যে কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম বাড়ছে by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
মোহাম্মদ
বিল্লাহ ও অন্তরা দম্পতির একমাত্র অপরিণত বয়সের শিশুর জন্ম হয় এই মাসের
প্রথম দিকে। অত্যন্ত ওজন কম হওয়ায় শিশুটি নানা সমস্যার কারণে জন্মের দুই
ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। অপর আরেক ইমা দম্পতির একমাত্র অপরিণত বয়সের শিশুর
জন্ম হয় গত চার বছর আগে। অত্যন্ত ওজন কম হওয়ায় (৯শ’৮০ গ্রাম) বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর নবজাতক আইসিইউতে (নিবির
পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র) ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শিশুটি নানা সমস্যায় ভুগছিল।
শিশুটিকে নিয়ে বাবা মা প্রায় দু’মাস অবস্থান করেন হাসপাতালটির নিউনেটালজি
বিভাগে। সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লাহ ও একই
বিভাগের অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল শিশুটি।
শিশুটির বাবা জানান, তার বাচ্চা স্বাভাবিক জন্মের আড়াই মাস আগেই জন্ম
নিয়েছে।
অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়ায় এক মাসের অধিক সময়ে শিশুটি ইনকিউবিটরে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তার শিশুটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে রাখার পরামর্শ দেন। এরপর থেকেই শিশুটিকে ইনকিউবিটরে, কখনোবা মায়ের কাছে কেএমসি পদ্ধতিতে প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা রাখাা হতো। এতে শিশুটির শারীরিক অবস্থা দ্রুত উন্নতি হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু এই দুই দম্পতির শিশুই নয়, দেশে বছরে সাড়ে ৪ লাখ অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর জন্ম হার বাড়ছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ শিশু সময়ের আগেই জন্ম নেয়। এদের মধ্যে ২৩ হাজার ৬০০ শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের পুষ্টিহীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে। এটি কমাতে, বাড়াতে হবে সচেতনতা আর নারীর ক্ষমতায়ন।
ইউনিসেফে’র তথ্যমতে, অপরিণত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর দশ দেশের মধ্যে সপ্তম। বাংলাদেশে প্রতি ১০টি শিশুর একটি অপরিণত শিশু জন্ম নেয়। উচ্চ আয়ের দেশের অপরিণত শিশু বেশি বেঁচে থাকে আর কম আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের শিশু বেশি বাঁচে না। এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের পুষ্টিহীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে, মায়ের ডায়াবেটিস, ধূমপান, দূষণ প্রভৃতি। বিশ্বে বছরে ১৫ মিলিয়ন তথা দেড় কোটি শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম গ্রহণ করে (মোট প্রসবের ৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ)।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরিণত শিশুরা অনেক সময় চোখে দেখে না, কানে শোনে না। তাই সঠিক সময়ে এদের পরীক্ষা করাতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে সঠিক ব্যবস্থা নিলে অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়। অপরিণত শিশুর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মৃত্যু কমাতে পারে মায়ের বুকের দুধ ও হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে বাচ্চা লালন-পালন করা। অপরিণত শিশুকে ক্যাঙ্গারু পদ্ধতিতে যত্ন নিয়ে তাদের মৃত্যু অনেক কমে যায়। তাই মাকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অপরিণত হয়ে জন্মালেও খুব সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। গর্ভকালীন উন্নত পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে অপরিণত শিশুর জন্ম রোধ করা যায়। শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৩৭ সপ্তাহের কম সময়ের আগেই অপরিণত শিশুর জন্মের হার ১৪ শতাংশ। এসব শিশুর ওজনও কম হচ্ছে। জন্মের সময়ে ২২ শতাংশ শিশুর ওজন আড়াই কেজিরও কম থাকে। অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়। শিশুদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে অনুপাত ১ দশমিক ২ শূন্য। অর্থাৎ ছেলে ১ দশমিক ২ শূন্য হলে মেয়ে শিশু একজন অপরিণত বয়সে জন্ম নিচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২৮ সপ্তাহেরও কম সময়ে জন্ম নেয় এমন শিশুর সংখ্যা ২২ হাজার।
