মানুষ কি করে অন্য প্রাণীর দুধ খেতে শিখলো?
বিবর্তনের প্রথম দিকে মানুষের অন্য প্রাণীর দুধ হজম করতে পারতো না। কিন্তু এখন অনেক জনগোষ্ঠীই গরু, উট, বা ছাগলের দুধ খায়।
কিভাবে মানুষের শরীরে অন্য প্রাণীর দুধ হজম করার ক্ষমতা তৈরি হলো?
ইদানীং বাজারে প্রাণীর দুধের নানা 'প্রতিযোগী' এসে গেছে। যেমন সয়া দুধ, আমন্ড বাদামের দুধ - এগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে।
যারা 'ভেগান' - তাদের জন্য, অথবা যাদের দুধে এ্যালার্জি আছে - তাদের জন্য এই বিকল্পগুলো বেশ সুবিধাজনক।
কিন্তু এগুলো এখনো জনপ্রিয়তার দিক থেকে প্রাণীজ দুধের কাছাকাছি আসতে পারে নি।
বিবিসির মাইকেল মার্শাল এক রিপোর্টে লিখছেন, প্রাণীজ দুধের সাথে মানুষের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের পুরোনো। এর ইতিহাসও অতি বিচিত্র উত্থান-পতনে ভরা।
মানুষ হয়ে অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা কি একটা 'আজব' ব্যাপার?
দুধ খাওয়াটা মানুষের কাছে এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে কেউ যদি বলে - এটা একটা আজব কাজ - তাহলে এ কথা যে বলবে তাকেই বরং আপনার একটা উদ্ভট লোক বলে বনে হবে।
কারণ আমরা কখনো এভাবে চিন্তা করি না।
একটি গরু বা অন্য কোন প্রাণীর দেহে দুধ তৈরি হয় - তার বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু মানুষ কি করছে? তারা গরুটার বাঁট টিপে টিপে সেই দুধ বের করে নিয়ে নিজেরা খাচ্ছে। এটা কি একটা আজব ব্যাপার নয়?
কিন্তু এমন সংস্কৃতিও আছে, যেখানে প্রাণীর দুধ খাবার কথা অনেকেরই প্রায় অজানা।
এই সেদিন, ২০০০ সালে চীনে একটা প্রচারাভিযান শুরু হয়েছিল যাতে লোকে স্বাস্থ্যগত কারণেই আরো বেশি করে দুধ এবং দুধজাত খাবার খায়।
এই প্রচারাভিযানটিকে চীনের বয়স্ক লোকদের দিক থেকে গভীর সন্দেহের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। দুধ থেকে যে পনির তৈরি হয় তা এখনও চীনের অনেক মানুষকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে।
বলা হয়, মানব প্রজাতির ইতিহাস মোটামুটি তিন লক্ষ বছরের। সে তুলনায় দুধ খাবার ইতিহাসকে প্রায় 'নতুন' বলা যায়।
মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগেও মানুষ দুধ প্রায় খেতোই না।
খেলেও তা ছিল খুবই বিরল। প্রথম যে মানুষেরা দুধ খেতে শুরু করে তারা ছিল পশ্চিম ইউরোপের কৃষক ও পশুচারণকারী জনগোষ্ঠীর লোক । এরাই ছিল প্রথম মানুষ যারা গরু বা অন্য পশুদের পোষ মানিয়ে গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করেছিল।
বর্তমানে উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্য আরো অনেক জায়গায় দুধ পান করাটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।
মানুষের জন্য অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা যে 'অস্বাভাবিক' তার একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আছে।
'বৈজ্ঞানিক যুক্তি'
দুধের মধ্যে আছে এক বিশেষ ধরণের শর্করা - যাকে বলে ল্যাকটোজ। ফল বা অন্যান্য মিষ্টি খাবারে যে শর্করা থাকে তার চেয়ে এটা অনেক আলাদা। আমরা যখন শিশু ছিলাম, আমাদের শরীর এক বিশেষ ধরণের এনজাইম তৈরি করতো যাকে বলে ল্যাকটেজ - যার কাজ ছিল আমাদের মায়ের দুধ হজম করতে সহায়তা করা। কিন্তু শিশু যখন মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয় - তখন অনেকের দেহেই সেই ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
এই ল্যাকটেজ ছাড়া দুধ ঠিকমত হজম হয় না। তাই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি বেশি দুধ খায় তাহলে তার পেটে গ্যাস হওয়া, পেটে ব্যথা, খিঁচুনি অথবা ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন গরু, কুকুর বা বিড়ালের মধ্যেও দেখা যায় যে তারা পূর্ণবয়স্ক হলে তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে অনেকেই দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন, কারণ তাদের দেহে ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয় না। মানুষের ক্ষেত্রে এটা কিভাবে ঘটলো?
