পাহাড় চিত্র… by বিপ্লব রহমান
পাহাড় হেসেছে জুম চাষে। সবুজ মরুভূমিতে প্রাণের উচ্ছাস।...
বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণাংশের পার্বত্য চট্রগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা জুম চাষ। এটি পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ। বংশ পরম্পরায় পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের ঢালে এই চাষাবাদে সুস্বাদু সব শষ্য, শাক-সব্জি, ফলমূলসহ নানান ধরণের বনজ ও ফলজ খাদ্য উৎপাদন করে আসছেন।
তবে ক্রমেই সমতল থেকে আসা বাঙালিদের বসতি বাড়ছে পাহাড়ে। কমে আসছে জুমের পাহাড়। দিন দিন জীবন হচ্ছে অনেক কঠিন।
ফুল বিঝুতে চাকমা শিশু-কিশোররা নৈবদ্য দেয় জলদেবতাকে।
পাহাড়ে চলছে বিঝু উৎসবের প্রস্তুতি। চাকমাদের পুরনো বর্ষ বিদায় ও নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানোর এই সামাজিক উৎসবের আনন্দ জানিয়ে দেয়, পাহাড়িরা শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রাখতে জানেন। মারমারা এই উৎসব পালন করেন ভিন্নভাবে। তাদের উৎসবের নাম সাংগ্রেং। ত্রিপুরাদের উৎসবটির নাম বৈসুক। আর তনচংগারা বলেন বিষু।
বৈসাবীর আনন্দ শোভাযাত্রার মিছিলে ঐতিহ্যবাসী সাজ-পোষকে তনচংগা শিশু।
পাহাড়ের ১৩টি ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতির মধ্য প্রধান তিনটি ক্ষুদ্র জাতি ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব যথাক্রমে বৈসুক-সাংগ্রেং-বিঝু…। এই তিনটি উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে উৎসবগুলোকে একত্রে ‘বৈসাবী’ও বলা হয়। সমতলে এই নামেই উৎসবগুলো পরিচিত।
সাংগ্রেং মেলায় ক্ষুদে বুদ্ধ।
রাঙামাটির চিৎমরমের পাহাড়ে বসেছে সাংগ্রেং মেলা। সেখানে ঘুরছিলো সন্যাস ধর্ম নেওয়া এই ক্ষুদে বুদ্ধ মারমা শিশুটি। উৎসবের আনন্দ থেকে সে বাদ পড়বে কেনো? বাংলা ভাষার সঙ্গে একদম পরিচয় নেই তার। এই ফটোব্লগারের মারমা ভাষা জানা নেই। দোভাষী ছাড়াই ইশারায় কাজ হয়। অলিম্পাস অটো-জুম ডিজিটাল ক্যামেরায় এভাবে জড়োসড় হয়ে পোজ দেয় ভান্তে। ভিউ ফাইন্ডারে নিজের ইমেজ দেখে অনাবিল হাসিতে ভেঙে পড়ে সে। আহা রে! সেই ছবিটি যদি তোলা যেতো!