অপরিণত শিশুর জন্মের সম্ভাব্য কিছু কারণ উল্লেখ করে শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, মায়ের পুষ্টিহীন, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, সাধারণত একটি শিশু জন্মের দু’বছর আগে আরেকটি শিশুর জন্ম হলে, মা স্থূলকায় হলে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে, হাইপারটেনশন থাকলে, গর্ভাবস্থায় মা একলাম্পশিয়ায় (কিচুনি) ভুগলে, গর্ভাবস্থায় মা রান্নার ধোঁয়ায় কাজ করলে, এজমা, গর্ভকালীন অবস্থায় পানি আগে ভাঙলে, গর্ভ অবস্থায় রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্ত শূন্যতা ইত্যাদি কারণে সন্তান অপরিণত হয়ে জন্মায় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কিশোরী বয়সে গর্ভবতী হলে অপরিণত বয়সের শিশু জন্মের ঝুঁকি থাকে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তা কমানো সম্ভব। কমপক্ষে দু’বছর অন্তর সন্তান নিলে এই ঝুঁকি এড়ানো যায় বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। গর্ভকালীন সঠিক যত্নবান হাওয়া, সময় মত ক্লিনিকে চেক আপ এবং নিরাপদ ডেলিভারি বা প্রসব অপরিণত শিশুর জন্মদান কমাতে সাহায্য করে। বিশ্বব্যাপী গুণগত স্বাস্থ্যসেবাই পারে অপরিণত বয়সে জন্মানো শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে। মায়ের বুকের দুধ, প্রত্যেক মা ও তার শিশুর উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা এধরনের শিশু মৃত্যু রোধে কাজ করে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) হচ্ছে, অপরিণত বয়সের শিশু ও কম ওজনের শিশুকে সুরক্ষা দেয়ার অন্যতম পন্থা।
এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, অপরিণত শিশু যাতে জন্ম না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপরিণত শিশু কেন জন্ম নেয়, এটা জানা উচিৎ। মা যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, তাহলে অপরিণত শিশু হতে পারে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া অপ্রাপ্ত বয়সে যদি মেয়ের বিয়ে হয়, তাহলেও অপরিণত শিশু জন্ম নিতে পারে। সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে চার ?লাখ শিশু অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়। অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে ২৬ হাজারের মতো শিশুর মৃত্যু ঘটে, যা মোট নবজাতকের মৃত্যুর হারের ৪৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ইনকিউবিটর নয়, মায়ের কাছে রেখেই অপরিণত শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির এ চিকিৎসা ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটালজি বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অপরিণত শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই, মায়ের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দিয়ে সাফল্য পাওয়া গেছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। মায়ের কাছে থাকলে বা ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার থাকলে শিশু উষ্ণতা পায়। মা শিশুর অবস্থা বুঝতে পারেন। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের পরে সর্বপ্রথম দিনাজপুরে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। রাজধানীর শিশু হাসপাতাল এই পদ্ধতি চালু হয় ২০১৩ সালে। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল সিএমসি চালুর প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরের জেলা শহরের হাসপাতালগুলোও ধারাবাহিকভাবে এই পদ্ধতি চালু করবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সামপ্রতি বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে শিশু ইনকিউবিটরের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে বা অধিক কার্যকর।
শিশু বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউর নিউনেটালজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নান এই বিষয়ে বলেন, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, এজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় পানি আগা ভাঙলে, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্ত শূন্যতা ইত্যাদি কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। কম বয়সে বিবাহ রোধ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে চেক আপ করা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে অপরিণত শিশুর জন্ম কমানো সম্ভব বলে এই শিশু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তিনি আরো জানান, বিএসএমএমইউর নিউনেটালজি বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে ৬০ শতাংশই হলো অপরিণত বয়সে জন্মা নেয়া শিশু। এই বিভাগের অপরিণত শিশু আসলে আমরা খুব জটিল না হলে ইনকিউবিটরে রাখি না। আমরা শিশুটিকে মায়ের কাছেই রাখি। মা শিশুকে আদর করে নিজের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে রাখেন। এতে করে শিশুটি মায়ের গায়ের উষ্ণতা পায় এবং বুকের দুধ পান করতে পারে প্রয়োজন হলে। শিশুটি কোন জটিলতায় ভুগলে মা-ই দ্রুত বুঝতে পারেন এবং চিকিৎসককে জানাতে পারেন। এতে শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে বাড়তি নার্সের প্রয়োজন হয় না। খরচের পরিমাণ অনেক কম হয়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৭ই নভেম্বর নানা উদ্যোগে বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস পালন করা হবে।
অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়ায় এক মাসের অধিক সময়ে শিশুটি ইনকিউবিটরে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তার শিশুটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে রাখার পরামর্শ দেন। এরপর থেকেই শিশুটিকে ইনকিউবিটরে, কখনোবা মায়ের কাছে কেএমসি পদ্ধতিতে প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা রাখাা হতো। এতে শিশুটির শারীরিক অবস্থা দ্রুত উন্নতি হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু এই দুই দম্পতির শিশুই নয়, দেশে বছরে সাড়ে ৪ লাখ অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর জন্ম হার বাড়ছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ শিশু সময়ের আগেই জন্ম নেয়। এদের মধ্যে ২৩ হাজার ৬০০ শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের পুষ্টিহীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে। এটি কমাতে, বাড়াতে হবে সচেতনতা আর নারীর ক্ষমতায়ন।
ইউনিসেফে’র তথ্যমতে, অপরিণত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর দশ দেশের মধ্যে সপ্তম। বাংলাদেশে প্রতি ১০টি শিশুর একটি অপরিণত শিশু জন্ম নেয়। উচ্চ আয়ের দেশের অপরিণত শিশু বেশি বেঁচে থাকে আর কম আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের শিশু বেশি বাঁচে না। এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের পুষ্টিহীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে, মায়ের ডায়াবেটিস, ধূমপান, দূষণ প্রভৃতি। বিশ্বে বছরে ১৫ মিলিয়ন তথা দেড় কোটি শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম গ্রহণ করে (মোট প্রসবের ৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ)।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরিণত শিশুরা অনেক সময় চোখে দেখে না, কানে শোনে না। তাই সঠিক সময়ে এদের পরীক্ষা করাতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে সঠিক ব্যবস্থা নিলে অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়। অপরিণত শিশুর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মৃত্যু কমাতে পারে মায়ের বুকের দুধ ও হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে বাচ্চা লালন-পালন করা। অপরিণত শিশুকে ক্যাঙ্গারু পদ্ধতিতে যত্ন নিয়ে তাদের মৃত্যু অনেক কমে যায়। তাই মাকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অপরিণত হয়ে জন্মালেও খুব সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। গর্ভকালীন উন্নত পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে অপরিণত শিশুর জন্ম রোধ করা যায়। শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৩৭ সপ্তাহের কম সময়ের আগেই অপরিণত শিশুর জন্মের হার ১৪ শতাংশ। এসব শিশুর ওজনও কম হচ্ছে। জন্মের সময়ে ২২ শতাংশ শিশুর ওজন আড়াই কেজিরও কম থাকে। অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়। শিশুদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে অনুপাত ১ দশমিক ২ শূন্য। অর্থাৎ ছেলে ১ দশমিক ২ শূন্য হলে মেয়ে শিশু একজন অপরিণত বয়সে জন্ম নিচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২৮ সপ্তাহেরও কম সময়ে জন্ম নেয় এমন শিশুর সংখ্যা ২২ হাজার।
অপরিণত শিশুর জন্মের সম্ভাব্য কিছু কারণ উল্লেখ করে শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, মায়ের পুষ্টিহীন, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, সাধারণত একটি শিশু জন্মের দু’বছর আগে আরেকটি শিশুর জন্ম হলে, মা স্থূলকায় হলে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে, হাইপারটেনশন থাকলে, গর্ভাবস্থায় মা একলাম্পশিয়ায় (কিচুনি) ভুগলে, গর্ভাবস্থায় মা রান্নার ধোঁয়ায় কাজ করলে, এজমা, গর্ভকালীন অবস্থায় পানি আগে ভাঙলে, গর্ভ অবস্থায় রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্ত শূন্যতা ইত্যাদি কারণে সন্তান অপরিণত হয়ে জন্মায় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কিশোরী বয়সে গর্ভবতী হলে অপরিণত বয়সের