দুধ হজম করার 'ল্যাকটেজ' এনজাইম কারো দেহে সারাজীবন থাকে, কারো থাকে না
প্রথম যে প্রাপ্তবয়স্ক ইউরোপিয়ানরা দুধ খেয়েছিল - তাদের হয়তো প্রচুর গ্যাস হতো।
কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই তাদের মধ্যে একটা বিবর্তন ঘটেছিল। তারা মায়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেও তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন অব্যাহত রয়ে গেল, দেখা গেল তারা দুধ খেলেও কোন বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে ডিএনএ'র একটি অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে - যা ল্যাকটেজ জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রবণতাকে বলে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স এবং এর বিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন প্যারিসের 'মিউজিয়াম অব হিউম্যানকাইন্ড'-এর অধ্যাপক লোরে সেগুরেল। তিনি বলছেন, "ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রথম ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স দেখা যায় এখন থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। আর মধ্য ইউরোপে এটা প্রথম দেখা যায় ৩ হাজার বছর আগে।"
বর্তমানে অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ প্রবণতা অর্থাৎ 'দুধ হজম করার ক্ষমতা' খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। উত্তর ইউরোপে এখন ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে।
আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
কিন্তু এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে যাদের দেহে ল্যাকটেজের অব্যাহত উপস্থিতি অনেক বিরল। আফ্রিকানদের অনেকের মধ্যেই এটা নেই। এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও এটা সাধারণত দেখা যায় না।
কেন এমন হয়, তা এখনো এক ধাঁধাঁ
বৈজ্ঞানিকরা বলছেন: কোন কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কি কারণে দুধ খাবার অভ্যাস গড়ে উঠেছে এবং তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে - এটার কোন সূত্র বের করা খুবই কঠিন।
মি. সেগুরেল বলছেন, "দুধ খাওয়াটা 'উপকারী' হয়ে উঠেছে কেন, বা অন্য অনেক রকম খাদ্যের উৎস থাকলেও একেবারে অন্য রকম একটি খাদ্য এই দুধই কেন এতটা 'গুরুত্বপূর্ণ' হয়ে উঠেছে - এটা বলা কঠিন।"
কেউ হয়তো বলতে পারেন, দুধ পান করার ফলে মানুষ নতুন একটি পুষ্টিদায়ক খাবারের সন্ধান পেয়েছে, তাদের অনাহারে থাকার ঝুঁকি কমেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এ যুক্তি খুব বেশি খাটে না।
যেসব লোক দুধ খেয়ে হজম করতে পারে না, তারাও অল্প পরিমাণ দুধজাতীয় খাবার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই খেতে পারে। তা ছাড়া দুধ থেকে যে মাখন, দই, ক্রিম এবং পনির তৈরি হয় - এর সবগুলোতেই ল্যাকটোজের পরিমাণ অনেক কমে যায়। চেডার এবং পারমিজিয়ানো নামে যে বিশেষ ধরণের পনির আছে তাতে মাত্র ১০ শতাংশ বা তারও কম ল্যাকটোজ থাকে।
"ঘন ক্রিম এবং মাখনে ল্যাকটোজের পরিমাণ সবচেয়ে কম" - বলছেন সেগুরেল। জানা যায়, চিজ বা পনির তৈরির কৌশল মানুষ বেশ দ্রুতই উদ্ভাবন করেছিল।
গত বছর সেপ্টেম্বরে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায় পড়ে এমন একটি এলাকায় পুরাতত্ববিদরা কিছু মৃৎপাত্রের অংশ খুঁজে পান - যাতে ফ্যাটি এসিডের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এতে মনে হয় ওই পাত্র দই বা ছানা জাতীয় কিছু তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো - যা পনির উৎপাদনের একটি ধাপ। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে দক্ষিণ ইউরোপের লোকেরা ৭,২০০ বছর আগেই পনির তৈরি করতো। ইউরোপের অন্যত্র আরো হাজারখানেক বছর পরের পনির উৎপাদনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। মনে রাখতে হবে তখনও ইউরোপের প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের দেহে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স অর্থাৎ দুধ হজম করার এনজাইমের স্থায়ী উপস্থিতি তৈরি হয় নি।
তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেনেটিক্সের অধ্যাপক ডালাস সোয়ালো বলছেন, কোন ধরণের লোকের দেহে পরিণত বয়সে উচ্চ মাত্রায় ল্যাকটেজ থাকে এবং কাদের থাকে না - তার একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে।
