বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণের পূর্ণ বিবরণঃ দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থেকে কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হোন
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সম্মানিত দেশি ও বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিগণ,
সহকর্মী নেতৃবৃন্দ, প্রিয় সাংবাদিক এবং সারাদেশ থেকে আগত
কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ভাই ও বোনেরা,
আসসালামু আলাইকুম
আজ আপনারা এখানে, এই সম্মেলন কেন্দ্রে সমবেত হয়েছেন বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে। আপনারা এসেছেন উত্তরে পঞ্চগড়, দক্ষিণে কক্সবাজার, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পূর্বে সিলেট থেকে। আপনারা এসেছেন উত্তরে ইউকে, দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিমে আমেরিকা ও পূর্বে মালয়েশিয়া থেকে।
আজ এখানে ঘটেছে সর্বস্তরের, সর্বশ্রেণীর মানুষের এক মহাসম্মিলন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আপনারা সবাই ঘটিয়েছেন এক অভূতপূর্ব বিশাল জনসমাবেশ।
মহান বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত জনগণের বিপুল সমর্থনধন্য দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।
মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা আমাদের দলের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছি। দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় এই ৩১ বছর ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আপনাদের যে সহযোগিতা ও সমর্থন আমরা পেয়েছি, সেজন্য আপনাদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আজকের এই মহতী সম্মেলনের শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অকাতরে জীবন উত্সর্গকারী দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের।
শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় নেতা মরহুম শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।
শ্রদ্ধা জানাই দেশের সব বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা বিভিন্নভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন, নানা নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হয়েছেন, তাদের সবার প্রতি।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা জীবন উত্সর্গ করেছেন, গণতন্ত্র সুরক্ষার লড়াইয়ে যারা ত্যাগ শিকার করেছেন এবং জনগণের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে আমাদের যেসব সাথী জীবন দিয়েছেন—আজ তাদের স্মৃতির প্রতিও জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।
সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা,
মাত্র ৩৫ মাস আগেও আজকের এই মহাসম্মিলন ছিল কল্পনারও অতীত।
আপনারা সবাই জানেন, প্রায় ৩৫ মাস আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে কী ঘটেছিল!
আপনারা জানেন, সেই দিনটির নাম চক্রান্তকারীরা দিয়েছে ইংরেজি ভাষায় ‘ওয়ান-ইলেভেন’।
এ নামটি তারা নকল করেছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে গেরিলা হামলার অনুকরণে—যার নাম হয়েছিল ‘নাইন-ইলেভেন’।
সেই নাইন-ইলেভেনের গেরিলা হামলা আমেরিকার হৃিপণ্ডে আঘাত করেছিল। আর ঠিক একইভাবে সেই ওয়ান-ইলেভেনের চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের হৃিপণ্ডে আঘাত করেছিল।
আপনারা জানেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেই নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে একটি মহল নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র শুরু করে। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতা নস্যাত্ করার এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল।
সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পৈশাচিক কায়দায় মানুষ খুন করা হয়। অব্যাহত অবরোধের মাধ্যমে জনগণকে জিম্মি এবং জাতীয় অর্থনীতির সীমাহীন ক্ষতিসাধন করা হয়। এভাবেই অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক শাসন জারির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশবাসীর ওপর এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো চেপে বসে জরুরি অবস্থার আবরণে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি সমর্থিত একটি অসাংবিধানিক সরকার। দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত সব রীতিনীতি উপেক্ষা করে দুই বছর ধরে চলতে থাকে সেই অবৈধ সরকারের গণতন্ত্র-বিনাশী ও জনস্বার্থবিরোধী অপশাসন।
ওই অবৈধ সরকারের গণবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের টার্গেট ছিল একদিকে দেশের সব অঞ্চলের সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এবং অন্যদিকে টার্গেট ছিল দেশের সব অঞ্চলের সর্বশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। তাদের শিকার হন রাজধানী ও মফস্বলের উঁচু-নিচু পর্যায়ের সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তাদের শিকার হন রাজধানী ও গ্রামগঞ্জের ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী।
ভেঙে ফেলা হয় যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রামগঞ্জের হাটবাজার। ভেঙে ফেলা হয় শহরের ফুটপাতে হকারদের বাজার। তাদের কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা দিয়ে তৈরি করা হয় তামাশার মার্কেট—হলিডে মার্কেট!
ভেঙে ফেলা হয় শহরের বহু বাড়িঘর। ভেঙে ফেলা হয় বহু বস্তি ও উপশহর।
সর্বনাশা ভাঙনের সেই সরকার সৃষ্টি করতে পারেনি কিছুই। বরং তারা কর্মহীন, গৃহহীন করে ফেলে লাখ লাখ মানুষকে। অসহায় হয়ে পড়ে অসংখ্য পরিবার।
অবৈধ সেই সরকার মানুষের গচ্ছিত সঞ্চয় ও পুঁজিতে হাত দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দেয়ার নামে জবরদস্তি করে তারা শত শত কোটি টাকা চাঁদা তুলেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক তথ্য অনুযায়ী জোর করে আদায় করা সেই টাকার সামান্য অংশই রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হয়েছিল।
দুর্নীত দমনের নামে দুর্নীতির এই ব্যাপক ও অবাধ চর্চা মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। এটাকে প্রতিরোধের ক্ষমতা নিরস্ত্র মানুষের ছিল না। তাদের অনেকেই জেলবন্দি হন। অনেকে পালিয়ে যান বিদেশে। আর বেশিরভাগই আতঙ্কে থাকেন নিজের দেশেই।
রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের রিমান্ডে নিয়ে চরম নির্যাতন করে ভুয়া স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তারা একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে। বস্তুত তাদের প্রশাসনিক কাজ তখন শুধু গ্রেফতার, রিমান্ড, টর্চার ও মামলা দায়েরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভীত পলিটিশিয়ান ও সন্ত্রস্ত বিজনেসম্যানদের পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়ে। তার ফলে চাল, ডাল, তেল, নুন, গুঁড়োদুধ, সব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায় বহুগুণ। ১১ জানুয়ারির হোতা মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের চক্রান্ত করার যোগ্যতা থাকলেও—দেশ চালানোর ন্যূনতম যোগ্যতা তাদের ছিল না।
সব ক্ষেত্রে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও হস্তক্ষেপ এবং ষড়যন্ত্র ও ব্যর্থতা এক ভয়ঙ্কর অবস্থা ডেকে আনে দেশের জন্য।
তারা সংবিধান ভেঙে তাদের মনের মানুষদের নিয়ে একটি অবৈধ সরকার গঠন করে। তারপর তারা তথাকথিত ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করতে এগিয়ে যায়। অর্থাত্ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে, বিভিন্ন দল ভেঙে এবং দলছুটদের নিয়ে কিংস পার্টি গঠনের অপচেষ্টা করতে থাকে। অপরদিকে কিছু অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে পলিটিশিয়ানদের চরিত্র হনন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
সেই সরকারের অতি বিপ্লবী ও অতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যোগ দেয় নির্বাচন কমিশন ও বিশেষ আদালত। অবৈধ সরকার, নির্বাচন কমিশন ও বিশেষ আদালতের এই ত্রিভুজ বা ট্রয়কা, বাংলাদেশের অতি কষ্টার্জিত এবং এর মাত্র পনের বছর আগে পুনঃঅর্জিত গণতন্ত্রকে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে।
জরুরি অবস্থার আওতায় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীসহ অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। বহুজনকে সাজানো মামলায় প্রহসনের বিচারে ২ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আমি দেশ ও দলের কথা বললাম। এবার পরিবার ও ব্যক্তির কথা বিনীতভাবে বলতে চাই।
ওই সময়ে বিএনপির সংগ্রামী নেতাকর্মীদের, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের অহেতুক গ্রেফতার করে তাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়। রিমান্ডের নামে নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভয়-হুমকি দেখানো হয় তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের।
আমার পরিবারও হয় তাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার। আমার দুই ছেলেকেই গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর আমার বড় ছেলে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে পঙ্গু করে ফেলা হয়। বানোয়াট মামলা রুজু করা হয় বিএনপি নেতাকমীূ এবং আমার দুই ছেলে ও আমার বিরুদ্ধে।
