জলে-স্থলে দুর্ঘটনাঃ আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার
জলে-স্থলে যানবাহন দুর্ঘটনা এখন আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মর্মান্তিক সংবাদ। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ভয়াবহ নৌযান দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময় বেশক’টি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে সড়কপথেও। সর্বশেষ বড় ধরনের বাস দুর্ঘটনার ঘটনাটি ঘটেছে ফরিদপুরে।
দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ২১ জন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে গত ৬ ডিসেম্বর এই দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। সংঘর্ষে দুটি বাস দুমড়ে-মুচড়ে রাস্তায় পড়ে থাকলে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে। জেলা প্রশাসন দুর্ঘটনায় নিহতদের চার হাজার করে টাকা এবং আহতদের চিকিত্সার ব্যয় বহন করার কথা জানিয়েছে।
সবচেয়ে মর্মবিদারী তথ্য হচ্ছে, বেশিরভাগ সড়ক ও নৌদুর্ঘটনার সঙ্গে অধিক সংখ্যায় জীবনহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এক হিসাব অনুসারে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে দুটি নৌযান দুর্ঘটনাসহ যতগুলো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে মাত্র একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন পাঁচজন। বাকি দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা দশের অধিক। পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য এক খবর অনুসারে, গত নভেম্বরের শেষার্ধ থেকে পয়লা ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৪ জন, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। লক্ষ্য করা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো এবং ঈদের পর কর্মস্থলমুখো যাত্রীবাহী বাস তুলনামূলকভাবে বেশি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। আনুপাতিকভাবে এ সময় লঞ্চডুবি, ট্রলারডুবি এবং বাসের সংঘর্ষে বেশি জীবনহানি ঘটেছে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, সম্প্রতি যেসব জীবনঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে নতুন কোনো কারণ যোগ হয়নি। সেই পুরনো অভিযোগ—যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, কাত হয়ে বা ফুটো হয়ে লঞ্চ ডুবে যাওয়া, পরস্পর মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়া, চালকের অমনোযোগিতা, খামখেয়ালি, অদক্ষতা, বেপরোয়া গতি, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ হচ্ছে চালকের দোষে দুই যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে সড়কে অতিরিক্ত বাঁক। পূর্বাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্দিষ্ট গতিসীমা অনুযায়ী গাড়ি না চালানো এবং এসব বাঁকে উদাসীনভাবে গাড়ি ওভারটেকিং করার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে, ঘটছে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি। এছাড়া গাড়ির চালক ও সহকারীর যখন-তখন মোবাইল ফোনে কথোপকথন, বাঁক সম্পর্কে সতর্ক না থাকা, বাসস্ট্যান্ড ও সড়কে অস্থায়ী বাজার ইত্যাদিও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। প্রায়ই দেখা যায়, মহাসড়কে সতর্কীকরণ বার্তা সংবলিত বিভিন্ন সাঙ্কেতিক চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও চালকরা তা মানছেন না। বাঁকের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার গতিসীমা লঙ্ঘন করে চালানো হচ্ছে বড় যাত্রীবাহী বাস ও মালবোঝাই কাভার্ড ভ্যান। এতে বাঁকের মধ্যে গাড়ি উল্টে পড়ছে অথবা মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। এ ঘটনা বেশি ঘটে বাঁকবহুল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। সর্বোপরি দিনের পর দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে। শহরাঞ্চলে যানজটের কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা কমলেও মহাসড়কে বেড়েছে।
উল্লেখ্য, মহাসড়ক নিরাপত্তা, সংরক্ষণ ও চলাচল বিধিমালা ২০০১-এ বলা আছে, ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতি নেই এমন কোনো মোটরযান মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে না। অথচ মহাসড়কগুলোতে রিকশা, অটোরিকশা, নসিমন, ট্রাক্টর ইত্যাদি চলাচল করছে। এক্ষেত্রে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ আছে। তবে সড়ক বা জলপথের বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী চালকের অসচেতনতা ও অদক্ষতা। অনেক সময় যাত্রীরাও বাদুরঝোলা হয়ে তড়িঘড়ি গন্তব্যে যেতে চান। বিশেষত শহরে পথচারীরা রাস্তা পারাপারে কোনো শৃঙ্খলা রক্ষা করেন না। এক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে গাড়িপ্রতি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে নিহতের সংখ্যা বছরে ১৬৯ জন। এ অবস্থায় দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং বাড়াতে হবে গণসচেতনতা। রাস্তা প্রশস্ত করা ছাড়াও লেন বাড়ানো, চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, যথাসম্ভব মহাসড়কে বাঁকের সংখ্যা কমানো এবং পুলিশি নজরদারি বৃদ্ধি করা দরকার। মোট কথা, কঠোর আইন প্রয়োগ করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে।
No comments