তিনি বলছেন, যারা পশুচারণ করতো, গরু-ছাগল-ভেড়া পালতো - তাদের দেহে উচ্চ মাত্রায় ল্যাকটেজ পাওয়া যায়। কিন্তু যারা শিকারী এবং কোন প্রাণী পুষতো না - তাদের মধ্যে জিনের ওই পরিবর্তনটি ঘটেনি। যেসব জনগোষ্ঠী শুধু চাষাবাদ করতো কিন্তু কোন পশুপালন করতো না - তাদের দেহেও 'ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স' নেই।
তার মানে হচ্ছে - যাদের জীবনধারার কারণে প্রাণীর দুধ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, তাদের দেহকে দুধ পানের উপযোগী করে তোলার জন্য বিবর্তিত হবার কোন চাপ ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন হলো, কিছু কিছু পশুচারণকারী জনগোষ্ঠীর দেহে এই বৈশিষ্ট্য তৈরি হলেও অন্যদের ক্ষেত্রে তা হলো না কেন?সেগুরেল বলছেন, মঙ্গোলিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ায় যেসব পশুচারণকারী জনগোষ্ঠী আছে তাদের দেহে ল্যাকটেজের উপস্থিতি অত্যন্ত কম - যদিও তারা খাদ্য হিসেবে তাদের পালিত পশুর দুধের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল।
অথচ নিকটবর্তী পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপের জনগোষ্ঠীগুলোর জিনে এ পরিবর্তন হয়েছে, কাজেই পূর্ব এশিয়ার গ্রুপগুলোতেও এ পরিবর্তন ছড়াবে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয় নি, এবং এটা একটা ধাঁধাঁ হিসেবে রয়ে গেছে, বলছেন সেগুরেল।
দুধ খাবার কি কোন উপকারিতা আছে?
সেগুরেল বলছেন, পুষ্টিগুণ ছাড়াও দুধ পানের হযতো আরো কিছু উপকারিতা আছে।
তিনি বলছেন, গবাদিপশুর যেসব রোগ হয় - তাদের পালনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সেসব রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। এটা হতেই পারে যে গরুর দুধ পান করলে মানবদেহে এমন কিছু এন্টিবডি তৈরি হয়, যাতে এ্যানথ্রাক্স ক্রিপটোস্পোরিডিওসিসের মতো রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। বাচ্চাদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর একটি উপকারিতাও তাই - শিশুর দেহকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা।
তবে কোন কোন জনগোষ্ঠীর দেহে যে ল্যাকটেজের উপস্থিতি থাকে না - এটা হয়তো নিতান্তই দৈবক্রমে ঘটেছে - এমনটাও হতে পারে। অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, "আপনি যদি পশুচারণকারী হন তাহলে আপনার দেহে দুধ হজম করার স্থায়ী ক্ষমতা তৈরি হবে - এটাই হচ্ছে সবচেয়ে আমাদের ছবিটার সবচেয়ে যৌক্তিক অংশ।কিন্তু দুধ হজম করতে হলে আপনার জিনের সেই বিশেষ মিউটেশনটা হতেই হবে - প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রশ্নটা আসবে তার পরে।"
অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, মঙ্গোলিয়ান গো-চারণকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেখা যায় যে তারা সাধারণত গাঁজানো দুধ খায় - যাতে ল্যাকটোজের পরিমাণ কমে যায়।
অধ্যাপক সোয়ালোর ছাত্রী ক্যাথরিন ওয়াকার বলছেন, "মানুষ দুধকে গাঁজিয়ে ল্যাকটোজ কমিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে এত উন্নতি করেছে, কিন্তু তার পরও তার দেহে দুধ হজমের এনজাইম রয়ে যাচ্ছে কেন সেটাও একটা প্রশ্ন - যার উত্তর পাওয়া কঠিন।"
হয়তো মানবদেহে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স তৈরি হবার একটি নয় বরং অনেক কারণ রয়েছে।
অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, "দুধে প্রচুর চর্বি, প্রোটিন, শর্করা বা সুগার, এবং ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির মতো অন্যান্য পুষ্টিগুণ রয়েছে - এবং এটাই হয়তো মানবদেহে দুধ হজম করার এনজাইমের স্থায়ী উপস্থিতির আসল কারণ। তা ছাড়া এটা পরিষ্কার পানিরও একটা উৎস। এটাও হয়তো কোন কোন জনগোষ্ঠীর বিবর্তনের কারণ হতে পারে।"
মানবদেহে এই পরিবর্তনটা এখনো ঘটছে কিনা তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। অধ্যাপক সোয়ালো ২০১৮ সালে একটা জরিপ চালিয়েছিলেন চিলির কোকুইম্বো এলাকায় পশুচারণকারী একটি জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রায় ৫০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন আসা ইউরোপিয়ানদের সাথে এই জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের যৌনমিলন ও সন্তান উৎপাদন হয়। এখন এই গোষ্ঠীটির মধ্যে দুধ হজম করার ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ৫ হাজার বছর আগে উত্তর ইউরোপে ঘটেছিল।
তবে কোকুইম্বো জনগোষ্ঠী দুধের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের অবস্থাটা পৃথিবীর অন্য জায়গার মতো নয়।
দুধ খাবার অভ্যাস কি কমছে?