আমিই যে তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিলাম সেটা আপনারা জানেন। দেশকে বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের অংশ হিসেবে তারা মাইনাস টু ফর্মুলা প্রচার করেছিল। আসলে সেটা ছিল মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা—শুধু আমাকে মাইনাস করার ফর্মুলা। তারা জানত আমাদের প্রিয় দল বিএনপিকে খণ্ড-বিখণ্ড ও দুর্বল করার প্রক্রিয়া কখনোই সফল হবে না, যদি আমি অটল থাকি। সে কারণেই তারা আমার ছেলেদের জিম্মি করে আমাকে জোর করে কয়েকবার বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু আমি তাদের পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিই, এদেশ আমার। এদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। আমার প্রিয় দেশ ও আমার দেশের অসহায় ও অধিকারবিহীন জনগণকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। মরতে হলে এদেশের পবিত্র মাটিতেই মরব।
আমার এই দৃঢ়তা শুধু আমাকে বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ করে দেয়নি, অন্য একটি দলের নেত্রীকেও দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছিল।
এখানে আমি সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৭ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি নিজের বাড়িতে অন্তরীণ ছিলাম। তারপর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি সাবজেলে বন্দি ছিলাম।
পক্ষান্তরে, অন্য একটি দলের নেত্রী জরুরি অবস্থা জারির পর বিদেশে চলে যান। যাওয়ার সময় তিনি ঢাকা এয়ারপোর্টে বলে গিয়েছিলেন, দেশে ফিরে এসে চক্রান্তকারীদের সব কাজের বৈধতা তিনি দিয়ে দেবেন। তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন, কিন্তু তিনিও জেলবন্দি হন। পরে তাকে আবার বিদেশ চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
একটানা দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি জেলে থাকি। আমার আপসহীনতাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। আমি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্ত হই। আর তিনি ফিরে আসেন ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন কেটেছে আমার একটানা নির্জন কারাবাস? সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় এখন নয়। তবে এটুকুই বলতে পারি, জেলে আমাকে শুধু একনজর দেখার জন্য আমার বৃদ্ধা মা দিনাজপুর থেকে কষ্ট করে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু তাকে আমার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি বেঁচে আছি কিনা, বেঁচে থাকলেও কেমন আছি, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা ও শোকে মৃত্যুবরণ করেন আমার মা। মাকে দেখার শেষ সুযোগও আমাকে দেয়া হয়নি। আমাকে দেখতে হয়েছে তার লাশ।
শুধু মাকে নয়, কোনো নিকট আত্মীয়-স্বজনকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি আমার মায়ের লাশ দেখার দিন আমার কারারুদ্ধ অসুস্থ ছেলেদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। আমার সঙ্গে যাতে তাদের দেখা না হয় সেজন্য আমার দুই অসুস্থ ছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল।
এমন নির্মম আচরণ করা হয়েছিল শুধু আমাকে দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। এটাই ছিল আমার অপরাধ। আর সেই অপরাধের জন্যই মিথ্যা অভিযোগে দুই পুত্রসহ আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল দীর্ঘ জেল-জীবন।
আমি জানি, আমার মতো দুঃখের অভিজ্ঞতা হয়েছে দলমত নির্বিশেষে বহু মা ও বোনের।
দেশের সেই দারুণ দুঃসময় মানুষকে সুদূর অতীতের বর্গীদের হামলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। মনে করিয়ে দিয়েছিল নিকট অতীতে একাত্তরে হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলার কথা।
আপনারা জানেন, একাত্তরেও আমাকে একসময় খুবই অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আমার স্বামী যখন মুক্তিযুদ্ধে চলে যান তখন আমি জানতাম না, তিনি আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা। তখন আমার দুই মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে গভীর উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠার মধ্য দিয়ে রাতের পর রাত আমাকে কাটাতে হয়েছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে হাজার শুকরিয়া, আমার স্বামী ফিরে আসেন বিজয়ী বীররূপে। কিন্তু আপনারা জানেন এর প্রায় ১০ বছর পর ১৯৮১-তে আমার স্বামী শহীদ হন চট্টগ্রামে। তখন থেকেই আবার শুরু হয় আমার অনিশ্চিত জীবন।
ভেবেছিলাম দুই ছেলেকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, আপনাদের কারণে। বিএনপির কারণে। বিএনপির নেতাকর্মীরাই আমাকে দলে টেনে নিয়ে আসেন।
১৯৮২ সাল থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করি। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি দলের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নিই। সেই দায়িত্ব আজও বহন করে চলেছি। মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একই পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। এর জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে আমি এখন খুবই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। নির্জন কারাবাস থেকে সোয়া এক বছর আগে আদালতের রায়ে মুক্ত হলেও আমি এখনও আরেক ধরনের নির্জনতার দণ্ড ভোগ করছি। গুরুতর অসুস্থ আমার দুই পুত্র এখন চিকিত্সার জন্য বিদেশে পড়ে আছে। আমার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও হিতৈষীদের, এমনকি আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের পর্যন্ত আমার বাসায় আসতে নানাভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে।
পবিত্র ঈদের দিনেও লোকজনকে শুভেচ্ছা জানাতে আমার বাসায় আসতে দেয়া হয় না। আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্যও চলছে বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র। অর্থাত্ এক-এগারর শাসকরা বিদায় নিলেও আমাদের হেনস্তা করার প্রক্রিয়া এখনও থামেনি।
দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর এক কঠিন দুঃসময়ে দেশ ও বিদেশে যেসব সহকর্মী অসীম সাহস ও অনড় আনুগত্য নিয়ে দলের কাজ করেছেন, দলের ঐক্য ও সংহতিকে ধরে রেখেছেন—আমি তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন এবং অজস্র ধন্যবাদ।
আমি গর্বিত যে, ওই দুঃশাসনের দুই বছরের অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার দেশবাসী মেনে নেয়নি। এদেশের সচেতন ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক এবং টিভি টকশোর বক্তারা তখন সত্য উচ্চারণ করেছিলেন নির্ভীক চিত্তে। আমি তাদেরও জানাই অভিনন্দন এবং স্বীকার করি কৃতজ্ঞতা।
আপনাদের সবার দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক চেতনা ও দলের প্রতি ভালোবাসার ফসল হচ্ছে আজকের এই মহাসম্মেলন।
আজকের বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল।
বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি রুখে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি—জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ—জিন্দাবাদ।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
জানুয়ারি ২০০৭-এ নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে যে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল বেগতিক দেখে তারাই আবার ২০০৮ সালের শেষ দিকে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
গণবিরোধী একটি অবৈধ সরকারের অধীনে এবং পক্ষপাতমূলক এক নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, এটা আমরা জানতাম। কিন্তু দেশ ও জনগণের কিছু বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম।
আপনারা জানেন, একটি প্রধান দল এবং তার সহযোগীরা জরুরি অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দৃঢ়তার কারণে নির্বাচনের আগেই সরকার দেশ থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাত্ এবারও আমরাই জনগণকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছি।
আমরা বিশ্বাস করি, কোনো অনির্বাচিত ও জনগণের কাছে জবাবদিহি ছাড়া সরকারের চেয়ে একটি নির্বাচিত সরকার ভালো। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশে অন্তত জনগণ কথা বলতে পারে, প্রতিবাদ জানাতে পারে এবং প্রয়োজনে আন্দোলন করে সরকার বদলাতে পারে। এটাও ছিল আমাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার আরেকটি কারণ।
আমাদের বিশ্বাস ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি পক্ষপাতিত্ব ছেড়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, সরকার যদি সত্যিকারের দল-নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রা
No comments