ক্রেওক্রাডং চূড়ায় বম শিশুর দল। সামনেই বড়দিন; সবাই খুব খুশী।
এক ডিসেম্বরে সকালে বান্দরবানের ক্রেওক্রাডং চূড়ায় দেখা মেলে এইসব হাসিখুশী বম শিশুদের । দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উঁচু পর্বত (প্রথমটি তাজিংডং, সেটি ক্রেওক্রাডং-এর পূর্বদিকে) চূড়ায় তারা আসন্ন বড়দিনের জন্য গিটার বাজিয়ে গান করছিলো। ছবির জন্য ক্রেওক্রাডং-এর পর্বত শিখরের সিঁড়িতে বসতে বললে সানন্দে হইচই করে বসে পড়ে তারা।
শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ে ঐতিহ্যবাহী কোমড় তাঁতে ব্যস্ত নাম বিস্মৃত অনার্সের ছাত্রী ত্রিপুরা মেয়েটি। পাহাড়ের সব জনজাতির রয়েছে এমনি নিজস্ব বয়নশিল্প।
পাহাড়ের সব জনজাতি আদিবাসীর রয়েছে নিজস্ব বয়নশিল্প কোমড় তাঁত। একেকটি ক্ষুদ্র জাতির তাঁতের কাপড়ের নকশা একেক রকম। কোনো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচংগা, ম্রো বা অন্যজাতির আদিবাসী নারীর পরনের লুঙ্গিটির নকশা দেখে সহজেই বলে দেয়া সম্ভব, তিনি কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন। পাহাড়ের বাইরেও এইসব আদিবাসীরা সযত্নে লালন করেন নিজস্ব রীতিনীতি-ঐহিত্য। যেমন, শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ে দেখা মেলে এই নাম বিস্মৃত স্নাতক পড়ুয়া মেয়েটির সঙ্গে। মা’র কাছে কোমড় তাঁতের হাতেখড়ি তার। আসন্ন বৈসুককে স্বাগত জানাতে নিজেই বুনছেন নিজের সাজ-পোষাক।
চিন্মুক পাহাড়ের ম্রো মেয়ে। হতদরিদ্র হলেও সাধ্যমত সাজগোজ তাদের পছন্দ। ক্যামেরা দেখে বেশ খানিকটা লাজুক হন তারা।
পাহাড়ের এক সময়ের দুর্ধর্ষ শিকারি ম্রো আদিবাসী। বিলুপ্ত প্রায় গহিন বনে এখন শিকার মেলা ভার। সেনা বাহিনী, বন বিভাগসহ নানান রকম অধিগ্রহণের খপ্পরে জুম চাষের জমিও কমে আসছে। চিম্বুক পাহাড় থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে শত শত ম্রো পরিবারকে। এরই প্রতিবাদে এক আদিবাসী সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন এই তিনটি ম্রো মেয়ে। এর আগে “চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো’ নামের ফটোব্লগে এ সর্ম্পকে বেশ খানিকটা বলা হয়েছে। সেখানে খানিকটা ম্রো জীবনচিত্রও ছবিতে দেখা যাবে।
চাকমা শিশু শিক্ষার্থীর দল। ছবি তোলার পর স্কুল ড্রেস বিহীন নাম বিস্মৃত মেয়েটি ভাঙা বাংলায় অস্ফুট স্বরে বলে, বাংলা ভাষা খুব কষ্ট!
পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়িদের মধ্যে চাকমারাই সংখ্যায় বেশী। তারা দেশের সবচেয়ে বড় জনজাতিগুলোরও একটি। শিক্ষাদীক্ষায় চাকমারা খুবই এগিয়ে। পাহাড়ে চাকমাদের শিক্ষার হার শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ; অর্থাৎ বাঙালিদের চেয়েও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। এর প্রধান কারণ, সাবেক গেরিলা নেতা এমএন লারমা’র শিক্ষা বিস্তারের সামাজিক আন্দোলন। গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী গঠনের আগে জনসংহতি সমিতর প্রতিষ্ঠাতা এই নেতা দলের সকল সংগঠকদে নির্দেশ দিয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে। কারণ তিনি জানতেন, শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে অতি পশ্চাৎপদ পাহাড়িদের বাকী মৌলিক চাহিদাগুলো নিজস্ব শক্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব। …এখন পাহাড় ও সমতলে সবখানে দাবি উঠেছে আদিবাসীর মাতৃভাষায় শিক্ষার।
সীতাকুণ্ডের পাহাড়ের হতদরিদ্র শিশুদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষা এক অলীক কল্পনা। তবু ছবি তুলতে পেরেই তারা খুশী।
সীতাকুন্ডের পাহাড়ে দেখা মেলে এইসব হাসিখুশী ত্রিপুরা শিশুদের। হতদরিদ্র কয়েকটি আদিবাসী গ্রামের জন্য এনজিওদের গড়া একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। দু-বেলা আহারই জোটেনা যাদের, তাদের আবার লেখাপড়া! গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে একজন মাত্র এসএসসি পাশ ব্যক্তির দেখা মেলে সেখানে।
সীতাকুণ্ড পাহাড়ের শ্রমদাস আদিবাসী কয়েকজন। অশেষ দুঃখগাঁথা যেনো আর ফুরায় না...
