ইতিহাসের কাঠগড়ায় জামায়াত by রাজীব আহাম্মদ

তিহাসের কাঠগড়ায় এখন জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক এ দলটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মুক্তির দাবিতে কেউ নেই দলটির পাশে। জোট শরিক, সমমনা দলগুলো নীরব। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিচার শুরু হওয়ায় মিত্র দলগুলোর অনেক নেতাই খুশি।


আবার দল হিসেবে জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও স্বাধীনতার বিরোধিতার প্রতীক হওয়ায় গোলাম আযমের মুক্তির পক্ষে নেই কোনো দল বা সংগঠন।আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা অভিযোগ অনুযায়ী, গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বেই স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল জামায়াতে
ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলিল (ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান) অনুযায়ী রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠনেও রয়েছে গোলাম আযমের ভূমিকা। একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার জন্য গোলাম আযমকেই দায়ী করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে। এসব কলঙ্কিত ভূমিকার কারণে জামায়াতের মিত্র কোনো দলের পক্ষেই গোলাম আযমের মুক্তি দাবি সম্ভব নয়। খেলাফত মজলিশের এক নেতা সমকালকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, দেশের মানুষ গোলাম আযমকে বিচার করার পক্ষে। কেউ তার মুক্তি দাবি করলে জনগণ তাকে ভালোভাবে নেবে না। তাই কারও পক্ষে এ ইস্যুতে জামায়াতের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
১২ বছর আগে রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেও জামায়াত এখন পর্যন্ত গোলাম আযমকেন্দ্রিক দল। জামায়াত নেতারাও প্রকাশ্যে গোলাম আযমকে দলীয় অভিভাবক হিসেবে পরিচয় দেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সাল, এ দীর্ঘ ১৩ বছর জামায়াতের কোনো পদে না থাকলেও দলের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল গোলাম আযমের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার অভিযোগে '৭২ সালে নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। '৭৬ সালে রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পেলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে সংগঠিত হয়। দলটির প্রধান ছিলেন মাওলানা আবদুর রহিম। ওই সময় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমিরও ছিলেন তিনি। '৭৮ সালে দেশে ফিরে '৭৯ সালের মে মাসে জামায়াত পুনর্গঠন করেন গোলাম আযম। তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকায় মাওলানা আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়। তবে অঘোষিত আমির ছিলেন গোলাম আযম। তখনকার মতো এখনও গোলাম আযমই জামায়াতের সর্বেসর্বা।
জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ তিন শীর্ষ নেতা ২৯ জুন আটক হওয়ার পরপরই তাদের মুক্তি দাবি করে বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপিসহ চার দলের সমমনা দলগুলো। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর চার দলের সমাবেশ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। এরপর প্রতিটি জনসভা থেকে তিনি একই দাবি জানান। ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর পর এ প্রসঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি দলটি। রাজনীতিতে মিত্র হলেও বিএনপি গোলাম আযমের মুক্তির দাবিতে জামায়াতের পাশে নেই।
জামায়াতের আরেক জোট শরিক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। দলটি জোট শরিক হলেও জামায়াতবিরোধী। দলটি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীবিরোধী ইসলামী ঐক্যজোট নেতাদের অনেকেই গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোয় খুশি। তবে এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি ফয়জুল্লাহ। তিনি সমকালকে জানান, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে বক্তব্য জানানো হবে।
নেজামে ইসলামী ও খেলাফত মজলিশ_ এ দুটি দল জামায়াতপন্থি হিসেবেই পরিচিত। খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক স্বাধীনতার সময় 'দালাল' মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তিনিও গোলাম আযম প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার হোক_ এটাই আমাদের চাওয়া। নেজামী ইসলামীর মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীও একই বক্তব্য দেন। তিনি জামায়াতের অন্য নেতাদের মুক্তি দাবি করলেও গোলাম আযম প্রসঙ্গে বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আমাদের বক্তব্য জানাব।
জামায়াতপন্থি সংগঠনগুলোও গোলাম আযম ইস্যুতে নিশ্চুপ রয়েছে। জামায়াতের নেতাদের তৈরি নাগরিক ফোরাম, সুশীল ফোরাম, জাগ্রত জনতা ফোরাম, দেশপ্রেমিক ফোরাম, স্বাধীনতা ফোরাম, দেশপ্রেমিক যুব শক্তি, ফোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ, কৃষিবিদ ফোরাম, চিকিৎসক ফোরাম, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ নামের সংগঠনগুলো আলোচনা সভা ও সেমিনারের নামে সারাবছর জামায়াতের পক্ষে সরব থাকলেও গোলাম আযম ইস্যুতে এখনও মুখ খোলেনি। এসব সংগঠনের এক নেতা সমকালকে বলেন, নিজামীর মুক্তির দাবি জানানো আর গোলাম আযমের মুক্তির দাবি জানানো এক নয়। কোনো পাবলিক ফোরামে গোলাম আযমের মুক্তির দাবি জানালে কেউই তা ভালোভাবে গ্রহণ করবে না।
জামায়াতপন্থি আলেমদের সংগঠন সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ সব ইস্যুতে পাশে দাঁড়ালেও গোলাম আযম ইস্যুতে জামায়াতের পাশে নেই। সংগঠনটির এক যুগ্ম মহাসচিব সমকালকে বলেন, গোলাম আযমের মুক্তির দাবি জানালে সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। তিনি দাবি করেন, সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও বাস্তব কারণেই গোলাম আযমের মুক্তির দাবি জানানো সম্ভব নয়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।

No comments

Powered by Blogger.