যুক্তি তক্ক ভাষা by মাসুদুজ্জামান
বাঙালির
হয়তো এটাই স্বভাব কিনা জানি না, সে কথা বলতে ভালোবাসে, তর্ক করতে
ভালোবাসে। কথা বলে সে সমস্ত আবেগ দিয়ে, শরীর দিয়ে। মানুষমাত্রেই এভাবে কথা
বলে। কিন্তু বাঙালিমাত্রেই নিজের বলা কথাকে যেভাবেই হোক প্রতিষ্ঠিত করার
জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আর এজন্যে সে অনর্গল কথা বলে যায়। এই সেই বাঙালি, যে
হয়তো ট্রেনে চেপে কোথাও যাচ্ছেন, কিংবা কোনো মহাসড়ক দিয়ে হু হু করে ছুটে
চলেছে তার বাস, কিংবা কিছুটা মন্থর কোনো যান- লঞ্চে চেপে যাচ্ছেন দূর কোনো
গন্তব্যে- কথা বলার লোক তার চাই-ই চাই। অচেনা সহযাত্রীকে তাই সহজেই সে আপন
করে নিয়ে নিজের কথার ‘শ্রোতা’ বানিয়ে নেন। আড্ডা হলে তো কথাই নেই। সবাই
সেখানে চেনা-জানা, সবার সঙ্গে সহজ সম্পর্ক, ফলে কথার তুবড়ি ছোটে।
টেলিভিশনের টক শোতে দেখি কথার এই অনর্গল অবিরল স্রোত। জনসভায় যারা কথা
বলেন, তাদের কথাও থামতে চান না। সংসদেও এই কথার সংকীর্তন। কখনো কখনো প্রকৃত
সঙ যারা, তারাও কোনো কোনো সাংসদের কথা শুনলে পেশাদারিত্বের কথা ভুলে যেতে
পারেন।
এই যে চারপাশে এত কথা আর কথা, আমাদের কর্ণপীড়ন আর মনোপীড়নের কারণ ঘটাচ্ছে, এসব কথার আদৌ কোনো সারবস্তু আছে কী? মানুষের কথা নিয়ে যেসব গবেষকদের কারবার, সেই ভাষাবিদরা বলছেন, আমরা দুই ধরনের কথা বলি- একটা হলো কেজো কথা, আরেকটা প্রতিদিনের সাদামাঠা কথা। কেজো কথা হলো প্রয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ কথা আর প্রতিদিনের জীবনযাপনের প্রয়োজনে যেসব কথা বলি, সেসব হচ্ছে সাধারণ কথা। সব কথারই কমবেশি গুরুত্ব আছে, তবে কেজো কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। কেজো কথাকেই আমরা নানা ভারি ভারি নামে চিহ্নিত করেছি- ‘বক্তৃতা’, ‘ভাষণ’, ‘অভিভাষণ’, ‘টক শো’, ‘বিতর্ক’ ইত্যাদি।
নামে যতই ভারি হোক, কথার মধ্যে যদি সারবস্তু না থাকে, তাহলে সে-কথা যে মাঠে মারা যায়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কথাকে তাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হয়, তা সে বক্তৃতাই হোক কিংবা বিতর্ক। ওই ভাষাবিদ বা যোগাযোগবিদরাই জানাচ্ছেন, সেই কথাই এখন গুরুত্বপূর্ণ যাকে আমরা চিন্তা ও মননের সঙ্গে অবিমিশ্র করে উপস্থাপন করে থাকি। অর্থাৎ সহজ সরল কথা নয়, কথার মধ্যে থাকতে হবে ভাবনা ও মননের গভীরতা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সরলভাবে উপস্থাপন না করে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে। আমরা যাকে বলি ‘কথার ধার’, গুরুত্বপূর্ণ কথায় থাকতে হবে এই ধার। ভাষাযোগাযোগবিদরা একেই ইংরেজিতে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা সাহিত্য সমালোচক, তার্কিক তাদের কথাও এই চিন্তনের অন্তর্ভুক্ত। কোনো বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ মূলত এই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক কথপোকথনের এটাই হচ্ছে প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে-কোনো বিষয়কে ক্রিটিক্যালি দেখতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু এই ক্রিটিক্যাল বা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বুঝবো আমরা?
বাঙালিদের স্বভাব নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘ছিদ্রান্বেষী’। ক্রিটিক্যাল চিন্তা মূলত এই ছিদ্রান্বেষণই, তবে শুধু ত্র“টি খুঁজে বের করে প্রতিপক্ষকে আত্মভাবনার দ্বারা রক্তাক্ত করা নয়, জর্জরিত করা নয়; প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটা যৌক্তিক বয়ান বা ডিসকোর্স দাঁড় করানোই হচ্ছে সমালোচনামূলক চিন্তনের মূল কথা। ফলে তা হয়ে দাঁড়ায় যুক্তি ও যুক্তির চর্চাবিশেষ। দার্শনিকরাই সমালোচনামূলক চিন্তনের উদ্ভাবক। জগত ও জীবনের কথা বলতে গিয়ে তারা যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন, সেটাই হচ্ছে সমালোচনামূলক ভাবনার ভিত্তি। তবে এই চিন্তন বহুমুখী। উদ্দেশ্যের ব্যাপকতা লক্ষ্য করবার মতো। কেউ বলেছেন সমালোচনামূলক চিন্তন একধরনের দক্ষতা যে দক্ষতা থাকলে প্রতিপক্ষ কীধরনের যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে কিংবা কী বলা হলো, অথবা প্রতিপক্ষের যুক্তির ত্র“টিপূর্ণ দিকগুলি সম্পর্কে ঠিক ঠিক বোঝা সহজ হয়। কেউ কেউ বলেন, সমালোচনামূলক চিন্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে এটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারলে যে-কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা অর্জিত হয়। কীভাবে একটা বিষয়কে সমালোচনা করা যায়, সেই কৌশলও একজন তার্কিক আয়ত্ত করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা কৌশল অর্জন করা গেলে প্রতিপক্ষের যুক্তিকে অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত করে দেওয়া যায়, যে-কোনো বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। উপযুক্ত যুক্তির জাল বিস্তার করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া যায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তরে এভাবেই গভীর জ্ঞান ও যুক্তির অধিকারী হতে পারলে, কেউ কেউ মনে করেন, যে-কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচক বা তার্কিক চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সমকালের এরকম পাঁচজন শিক্ষাদার্শনিক রবার্ট এনিস, রিচার্ড পল, জন মেপেক, হার্ভে সিয়েজেল এবং জেন রোনাল্ড মার্টিন এভাবেই ক্রিটিক্যাল চিন্তনকে চিহ্নিত করেছেন। সিয়েজেল খুব স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন সমালোচনামূলক চিন্তনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট বিষয়জ্ঞান এবং যুক্তির সম্পর্ক গভীর।
লক্ষণীয়, সিয়েজেল সাধারণ সাদামাঠা যুক্তি নয়, বলেছেন ক্রিটিক্যাল রিজনিং বা সমালোচনামূলক যুক্তির কথা। একজন সমালোচক এভাবেই সমালোচনামূলক চিন্তক হয়ে উঠতে পারেন। তিনি যুক্তির কথা বলতে গিয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন জ্ঞানতত্ত্বের ওপর। জেন মার্টিন আবার এই জ্ঞানতাত্ত্বিক জ্ঞান বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। অর্থাৎ একমুখী কোনো জ্ঞান নয়, জ্ঞানের নানা শাখায় একজন তার্কিকের বিচরণ থাকা আবশ্যিক। অর্থাৎ জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা দিক সম্পর্কে তাকে অবহিত হতে হবে, বহুত্বধর্মী ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এই জ্ঞানই হচ্ছে সমালোচনামূলক যুক্তির মূল ভিত্তি। কার্ল আসস্টোন এই ভাবনাকে আরেকটু বিস্তৃত করে বলেছেন, সমালোচনামূলক চিন্তককে “বহুমুখী মানবীয় সমস্যা সম্পর্কে আগ্রহী হতে হবে আর তাকে চিন্তা, কর্মতৎপরতা, প্রকাশ এবং এদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক কী, সে-সব বিষয়ে অবহিত হতে হবে।”
মানবীয় চিন্তন ও চিন্তার প্রকাশ মূলত গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিস্তৃত ও গভীরতর হয়ে উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসা তৈরি হবার ফলে আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় মানুষ জ্ঞানচর্চায় যেমন জড়িয়ে পড়েছে, তেমনি উৎপাদন করছে বিপুল জ্ঞান। ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের সূত্রে উৎপাদিত এই জ্ঞানের বিপুল বিস্তার এখন একটা সাধারণ ঘটনামাত্র। প্রযুক্তি আমাদের জ্ঞানচর্চাকে শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছে না, মানুষকে বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী করে তুলছে, একেবারে দৈনন্দিন পঠনপাঠনের সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছে। অসংখ্য ছাপা গ্রন্থ এখন ইবুকের আকারে অন্তর্জালেই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে নানা তত্ত্ব ও ভাবনার সৃষ্টিতে। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বভাবনার আবির্ভাবে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার এতটাই স্ফীত হয়ে উঠেছে যে, যারা চিন্তক, ভাবুক, সমালোচক, তার্কিক, তাদের এই উৎপাদিত জ্ঞানচর্চার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাধারণ ভাবনার পরিবর্তে ভাবুকেরা এই সময় থেকেই জড়িয়ে পড়েছেন সমালোচনামূলক ভাবনায়। বিশ শতকের ভাবনার ইতিহাস মূলত এই সমালোচনামূলক চিন্তনের ইতিহাস। সর্বজনীন যুক্তি এবং কার্যকারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন দার্শনিক ও ভাবুকেরা। ফলে চিন্তার ধরনও অনেকখানি পাল্টে গেছে। এই লেখায় সবার সম্পর্কে নয়, আমি নীৎসে, হাইদেগার, ভিটগেনস্টাইন এবং উত্তর-কাঠামোবাদী ফরাসি ভাবুকেরা যে নতুন চিন্তনের কথা বলেছেন, সেই ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সমালোচনামূলক ভাবনার সমগ্র ডিসকোর্স মূলত পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। এই ভাবনা, বলাবাহুল্য, শুরু হবে কান্টকে দিয়ে। এরপর দ্বিমুখী ধারায় তা অগ্রসর হয়েছে : এর একটি ধারার প্রবক্তা হচ্ছেন হোর্খেমার এবং আরেকটির আদোর্নো। চতুর্থ স্তরে আবির্ভাব ঘটছে হাবেরমাসের। সবশেষে পাওয়া যাবে ভিটগেনস্টাইন, ফুকো ও লিয়োতার্দের ভাবনাচিন্তনের সূত্রগুলি। বলা নিষ্প্রয়োজন, যুক্তিভাবনার ইতিহাস মূলত দর্শনের ইতিহাস। কান্ট তাই বলেছিলেন, “দর্শন হচ্ছে সবধরনের জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্কিত এক বিজ্ঞান, মানবীয় যুক্তিবোধের মধ্য দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটে।” হাইদেগার তার লেখা ‘কাকে বলে চিন্তন’ (১৯৬৮) শীর্ষক একটি বক্তৃতামালা শুরুই করেছিলেন এইভাবে : “আমরা যখন চিন্তা করতে বসি তখনই কেবল বুঝতে পারি চিন্তা বলতে কী বোঝায়। যদি তাতে সফল হই তাহলে চিন্তা কী জিনিস তা আমরা শিখে ফেলি।” হাইদেগারের মতে যদিও আমরা চিন্তা জাগানিয়া একটা জ্বলন্ত সময়ের মানুষ, তবু আমরা চিন্তা করতে শিখিনি। তাই চিন্তার স্বরূপ-প্রকৃতি বুঝতে হলে, হাইদেগার বলছেন, আমাদের একটা বিষয়কে নানাভাবে ভাবতে হবে, চিন্তা করতে শিখতে হবে।
হাইদেগারের আরেকটা বই- ‘কবিতা, ভাষা ও চিন্তন’ (১৯৭১)-এর ভূমিকায় সম্পাদক আলবেয়ার হফ্সটাটার হাইদেগারের ভাষার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, হাইদেগার নিজের একটা শৈলী আছে। তিনি একজন মৌলিক চিন্তাবিদ। তার একটা দুটো বাক্যই তাকে ভিটগেস্টাইন, রাসেল অথবা হোয়াইটহেড থেকে তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। হফ্সটাটার এইখানে মানবীয় চিন্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি হলো ভাষার দিক। অর্থাৎ চিন্তনের সঙ্গে ভাষার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ভাষার মধ্য দিয়েই আমরা সবকিছু ভাবি আবার তা প্রকাশও করি ভাষা দিয়ে। চিন্তাই এখানে হয়ে উঠেছে অনন্য এক শৈলী।
পশ্চিমী দর্শনে হাইদেগার নানা ধরনের ভাবনার উদ্ভাবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে চিন্তন আসলে কী, এই ধারণাটি গঠন করে দিয়েছেন তিনি।
হাইদেগারের মতে চিন্তন বা ভাবনা হলো : (১) সাধারণ বিশ্বাস বা ধারণা বা ডক্সা : এটি আমাদের ভাবনা, মতামত গঠন করে দেয় (মতপ্রকাশ); (২) ‘প্রতিনিধিত্বশীলতা’ : বিশেষ কোনো অবস্থাকে প্রকাশ করা (প্রতিনিধিত্ব); (৩) ‘যুক্তিশীলতা’ : ধারাবাহিকভাবে কোনো ভাবনাকে গঠন করে উপসংহারে পৌঁছানো (যুক্তির ক্রম অনুসরণ); (৪) ‘সমস্যার সমাধান’ : বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা (সমস্যার সমাধান করা); (৫) ‘বেরিফ’ (হেগেল) : ধারাবাহিক ভাবনা ও ভাবনার গঠন (অনুধাবন); (৬) সর্বজনীনতার সূত্র অনুসারে কোনো বিষয় সম্পর্কে বোঝা অথবা ব্যাখ্যা করা (বাস্তবোচিত বিচার-বিবেচনা); (৭) যা কিছু অপ্রকাশিত রয়ে গেছে তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা বা প্রকাশ করা (সত্তার অর্থ উন্মোচন- হাইদেগারীয় ভাবনা); (৮) ‘হয়ে ওঠা’র এক প্রক্রিয়া (হাইদেগারের উত্তর-পরাতাত্ত্বিক চিন্তন)। আগেই উল্লেখ করেছি, হাইদেগার কাব্যচিন্তার বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেও একটি বই লিখেছিলেন। কবিতার ভাষা, বিশেষ করে এর চিন্তাসূত্র যে ভিন্ন সেকথা তিনি ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন। হাইদেগারের ভাবনাতেই মূলত বিভিন্ন ধরনের চিন্তনের পরিচয় পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ধরনের চিন্তার পাশাপাশি সমালোচনামূলক চিন্তাকেও তিনি নানা সময়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মানবীয় ভাবনা বা চিন্তন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে, বিশেষ করে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর যে রূপান্তর ঘটে, হাইদেগার সেকথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক কালে, এমনকি এই সময়েও আমরা জানি, কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে নানা তথ্য বিন্যাসের নানা প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার ঘটছে। উত্তর-আধুনিক দুই ভাবুক-দার্শনিক লিয়োতার এবং দেলেউজ সমকালীন এই চিন্তনকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : প্রথমত, চিন্তা হচ্ছে তথ্য-প্রক্রিয়াকরণ (জ্ঞানতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞান); দ্বিতীয়ত, চিন্তা হচ্ছে মেটান্যারেটিভ বা পরাবর্ণনা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা : বর্ণনা বা পরাবর্ণনার সমালোচনা - এর মধ্য দিয়ে কোনো বর্ণনার মধ্যে যে আরও অতিরিক্ত কিছু থাকতে পারে তার বিশ্লেষণ (লিয়োতার্দ); তৃতীয়ত, চিন্তা হচ্ছে ধারণার গঠন : দর্শনায়িত করা (দেলেউজ)।
চিন্তা বা সমালোচনার বিষয়টি তাই বহুমুখী, অর্থাৎ চিন্তার রয়েছে না ধরন, নানা রূপ। বিভিন্ন দার্শনিক এই বহুত্বধর্মী চিন্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, হাইদেগার থেকে ভিটগেনস্টাইন পর্যন্ত চিন্তার এই বিশ্লেষণ প্রসারিত হয়ে আছে। ভিটগেনস্টাইনের মতে দর্শন হচ্ছে এমন একধরনের ভাবনামূলক কর্ম যা বিজ্ঞান থেকে পৃথক একটি বিষয় হিসেবে দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেয়। তিনি বলেছেন, ব্যাকরণ যুক্তির কার্যকারণ সূত্র থেকে আলাদা। ভাষা ও জ্ঞান ভাষাতত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সঙ্গে কতটা যুক্ত তা দেখার খুব প্রয়োজন নেই। একসময় যাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো, সেই ‘শব্দার্থতাত্ত্বিক ঈশ্বরবাদে’র মৃত্যু ঘটে গেছে। ভিটগেনস্টাইন এভাবেই তার বিশ্লেষণী দর্শনের তত্ত্বটি হাজির করেছেন। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বৈশ্লেষিক/সংশ্লেষী, পরিকল্প/আধেয়র মধ্যেকার পার্থক্য। এরই ওপর ভিত্তি করে তিনি বৈশ্লেষিক দর্শনের বিষয়টিকে আরও সুসংহত করেছেন। এখানে বলা প্রয়োজন, যারা তার্কিক বা যুক্তিতর্কে বিশ্বাস করেন, তাদের এই বৈশ্লেষিক দর্শনের বিষয়টি ভালো জানা থাকা দরকার। এই দর্শন আমাদের শেখাতে পারে কীভাবে আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান আর ভাষাবিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে প্রাঞ্জলভাবে যুক্তি দাঁড় করিয়ে কথার পর কথা বলা যায়। আধুনিক বৈশ্লেষিক দর্শন মূলত কান্টের ‘পরিকল্প ও আধেয়’র ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ভিটগেনস্টাইন এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন চিন্তনের একটা নতুন ধারণা। এতে তিনি উল্লেখ করেন ‘ঘটনার যৌক্তিক ছবির’ কথা যা আমাদের মনের সঙ্গে যুক্ত, বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ভিটগেনস্টাইন মনে করেন চিন্তন হচ্ছে ভাষিক একটা ব্যাপার। চিন্তার ব্যাপারটি শুধু ভাবনার ওপর নির্ভরশীল নয়, ভাষাকাঠামো বা যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তার গঠনের ওপরও নির্ভর করে, পরিণত বয়সে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। মানসবাদ (মেন্টালিজম) ও তার নিজস্ব ভাষাবাদ (লিঙ্গুয়ালিজম) এই দুইয়ের মিশ্রণেই চিন্তার ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয় বা গঠিত হয়।
ভিটগেনস্টাইন সবধরনের মানসনির্ভর চিন্তাকে অগ্রাহ্য করে ভাবনাকে আচরণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বলেছেন, চিন্তা হচ্ছে একধরনের মানসিক ক্রিয়া; নিষ্ক্রিয় কিছু নয়। এটা এমন একধরনের ‘কর্ম’ যা সাধারণত ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ চিন্তার রয়েছে একটা ভাষিক দিক। বিভিন্ন ধরনের চিন্তাকে বুঝতে হলে ভাষার দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে, না হলে তার্কিক হিসেবে কেউ সফল হতে পারবে না, বক্তা হিসেবেও না। বলা বাহুল্য, এটা একটা সাধারণ কথা, আমরা সবাই কমবেশি এই কথাটা জানি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিন্তার সঙ্গে যুক্তিকে কিভাবে সমন্বিত করে সমালোচনামূলক ভাষায় কথা বলা যাবে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ছিদ্রান্বেষণের কথা দিয়ে, কিন্তু এই ছিদ্রান্বেষণ করা বা সমালোচক হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের মেধা, পঠনপাঠন আর বিশ্লেষণ ক্ষমতার ওপরই নির্ভর করছে আমরা যুক্তি তক্ত গপ্পে কতটা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারি। কিন্তু আমাদের চারপাশের যেসব মানুষ গণমাধ্যমে কথা বলেন কিংবা সাহিত্য সমালোচনা করে থাকেন, তারা কেউ কেউ পেশাদার কথাকার হয়ে উঠছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের কথায় বা সমালোচনায় গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা দু-এক পাতার তত্ত্বকথা জেনে বা পড়ে, অথবা অন্যের তাত্ত্বিক লেখার ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে চটকদার নামসর্বস্ব বই লিখে চলেছেন। কথার (এবং সমালোচনার) এই যে অপচয়, অচিরেই তা বন্ধ করা না গেলে জাতিগতভাবে চিন্তনশূন্য বাচালতায় চারপাশ ভরে যাবে, প্রকৃত চিন্তকের দেখা আমরা পাব না।