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতকুণ্ডের পাহাড়ের পদদেশের ত্রিপুরা আদিবাসী গ্রামে দেখা মেলে ভূমিহীন এই সব হতদরিদ্র মানুষদের। পাকিস্তান আমলে দুর্ভেদ্য জঙ্গল পরিস্কার করে গ্রামের পত্তন করেছিলেন তারা। বংশপরম্পরায় ভোগ করে আসছিলেন নিজস্ব চাষবাসের জমি। কিন্তু নথিপত্র-দলিলের ধারণা থাকায় তারা এখন জমির ওপর অধিকার হারিয়ে ভূমিহীন, শ্রমদাস। যে জমি উৎকর্ষের জন্য এক সময় তারা প্রস্তুত করেছিলেন, এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন সেইসব জমিতেই তারা দিনমজুরী করে কোনো রকমে জীবন নির্বাহ করেন।
বাঘাইছড়িতে সেনা-সেটেলারদের সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে স্মৃতির মিনার।
এইসব চলতি জীবন প্রবাহের বাইরে পাহাড়ের নির্মম বাস্তবতা এই যে, সেনা ও বাঙালি সেটেলার উপস্থিতিতে সেখানে বাঘাইছড়ির মতো একের পর এক সহিংসতা ঘটছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির আগে সেখানে হয়েছে সেনা-সেটেলার যৌথ আক্রমনে অন্তত ১৩টি গণহত্যা। চুক্তির পরেও পাহাড়ের এইসব হর্তাকর্তাদের থাবায় বার বার বিঘ্ন ঘটছে শান্ত পাহাড়ি জনপদে।
বাঘাইছড়ি সহিংসতায় গৃহহীন একজন নারী। পোড়া ভিটায় আবারো জীবন গড়ার সামান্য স্বপ্ন তার।
বাঘাইছড়িতে লোভি মানুষের হিংসার অনলে পুড়ে যায় অন্তত ২০০ আদিবাসী ঘর। খুন হন অন্তত দুজন আদিবাসী মানুষ। ভাবতে অবাক লাগে যে, দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনী জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষা করে চলেছে, দেশের ভেতরেই তাদের পাকিপনার মুখ ও মুখোশ– দুইই কি ভয়ঙ্কর! পাহাড়ে এই সহিংসতার মূলে রয়েছে ভূমি বিরোধ। পার্বত্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন, তথা চুক্তির মৌলিক শর্তসমূহ পূরণ না হলে একের পর এক সহিংসতা ঘটতেই থাকবে।
পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তী এমএন লারমার ছবিসহ সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী প্রধান ঊষাতন তালুকদার।
সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী পাহাড়ে স্বাধীকার তথা আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুই দশক গেরিলা যুদ্ধ করেছে। আনুমানিক প্রায় ২৫ হাজার পাহাড়ি-বাঙালির রক্তের বিনিময়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে শান্তিচুক্তি। কিন্তু আওয়ামী লীগ-তত্ত্বাবধায়ক সরকার-বিএনপি-তত্ত্বাবধায়ক সরকার-আওয়ামী লীগ শাসন আমলের দেড়যুগেও শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তসমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারগুলোর সীমাহীন সদিচ্ছার অভাবে কার্যতঃ চুক্তিটি পরিনত হয়েছে। ইতিহাস বলে, ইনসার্জেন্সি নাকি কখনো পুরোপুরি শেষ হয় না। আবার ইতিহাস এ কথাও বলে, ইতিহাস থেকে নাকি কেউ শিক্ষা নেয় না; তাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নাকি হয়!
No comments