চিকিৎসা সমাজসেবা কার্যক্রমের বেহালদশাঃ গরিব রোগীরা দাঁড়াবে কোথায়?



দেশের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে অভিযোগের বহর কেবলই বাড়ছে। কোনোটি অতিশয় রুগ্ন, কোনোটি অর্ধমৃত। কোনোটি হোঁচট খেতে খেতে চলত্শক্তি হারিয়ে ফেলছে। কোনোটি আবার পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। বর্তমানে এই তালিকায় যোগ হয়েছে সমাজসেবা অধিদফতরের নাম।
সংস্থাটির চিকিত্সা সেবার ওপর দীন-দরিদ্র রোগীরা আর ভরসা রাখতে পারছে না। যদিও তাদের নানাভাবে চিকিত্সা পেতে সহায়তা দেয়ার জন্যই শুরু হয়েছিল চিকিত্সা সেবার কার্যক্রম। জানা গেছে, সরকারের অবহেলা, কর্মকর্তাদের অনিয়ম এবং লোকবল সঙ্কটের ফলে জনস্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের অবস্থা চূড়ান্ত বেহাল হয়ে পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এই কার্যক্রমের আওতাধীন হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়ে কোনো রোগী সহায়তার জন্য আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক তার আবেদন যাচাই করে সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা নেন। অভিযোগ আছে, বর্তমানে এই যাচাইয়ের কাজটি স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে না। অনেক সময় তা এত বিলম্বিত হচ্ছে যে, যাচাইয়ের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আবেদনকারী রোগী মারা যাচ্ছেন কিংবা তার অসুস্থতা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এমনকি হাসপাতালের একশ্রেণীর চিকিত্সক, কর্মকর্তা, নার্স ও স্টাফকে ঘুষ দেয়া ছাড়া গরিব রোগীদের সেবা মিলছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বর্তমানে ঢাকায় ১৭টি সরকারি হাসপাতালসহ দেশের ৮৭টি হাসপাতালে এ কার্যক্রম চলছে। সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পভুক্ত এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিত্সা সহায়তা এবং দিকনির্দেশনা দেয়া ছাড়াও প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে ওষুধ, রক্ত, পথ্য, কাপড়-চোপড়, ক্র্যাচ, হুইল চেয়ার, কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেয়া হয়। প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতাল বদলের ব্যবস্থা নেয়ারও নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রোগী দরিদ্র কিনা তার যাচাই-বাছাই নিয়ে। এখানেই যত অনিয়ম-অবহেলা শিকড় গেড়ে বসেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ঢাকার ১৭টি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী সমেত নিয়োজিত লোকসংখ্যা প্রায় জনা পঞ্চাশেক। ফলে হাজার হাজার গরিব রোগী সম্পর্কে তথ্য যাচাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো হাসপাতালে আবার কর্মকর্তার পদ বলে কিছু নেই। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে লোকবল সঙ্কট আরও প্রকট। অভিযোগ আছে, জনবল বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে বার বার আবেদন জানিয়েও কোনো ফল হচ্ছে না। এ অবস্থায় দরিদ্র রোগীদের সেবার মান কোন্ তলানিতে ঠেকেছে তা অনুমান করতেও ভয় হয়।
উল্লেখ্য, চিকিত্সা কার্যক্রম পরিচালনা করতে সরকার সমাজসেবা অধিদফতরকে প্রতি অর্থবছরের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দেয়। সর্বোচ্চ বরাদ্দ দুই লাখ টাকা। এছাড়া কার্যক্রম চালাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়। তা সরকারি বরাদ্দের তুলনায় বহুগুণ বেশি। অর্থাত্ ‘চিকিত্সা সমাজসেবা কার্যক্রম’ চালাতে কোনো ধরনের অর্থ সঙ্কট নেই। সঙ্কট যত ব্যবস্থাপনায়, দায়িত্ব পালনে। সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, বর্তমানে কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি তদারকি একেবারেই নেই। ফলে প্রকৃত গরিব হলেও অসংখ্য রোগী সেবা থেকে বঞ্চিত হন। গরিব প্রমাণ করতে অযথা হয়রানির শিকার হন অনেকের অভিভাবক। এসব অনিয়ম-অবহেলার ফলে এ খাতে রোগীর সংখ্যাও কমে আসছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সাড়ে আট লাখের মতো রোগী চিকিত্সা সেবা পেয়েছে। ২০০৭-০৮ সময়কালে এ সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের অধোগতি বিস্ময়কর। তালিকায় রয়েছে মাত্র তিন লাখ ৫৩ হাজার। চলতি অর্থবছরে আরও কমবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় সমাজসেবা, গরিব রোগী সেবার বেহালদশা কতটা, তা গবেষণা করে বের করার দরকার পড়ে না। এমনিতেই দেশে গোটা স্বাস্থ্যসেবার মান নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, চিকিত্সক, নার্স, কর্মচারী নেই; নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ, যন্ত্রপাতি, অ্যাম্বুলেন্স। তার ওপর যদি সেবা সংস্থা নামের বিশেষ কার্যক্রমেও অনিয়ম-অবহেলা-দুর্নীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়, তাহলে ক্রমবর্ধমান গরিব রোগী দাঁড়াবে কোথায়? এই জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার দায় সংশ্লিষ্ট সবার। কারণ চিকিত্সা সেবা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া এ খাতে কোনো অবহেলা-অনিয়ম যে কোনো বিবেচনায় অমানবিক এবং শাস্তিযোগ্য। এ ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থাপনায় যে বিস্ময়কর খামতি রয়েছে তা দূর করে গরিবদের চিকিত্সা সেবা নিশ্চিত করা হবে—এটাই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.