বলদের দিশা by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
গত ২৭-১০-০৯ তারিখে এই কলামে ‘বদলের দিশা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। লেখাটা নতুন করে পড়তে গিয়ে, ‘বদল’ শব্দটা কেন জানি মাথায় ঢুকে প্রচণ্ড দাপাদাপি শুরু করল! দাপাদাপি করতে করতে অক্ষরগুলো এলোমেলো হয়ে যেভাবে বেরিয়ে এলো, তা হলো—‘বলদ’।
আর এই ‘বলদ’ আমার কাছে ‘বদল’-এর চেয়েও তাত্পর্যপূর্ণ মনে হলো। অবশ্য একটা বিশেষ বদলের মধ্য দিয়েই পুরুষ গরু বলদে পরিণত হয় এবং তারপর তার আর কোনো বদল হয় না। বলদ গো-সম্পদের একটি বিশেষ শ্রেণী। এই শ্রেণীটি যে পুরুষ গরুর, তা আগেই বলেছি। জন্মের পর অবশ্য সব গো-সন্তানকেই বলা হয় বাছুর। এর পরবর্তী পর্যায়ে এসে লিঙ্গ বিভাজন গণ্য করে মেয়ে বাছুরের নাম হয় ‘বক্না’, পুরুষ বাছুরের নাম হয় এঁড়ে। এই এঁড়ে আরও বেড়ে ওঠার আগেই তাদের মধ্যে যাদের মুষ্ক অর্থাত্ অণ্ডথলি ছিন্ন করা হয়, সে হয়ে যায় বলদ বা দাম্ড়া। মুষ্ক ছিন্ন হয় না যে এঁড়ের, সে এঁড়ে অবস্থা ছেড়ে আরও বেড়ে উঠলে আখ্যা পায় ষাঁড়-ষণ্ড ইত্যাদি। ষাঁড় বা ষণ্ডের কথা থাক। আমি বলদ সম্পর্কেই দু’কথা বলতে চাই।
বলদ-দাম্ড়া কিংবা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বল্দা’, এই শব্দগুলো—অলস, অকেজো, বোকা ইত্যাদি বোঝাতে মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে প্রকৃত বলদের শ্রেণীভেদ আছে। হালের বলদ, গাড়ি টানার বলদ এবং কলুর বলদ। এর মধ্যে কলুর বলদ একটি অতি তাত্পর্যপূর্ণ শব্দ। সাধক রামপ্রসাদের একটি অতি প্রচলিত ও জনপ্রিয় গানের মধ্যে পেয়েছি—‘মা আমায় ঘোরাবি কত/ কলুর-চোখ বাঁধা বলদের মত।’ কলুর বলদ হাঁটতেই থাকে—কিন্তু এগোয় না, ঘোরে। একই বৃত্তে ঘোরে। চোখে পট্টি থাকায় গন্তব্য দেখতে পায় না বলেই সেভাবে পায়ে পায়ে এগিয়েই যাচ্ছে। হয়তো কোনোদিনের দেখা, সবুজ সতেজ ঘাসের চারণভূমির স্বপ্ন আসে তার মনে। অবশ্য বলদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে গরু মুক্তি পেলে, স্বপ্নের কারণে হোক, স্মৃতির কারণে হোক অথবা প্রবৃত্তি বা প্রবণতার কারণেই হোক—সবুজ মাঠেই সে ছোটে। কলুর বলদ সামনে ধরা শুকনো খড়-বিচালি খেতে খেতেই একদিন সতেজ ঘাস ও খড়-বিচালির স্বাদের পার্থক্য আর ধরতে পারে না, হারিয়ে ফেলে পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা। সে ঘানিগাছের সঙ্গে যুক্ত থেকে একই বৃত্তে হাঁটে আর হাঁটে। তাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে তৈলবীজ পিষে তেল বের করে নেয় কলু।