গত কয়েক বছর যাবৎ যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হতে পারে, লোকজন বোধহয় দুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান একটি রিপোর্ট করে।
এতে বলা হয়, ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে গরুর দুধের প্রতি আকর্ষণ কমে যাচ্ছে, বরং ওট এবং বাদামের দুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ক্রমাগত বাড়ছে। এতে মনে হয় ঐতিহ্যগত দুধের জন্য একটা লড়াই আসন্ন।
কিন্তু পরিসংখ্যান দেখলে দেখবেন ব্যাপারটা উল্টো। আইএফসিএন নামের ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক তাদে ২০১৮ সালের রিপোর্টে বলছে, ১৯৯৮ সাল থেকে বৈশ্বিক দুধের উৎপাদন প্রতি বছরই বেড়েছে। ২০১৭ সালে বিশ্বে দুধ উৎপাদন হয়েছে ৮৬ কোটি ৪০ লাখ টন। আইএফসিএন বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দুধ উৎপাদন আরো ৩৫ শতাংশ বাড়বে।
মানুষ কি খাচ্ছে তার পর ২০১০ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে দুধ খাওয়ার পরিমাণ গত দু দশেকে কমেছে, এর জায়গায় কোমল পানীয় পান বেড়েছে। অন্যদিকে এশিয়ায় দুধ খাওয়া বেড়েছে। ২০১৫ সালে ১৮৭টি দেশে চালানো আরেক জরিপে দেখা যায়, বয়স্কদের মধ্যে দুধ খাওয়া বাড়ছে, এর অর্থ হতে পারে তরুণদের মধ্যে দুধ অতোটা জনপ্রিয় নয়। কাজেই বিশ্বে দুধের প্রতি আকর্ষণ যেভাবে বাড়ছে - তাতে 'বিকল্প দুধ' যে তার জায়গা দখল করে নেবে, বা বাজারে আঘাত হানবে - এমন মনে হয় না।
তা ছাড়া সয়া, ওট বা আমন্ডের মতো বিকল্প দুধে দুধের মতো পুষ্টিগুণও নেই। এটা শুথু ভেগান বা দুধে এ্যালার্জি আছে এমন লোকদের জন্যই সুবিধাজনক।
এশিয়াতে দুধের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে সেটা বেশ বিস্ময়কর।
কারণ এশিয়াতে বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রেই বড় হবার পর তাদের দেহে দুধ হজম করার ল্যাকটেজ এনজাইম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
তুলনামূলকভাবে দুধের উপকারিতার চেয়ে অধিকাংশ এশিয়ানের ক্ষেত্রে এটা হজম করতে গিয়ে যে সমস্যা হয় - তার পরিমাণ বেশি।
উন্নয়নশীল কিছু দেশে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মানুষের মধ্যে লামার মতো অন্য প্রাণীর দুধ প্রচলিত করার চেষ্টা করেছে, কারণ এটা হয়তো গরুর দুধের চেয়ে সহজপ্রাপ্য বা সস্তা হবে।
এ বছরই জানুয়ারি মাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ জরিপে এমন কিছু বৈশ্বিক স্বাস্থ্যকর খাবারের কথা বলা হয়েছে - যাতে স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে, আবার পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম হবে।
এতে রেড মিট অর্থাৎ গরু-ছাগল-ভেড়ার মাংস ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ বা তার সমমানের কিছু খাবার কথা ঠিকই বলা হয়েছে।
সুতরাং মানুষের খাদ্য হিসেবে দুধ এখনো ভালোভাবেই টিকে আছে, এবং এখনো তার প্রসার হচ্ছে।
যদিও আমাদের দেহে এই দুধ হজম করার ক্ষমতার বিবর্তন থেমে গেছে।
সূত্রঃ বিবিসি
কিভাবে মানুষের শরীরে অন্য প্রাণীর দুধ হজম করার ক্ষমতা তৈরি হলো?
ইদানীং বাজারে প্রাণীর দুধের নানা 'প্রতিযোগী' এসে গেছে। যেমন সয়া দুধ, আমন্ড বাদামের দুধ - এগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে।
যারা 'ভেগান' - তাদের জন্য, অথবা যাদের দুধে এ্যালার্জি আছে - তাদের জন্য এই বিকল্পগুলো বেশ সুবিধাজনক।
কিন্তু এগুলো এখনো জনপ্রিয়তার দিক থেকে প্রাণীজ দুধের কাছাকাছি আসতে পারে নি।
বিবিসির মাইকেল মার্শাল এক রিপোর্টে লিখছেন, প্রাণীজ দুধের সাথে মানুষের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের পুরোনো। এর ইতিহাসও অতি বিচিত্র উত্থান-পতনে ভরা।
মানুষ হয়ে অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা কি একটা 'আজব' ব্যাপার?
দুধ খাওয়াটা মানুষের কাছে এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে কেউ যদি বলে - এটা একটা আজব কাজ - তাহলে এ কথা যে বলবে তাকেই বরং আপনার একটা উদ্ভট লোক বলে বনে হবে।
কারণ আমরা কখনো এভাবে চিন্তা করি না।
একটি গরু বা অন্য কোন প্রাণীর দেহে দুধ তৈরি হয় - তার বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু মানুষ কি করছে? তারা গরুটার বাঁট টিপে টিপে সেই দুধ বের করে নিয়ে নিজেরা খাচ্ছে। এটা কি একটা আজব ব্যাপার নয়?
কিন্তু এমন সংস্কৃতিও আছে, যেখানে প্রাণীর দুধ খাবার কথা অনেকেরই প্রায় অজানা।
এই সেদিন, ২০০০ সালে চীনে একটা প্রচারাভিযান শুরু হয়েছিল যাতে লোকে স্বাস্থ্যগত কারণেই আরো বেশি করে দুধ এবং দুধজাত খাবার খায়।
এই প্রচারাভিযানটিকে চীনের বয়স্ক লোকদের দিক থেকে গভীর সন্দেহের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। দুধ থেকে যে পনির তৈরি হয় তা এখনও চীনের অনেক মানুষকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে।
বলা হয়, মানব প্রজাতির ইতিহাস মোটামুটি তিন লক্ষ বছরের। সে তুলনায় দুধ খাবার ইতিহাসকে প্রায় 'নতুন' বলা যায়।
মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগেও মানুষ দুধ প্রায় খেতোই না।
খেলেও তা ছিল খুবই বিরল। প্রথম যে মানুষেরা দুধ খেতে শুরু করে তারা ছিল পশ্চিম ইউরোপের কৃষক ও পশুচারণকারী জনগোষ্ঠীর লোক । এরাই ছিল প্রথম মানুষ যারা গরু বা অন্য পশুদের পোষ মানিয়ে গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করেছিল।
বর্তমানে উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্য আরো অনেক জায়গায় দুধ পান করাটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।
মানুষের জন্য অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা যে 'অস্বাভাবিক' তার একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আছে।
'বৈজ্ঞানিক যুক্তি'
দুধের মধ্যে আছে এক বিশেষ ধরণের শর্করা - যাকে বলে ল্যাকটোজ। ফল বা অন্যান্য মিষ্টি খাবারে যে শর্করা থাকে তার চেয়ে এটা অনেক আলাদা। আমরা যখন শিশু ছিলাম, আমাদের শরীর এক বিশেষ ধরণের এনজাইম তৈরি করতো যাকে বলে ল্যাকটেজ - যার কাজ ছিল আমাদের মায়ের দুধ হজম করতে সহায়তা করা। কিন্তু শিশু যখন মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয় - তখন অনেকের দেহেই সেই ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
এই ল্যাকটেজ ছাড়া দুধ ঠিকমত হজম হয় না। তাই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি বেশি দুধ খায় তাহলে তার পেটে গ্যাস হওয়া, পেটে ব্যথা, খিঁচুনি অথবা ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন গরু, কুকুর বা বিড়ালের মধ্যেও দেখা যায় যে তারা পূর্ণবয়স্ক হলে তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে অনেকেই দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন, কারণ তাদের দেহে ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয় না। মানুষের ক্ষেত্রে এটা কিভাবে ঘটলো?
দুধ হজম করার 'ল্যাকটেজ' এনজাইম কারো দেহে সারাজীবন থাকে, কারো থাকে না
প্রথম যে প্রাপ্তবয়স্ক ইউরোপিয়ানরা দুধ খেয়েছিল - তাদের হয়তো প্রচুর গ্যাস হতো।
কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই তাদের মধ্যে একটা বিবর্তন ঘটেছিল। তারা মায়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেও তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন অব্যাহত রয়ে গেল, দেখা গেল তারা দুধ খেলেও কোন বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে ডিএনএ'র একটি অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে - যা ল্যাকটেজ জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রবণতাকে বলে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স এবং এর বিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন প্যারিসের 'মিউজিয়াম অব হিউম্যানকাইন্ড'-এর অধ্যাপক লোরে সেগুরেল। তিনি বলছেন, "ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রথম ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স দেখা যায় এখন থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। আর মধ্য ইউরোপে এটা প্রথম দেখা যায় ৩ হাজার বছর আগে।"
বর্তমানে অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ প্রবণতা অর্থাৎ 'দুধ হজম করার ক্ষমতা' খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। উত্তর ইউরোপে এখন ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে।
আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
কিন্তু এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে যাদের দেহে ল্যাকটেজের অব্যাহত উপস্থিতি অনেক বিরল। আফ্রিকানদের অনেকের মধ্যেই এটা নেই। এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও এটা সাধারণত দেখা যায় না।
কেন এমন হয়, তা এখনো এক ধাঁধাঁ
বৈজ্ঞানিকরা বলছেন: কোন কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কি কারণে দুধ খাবার অভ্যাস গড়ে উঠেছে এবং তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে - এটার কোন সূত্র বের করা খুবই কঠিন।
মি. সেগুরেল বলছেন, "দুধ খাওয়াটা 'উপকারী' হয়ে উঠেছে কেন, বা অন্য অনেক রকম খাদ্যের উৎস থাকলেও একেবারে অন্য রকম একটি খাদ্য এই দুধই কেন এতটা 'গুরুত্বপূর্ণ' হয়ে উঠেছে - এটা বলা কঠিন।"
কেউ হয়তো বলতে পারেন, দুধ পান করার ফলে মানুষ নতুন একটি পুষ্টিদায়ক খাবারের সন্ধান পেয়েছে, তাদের অনাহারে থাকার ঝুঁকি কমেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এ যুক্তি খুব বেশি খাটে না।
যেসব লোক দুধ খেয়ে হজম করতে পারে না, তারাও অল্প পরিমাণ দুধজাতীয় খাবার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই খেতে পারে। তা ছাড়া দুধ থেকে যে মাখন, দই, ক্রিম এবং পনির তৈরি হয় - এর সবগুলোতেই ল্যাকটোজের পরিমাণ অনেক কমে যায়। চেডার এবং পারমিজিয়ানো নামে যে বিশেষ ধরণের পনির আছে তাতে মাত্র ১০ শতাংশ বা তারও কম ল্যাকটোজ থাকে।
"ঘন ক্রিম এবং মাখনে ল্যাকটোজের পরিমাণ সবচেয়ে কম" - বলছেন সেগুরেল। জানা যায়, চিজ বা পনির তৈরির কৌশল মানুষ বেশ দ্রুতই উদ্ভাবন করেছিল।
গত বছর সেপ্টেম্বরে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায় পড়ে এমন একটি এলাকায় পুরাতত্ববিদরা কিছু মৃৎপাত্রের অংশ খুঁজে পান - যাতে ফ্যাটি এসিডের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এতে মনে হয় ওই পাত্র দই বা ছানা জাতীয় কিছু তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো - যা পনির উৎপাদনের একটি ধাপ। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে দক্ষিণ ইউরোপের লোকেরা ৭,২০০ বছর আগেই পনির তৈরি করতো। ইউরোপের অন্যত্র আরো হাজারখানেক বছর পরের পনির উৎপাদনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। মনে রাখতে হবে তখনও ইউরোপের প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের দেহে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স অর্থাৎ দুধ হজম করার এনজাইমের স্থায়ী উপস্থিতি তৈরি হয় নি।
তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেনেটিক্সের অধ্যাপক ডালাস সোয়ালো বলছেন, কোন ধরণের লোকের দেহে পরিণত বয়সে উচ্চ মাত্রায় ল্যাকটেজ থাকে এবং কাদের থাকে না - তার একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে।
তিনি বলছেন, যারা পশুচারণ করতো, গরু-ছাগল-ভেড়া পালতো - তাদের দেহে উচ্চ মাত্রায় ল্যাকটেজ পাওয়া যায়। কিন্তু যারা শিকারী এবং কোন প্রাণী পুষতো না - তাদের মধ্যে জিনের ওই পরিবর্তনটি ঘটেনি। যেসব জনগোষ্ঠী শুধু চাষাবাদ করতো কিন্তু কোন পশুপালন করতো না - তাদের দেহেও 'ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স' নেই।
তার মানে হচ্ছে - যাদের জীবনধারার কারণে প্রাণীর দুধ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, তাদের দেহকে দুধ পানের উপযোগী করে তোলার জন্য বিবর্তিত হবার কোন চাপ ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন হলো, কিছু কিছু পশুচারণকারী জনগোষ্ঠীর দেহে এই বৈশিষ্ট্য তৈরি হলেও অন্যদের ক্ষেত্রে তা হলো না কেন?সেগুরেল বলছেন, মঙ্গোলিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ায় যেসব পশুচারণকারী জনগোষ্ঠী আছে তাদের দেহে ল্যাকটেজের উপস্থিতি অত্যন্ত কম - যদিও তারা খাদ্য হিসেবে তাদের পালিত পশুর দুধের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল।
অথচ নিকটবর্তী পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপের জনগোষ্ঠীগুলোর জিনে এ পরিবর্তন হয়েছে, কাজেই পূর্ব এশিয়ার গ্রুপগুলোতেও এ পরিবর্তন ছড়াবে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয় নি, এবং এটা একটা ধাঁধাঁ হিসেবে রয়ে গেছে, বলছেন সেগুরেল।
দুধ খাবার কি কোন উপকারিতা আছে?
সেগুরেল বলছেন, পুষ্টিগুণ ছাড়াও দুধ পানের হযতো আরো কিছু উপকারিতা আছে।
তিনি বলছেন, গবাদিপশুর যেসব রোগ হয় - তাদের পালনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সেসব রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। এটা হতেই পারে যে গরুর দুধ পান করলে মানবদেহে এমন কিছু এন্টিবডি তৈরি হয়, যাতে এ্যানথ্রাক্স ক্রিপটোস্পোরিডিওসিসের মতো রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। বাচ্চাদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর একটি উপকারিতাও তাই - শিশুর দেহকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা।
তবে কোন কোন জনগোষ্ঠীর দেহে যে ল্যাকটেজের উপস্থিতি থাকে না - এটা হয়তো নিতান্তই দৈবক্রমে ঘটেছে - এমনটাও হতে পারে। অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, "আপনি যদি পশুচারণকারী হন তাহলে আপনার দেহে দুধ হজম করার স্থায়ী ক্ষমতা তৈরি হবে - এটাই হচ্ছে সবচেয়ে আমাদের ছবিটার সবচেয়ে যৌক্তিক অংশ।কিন্তু দুধ হজম করতে হলে আপনার জিনের সেই বিশেষ মিউটেশনটা হতেই হবে - প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রশ্নটা আসবে তার পরে।"
অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, মঙ্গোলিয়ান গো-চারণকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেখা যায় যে তারা সাধারণত গাঁজানো দুধ খায় - যাতে ল্যাকটোজের পরিমাণ কমে যায়।
অধ্যাপক সোয়ালোর ছাত্রী ক্যাথরিন ওয়াকার বলছেন, "মানুষ দুধকে গাঁজিয়ে ল্যাকটোজ কমিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে এত উন্নতি করেছে, কিন্তু তার পরও তার দেহে দুধ হজমের এনজাইম রয়ে যাচ্ছে কেন সেটাও একটা প্রশ্ন - যার উত্তর পাওয়া কঠিন।"
হয়তো মানবদেহে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স তৈরি হবার একটি নয় বরং অনেক কারণ রয়েছে।
অধ্যাপক সোয়ালো বলছেন, "দুধে প্রচুর চর্বি, প্রোটিন, শর্করা বা সুগার, এবং ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির মতো অন্যান্য পুষ্টিগুণ রয়েছে - এবং এটাই হয়তো মানবদেহে দুধ হজম করার এনজাইমের স্থায়ী উপস্থিতির আসল কারণ। তা ছাড়া এটা পরিষ্কার পানিরও একটা উৎস। এটাও হয়তো কোন কোন জনগোষ্ঠীর বিবর্তনের কারণ হতে পারে।"
মানবদেহে এই পরিবর্তনটা এখনো ঘটছে কিনা তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। অধ্যাপক সোয়ালো ২০১৮ সালে একটা জরিপ চালিয়েছিলেন চিলির কোকুইম্বো এলাকায় পশুচারণকারী একটি জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রায় ৫০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন আসা ইউরোপিয়ানদের সাথে এই জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের যৌনমিলন ও সন্তান উৎপাদন হয়। এখন এই গোষ্ঠীটির মধ্যে দুধ হজম করার ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ৫ হাজার বছর আগে উত্তর ইউরোপে ঘটেছিল।
তবে কোকুইম্বো জনগোষ্ঠী দুধের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের অবস্থাটা পৃথিবীর অন্য জায়গার মতো নয়।
দুধ খাবার অভ্যাস কি কমছে?
