৫৭ শতাংশ লোক জানেনা তার ডায়াবেটিস by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
আনিসুল
হক ও তার স্ত্রী রেবা খাতুন দুইজনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের বয়স ৬০-এর
কাছাকাছি। তাদের প্রায়ই রাজধানীর শাহবাগে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে যেতে
হয়। প্রতিদিনই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুয়ায়ী ওষুধ খাওয়া ছাড়াও ৪০ মিনিট
হাঁটছেন তারা। খাওয়া-দাওয়া আগের চেয়ে অনেক নিয়ন্ত্রণে। শুধু আনিসুল হক
দম্পতি নয়, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা এভাবেই দিন পার করছেন।
বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে এই
রোগীর সংখ্যা অর্ধ কোটির উপরে।
বছরে বাড়ছে আরো ১ লাখ রোগী। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের ৫৭ শতাংশ লোক জানেন না যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০১৭ সালের হিসাব মতে, বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪২ কোটি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে রোগীর সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশমে। নানা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরও দেশের ডায়াবেটিক রোগীর মাত্র ২৫ ভাগকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। প্রতি বছর ১৪ই নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্যশিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তবে, উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ডায়াবেটিক রোগীর বৃদ্ধির হার বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফ উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন ডায়াবেটিস মহামারী আকার ধারণ করছে। ডায়াবেটিস যে হারে বাড়ছে তাতে এখনই এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ, স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। ঘন ঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। এক পর্যায়ে পৌঁছলে অনেক জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিস। তিনি জানান, সারা দুনিয়ার অর্ধেক রোগী জানে না তার ডায়াবেটিস হয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) সূত্র জানায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী বেশি। প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সমপ্রতি বাডাস কর্পোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে ৫০ কোটিতে। বাংলাদেশে আশির দশকে ডায়াবেটিস রোগী সংখ্যা ছিল যেখানে মাত্র ২ শতাংশ এটি এখন শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলে ৮ শতাংশ। এছাড়াও প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস-এর আগের ধাপ)-এর হার আরও প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বিএসএমএমইউ’র এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আশির দশকে যেখানে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ, সেখানে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের সামগ্রিক প্রবণতা ৮ শতাংশের মতো। এভাবে ক্রমশ ডায়াবেটিস বাড়তে থাকলে শুধু ডায়াবেটিসের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হবে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাছাড়া, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া, পায়ে পচন, এমনকি পা কেটে ফেলা পর্যন্ত লাগতে পারে। এত বড় বৈশ্বিক এই স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে দরকার জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা। সময়মতো ইন্টারভেনশন (খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন), নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যা শতকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এই সংখ্যা ২০ বছর আগে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছিল। এটা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ন ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই এই রোগে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডাযাবেটিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সেই শিশু পূর্ণবয়স্ক হবার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার জন্য একজন রোগীর মাসিক গড়ে ২ হাজার টাকা খরচ করতে হয় বলে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটোই প্রয়োজন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলছেন, সকল ডায়াবেটিক রোগীকে ট্যাবলেট খেতেই হয়। যেহেতু এর সঙ্গে অন্যান্য রোগ থাকে, এ ধরণের একটি রোগী কোন মতেই প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার নিচে চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মাহবুব। অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে। এ রোগের চিকিৎসা নিতে মানুষের আর্থিক চাপ যেমন বাড়ছে তেমনি মানুষের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। যেটি দেশেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এদিকে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিল বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)। গত ১০ বছরেও ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে এক অনুষ্ঠানে এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংঠনটির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান। তিনি জানান, গত দশ বছর এই সংক্রান্ত ফাইল এই মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয় ঘুরছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নীতিমালা কোনো মন্ত্রণালয় উপস্থাপন করবে তা নিয়েও চলছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বাডাস’র সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক ৫০ লাখ লোক এই রোগে আক্রান্ত। গ্রামের চেয়ে শহরে ডায়াবেটিসের রোগী বেশি। বহুবিধি কারণে এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে জীবন-যাত্রার পরিবর্তন, নগরায়ন, শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ইত্যাদি। তিনি জানান, দেশে ৫০ শতাংশ অপরিকল্পিত গর্ভবতি হচ্ছেন। ওই অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ৫৭ শতাংশ লোক জানেনা যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