হঠাত্ মনে হলো, আমরা কী? রাষ্ট্রযন্ত্র নামক ঘানি গাছের সঙ্গে বাঁধা থেকে আমরাও কি সেই কবে থেকে একই বৃত্তে ঘুরছি না? আমাদের সঙ্গে কলুর বলদের খুব কি কোনো পার্থক্য আছে? ছোট-বড় নানা মাপের কলু আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তেল বের করে নিচ্ছে। ঘানি গাছের কলুর মতোই রাষ্ট্রযন্ত্রের কলুরাও সেই তেলের মালিক নয়। তবে ঘানি গাছের কলু যেমন শুধু পারিশ্রমিক পায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কলুরা তেমন নয়। তারা পারিশ্রমিকের সঙ্গে সঙ্গে লভ্যাংশও পায়। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মূলের সঙ্গে যুক্ত কলুরা পায় লভ্যাংশ ও পুরস্কার। আর বলদ কিছুই পায় না। আমি বলছি কলুর বলদের কথা। গাড়িটানা বা লাঙলটানা বলদেরা গাড়ি বা লাঙলের সঙ্গে জোড়া থাকলেও যেতে যেতে এদিক-ওদিক মুখ বাড়ানোর সুযোগ পায়। তাদের চোখে পট্টি থাকে না। কিন্তু কলুর বলদের চোখ ঢাকা। সে যে কখন কার কোন্ তৈলবীজ পিষে তেল বের করে দিচ্ছে, তাও জানে না। ঘানি গাছের কলুর মতোই রাষ্ট্রঘানির চালক কলুও অবশ্য জানে না যে কোন্ তৈলবীজ পিষে তেল বের করে কাকে দিচ্ছে। তবে ঘানি গাছের কলু যেমন ক্রয় সূত্রে তার ঘানিগাছ ও বলদের মালিক, রাষ্ট্রঘানির কলু তা নয় বলেই হয়তো ঘানি এবং বলদ দুইয়ের ওপরই তার মমতা কম। আসল মালিক নয় বলেই মালিকানা ফলানোর, অর্থাত্ যতদিন চালনার ভার হাতে আছে ততদিন যত বেশি সম্ভব তেল বের করে নেয়ার তত্পরতাই প্রকট হয়ে ওঠে তার। তাতে ঘানি বা বলদ বাঁচল না মরল, তা দেখার অবকাশ থাকে না। ওদিকে যে তেলের জন্য লগ্নি করে বসে আছে মহাজনরা! তারা লগ্নি দ্বিগুণ-চৌগুণ যদি না পায়, তাহলে মালিকানা ফলানোর কিংবা চালকের আসনে পোক্ত হওয়ার সুযোগ যে হাতছাড়া হয়ে যাবে!
আমাদের তথাকথিত ‘মালিকেরা’ যখন মহাজনদের দরবারে যায়, তখন অনেক ক্ষেত্রে লালগালিচা অভ্যর্থনাও পায়। ওই গালিচার ওপর পা রেখেই আমাদের চালকরা বুঝে যায়, যতদিন তারা বলদদের রক্ত ঢালতে পারবে, ততদিন ওই গালিচা লাল থাকবে। মহাজনদের দরবারের বৈঠকে অনেক কথা হয়। আমাদের মালিকদের চামচারা সেসব কথার নানা ব্যাখ্যা, নানা অর্থ করে, সতেজ সবুজ ঘাসের স্বপ্ন বানিয়ে বলদদের চোখের সামনে দোলাতে থাকে। আমরা বলদেরা সেই আহলাদে চোখ বুজে সেই স্বপ্নে বিভোর। কখনও কখনও শুকনো বিচুলির জাবর কাটতে কাটতে স্বপ্নেই সবুজ ঘাসের স্বাদ পেতে থাকি। একটা গল্প বলে শেষ করতে চাই। আমাদের এক বন্ধু এক অফিসের বড় পোস্টে চাকরি করত। আমরা অন্য বন্ধুরা মিলে তার অফিসারগিরি দেখতে যাই, এটা তার বড়ই পুলকের ব্যাপার ছিল। আমরা গেলে সে তার ঠাটবাটের গল্প করত। তারপর এক সময় বেল টিপে পিওন ডেকে হাঁক ছেড়ে হুকুম দিত চা-নাস্তার। এত জোরে বলত যে আশপাশের সব রুম থেকেই শোনা যেত। পিওন মাথা দুলিয়ে চলে যেত, আমরা বিদায় না হওয়া পর্যন্ত আর ফিরত না। চা-নাস্তাও আসত না। আমরা ভাবতাম পিওনটা বড় বেয়াদব। অনেক পরে জেনেছিলাম, বন্ধু যদি হাতের তালু পিওনের দিকে দিয়ে মৃদু ধাক্কা দেয়ার ভঙ্গি করত—তাহলে পিওন যেত, আর ফিরত না। আর আসলেই যাকে চা-নাস্তা খাওয়াতে চাইত—তার বেলায় বন্ধুর হাতের ভঙ্গি হতো ডাকার মতো। সামনেই তেমন এক মহাজনের (নাকি বন্ধুর!!) সঙ্গে বৈঠকে যাওয়ার কথা শুনছি। তার হাতের ভঙ্গিটি কেমন হবে, দেখা যাক। দেখা যাক আমরা কলুর বলদেরা এবার কোন দিশা পাই!
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments