ম্যানিকিনের মতো মানুষ by মাহমুদ শামসুল হক
চৌষট্টি কলার কথা বলেছেন প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত বাত্সায়ন। এখন এর সঙ্গে আর দুটো কলা যোগ করা দরকার—বিজ্ঞাপন-কলা এবং প্যাকেজ-কলা। ‘মুক্তবাজার’ নামে যে বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, তাতে এই দ্বিবিধ কলাকে বাদ রাখার আর কোনো রাহা নেই। একালের অর্থনীতিবিদরা যাই বলুন, এখন কলার সংখ্যা ছিষট্টি।
পণ্যদ্রব্য তো বটেই, জীবন্ত মানুষকে মুক্তবাজারে চড়াদামে বেচে দেয়া যায় বিজ্ঞাপন আর প্যাকেজ বা মোড়কের জোরে। অপ্রয়োজনীয় মালসামানাও উদ্দীপক বিজ্ঞাপন দিলে হুহু করে বিক্রি হয়ে যায়। সুদৃশ্য মোড়কে মাটির ঢেলা ভরে দিলেও রাতারাতি ফেঁপে ওঠে সেটির বাজার। তবে বিজ্ঞাপনের সুন্দরী মডেলকে বলতে হবে, এ মাটির ভেষজগুণ এত তীব্র যে দিনসাতেক মাখলেই জোসনার মতো ঝলসে উঠবে কালো মেয়ের ত্বক। তখন আর ঠেকায় কে! বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা শপিংমলে ছুটে যাবে ক্রলিং করে। আজকাল এ ধরনের বিচিত্র মাটি-কাদা, নষ্ট, রাবিশ ইত্যাদি বেচাকেনার হিড়িক পড়েছে। তা অনেকটা আঁচ করা যায় বাহারি সব বিজ্ঞাপনের বহর দেখে। শত শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দৈনিক ছাপা হচ্ছে কাগজে, দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আজেবাজে পণ্য আর মডেল মিলে রচিত মোহের ইন্দ্রজালে আটকে যাচ্ছে খাদকসমাজ।
আজকের শহর মানেই বাজার। শহুরে সংস্কৃতির অর্থ বাজার সংস্কৃতি। পণ্যবাজারে মানুষও পণ্য হয়ে উঠছে। বিক্রি হচ্ছে। নিজেরাই বেচছে নিজেদের। বস্তুত মুনাফার হাটে সবাই একেকজন সেল্সম্যান এবং বিজ্ঞাপনের মডেল। দরকারি-অদরকারি সামগ্রী ছাড়াও মানুষ মুনাফার লোভে বেচে দিচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, চরিত্র, নীতি, আদর্শ, বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা সবকিছু। মানুষ স্বেচ্ছায় ঢুকে যাচ্ছে বিচিত্র সব প্যাকেটে। নারীর ক্ষেত্রে একথা একটু বেশি সত্য। পুঁজিবাদী মাফিয়াদের বিবেচনায় নারী মানেই রমণী। ভোগ্যপণ্য এবং রূপচর্চার বিজ্ঞাপনে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের, তাতে বিজ্ঞাপিত পণ্যের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে নারীর পণ্যমান। ব্রা, কাঁচুলি, ব্লাউজ, ব্লেড থেকে শুরু করে খাদ্য-অখাদ্য, ড্রাগ, মদসহ তাবত বিলাসপণ্যে নারীর লাস্য এখন