তথ্যসূত্র : কে. আলস্টন, ‘রি/থিংকিং ক্রিটিক্যাল থিংকিং : দ্য সেডাকশন অফ এভরিডে লাইফ’, স্টাডিজ ইন ফিলোসফি অ্যান্ড এডুকেশন; জাইলস দেলেউজ, কান্ট’স ক্রিটিক্যাল ফিলোসফি: দ্য ডকট্রিন অফ দ্য ফ্যাকাল্টিজ; য়ুরগেন হাবেরমাস, নলেজ অ্যান্ড হিউম্যান ইন্টারেস্ট; মার্টিন হাইদেগার, ডিসকোর্স অন থিংকিং এবং পোয়েট্রি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড থট; জ্যঁ-ফ্রাসোঁয়া লিয়োতার্দ, দ্য পোস্টমডার্ন কন্ডিশন: এ রিপোর্ট অফ নলেজ; হার্ভে সিজেল, এডুকেটিং রিজন: র্যাশনালিটি, ক্রিটিক্যাল থিংকিং অ্যান্ড এডুকেশন; ভিটগেনস্টাইন, ফিলোসফিকাল ইনভেস্টিগেশন এবং অন ক্রিয়েটিভিটি।
এই যে চারপাশে এত কথা আর কথা, আমাদের কর্ণপীড়ন আর মনোপীড়নের কারণ ঘটাচ্ছে, এসব কথার আদৌ কোনো সারবস্তু আছে কী? মানুষের কথা নিয়ে যেসব গবেষকদের কারবার, সেই ভাষাবিদরা বলছেন, আমরা দুই ধরনের কথা বলি- একটা হলো কেজো কথা, আরেকটা প্রতিদিনের সাদামাঠা কথা। কেজো কথা হলো প্রয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ কথা আর প্রতিদিনের জীবনযাপনের প্রয়োজনে যেসব কথা বলি, সেসব হচ্ছে সাধারণ কথা। সব কথারই কমবেশি গুরুত্ব আছে, তবে কেজো কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। কেজো কথাকেই আমরা নানা ভারি ভারি নামে চিহ্নিত করেছি- ‘বক্তৃতা’, ‘ভাষণ’, ‘অভিভাষণ’, ‘টক শো’, ‘বিতর্ক’ ইত্যাদি।
নামে যতই ভারি হোক, কথার মধ্যে যদি সারবস্তু না থাকে, তাহলে সে-কথা যে মাঠে মারা যায়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কথাকে তাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হয়, তা সে বক্তৃতাই হোক কিংবা বিতর্ক। ওই ভাষাবিদ বা যোগাযোগবিদরাই জানাচ্ছেন, সেই কথাই এখন গুরুত্বপূর্ণ যাকে আমরা চিন্তা ও মননের সঙ্গে অবিমিশ্র করে উপস্থাপন করে থাকি। অর্থাৎ সহজ সরল কথা নয়, কথার মধ্যে থাকতে হবে ভাবনা ও মননের গভীরতা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সরলভাবে উপস্থাপন না করে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে। আমরা যাকে বলি ‘কথার ধার’, গুরুত্বপূর্ণ কথায় থাকতে হবে এই ধার। ভাষাযোগাযোগবিদরা একেই ইংরেজিতে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা সাহিত্য সমালোচক, তার্কিক তাদের কথাও এই চিন্তনের অন্তর্ভুক্ত। কোনো বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ মূলত এই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক কথপোকথনের এটাই হচ্ছে প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে-কোনো বিষয়কে ক্রিটিক্যালি দেখতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু এই ক্রিটিক্যাল বা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বুঝবো আমরা?
বাঙালিদের স্বভাব নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘ছিদ্রান্বেষী’। ক্রিটিক্যাল চিন্তা মূলত এই ছিদ্রান্বেষণই, তবে শুধু ত্র“টি খুঁজে বের করে প্রতিপক্ষকে আত্মভাবনার দ্বারা রক্তাক্ত করা নয়, জর্জরিত করা নয়; প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটা যৌক্তিক বয়ান বা ডিসকোর্স দাঁড় করানোই হচ্ছে সমালোচনামূলক চিন্তনের মূল কথা। ফলে তা হয়ে দাঁড়ায় যুক্তি ও যুক্তির চর্চাবিশেষ। দার্শনিকরাই সমালোচনামূলক চিন্তনের উদ্ভাবক। জগত ও জীবনের কথা বলতে গিয়ে তারা যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন, সেটাই হচ্ছে সমালোচনামূলক ভাবনার ভিত্তি। তবে এই চিন্তন বহুমুখী। উদ্দেশ্যের ব্যাপকতা লক্ষ্য করবার মতো। কেউ বলেছেন সমালোচনামূলক চিন্তন একধরনের দক্ষতা যে দক্ষতা থাকলে প্রতিপক্ষ কীধরনের যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে কিংবা কী বলা হলো, অথবা প্রতিপক্ষের যুক্তির ত্র“টিপূর্ণ দিকগুলি সম্পর্কে ঠিক ঠিক বোঝা সহজ হয়। কেউ কেউ বলেন, সমালোচনামূলক চিন্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে এটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারলে যে-কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা অর্জিত হয়। কীভাবে একটা বিষয়কে সমালোচনা করা যায়, সেই কৌশলও একজন তার্কিক আয়ত্ত করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা কৌশল অর্জন করা গেলে প্রতিপক্ষের যুক্তিকে অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত করে দেওয়া যায়, যে-কোনো বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। উপযুক্ত যুক্তির জাল বিস্তার করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া যায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তরে এভাবেই গভীর জ্ঞান ও যুক্তির অধিকারী হতে পারলে, কেউ কেউ মনে করেন, যে-কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচক বা তার্কিক চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সমকালের এরকম পাঁচজন শিক্ষাদার্শনিক রবার্ট এনিস, রিচার্ড পল, জন মেপেক, হার্ভে সিয়েজেল এবং জেন রোনাল্ড মার্টিন এভাবেই ক্রিটিক্যাল চিন্তনকে চিহ্নিত করেছেন। সিয়েজেল খুব স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন সমালোচনামূলক চিন্তনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট বিষয়জ্ঞান এবং যুক্তির সম্পর্ক গভীর।
লক্ষণীয়, সিয়েজেল সাধারণ সাদামাঠা যুক্তি নয়, বলেছেন ক্রিটিক্যাল রিজনিং বা সমালোচনামূলক যুক্তির কথা। একজন সমালোচক এভাবেই সমালোচনামূলক চিন্তক হয়ে উঠতে পারেন। তিনি যুক্তির কথা বলতে গিয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন জ্ঞানতত্ত্বের ওপর। জেন মার্টিন আবার এই জ্ঞানতাত্ত্বিক জ্ঞান বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। অর্থাৎ একমুখী কোনো জ্ঞান নয়, জ্ঞানের নানা শাখায় একজন তার্কিকের বিচরণ থাকা আবশ্যিক। অর্থাৎ জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা দিক সম্পর্কে তাকে অবহিত হতে হবে, বহুত্বধর্মী ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এই জ্ঞানই হচ্ছে সমালোচনামূলক যুক্তির মূল ভিত্তি। কার্ল আসস্টোন এই ভাবনাকে আরেকটু বিস্তৃত করে বলেছেন, সমালোচনামূলক চিন্তককে “বহুমুখী মানবীয় সমস্যা সম্পর্কে আগ্রহী হতে হবে আর তাকে চিন্তা, কর্মতৎপরতা, প্রকাশ এবং এদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক কী, সে-সব বিষয়ে অবহিত হতে হবে।”
মানবীয় চিন্তন ও চিন্তার প্রকাশ মূলত গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিস্তৃত ও গভীরতর হয়ে উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসা তৈরি হবার ফলে আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় মানুষ জ্ঞানচর্চায় যেমন জড়িয়ে পড়েছে, তেমনি উৎপাদন করছে বিপুল জ্ঞান। ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের সূত্রে উৎপাদিত এই জ্ঞানের বিপুল বিস্তার এখন একটা সাধারণ ঘটনামাত্র। প্রযুক্তি আমাদের জ্ঞানচর্চাকে শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছে না, মানুষকে বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী করে তুলছে, একেবারে দৈনন্দিন পঠনপাঠনের সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছে। অসংখ্য ছাপা গ্রন্থ এখন ইবুকের আকারে অন্তর্জালেই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে নানা তত্ত্ব ও ভাবনার সৃষ্টিতে। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বভাবনার আবির্ভাবে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার এতটাই স্ফীত হয়ে উঠেছে যে, যারা চিন্তক, ভাবুক, সমালোচক, তার্কিক, তাদের এই উৎপাদিত জ্ঞানচর্চার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাধারণ ভাবনার পরিবর্তে ভাবুকেরা এই সময় থেকেই জড়িয়ে পড়েছেন সমালোচনামূলক ভাবনায়। বিশ শতকের ভাবনার ইতিহাস মূলত এই সমালোচনামূলক চিন্তনের ইতিহাস। সর্বজনীন যুক্তি এবং কার্যকারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন দার্শনিক ও ভাবুকেরা। ফলে চিন্তার ধরনও অনেকখানি পাল্টে গেছে। এই লেখায় সবার সম্পর্কে নয়, আমি নীৎসে, হাইদেগার, ভিটগেনস্টাইন এবং উত্তর-কাঠামোবাদী ফরাসি ভাবুকেরা যে নতুন চিন্তনের কথা বলেছেন, সেই ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সমালোচনামূলক ভাবনার সমগ্র ডিসকোর্স মূলত পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। এই ভাবনা, বলাবাহুল্য, শুরু হবে কান্টকে দিয়ে। এরপর দ্বিমুখী ধারায় তা অগ্রসর হয়েছে : এর একটি ধারার প্রবক্তা হচ্ছেন হোর্খেমার এবং আরেকটির আদোর্নো। চতুর্থ স্তরে আবির্ভাব ঘটছে হাবেরমাসের। সবশেষে পাওয়া যাবে ভিটগেনস্টাইন, ফুকো ও লিয়োতার্দের ভাবনাচিন্তনের সূত্রগুলি। বলা নিষ্প্রয়োজন, যুক্তিভাবনার