কোপেনহেগেন সম্মেলন নিয়ে সংশয়ঃ জলবায়ু সংক্রান্ত সমঝোতা কতদূর!
মৎস্য কন্যার প্রতীকধারী কোপেনহেগেন এখন হয়ে উঠেছে আশার শহর। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে সারা বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেখানে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আরও কমানোর বিষয়টিই ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে শুরু হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার প্রধান বিষয়।
উন্নত দেশগুলোতে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমন ও মানিয়ে নেয়ার জন্য উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দান এবং এসব নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি প্রণয়নের লক্ষ্যে ৭ ডিসেম্বর এই সম্মেলন শুরু হয়েছে। ১২ দিনব্যাপী সম্মেলন শেষ হবে ১৮ ডিসেম্বর। বিশ্বের ১৯২টি দেশের প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধির অংশগ্রহণে এ সম্মেলনে আলোচনা করবেন ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। উদ্বোধনী অধিবেশনের ভাষণে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) সভাপতি রাজেন্দ্র কুমার পাচুরি বাংলাদেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বলে উল্লেখ করে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। অধিবেশনের সভাপতি ডেনমার্কের জলবায়ুমন্ত্রী কনি হেডহার্ড বলেছেন, সম্মেলন শুরুর আগেই ব্রাজিল, চীন, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা কার্বন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল জোগাতে হবে। এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর সমঝোতা হবে কিনা, কোপেনহেগেন সম্মেলন শুরুর আগেই তা নিয়ে সংশয় দেখা গেছে।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত উন্নত বিশ্বই দায়ী। এর শিকার মূলত উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো। তাই বিশ্ব জলবায়ু বিপর্যয় রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও তহবিল জোগান দেয়ার দায় প্রধানত উন্নত দেশগুলোরই। এক্ষেত্রে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো খবর নেই। বিশ্বব্যাংকের মতে, এ কাজে বছরে সাড়ে সাতশ’ কোটি থেকে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হতে পারে। অন্যদিকে লন্ডনভিত্তিক পরিবেশ থিঙ্ক ট্যাংক ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বলেছে, বছরে প্রায় দু’হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতেই হবে। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর মনোভাব কী? চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত জি-এইট সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য অনুন্নত বিশ্বকে বরাদ্দ হিসেবে ৬শ’ কোটি মার্কিন ডলার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ বরাদ্দও কোনো দেশের সরকার সরাসরি পাবে না, বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে পাবে। অর্থাত্ নিজেদের সৃষ্ট জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হয়েও অনুন্নত দেশগুলোকে উন্নত বিশ্ব নতুন করে ঋণের জালে জড়াতে চায়। এ মনোভাব পাল্টে গেছে তেমন কোনো আভাস পাওয়া গেছে বলা যাবে না। তাহলে সমঝোতার কী হবে?
অথচ কোপেনহেগেন সম্মেলনে সমঝোতা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘কিয়োটো সনদে’র মেয়াদ আগামী ২০১২ সাল পর্যন্ত। সে সনদ অনুযায়ী বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ কমিয়ে আনার সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে সনদে স্বাক্ষর করেনি। তাই কোপেনহেগেন সম্মেলনে সমঝোতা কিয়োটো সনদের ধারাবাহিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। তবে এ জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সম্মেলনের মূল অধিবেশন হবে আগামী ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর। যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ ৬২ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকবেন। সেখানেই কোপেনহেগেন সম্মেলনের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সে অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকভাবে ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চাইবেন উন্নত দেশগুলোর কাছে। এর ফলাফল কী হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশজুড়ে যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় করা শুরু হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ে নতুন মাত্রা সৃষ্টি হবে জোর গলায় বলা যায়। এ অবস্থায় শুধু দেশের বাইরে সোচ্চার হলেই হবে না, পরিবেশ ও জনজীবন রক্ষায় দেশের ভেতরেও সমানভাবে সচেষ্ট হতে হবে। নইলে মহাবিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।
No comments