কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন ২৫২ রান করল আবদুর রাজ্জাকের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের সুবাদে, তখন মনে হচ্ছিল, জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে হয়তো আমরা জিতেই যাচ্ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেটের হার। কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। কিন্তু এর চেয়েও অনেক বড় বড় দুঃসংবাদে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো আকীর্ণ হয়ে আছে। সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েই চলেছে। আমরা সংখ্যা হিসাব করছি। কিন্তু মানুষ তো কোনো সংখ্যা নয়। প্রত্যেক মানুষই মানুষ। যে যায়, সে আর ফিরে আসে না। তার পরিবার-পরিজন বোঝে, স্বজন হারানোর বেদনা কাকে বলে। এই অবস্থায় আরও একটা মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগ। হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে এসে আর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।তাদের নেতারা সব সময় বলে এসেছেন, তাঁদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তাঁরা কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা বা জ্বালাও-পোড়াও নীতিতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ৫ মে ২০১৩ দিনভর জ্বলল আগুন। স্থাপনা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ—পরিস্থিতি হয়ে উঠল ভয়াল। হেফাজতের নেতারা বলে আসছেন, তাঁরা কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন করছেন না, কাউকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্যও না। কিন্তু স্পষ্টতই দেখা গেল, তাঁরা সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিলেন, তাঁরা বললেন, তাঁরা আর বাড়ি ফিরে যাবেন না, বিএনপিও ঘোষণা করল, হেফাজতের পাশে দাঁড়ান। হেফাজতের ১৩ দফা অরাজনৈতিক নয়, তাদের কর্মসূচিও অরাজনৈতিক নয়, কিন্তু তা কেবল সরকার উৎখাতের রাজনৈতিক কর্মসূচির রূপই পরিগ্রহ করল না, তা সহিংস কর্মসূচিতে পরিণত হলো। পরিস্থিতি ক্রমেই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, সরকার শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতের মতিঝিলের অবস্থান ভেঙে দিতে সমর্থ হলো। মহানগর পুলিশ সব ধরনের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বিএনপিও তাদের ৬ মের সমাবেশ বা অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিল। দেখা যাচ্ছে, কেউ কথা রাখেনি। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের হয়তো একটা যোগাযোগ ছিল, যেটা হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ৫ মের উক্তিতেই বোধগম্য, তিনি বলছিলেন, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াত-শিবির, এটা হেফাজতের কাজ নয়, তখনো হয়তো তিনি আশা করছিলেন, সন্ধ্যার দিকে হেফাজত তাদের কর্মসূচি শেষ করে বাড়ি ফিরে যাবে। তা হয়নি। হেফাজত কথা রাখেনি। হেফাজতের নেতারা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলছিলেন, ঘেরাও কর্মসূচি সমাপ্ত করার জন্য তাঁদের একটা সমাবেশ বিকেলে হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, মতিঝিলের সমাবেশটা তাঁরা করতে চেয়েছিলেন সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে, ৫ মের ঢাকা ঘেরাওয়ের সমাপ্তি টানার জন্য নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, সবগুলো পক্ষই সমস্যা সমাধানের জন্য যতগুলো বিকল্প ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপটা বেছে নিয়েছে। ৪ এপ্রিলের মহাসমাবেশ থেকেই হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তারা ৫ মে ঢাকা ঘেরাও করতে আসবে। এই এক মাসে বড় বড় আওয়াজ দেওয়া ছাড়া সরকার আর আওয়ামী জোট নেতারা আর কী করেছেন? আগেই বলেছি, হেফাজতের দাবিগুলো রাজনৈতিক, তাদের কর্মসূচিও রাজনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য। রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখলে তা সমাধানের জন্য ভুল পথ অবলম্বন করতে প্ররোচিত করে। বোঝাই যাচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে হেফাজতের একটা সমঝোতা হয়েছে, সরকার সেটা আগে থেকে টের পেল না? যদি শক্তি প্রয়োগই করতে হয়, সেটাও তো করা যেত আগে থেকে, ঢাকায় এতগুলো মানুষকে সমবেত হতে দিয়ে তারপর শক্তি প্রয়োগ করাটা কি সবচেয়ে খারাপ বিকল্পটাকেই বেছে নেওয়া নয়? সরকারের কাছে তথ্য থাকবে না? তারা জানবে না, হেফাজত কী করতে চাইছে, বিএনপি কী করতে চাইছে হেফাজতে ইসলাম কি বিএনপির ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হলো না? তারা যা এত দিন ধরে বলে আসছে, তারা শান্তিকামী, তাদের সব কর্মসূচি হয় অহিংস, তাদের সেই কথারই বা মূল্য থাকল কোথায়? আর বিএনপির যেনতেন প্রকারে চাই ক্ষমতা। তারা নিজেরা বড় সমাবেশ করতে পারে না, বড় আন্দোলন করতে পারে না, হরতালে দেখা যায়, একটা ব্যানার যত বড়, তার পেছনে তাদের সংগঠন বা অঙ্গসংগঠনগুলোর এতজন কর্মীও জোটে না, যাতে ব্যানারটার পেছনে এক সারি লোক পাওয়া যায়। এই অবস্থায় বিএনপি একবার জামায়াতকে, একবার হেফাজতে ইসলামকে সরকার উৎখাতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। বিএনপির নিজেদের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ, নিজেদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি আছে কি না, তা ভাবার সময় কই, আগে তো সরকারকে বিপদে ফেলো। জামায়াতে ইসলামীর জন্য এটা তো প্রায় মরণপণ লড়াই, তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচার হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, তারা যে করেই হোক, এই সরকারের শাসনের অবসান চায়। এই অবস্থায় সরকার ঘটনাটাকে এত দূর পর্যন্ত গড়াতে দিল এবং শেষ পর্যন্ত শক্তি প্রয়োগ করল। তার ফল কী হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো এর রেশ আমাদের বহু বছর ধরে টানতে হবে। আমরা সব পক্ষকেই বলব, শান্তির পথই শ্রেষ্ঠ পথ। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য। গণতন্ত্রেরও কোনো বিকল্প নেই। এমন কোনো কর্মসূচি কোনো পক্ষেরই দেওয়া উচিত নয়, যা প্রাণহানি, সম্পদহানির কারণ হয়, যা দেশে শান্তিশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। এমন কোনো কর্মসূচি নেওয়া উচিত নয়, যাতে দেশে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। মতিঝিল থেকে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকারীদের বল প্রয়োগে সরিয়ে দিয়ে, বিএনপিকে ৬ মের সমাবেশ বা অবস্থান কর্মসূচি থেকে নিরত রেখে সরকার হয়তো ভাবতে পারে, একটা বড় বিপর্যয় তারা সামলাতে পারল। কিন্তু শক্তি প্রয়োগে বিক্ষুব্ধ মানুষকে বিতাড়িত করলেই কি বিক্ষোভের অবসান ঘটবে? যদি কোথাও ধোঁয়া দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে আগুনও আছে। হেফাজতে ইসলাম কিংবা ডানপন্থী দলগুলো যখন এত মানুষের সমাবেশ করতে পারে, তখন বুঝতে হবে, সে শক্তি তারা এক দিনে অর্জন করেনি! ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণীভেদ থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি শক্তির প্রণোদনা—নানা রসায়ন কাজ করেছে বহু বছর ধরে। কওমি মাদ্রাসায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী। তাদের সমাজের বিভিন্ন পেশায় দক্ষতার সঙ্গে নিয়োজিত হওয়ার মতো শিক্ষা কি আমরা দিয়েছি? আজ তারা তাদের ভাগ যদি চাইতে আসে, তখন আমরা হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, এরা কারা? এরা আমাদেরই ছেলেমেয়ে, যাদের মনের বেদনা আমরা কোনো দিনও বোঝার চেষ্টা করিনি। এর সঙ্গে আছে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সর্বত্র দুর্নীতি, দলীয়করণ, দখলবাজি, অপশাসন, সন্ত্রাস। আছে বিচারহীনতা। আইনের শাসন না থাকা। সরকারি নেতারা অজনপ্রিয়। অনেকে এলাকায় যেতে পারেন না, এলাকাবাসীর সামনে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা তাঁদের নেই। মানুষ যে ভোটের মাধ্যমে বিকল্প বেছে নেবে, সে আশাও খুব দেখা যায় না, ছিল একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তাও উঠে গেছে। আর মানুষের সামনে খুব বিকল্পও কিছু নেই। সেই বিএনপি, সেই আওয়ামী লীগ। সেই চিরপুরাতন অগণতান্ত্রিক আচরণ। কেউ বা পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি করে, কেউ বা সিঙ্গাপুরে টাকা পাঠিয়ে কলঙ্কিত হয়। এত কিছুর মধ্যেও দেশের সাধারণ মানুষ দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা খেতে-খামারে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, দেশে-বিদেশে নিজের আয় উন্নতির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করছেন, তার মাধ্যমে দেশটাও বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁদের পথে বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংঘাতময় রাজনীতি। আমাদের রাজনীতিকে অবশ্যই উন্নয়নবান্ধব হতে হবে। প্রথম শর্ত হলো শান্তি। শান্তিশৃঙ্খলা না থাকলে কিছুই থাকে না। কিন্তু বল প্রয়োগ করে শান্তি অর্জিত হয় না। কৌশলী হতে হয়। উদার ও সহনশীল হতে হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করতে হয়। কথাগুলো অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে। জানি অরণ্যে রোদন করাই হচ্ছে। তবু বলার কথাটা বলে যেতেই হবে। রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই খুঁজে বের করতে হবে। আর তা করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই। ৫ মের ঘটনা এত দূর পর্যন্ত ঘটতে পারল কেন, এটা অবশ্যই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। আর এর পরিণতি কীভাবে আমাদের দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি সামলাবে, তাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সমাজে অনেক মত থাকবে, পথ থাকবে। বিভিন্ন আদর্শ থাকবে, বিভিন্ন জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মানুষ থাকবে। সবাইকে রাষ্ট্রে ও সমাজে তার জায়গায় অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে থাকতে দিতে হবে। আমরা এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিনাশ চাইছি। সেটা হয় না। হানাহানি সমস্যার সমাধান আনে না, সমস্যা বাড়ায়। আমাদের দুর্বল অর্থনীতির দেশে আমরা হানাহানির ধকল সামলাতে পারব না। আমাদেরকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটা পথ বের করতে পারতেই হবে। কিন্তু যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা স্থায়ী করার নেশায় উন্মত্ত রাজনীতির দাবানলে আর কত জীবনকে বলি হতে হবে, আমরা জানি না। আমরা খুব খারাপ একটা সময় অতিক্রম করছি। শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাস হয়ে উঠেছে। আমাদের কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। আজ নেই, কিন্তু আগামীকাল সুসংবাদ পাব, এই আশাও নেই।
No comments