পাকিস্তান-সেনাবাহিনী চলছে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে by ইরফান হুসাইন
আমরা আর একটা নির্বাচিত সরকারকে তার মেয়াদ ফুরোনোর আগেই সরিয়ে দেওয়া হলে কী অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, সেটা বিচার করে দেখতে পারি। আদালতকে এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যেতে পারে। মিডিয়াকেও একই অবস্থায় আবিষ্কার করা যেতে পারে।
এটা একটা বিপজ্জনক উদাহরণ সৃষ্টি করবে। পিপিপিকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলা হলে পুনরায় তারা শহীদি জোশ নিয়ে জেগে উঠতে সক্ষম হবে অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্দশাগ্রস্ত একটি দেশ কীভাবে উদ্ধার পেতে পারে, ভূমিকম্প ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দেশটি কী পদক্ষেপ নিতে পারে_ পাকিস্তানে আমরা এসব চিন্তা বাদ দিয়ে এখন মনুষ্যসৃষ্ট সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছি। সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সাম্প্রতিক সংঘাতের অবস্থা দেখে তাই মনে হয়। মেমোগেট মামলায় সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দাপ্রধানের সরকারি চ্যানেলকে এড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দাখিল করার ঘটনাকে প্রধানমন্ত্রী অসাংবিধানিক বলাতে তারা নাখোশ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে সামরিক বাহিনীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভয়াবহ পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
এর অর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অসাংবিধানিকভাবে কাজ করার অভিযোগের কারণে সামরিক বাহিনী মনোক্ষুণ্নম্ন হয়েছে। এই একই প্রতিষ্ঠান দেশের বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত অন্তত চারবার হস্তক্ষেপ করেছে। এভাবে তারা বারবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করতে পারেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। আর এখন জেনারেলরা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের ব্যাপারে ক্রোধ প্রকাশ করছেন। তারা যদি সংবিধানসম্মত উপায়েই কাজ করতে চাইতেন, তাহলে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রেসিডেন্টকে মান্য করে চলা যে তাদের কর্তব্য, সেটুকু জ্ঞান রাখতেন। তাদের পূর্বাপর আচরণে তেমন পার্থক্য হয়নি।
সত্যি কথা হচ্ছে, একেবারে শুরুর দিকে জেনারেলরা প্রেসিডেন্ট জারদারির অধীনে কাজ করতে বিরক্তি বোধ করলেও তখন তারা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের সংযত রেখেছিলেন। কারণ, তখন কোনো বিকল্প মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। তখন তারা ক্ষমতা থেকে উৎখাতের প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ মিয়া নওয়াজ শরীফের পরিবর্তে সহজে প্রভাবিত করা যাবে মনে করে জারদারিকেই মেনে নিয়েছিলেন। এখন দৃশ্যত সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের সহায়তায় তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খানকে দেখা যাচ্ছে। ফলে তাদের সামনে এখন তৃতীয় অপশন রয়েছে। এ কারণেই আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ানো হয়ে থাকবে। সম্প্রতি ফরেন পলিসিতে ক্রিস্টেন ফেয়ার 'পাকিস্তানের ধীরলয়ের ক্যু' শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন, এখন শয়তানিটা স্পষ্ট। মেমোগেট আসলে আদালতের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূক্ষ্ম চাল বিশেষ। এখানে হুসেইন হাক্কানী উপলক্ষ মাত্র।
এখন এটা স্পষ্ট যে, মার্চে সিনেট নির্বাচনের আগেই সরকারের পতন ঘটানোর জন্য রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্য ও গোপনে ঘোঁট পাকিয়েছে। তবে, মার্চ পর্যন্ত পিপিপি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলে তারা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটেও বেশ কিছু আসন জিতে আইনের ব্যাপারে ভেটো ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এটা বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল ও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সবার কাছেই অগ্রহণযোগ্য। টিভি চ্যাটে যারা পক্ষে বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন তাদের অনেকেও এই মন্ত্রণাকে সমর্থন করেন বলেই মনে হয়। অব্যশ্য সেনাবাহিনী সরাসরি মাঠে নেমে পড়ে দায়িত্বটা প্রকাশ্যে নিজেদের কাঁধে নিতে চাচ্ছে না। তারা আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখেই শিকার করতে আগ্রহী। মেমোগেট ও এনআরওর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে সরকারের দিকে বন্দুক তাক করেছে।
এখন আমরা আর একটা নির্বাচিত সরকারকে তার মেয়াদ ফুরোনোর আগেই সরিয়ে দেওয়া হলে কী অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, সেটা বিচার করে দেখতে পারি। আদালতকে এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যেতে পারে। মিডিয়াকেও একই অবস্থায় আবিষ্কার করা যেতে পারে। এটা একটা বিপজ্জনক উদাহরণ সৃষ্টি করবে। পিপিপিকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলা হলে পুনরায় তারা শহীদি জোশ নিয়ে জেগে উঠতে সক্ষম হবে।
পিপিপি সরকারকে তাদের অযোগ্যতার জন্য ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত কিনা_ সেটা নির্ধারণের ভারটা জনতার ওপর আমরা ন্যস্তস্ন করি না কেন? তুরস্কে আমরা এখন বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। সেখানে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই কয়েক বছর আগেও তুরস্কে জেনারেলরা জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানের মতোই সরকারের মধ্যে সরকার হিসেবে পরিচিত ছিল।
তুরস্কে যেটা পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হলো সেখানকার নির্বাচিত সরকার ক্যু হতে পারে এমন আশঙ্কা না করে অবসরপ্রাপ্ত হোক আর কর্মরত হোক, জেনারেলদের চাকরিচ্যুত ও গ্রেফতার করতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের সুশাসনের কারণেই। অনুগ্র ইসলামী জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে) তুরস্কে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে দেশের অর্থনীতিকে বিতর্কহীনভাবে ভালো অবস্থায় নিয়ে গেছে এবং তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ওপর বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। পর পর নির্বাচনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে তারা সরকারের ভেতর সরকার থাকার আশঙ্কাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
তুরস্ক থেকে বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সিভিল সোসাইটির। বছরের পর বছর এরা উভয়েই সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ ও তাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। বেসামরিক রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা দখলের জন্য তাদের ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ নেই। ক্ষমতায় থাকাকালে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের সরকার পরিচালনায় পারফরম্যান্স উন্নত করতে হবে এবং বিরোধী দলে থাকার সময় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করতে হবে।
হস্তক্ষেপ করার জন্য আদালত ও সামরিক বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা হয়েছে। বর্তমান সরকার চার বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের কাজকর্ম দিয়ে আবেদন সৃষ্টি করতে পারলে এখন তারা অনেক বেশি সমর্থন আশা করতে পারত। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে তাদের পক্ষ খুব কম লোকই সমর্থন করে। তা সত্ত্ব্বেও আমি মনে করি, একটি নির্বাচিত সরকার ভালো কি খারাপ সে ব্যাপারে রায় দেওয়া আদালত বা জেনারেলদের কর্ম নয়। ভোটারদেরই কেবল সে অধিকার রয়েছে। ক্যু এবং সরকারের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই তাকে বিদায় করে দেওয়ার ধারাবাহিক বিষাক্ত পথপরিক্রমার ইতি টানার এটাই উপযুক্ত সময়।
মনসুর ইজাজের মতো একজন সন্দেহজনক ব্যক্তি কীভাবে সরকারকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করাতে পারল_ তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।
মেমোগেট আদৌ সঠিক কি-না_ এটা বিচার-বিবেচনা না করেই বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। তবে, আদৌ যদি আবেদন জানানো হয়ে থাকেও, তাহলে যার জন্য তা করা হয়েছে তা তো দেশে নির্বাচিত সরকার রক্ষা ও সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক সরকারের অধীন করার স্বার্থেই করা হয়েছে। আমাদের সংবিধান কি সেটাই বলে না?
ইরফান হুসাইন :'ফ্যাটাল ফল্টলাইন :পাকিস্তান, ইসলাম ও দ্য ওয়েস্ট' নামক গ্রন্থের প্রণেতা। পাকিস্তানের ডন থেকে
ভাষান্তর :সুভাষ সাহা
No comments