ইতিহাস মূলত দর্শনের ইতিহাস। কান্ট তাই বলেছিলেন, “দর্শন হচ্ছে সবধরনের জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্কিত এক বিজ্ঞান, মানবীয় যুক্তিবোধের মধ্য দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটে।” হাইদেগার তার লেখা ‘কাকে বলে চিন্তন’ (১৯৬৮) শীর্ষক একটি বক্তৃতামালা শুরুই করেছিলেন এইভাবে : “আমরা যখন চিন্তা করতে বসি তখনই কেবল বুঝতে পারি চিন্তা বলতে কী বোঝায়। যদি তাতে সফল হই তাহলে চিন্তা কী জিনিস তা আমরা শিখে ফেলি।” হাইদেগারের মতে যদিও আমরা চিন্তা জাগানিয়া একটা জ্বলন্ত সময়ের মানুষ, তবু আমরা চিন্তা করতে শিখিনি। তাই চিন্তার স্বরূপ-প্রকৃতি বুঝতে হলে, হাইদেগার বলছেন, আমাদের একটা বিষয়কে নানাভাবে ভাবতে হবে, চিন্তা করতে শিখতে হবে।
হাইদেগারের আরেকটা বই- ‘কবিতা, ভাষা ও চিন্তন’ (১৯৭১)-এর ভূমিকায় সম্পাদক আলবেয়ার হফ্সটাটার হাইদেগারের ভাষার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, হাইদেগার নিজের একটা শৈলী আছে। তিনি একজন মৌলিক চিন্তাবিদ। তার একটা দুটো বাক্যই তাকে ভিটগেস্টাইন, রাসেল অথবা হোয়াইটহেড থেকে তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। হফ্সটাটার এইখানে মানবীয় চিন্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি হলো ভাষার দিক। অর্থাৎ চিন্তনের সঙ্গে ভাষার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ভাষার মধ্য দিয়েই আমরা সবকিছু ভাবি আবার তা প্রকাশও করি ভাষা দিয়ে। চিন্তাই এখানে হয়ে উঠেছে অনন্য এক শৈলী।
পশ্চিমী দর্শনে হাইদেগার নানা ধরনের ভাবনার উদ্ভাবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে চিন্তন আসলে কী, এই ধারণাটি গঠন করে দিয়েছেন তিনি।
হাইদেগারের মতে চিন্তন বা ভাবনা হলো : (১) সাধারণ বিশ্বাস বা ধারণা বা ডক্সা : এটি আমাদের ভাবনা, মতামত গঠন করে দেয় (মতপ্রকাশ); (২) ‘প্রতিনিধিত্বশীলতা’ : বিশেষ কোনো অবস্থাকে প্রকাশ করা (প্রতিনিধিত্ব); (৩) ‘যুক্তিশীলতা’ : ধারাবাহিকভাবে কোনো ভাবনাকে গঠন করে উপসংহারে পৌঁছানো (যুক্তির ক্রম অনুসরণ); (৪) ‘সমস্যার সমাধান’ : বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা (সমস্যার সমাধান করা); (৫) ‘বেরিফ’ (হেগেল) : ধারাবাহিক ভাবনা ও ভাবনার গঠন (অনুধাবন); (৬) সর্বজনীনতার সূত্র অনুসারে কোনো বিষয় সম্পর্কে বোঝা অথবা ব্যাখ্যা করা (বাস্তবোচিত বিচার-বিবেচনা); (৭) যা কিছু অপ্রকাশিত রয়ে গেছে তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা বা প্রকাশ করা (সত্তার অর্থ উন্মোচন- হাইদেগারীয় ভাবনা); (৮) ‘হয়ে ওঠা’র এক প্রক্রিয়া (হাইদেগারের উত্তর-পরাতাত্ত্বিক চিন্তন)। আগেই উল্লেখ করেছি, হাইদেগার কাব্যচিন্তার বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেও একটি বই লিখেছিলেন। কবিতার ভাষা, বিশেষ করে এর চিন্তাসূত্র যে ভিন্ন সেকথা তিনি ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন। হাইদেগারের ভাবনাতেই মূলত বিভিন্ন ধরনের চিন্তনের পরিচয় পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ধরনের চিন্তার পাশাপাশি সমালোচনামূলক চিন্তাকেও তিনি নানা সময়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মানবীয় ভাবনা বা চিন্তন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে, বিশেষ করে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর যে রূপান্তর ঘটে, হাইদেগার সেকথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক কালে, এমনকি এই সময়েও আমরা জানি, কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে নানা তথ্য বিন্যাসের নানা প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার ঘটছে। উত্তর-আধুনিক দুই ভাবুক-দার্শনিক লিয়োতার এবং দেলেউজ সমকালীন এই চিন্তনকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : প্রথমত, চিন্তা হচ্ছে তথ্য-প্রক্রিয়াকরণ (জ্ঞানতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞান); দ্বিতীয়ত, চিন্তা হচ্ছে মেটান্যারেটিভ বা পরাবর্ণনা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা : বর্ণনা বা পরাবর্ণনার সমালোচনা - এর মধ্য দিয়ে কোনো বর্ণনার মধ্যে যে আরও অতিরিক্ত কিছু থাকতে পারে তার বিশ্লেষণ (লিয়োতার্দ); তৃতীয়ত, চিন্তা হচ্ছে ধারণার গঠন : দর্শনায়িত করা (দেলেউজ)।