এক অনিবার্য বস্তু। এমনকি মেয়েদের একান্ত ব্যবহার্য প্যাডের বিজ্ঞাপনেও আর কোনো রাখঢাক থাকছে না। পণ্যের দাম চড়াতে এভাবে পুঁজিবাদী মুনাফাখোররা বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে দিচ্ছে তীব্র যৌনাবেদন। এর উদ্দেশ্যটা যিনি ব্যবহৃত হচ্ছেন তার অজানা নয়। ক্রেতাদেরও কমবেশি জানা। মনো-সমাজবিদরা আগাগোড়াই বলে আসছেন, আদিমতম কামবৃত্তির কাছে আবেদন করলে যত সহজে সাড়া পাওয়া যায়, অন্য উপায়ে তা পাওয়া যায় না। এই মহাসত্যটি সবচেয়ে ভালো জানেন পুুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ এবং বড় বড় কোম্পানির মার্কেট রিসার্চ ও মোটিভেশন রিসার্চ দফতরের মনোবিদরা। যারা মোটা মাইনের বিনিময়ে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও মডেলদের যৌনাত্মক ভূমিকার বিষয়টি দেখভাল করেন।
হাল আমলে জীবন্ত মডেলের পাশাপাশি মেশিনে বানানো ‘মডেল’রা শোভা বাড়াচ্ছে বিখ্যাত সব শপিংমলের। এগুলোকে বলা হয় ডল অথবা ম্যানিকিন। এই ম্যানিকিন মডেল তৈরির উদ্গাতা পুঁজিবাদী বাণিজ্যের বুদ্ধিমান মাফিয়ারা। দুনিয়ার যে কোনো অভিজাত শপিংমলে এখন সেজে থাকে নানা বয়সের আদলে তৈরি নারী-পুরুষ ম্যানিকিন। এর বেশিরভাগই গড়নের দিক থেকে ‘স্লিম সুন্দরী’ এবং বিনম্র বা উত্কট যৌনাবেদনময়ী। তৈরি পোশাক, অন্তর্বাস, শাড়ি, গহনা ইত্যাদি দোকানে এদের এমনভাবে গুছিয়ে রাখা হয় যেন হাতছানি দিয়ে ক্রেতাদের টানছে এই বলে যে, এই পোশাক বা গয়না পরে আমার মতো নিপাট সুন্দরী এবং আবেদনময়ী হয়ে ওঠো। গরিব দেশের দোকানপাটেও ম্যানিকিন সজ্জার হিড়িক এখন লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, পুঁজিবাদী উন্নত বিশ্বে যন্ত্র-সচল ম্যানিকিনও পাওয়া যায়। সেগুলো হাত-পা নেড়ে এমনকি কথা বলে ক্রেতাদের ফুসলায়।
গবেষকদের মতে, বিদেশি খেলার পুতুল পর্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে শিশুমনে। তাহলে যৌনাবেদন তথা ঠারযুক্ত প্রমাণসাইজ ম্যানিকিন যে বিশেষ করে উঠতি বয়সীদের মধ্যে নেগেটিভ ভাইস তৈরি করবে তাতে আর সন্দেহ কী! তারা আরও বলেন, ম্যানিকিনের সার্বিক গড়ন দেখে সাধারণ ক্রেতার মধ্যে ফ্যাশনের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা তৈরি হয়। সেই চাহিদা পূরণ করতে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অতি মুনাফাখোরদের দিতে হয় চড়া দাম। বিজ্ঞাপন এবং ম্যানিকিনের প্ররোচনা এতই প্রবল!