২০০৮ সালে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে-ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচির অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে(যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে আজ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘আসুন, পরিবারকে ডায়াবেটিসমুক্ত রাখি’।
বছরে বাড়ছে আরো ১ লাখ রোগী। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের ৫৭ শতাংশ লোক জানেন না যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০১৭ সালের হিসাব মতে, বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪২ কোটি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে রোগীর সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশমে। নানা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরও দেশের ডায়াবেটিক রোগীর মাত্র ২৫ ভাগকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। প্রতি বছর ১৪ই নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্যশিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তবে, উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ডায়াবেটিক রোগীর বৃদ্ধির হার বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফ উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন ডায়াবেটিস মহামারী আকার ধারণ করছে। ডায়াবেটিস যে হারে বাড়ছে তাতে এখনই এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ, স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। ঘন ঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। এক পর্যায়ে পৌঁছলে অনেক জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিস। তিনি জানান, সারা দুনিয়ার অর্ধেক রোগী জানে না তার ডায়াবেটিস হয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) সূত্র জানায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী বেশি। প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সমপ্রতি বাডাস কর্পোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে ৫০ কোটিতে। বাংলাদেশে আশির দশকে ডায়াবেটিস রোগী সংখ্যা ছিল যেখানে মাত্র ২ শতাংশ এটি এখন শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলে ৮ শতাংশ। এছাড়াও প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস-এর আগের ধাপ)-এর হার আরও প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বিএসএমএমইউ’র এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আশির দশকে যেখানে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ, সেখানে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের সামগ্রিক প্রবণতা ৮ শতাংশের মতো। এভাবে ক্রমশ ডায়াবেটিস বাড়তে থাকলে শুধু ডায়াবেটিসের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হবে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাছাড়া, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া, পায়ে পচন, এমনকি পা কেটে ফেলা পর্যন্ত লাগতে পারে। এত বড় বৈশ্বিক এই স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে দরকার জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা। সময়মতো ইন্টারভেনশন (খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন), নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যা শতকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এই সংখ্যা ২০ বছর আগে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছিল। এটা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ন ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই এই রোগে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডাযাবেটিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সেই শিশু পূর্ণবয়স্ক হবার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার জন্য একজন রোগীর মাসিক গড়ে ২ হাজার টাকা খরচ করতে হয় বলে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটোই প্রয়োজন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলছেন, সকল ডায়াবেটিক রোগীকে ট্যাবলেট খেতেই হয়। যেহেতু এর সঙ্গে অন্যান্য রোগ থাকে, এ ধরণের একটি রোগী কোন মতেই প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার নিচে চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মাহবুব। অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে। এ রোগের চিকিৎসা নিতে মানুষের আর্থিক চাপ যেমন বাড়ছে তেমনি মানুষের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। যেটি দেশেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এদিকে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিল বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)। গত ১০ বছরেও ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে এক অনুষ্ঠানে এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংঠনটির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান। তিনি জানান, গত দশ বছর এই সংক্রান্ত ফাইল এই মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয় ঘুরছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নীতিমালা কোনো মন্ত্রণালয় উপস্থাপন করবে তা নিয়েও চলছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বাডাস’র সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক ৫০ লাখ লোক এই রোগে আক্রান্ত। গ্রামের চেয়ে শহরে ডায়াবেটিসের রোগী বেশি। বহুবিধি কারণে এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে জীবন-যাত্রার পরিবর্তন, নগরায়ন, শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ইত্যাদি। তিনি জানান, দেশে ৫০ শতাংশ অপরিকল্পিত গর্ভবতি হচ্ছেন। ওই অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ৫৭ শতাংশ লোক জানেনা যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
২০০৮ সালে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে-ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচির অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে(যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে আজ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘আসুন, পরিবারকে ডায়াবেটিসমুক্ত রাখি’।
No comments