শিশু জন্মের ঝুঁকি থাকে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তা কমানো সম্ভব। কমপক্ষে দু’বছর অন্তর সন্তান নিলে এই ঝুঁকি এড়ানো যায় বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। গর্ভকালীন সঠিক যত্নবান হাওয়া, সময় মত ক্লিনিকে চেক আপ এবং নিরাপদ ডেলিভারি বা প্রসব অপরিণত শিশুর জন্মদান কমাতে সাহায্য করে। বিশ্বব্যাপী গুণগত স্বাস্থ্যসেবাই পারে অপরিণত বয়সে জন্মানো শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে। মায়ের বুকের দুধ, প্রত্যেক মা ও তার শিশুর উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা এধরনের শিশু মৃত্যু রোধে কাজ করে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) হচ্ছে, অপরিণত বয়সের শিশু ও কম ওজনের শিশুকে সুরক্ষা দেয়ার অন্যতম পন্থা।
এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, অপরিণত শিশু যাতে জন্ম না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপরিণত শিশু কেন জন্ম নেয়, এটা জানা উচিৎ। মা যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, তাহলে অপরিণত শিশু হতে পারে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া অপ্রাপ্ত বয়সে যদি মেয়ের বিয়ে হয়, তাহলেও অপরিণত শিশু জন্ম নিতে পারে। সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে চার ?লাখ শিশু অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়। অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে ২৬ হাজারের মতো শিশুর মৃত্যু ঘটে, যা মোট নবজাতকের মৃত্যুর হারের ৪৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ইনকিউবিটর নয়, মায়ের কাছে রেখেই অপরিণত শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির এ চিকিৎসা ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটালজি বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অপরিণত শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই, মায়ের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দিয়ে সাফল্য পাওয়া গেছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। মায়ের কাছে থাকলে বা ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার থাকলে শিশু উষ্ণতা পায়। মা শিশুর অবস্থা বুঝতে পারেন। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের পরে সর্বপ্রথম দিনাজপুরে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। রাজধানীর শিশু হাসপাতাল এই পদ্ধতি চালু হয় ২০১৩ সালে। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল সিএমসি চালুর প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরের জেলা শহরের হাসপাতালগুলোও ধারাবাহিকভাবে এই পদ্ধতি চালু করবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সামপ্রতি বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে শিশু ইনকিউবিটরের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে বা অধিক কার্যকর।
শিশু বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউর নিউনেটালজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নান এই বিষয়ে বলেন, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, এজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় পানি আগা ভাঙলে, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্ত শূন্যতা ইত্যাদি কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। কম বয়সে বিবাহ রোধ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে চেক আপ করা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে অপরিণত শিশুর জন্ম কমানো সম্ভব বলে এই শিশু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তিনি আরো জানান, বিএসএমএমইউর নিউনেটালজি বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে ৬০ শতাংশই হলো অপরিণত বয়সে জন্মা নেয়া শিশু। এই বিভাগের অপরিণত শিশু আসলে আমরা খুব জটিল না হলে ইনকিউবিটরে রাখি না। আমরা শিশুটিকে মায়ের কাছেই রাখি। মা শিশুকে আদর করে নিজের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে রাখেন। এতে করে শিশুটি মায়ের গায়ের উষ্ণতা পায় এবং বুকের দুধ পান করতে পারে প্রয়োজন হলে। শিশুটি কোন জটিলতায় ভুগলে মা-ই দ্রুত বুঝতে পারেন এবং চিকিৎসককে জানাতে পারেন। এতে শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে বাড়তি নার্সের প্রয়োজন হয় না। খরচের পরিমাণ অনেক কম হয়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৭ই নভেম্বর নানা উদ্যোগে বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস পালন করা হবে।
No comments