লক্ষণীয় যে, এজাতীয় সব পুঁজিবাদী প্ররোচনা মিলেমিশে আমাদের মতো গরিব দেশের পোশাক সংস্কৃতিতেও প্রখর হয়ে উঠছে যৌন আঙ্গিক চেতনা। অর্থাত্ মানুষ পরিণত হচ্ছে সামগ্রীতে, পোশাকপত্র তার মোড়ক। ধনতান্ত্রিক সমাজে ঢাকঢোল পিটিয়েই যা শুরু হয়ে গেছে সেই কবে। পণ্ডিতদের অনেকের মতে, বর্তমানে পুঁজিবাদের মহাবট আমেরিকার মহিলারা প্রায় সবাই হয়ে উঠেছে একেকটি জীবন্ত-জ্বলন্ত ম্যানিকিন। আমেরিকার মেয়েদের পোশাক প্রসঙ্গে গত শতকের ষাটের দশকে চিন্তাবিদ ম্যাকলুহান মন্তব্য করেছিলেন, ‘The American woman for the fist time presents herself as to be touched and handled, not just to be looked at’-এর বাংলান্তর করেছেন সমাজবিদ বিনয় ঘোষ—‘পোশাক পরে সেজেগুজে আজ আর মহিলারা শুধু বলতে চান না ‘আমাকে দ্যাখো’, তারা বলতে চান ‘আমাকে স্পর্শ করো’, ‘নেড়েচেড়ে দ্যাখো’। তারা সেখানে যাই বলুক, অন্যদের কিন্তু নড়েচড়ে বসতে হবে। সমাজবিদ তো বটেই, সবার কড়া নজর রাখতে হবে পুঁজিবাদী বাজার ও মুনাফা-সংস্কৃতির প্ররোচনায় যেন ম্যানিকিনসদৃশ মানুষের সংখ্যা বেড়ে না যায়।
আজকের শহর মানেই বাজার। শহুরে সংস্কৃতির অর্থ বাজার সংস্কৃতি। পণ্যবাজারে মানুষও পণ্য হয়ে উঠছে। বিক্রি হচ্ছে। নিজেরাই বেচছে নিজেদের। বস্তুত মুনাফার হাটে সবাই একেকজন সেল্সম্যান এবং বিজ্ঞাপনের মডেল। দরকারি-অদরকারি সামগ্রী ছাড়াও মানুষ মুনাফার লোভে বেচে দিচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, চরিত্র, নীতি, আদর্শ, বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা সবকিছু। মানুষ স্বেচ্ছায় ঢুকে যাচ্ছে বিচিত্র সব প্যাকেটে। নারীর ক্ষেত্রে একথা একটু বেশি সত্য। পুঁজিবাদী মাফিয়াদের বিবেচনায় নারী মানেই রমণী। ভোগ্যপণ্য এবং রূপচর্চার বিজ্ঞাপনে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের, তাতে বিজ্ঞাপিত পণ্যের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে নারীর পণ্যমান। ব্রা, কাঁচুলি, ব্লাউজ, ব্লেড থেকে শুরু করে খাদ্য-অখাদ্য, ড্রাগ, মদসহ তাবত বিলাসপণ্যে নারীর লাস্য এখন এক অনিবার্য বস্তু। এমনকি মেয়েদের একান্ত ব্যবহার্য প্যাডের বিজ্ঞাপনেও আর কোনো রাখঢাক থাকছে না। পণ্যের দাম চড়াতে এভাবে পুঁজিবাদী মুনাফাখোররা বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে দিচ্ছে তীব্র যৌনাবেদন। এর উদ্দেশ্যটা যিনি ব্যবহৃত হচ্ছেন তার অজানা নয়। ক্রেতাদেরও কমবেশি জানা। মনো-সমাজবিদরা আগাগোড়াই বলে আসছেন, আদিমতম কামবৃত্তির কাছে আবেদন করলে যত সহজে সাড়া পাওয়া যায়, অন্য উপায়ে তা পাওয়া যায় না। এই মহাসত্যটি সবচেয়ে ভালো জানেন পুুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ এবং বড় বড় কোম্পানির মার্কেট রিসার্চ ও মোটিভেশন রিসার্চ দফতরের মনোবিদরা। যারা মোটা মাইনের বিনিময়ে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও মডেলদের যৌনাত্মক ভূমিকার বিষয়টি দেখভাল করেন।
