায় মুক্তি পেতে থাকেন। এভাবে দিন বদলের বেলুন ফুটো হয়ে চুপসে যেতে থাকে। এ অবস্থা সাধারণ মানুষকে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ করছে। বিগত নির্বাচনে দেয়া ভোটের এহেন অমর্যাদায় হতাশায় ডুবে যায় জাতি।
মানুষ আশা করেছিল, দিনবদলের কাণ্ডারিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। দেশকে সম্মানিত করবেন বিশ্বের দরবারে। শেয়ারবাজার কেলেংকারির পথঘাট কেমন তা পূর্ব অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জানা। তারপর একদিনে নয়, দিনে দিনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা মানুষ সর্বস্বান্ত হতে থাকে, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রতিবিধান পাওয়া যায় না। দলীয় ক্ষমতাবানরা ফেঁসে যাবে বলে তদন্ত রিপোর্টের নির্দেশনা মুখ থুবড়ে পড়ে। পদ্মা সেতু কেলেংকারি নিয়ে কম তো হল না। সরকার যা বোঝাতে চায় বোঝাতে পারে, তবে ভোটারের যেটুকু বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ যেখানে বড়, সেখানে কোনো যুক্তি কাজে লাগে না। পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি- সরকারের এই সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয়, তবে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে মানুষের ভেতরকার ধোঁয়াশা মোচন করা সরকারেরই কর্তব্য।
ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকার পক্ষের যত নিন্দাই থাক, সাধারণ মানুষ এই নোবেল বিজয়ীকে ত্যাগ করেনি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বাঙালির অহংকার করার মতো অনেক ঘটনা ছিল। ঔপনিবেশিক যুগ এবং পাকিস্তান শাসনামলে গৌরব করার মতো অনেক বাঙালি নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা ধারাবাহিক গৌরবের পতাকা বহন করেছিলেন। এর পরই গ্রাস করল ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতার রাজনীতি। এ প্রজন্ম চারপাশ থেকে যখন গৌরব খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি তাদের নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল। ইউনূস কোন পথে নোবেল পেলেন, তার কী কী সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে তো ঈর্ষাকাতর অন্য কোনো দেশ গবেষণা করবে। আমরা আমাদের গৌরবের অংশটুকু ধারণ করতে চাই। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ লক্ষ্য করল এ নোবেল বিজয়ী কীভাবে সরকারি দল ও সরকারের রোষানলে পড়লেন। সরকারি এসব অভব্য আচরণ ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। এত কিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধøাত এ দেশের মুক্ত বিবেকের মানুষ চাইবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থানে থাকুক। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হবে, এখন এটাই আমাদের ভাবনা। কারণ আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতকিছুর পরও বক্তৃতায় যখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট না দেয়ার কারণ বুঝতে পারেন না, তখন আমরা হতাশা বোধ করি। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি বরাবর আশাবাদী। তাই বলব, আওয়ামী লীগ সবকিছু হারিয়ে ফেলেনি। তার প্রতিপক্ষরাও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। আওয়ামী লীগ এখনও যদি ভুল শুধরে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক সৎ রাজনীতির পথে হাঁটতে পারে, তবে ভোটারদের আস্থায় ফিরে আসতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments