কুসিক নির্বাচন-জয়তু ইভিএম জয়তু ইসি by মাহফুজ মিশু

রাজিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এখন পর্যন্ত কেউই আত্মসমালোচনা করেননি। এমনকি কেন এই পরাজয় তা বিশেল্গষণের চেষ্টাও করেননি। বরং তারা অনেক বেশি ব্যস্ত দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এই ধারণা প্রমাণ করতে।


যদিও এসব করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে ফেরাতে পারবে না আওয়ামী লীগ_ এই সত্য দিবালোকের মতোই স্পষ্ট মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তির আগের দিন, আবারও একটি পরাজয়ের গল্গানি সরকারি দল আওয়ামী লীগের ঝুড়িতে। চট্টগ্রামের পর নারায়ণগঞ্জ এবং সর্বশেষ কুমিল্লা। টানা তিন সিটি নির্বাচনে ভরাডুবি সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীর। তাই অনেকেই বলছেন, জনপ্রিয়তা কমেছে আওয়ামী লীগের। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মূল্যায়ন, শূন্যের কোঠায় সরকারের জনপ্রিয়তা, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লা নির্বাচন বর্জন করেছিল দলটি। আর বিজয়ের পরমুহূর্তেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়রের সরল স্বীকারোক্তি, 'আমি ইভিএম ভালো বুঝি না, নেত্রীও না।' রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল হক সাক্কুর জবাব, 'মিথ্যা বলার পরিবেশ নেই। দেখলাম তো সম্ভব হলো।' আর এসবের ওপর ভিত্তি করে কেউ কেউ বলা শুরু করেছেন, আসলে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে জিতেছে সরকার তথা সরকারি দল আওয়ামী লীগ। তাদের ব্যাখ্যা, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে, সেহেতু রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, সেটি প্রমাণের এজেন্ডা আগে থেকেই ছিল সরকারি দলের। সঙ্গে যোগ হয়েছে, বুঝে বা না বুঝে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের বিরোধিতা। যদিও বিজয়ের পরমুহূর্তেই কুমিল্লার মেয়রকে আবারও দলে টানার প্রক্রিয়া শুরু করেছে দলটি আর সাক্কুও তাতে বেশ খুশি। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও মূল্যায়ন, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারের পর কুমিল্লায় সবক'টি কেন্দ্রে এর ব্যবহার এবং সবক'টি নির্বাচনের ফল কোনো না কোনোভাবে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে, এই পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। অবশ্য আলোচ্য এসব ব্যাখ্যার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই আমি। নির্বাচনের আগে-পরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এখানে শাসক দল আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে কয়েকটি কারণ। প্রথমত, প্রার্থী নির্বাচনে তৃণমূল কর্মীদের মতামত নেওয়া হয়নি বা নিলেও উপেক্ষা করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মাঠে নামেননি পুরোদমে। লোক দেখানো বা কেন্দ্রীয় নেতারা গেলে তারা সরব হলেও মূলত নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় ছিলেন না জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই। দ্বিতীয়ত, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ আফজল খান, তার বয়স সত্তরের ওপরে। নির্বাচনী প্রচার যখন তুঙ্গে, যখন অন্য প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন কোনোদিনই সকাল ১১টার আগে প্রচার কাজে নামেননি কিংবা নামতে পারেননি আফজল খান। কারণ শারীরিক অসুস্থতা। তিনি নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শীতে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। যে নেতা শীতে কাতর হয়ে ভোট চাওয়ার সময়ই বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না, তাকে মানুষ ভোট দেবে, এই বিশ্বাস কীভাবে হলো ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতাদের, আমার মাথায় তা ঢোকে না। আর যে ক'দিন তিনি জনসংযোগ চালিয়েছেন, কোনোদিনই তিনি গাড়ি থেকে নামেননি। বাসার সামনে তিনি গাড়িতে উঠতেন, প্রচারের সময় গাড়ি থেকেই হাত নাড়তেন, বক্তৃতা করতেন, এমনকি গাড়িতে বসেই রেডিও-টেলিভিশন-পত্রিকা তথা সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতেন। অবশ্য প্রচারের শেষ দিন অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি সাংবাদিকরা অনেক অনুরোধ করে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ইন্টারভিউ করতে পেরেছিলেন। এমন শারীরিকভাবে স্বাভাবিক হাঁটাচলায় অক্ষম একজন নেতাকে অনেকেই নিজের শহরের প্রথম অভিভাবক হিসেবে মানতে চাননি, মানেননি। বিশেষ করে, যে শহরের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি নারী ভোটার তাদের কারও কাছেই সরাসরি গিয়ে ভোট চাইতে পারেননি আফজল খান। আর নবীন ভোটারদের একটা বড় অংশই তাকে চেনেন না, বরং বিদ্রোহী প্রার্থী তানিম বা মিঠু অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল তরুণদের কাছে। কুমিল্লা শহরে সংখ্যালঘু ভোটার যারা, তারাও আফজল খানের পক্ষে ছিলেন না। কারণ তার পরিবারের অনেককে নিয়েই আতঙ্ক আছে তাদের। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব তো আছেই। জেলার পাঁচ সংসদ সদস্যের রেষারেষি তো নতুন কিছু নয়। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, আফজল খানকে সমর্থন না দিয়ে অন্য কাউকে প্রার্থী করলেই কি সিটি নির্বাচন জিততে পারত আওয়ামী লীগ? ভোটের পরিসংখ্যান অবশ্য বলে_ না, পারত না। কারণ ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে বিজয়ী হয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু। দলের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী এবং মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি নেতা এয়ার আহমেদ সেলিমের ভোট যোগ করলেও ব্যবধান থাকে প্রায় ২০ হাজারের মতো। তাহলে কি আওয়ামী লীগের এই ভরাডুবির জন্য জনগণের সরকারবিরোধী মনোভাব দায়ী? বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার আঘাতে মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে প্রতিদিনই। সারাদেশের জনগণের সেই মনোভাবই কি তবে প্রতিফলিত হলো পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়তো সময় লাগবে। পরাজিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এখন পর্যন্ত কেউই আত্মসমালোচনা করেননি। এমনকি কেন এই পরাজয় তা বিশেল্গষণের চেষ্টাও করেননি। বরং তারা অনেক বেশি ব্যস্ত দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এই ধারণা প্রমাণ করতে। যদিও এসব করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে ফেরাতে পারবে না আওয়ামী লীগ_ এই সত্য দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। তাহলে যা দাঁড়াল তা হলো, কুমিল্লার নির্বাচনে কোনোভাবেই, কোনো সমীকরণেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। তাহলে জিতল কে? বিএনপি? মনে হতে পারে, বিএনপিই জিতেছে। যেহেতু কেবল মেয়র নয়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এমনকি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনেও অনেক এগিয়ে বিএনপি সমর্থিত বা বিএনপি মনোভাবাপন্ন নেতারা। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অর্জন কী এই নির্বাচনে? অর্জন হলো, কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দেওয়া নেতাকে মাথায় তুলে নিয়েছে কুমিল্লা শহরের মানুষ। আর যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে নির্বাচনে কারচুপির হাতিয়ার বলে প্রমাণ করছেন বিএনপির নেতা আর পালিত বুদ্ধিজীবীরা, সেই মেশিনেই নির্বাচন হলো, সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ফল জানা গেল, কোনো কারচুপি বা অনিয়মের অভিযোগ এলো না কোনো পক্ষের কাছ থেকেই। ফলে এরপর ইভিএম পদ্ধতির বিরোধিতা করে হালে পানি পাবে না দলটি। তাহলে জিতল কে? জিতল জনগণ। জিতলেন কুমিল্লার সাধারণ ভোটাররা। তারা ভোট দিয়ে বুঝিয়েছেন, মন্দের ভালো বেছে নিতে পারেন তারা। তার জন্য দলীয় সমর্থন খুব জরুরি না। আর ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ইলেকট্রনিক মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। এ পদ্ধতি নিয়ে তাদের অভিযোগ তেমন নেই। বরং খুশি বেশিরভাগ ভোটার। কারণ ব্যালট পেপার নেই, ছিনতাইয়ের ভয় নেই, বরং মোট কতটি ভোট পড়ছে প্রতি মুহূর্তে তা সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন প্রার্থীদের এজেন্টরা। তাই কুমিল্লার নির্বাচনে জয় হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের, জয় হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের।

মাহফুজ মিশু : সাংবাদিক সধযভুঁসরংযঁ@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.