হাল আমলে জীবন্ত মডেলের পাশাপাশি মেশিনে বানানো ‘মডেল’রা শোভা বাড়াচ্ছে বিখ্যাত সব শপিংমলের। এগুলোকে বলা হয় ডল অথবা ম্যানিকিন। এই ম্যানিকিন মডেল তৈরির উদ্গাতা পুঁজিবাদী বাণিজ্যের বুদ্ধিমান মাফিয়ারা। দুনিয়ার যে কোনো অভিজাত শপিংমলে এখন সেজে থাকে নানা বয়সের আদলে তৈরি নারী-পুরুষ ম্যানিকিন। এর বেশিরভাগই গড়নের দিক থেকে ‘স্লিম সুন্দরী’ এবং বিনম্র বা উত্কট যৌনাবেদনময়ী। তৈরি পোশাক, অন্তর্বাস, শাড়ি, গহনা ইত্যাদি দোকানে এদের এমনভাবে গুছিয়ে রাখা হয় যেন হাতছানি দিয়ে ক্রেতাদের টানছে এই বলে যে, এই পোশাক বা গয়না পরে আমার মতো নিপাট সুন্দরী এবং আবেদনময়ী হয়ে ওঠো। গরিব দেশের দোকানপাটেও ম্যানিকিন সজ্জার হিড়িক এখন লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, পুঁজিবাদী উন্নত বিশ্বে যন্ত্র-সচল ম্যানিকিনও পাওয়া যায়। সেগুলো হাত-পা নেড়ে এমনকি কথা বলে ক্রেতাদের ফুসলায়।
গবেষকদের মতে, বিদেশি খেলার পুতুল পর্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে শিশুমনে। তাহলে যৌনাবেদন তথা ঠারযুক্ত প্রমাণসাইজ ম্যানিকিন যে বিশেষ করে উঠতি বয়সীদের মধ্যে নেগেটিভ ভাইস তৈরি করবে তাতে আর সন্দেহ কী! তারা আরও বলেন, ম্যানিকিনের সার্বিক গড়ন দেখে সাধারণ ক্রেতার মধ্যে ফ্যাশনের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা তৈরি হয়। সেই চাহিদা পূরণ করতে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অতি মুনাফাখোরদের দিতে হয় চড়া দাম। বিজ্ঞাপন এবং ম্যানিকিনের প্ররোচনা এতই প্রবল!
লক্ষণীয় যে, এজাতীয় সব পুঁজিবাদী প্ররোচনা মিলেমিশে আমাদের মতো গরিব দেশের পোশাক সংস্কৃতিতেও প্রখর হয়ে উঠছে যৌন আঙ্গিক চেতনা। অর্থাত্ মানুষ পরিণত হচ্ছে সামগ্রীতে, পোশাকপত্র তার মোড়ক। ধনতান্ত্রিক সমাজে ঢাকঢোল পিটিয়েই যা শুরু হয়ে গেছে সেই কবে। পণ্ডিতদের অনেকের মতে, বর্তমানে পুঁজিবাদের মহাবট আমেরিকার মহিলারা প্রায় সবাই হয়ে উঠেছে একেকটি জীবন্ত-জ্বলন্ত ম্যানিকিন। আমেরিকার মেয়েদের পোশাক প্রসঙ্গে গত শতকের ষাটের দশকে চিন্তাবিদ ম্যাকলুহান মন্তব্য করেছিলেন, ‘The American woman for the fist time presents herself as to be touched and handled, not just to be looked at’-এর বাংলান্তর করেছেন সমাজবিদ বিনয় ঘোষ—‘পোশাক পরে সেজেগুজে আজ আর মহিলারা শুধু বলতে চান না ‘আমাকে দ্যাখো’, তারা বলতে চান ‘আমাকে স্পর্শ করো’, ‘নেড়েচেড়ে দ্যাখো’। তারা সেখানে যাই বলুক, অন্যদের কিন্তু নড়েচড়ে বসতে হবে। সমাজবিদ তো বটেই, সবার কড়া নজর রাখতে হবে পুঁজিবাদী বাজার ও মুনাফা-সংস্কৃতির প্ররোচনায় যেন ম্যানিকিনসদৃশ মানুষের সংখ্যা বেড়ে না যায়।
No comments