গত কয়েক বছর যাবৎ যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হতে পারে, লোকজন বোধহয় দুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান একটি রিপোর্ট করে।
এতে বলা হয়, ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে গরুর দুধের প্রতি আকর্ষণ কমে যাচ্ছে, বরং ওট এবং বাদামের দুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ক্রমাগত বাড়ছে। এতে মনে হয় ঐতিহ্যগত দুধের জন্য একটা লড়াই আসন্ন।
কিন্তু পরিসংখ্যান দেখলে দেখবেন ব্যাপারটা উল্টো। আইএফসিএন নামের ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক তাদে ২০১৮ সালের রিপোর্টে বলছে, ১৯৯৮ সাল থেকে বৈশ্বিক দুধের উৎপাদন প্রতি বছরই বেড়েছে। ২০১৭ সালে বিশ্বে দুধ উৎপাদন হয়েছে ৮৬ কোটি ৪০ লাখ টন। আইএফসিএন বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দুধ উৎপাদন আরো ৩৫ শতাংশ বাড়বে।
মানুষ কি খাচ্ছে তার পর ২০১০ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে দুধ খাওয়ার পরিমাণ গত দু দশেকে কমেছে, এর জায়গায় কোমল পানীয় পান বেড়েছে। অন্যদিকে এশিয়ায় দুধ খাওয়া বেড়েছে। ২০১৫ সালে ১৮৭টি দেশে চালানো আরেক জরিপে দেখা যায়, বয়স্কদের মধ্যে দুধ খাওয়া বাড়ছে, এর অর্থ হতে পারে তরুণদের মধ্যে দুধ অতোটা জনপ্রিয় নয়। কাজেই বিশ্বে দুধের প্রতি আকর্ষণ যেভাবে বাড়ছে - তাতে 'বিকল্প দুধ' যে তার জায়গা দখল করে নেবে, বা বাজারে আঘাত হানবে - এমন মনে হয় না।
তা ছাড়া সয়া, ওট বা আমন্ডের মতো বিকল্প দুধে দুধের মতো পুষ্টিগুণও নেই। এটা শুথু ভেগান বা দুধে এ্যালার্জি আছে এমন লোকদের জন্যই সুবিধাজনক।
এশিয়াতে দুধের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে সেটা বেশ বিস্ময়কর।
কারণ এশিয়াতে বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রেই বড় হবার পর তাদের দেহে দুধ হজম করার ল্যাকটেজ এনজাইম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
তুলনামূলকভাবে দুধের উপকারিতার চেয়ে অধিকাংশ এশিয়ানের ক্ষেত্রে এটা হজম করতে গিয়ে যে সমস্যা হয় - তার পরিমাণ বেশি।
উন্নয়নশীল কিছু দেশে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মানুষের মধ্যে লামার মতো অন্য প্রাণীর দুধ প্রচলিত করার চেষ্টা করেছে, কারণ এটা হয়তো গরুর দুধের চেয়ে সহজপ্রাপ্য বা সস্তা হবে।
এ বছরই জানুয়ারি মাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ জরিপে এমন কিছু বৈশ্বিক স্বাস্থ্যকর খাবারের কথা বলা হয়েছে - যাতে স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে, আবার পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম হবে।
এতে রেড মিট অর্থাৎ গরু-ছাগল-ভেড়ার মাংস ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ বা তার সমমানের কিছু খাবার কথা ঠিকই বলা হয়েছে।
সুতরাং মানুষের খাদ্য হিসেবে দুধ এখনো ভালোভাবেই টিকে আছে, এবং এখনো তার প্রসার হচ্ছে।
যদিও আমাদের দেহে এই দুধ হজম করার ক্ষমতার বিবর্তন থেমে গেছে।
সূত্রঃ বিবিসি
No comments