সংবিধান ও প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা
রাজনীতিবিদ ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) দেশের সংবিধান ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রথম আলোয় যে নিবন্ধ লিখেছেন (এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা আর নয়, ১১ মে, ২০১৩), তা খুবই সময় উপযোগী ও প্রশংসনীয়। অবশ্য তিনি যে খুব নতুন কিছু বলেছেন, তা নয়। তবে তিনি খুবই সুচিন্তিতভাবে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা তথা প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাগুলো চিহ্নিত করেছেন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদটি যে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে এবং প্রধানমন্ত্রীর যে কার্যত কোনো জবাবদিহি নেই (কাগজে আছে, বাস্তবে নেই), তা-ও জনাব কাদের চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। আমাদের রাজনীতির অঙ্গন ও মিডিয়া আরেকটি সংসদ নির্বাচনের বিতর্কে বর্তমানে ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু সেই সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার একটি এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা তথা একজন প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্বকে যে ডেকে আনছি, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ, বেশির ভাগ রাজনীতিক ও মিডিয়া এ মুহূর্তের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। যাঁরা কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, তাঁরা এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী করতে চান, যাতে তাঁর নিজের পদ, সুবিধা, ব্যবসা ও প্রভাব নিশ্চিত থাকে। প্রধানমন্ত্রী পদের ব্যক্তিটি দেশের বা গণতন্ত্রের জন্য কী করছেন বা করবেন, তা দেখা দলীয় নেতাদের কাজ নয়। বেশির ভাগ দলীয় নেতা শুধু নিজের সুবিধা ও অবস্থানটুকু দেখেন। বেশির ভাগ রাজনীতিক দলের মধ্যে বা সংসদের মধ্যে এমন কোনো ভূমিকা পালন করতে চান না, যাতে তাঁর সুবিধা ও অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। বেশির ভাগ মিডিয়াও ‘বর্তমান’ নিয়ে ব্যস্ত। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বা প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। ব্যতিক্রম খুব কম। এই পটভূমিতে জি এম কাদেরের প্রবন্ধটি অনেকের কাছে অরণ্যে রোদন মনে হতে পারে। হ্যাঁ, কিছুটা অরণ্যে রোদন তো বটেই। এ রকম রোদন অনেক বছর ধরে অনেকে করেছেন। এখনো করছেন। তেমন ফল পাওয়া যায় না। কারণ, সংবিধানই দেশের বড় সমস্যা। আর সেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারেন কেবল দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুগত ও আজ্ঞাবহ বলে তাঁরা সেটি করবেন না। জি এম কাদের এই একনায়কত্বের অবসানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন, যা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র চালু করতে হলে এ ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা কে করবেন? যাঁদের ওপর সংবিধান (আবার সংবিধানই) এই দায়িত্ব দিয়েছে, তাঁরাই তো এই অপরাজনীতির প্রতিনিধি হয়ে বসে আছেন। এই জট খোলা খুব সহজ কাজ নয়।
আমার খুব কৌতূহল, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও তাঁদের পারিবারিক উত্তরসূরিরা প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকলে (সে রকম দিন কি কখনো আসবে?) তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংসদেরা সংবিধানে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ এই একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন? অনুমান করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যেকোনো নেতাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ এত একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে দিতে দুই দলই রাজি হবে না। দুই দলের পোঁ ধরা বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টরা তখন সংবিধান সংশোধনের পক্ষে নানা যুক্তি দেখাবেন। যা এখন তাঁরা বলছেন না, পাছে ‘নেত্রী’ নারাজ হন। জনাব কাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার বলছি, আমার ধারণা, দুই বড় দল ও তাদের পরিবার যত দিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে, তত দিন এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হবে না। অতএব, আরও বহুদিন ‘এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাই’ গণতন্ত্রের নামে আমাদের মেনে নিতে হবে।
আমাদের নাগরিক সমাজ যদি সংবিধানের এসব ধারা সম্পর্কে সোচ্চার হতো, আন্দোলন করত, তাহলে হয়তো বড় দুই দল সংবিধান সংশোধনে বাধ্য হতো। কিন্তু নাগরিক সমাজ সংঘবদ্ধ নয়। রাজনৈতিকভাবেও সচেতন নয়। নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ দুই দলের কৃপাপ্রার্থী। কাজেই সরকারের প্রতি মোহহীন নাগরিক সমাজ খুবই ক্ষুদ্র ও তারা সক্রিয় নয়। ফলে এই আন্দোলন কখনো দানা বাঁধেনি। এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও নানা দলের তল্পিবাহক। আবার স্বাধীন বা দলনিরপেক্ষ মিডিয়া এসব বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। অথচ মূল গোলমাল কিন্তু সংবিধানের মধ্যেই নিহিত। অতীতে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে বা গণতন্ত্রের স্বার্থে হয়নি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে পৃথিবী, দেশ, সমাজ ও বাস্তবতার ব্যাপক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সংবিধানের ব্যাপক পরিমার্জনার যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া—কেউই তেমন গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করছে না। আমরা দেশের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু অনেক সমস্যার মূলে যে সংবিধান, তা অনেক সময় লক্ষ করি না। ‘এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা’ আমাদের সমস্যা বাড়িয়েছে, কমায়নি। সংবিধানের এই দুর্বলতাগুলো নিয়ে কি আমরা সোচ্চার হব? নাকি সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দেব?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ওউন্নয়নকর্মী।
আমার খুব কৌতূহল, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও তাঁদের পারিবারিক উত্তরসূরিরা প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকলে (সে রকম দিন কি কখনো আসবে?) তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংসদেরা সংবিধানে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ এই একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন? অনুমান করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যেকোনো নেতাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ এত একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে দিতে দুই দলই রাজি হবে না। দুই দলের পোঁ ধরা বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টরা তখন সংবিধান সংশোধনের পক্ষে নানা যুক্তি দেখাবেন। যা এখন তাঁরা বলছেন না, পাছে ‘নেত্রী’ নারাজ হন। জনাব কাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার বলছি, আমার ধারণা, দুই বড় দল ও তাদের পরিবার যত দিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে, তত দিন এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হবে না। অতএব, আরও বহুদিন ‘এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাই’ গণতন্ত্রের নামে আমাদের মেনে নিতে হবে।
আমাদের নাগরিক সমাজ যদি সংবিধানের এসব ধারা সম্পর্কে সোচ্চার হতো, আন্দোলন করত, তাহলে হয়তো বড় দুই দল সংবিধান সংশোধনে বাধ্য হতো। কিন্তু নাগরিক সমাজ সংঘবদ্ধ নয়। রাজনৈতিকভাবেও সচেতন নয়। নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ দুই দলের কৃপাপ্রার্থী। কাজেই সরকারের প্রতি মোহহীন নাগরিক সমাজ খুবই ক্ষুদ্র ও তারা সক্রিয় নয়। ফলে এই আন্দোলন কখনো দানা বাঁধেনি। এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও নানা দলের তল্পিবাহক। আবার স্বাধীন বা দলনিরপেক্ষ মিডিয়া এসব বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। অথচ মূল গোলমাল কিন্তু সংবিধানের মধ্যেই নিহিত। অতীতে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে বা গণতন্ত্রের স্বার্থে হয়নি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে পৃথিবী, দেশ, সমাজ ও বাস্তবতার ব্যাপক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সংবিধানের ব্যাপক পরিমার্জনার যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া—কেউই তেমন গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করছে না। আমরা দেশের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু অনেক সমস্যার মূলে যে সংবিধান, তা অনেক সময় লক্ষ করি না। ‘এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা’ আমাদের সমস্যা বাড়িয়েছে, কমায়নি। সংবিধানের এই দুর্বলতাগুলো নিয়ে কি আমরা সোচ্চার হব? নাকি সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দেব?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ওউন্নয়নকর্মী।
No comments