চিন্তা বা সমালোচনার বিষয়টি তাই বহুমুখী, অর্থাৎ চিন্তার রয়েছে না ধরন, নানা রূপ। বিভিন্ন দার্শনিক এই বহুত্বধর্মী চিন্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, হাইদেগার থেকে ভিটগেনস্টাইন পর্যন্ত চিন্তার এই বিশ্লেষণ প্রসারিত হয়ে আছে। ভিটগেনস্টাইনের মতে দর্শন হচ্ছে এমন একধরনের ভাবনামূলক কর্ম যা বিজ্ঞান থেকে পৃথক একটি বিষয় হিসেবে দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেয়। তিনি বলেছেন, ব্যাকরণ যুক্তির কার্যকারণ সূত্র থেকে আলাদা। ভাষা ও জ্ঞান ভাষাতত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সঙ্গে কতটা যুক্ত তা দেখার খুব প্রয়োজন নেই। একসময় যাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো, সেই ‘শব্দার্থতাত্ত্বিক ঈশ্বরবাদে’র মৃত্যু ঘটে গেছে। ভিটগেনস্টাইন এভাবেই তার বিশ্লেষণী দর্শনের তত্ত্বটি হাজির করেছেন। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বৈশ্লেষিক/সংশ্লেষী, পরিকল্প/আধেয়র মধ্যেকার পার্থক্য। এরই ওপর ভিত্তি করে তিনি বৈশ্লেষিক দর্শনের বিষয়টিকে আরও সুসংহত করেছেন। এখানে বলা প্রয়োজন, যারা তার্কিক বা যুক্তিতর্কে বিশ্বাস করেন, তাদের এই বৈশ্লেষিক দর্শনের বিষয়টি ভালো জানা থাকা দরকার। এই দর্শন আমাদের শেখাতে পারে কীভাবে আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান আর ভাষাবিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে প্রাঞ্জলভাবে যুক্তি দাঁড় করিয়ে কথার পর কথা বলা যায়। আধুনিক বৈশ্লেষিক দর্শন মূলত কান্টের ‘পরিকল্প ও আধেয়’র ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ভিটগেনস্টাইন এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন চিন্তনের একটা নতুন ধারণা। এতে তিনি উল্লেখ করেন ‘ঘটনার যৌক্তিক ছবির’ কথা যা আমাদের মনের সঙ্গে যুক্ত, বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ভিটগেনস্টাইন মনে করেন চিন্তন হচ্ছে ভাষিক একটা ব্যাপার। চিন্তার ব্যাপারটি শুধু ভাবনার ওপর নির্ভরশীল নয়, ভাষাকাঠামো বা যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তার গঠনের ওপরও নির্ভর করে, পরিণত বয়সে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। মানসবাদ (মেন্টালিজম) ও তার নিজস্ব ভাষাবাদ (লিঙ্গুয়ালিজম) এই দুইয়ের মিশ্রণেই চিন্তার ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয় বা গঠিত হয়।
ভিটগেনস্টাইন সবধরনের মানসনির্ভর চিন্তাকে অগ্রাহ্য করে ভাবনাকে আচরণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বলেছেন, চিন্তা হচ্ছে একধরনের মানসিক ক্রিয়া; নিষ্ক্রিয় কিছু নয়। এটা এমন একধরনের ‘কর্ম’ যা সাধারণত ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ চিন্তার রয়েছে একটা ভাষিক দিক। বিভিন্ন ধরনের চিন্তাকে বুঝতে হলে ভাষার দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে, না হলে তার্কিক হিসেবে কেউ সফল হতে পারবে না, বক্তা হিসেবেও না। বলা বাহুল্য, এটা একটা সাধারণ কথা, আমরা সবাই কমবেশি এই কথাটা জানি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিন্তার সঙ্গে যুক্তিকে কিভাবে সমন্বিত করে সমালোচনামূলক ভাষায় কথা বলা যাবে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ছিদ্রান্বেষণের কথা দিয়ে, কিন্তু এই ছিদ্রান্বেষণ করা বা সমালোচক হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের মেধা, পঠনপাঠন আর বিশ্লেষণ ক্ষমতার ওপরই নির্ভর করছে আমরা যুক্তি তক্ত গপ্পে কতটা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারি। কিন্তু আমাদের চারপাশের যেসব মানুষ গণমাধ্যমে কথা বলেন কিংবা সাহিত্য সমালোচনা করে থাকেন, তারা কেউ কেউ পেশাদার কথাকার হয়ে উঠছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের কথায় বা সমালোচনায় গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা দু-এক পাতার তত্ত্বকথা জেনে বা পড়ে, অথবা অন্যের তাত্ত্বিক লেখার ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে চটকদার নামসর্বস্ব বই লিখে চলেছেন। কথার (এবং সমালোচনার) এই যে অপচয়, অচিরেই তা বন্ধ করা না গেলে জাতিগতভাবে চিন্তনশূন্য বাচালতায় চারপাশ ভরে যাবে, প্রকৃত চিন্তকের দেখা আমরা পাব না।
তথ্যসূত্র : কে. আলস্টন, ‘রি/থিংকিং ক্রিটিক্যাল থিংকিং : দ্য সেডাকশন অফ এভরিডে লাইফ’, স্টাডিজ ইন ফিলোসফি অ্যান্ড এডুকেশন; জাইলস দেলেউজ, কান্ট’স ক্রিটিক্যাল ফিলোসফি: দ্য ডকট্রিন অফ দ্য ফ্যাকাল্টিজ; য়ুরগেন হাবেরমাস, নলেজ অ্যান্ড হিউম্যান ইন্টারেস্ট; মার্টিন হাইদেগার, ডিসকোর্স অন থিংকিং এবং পোয়েট্রি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড থট; জ্যঁ-ফ্রাসোঁয়া লিয়োতার্দ, দ্য পোস্টমডার্ন কন্ডিশন: এ রিপোর্ট অফ নলেজ; হার্ভে সিজেল, এডুকেটিং রিজন: র্যাশনালিটি, ক্রিটিক্যাল থিংকিং অ্যান্ড এডুকেশন; ভিটগেনস্টাইন, ফিলোসফিকাল ইনভেস্টিগেশন এবং অন ক্রিয়েটিভিটি।
No comments