উফ্, অসহ্য by সুলতানা আলগিন
মডেল: পূজা রায় |
কৈশোরে
পড়তেই ঐশীর (ছদ্মনাম) কাছে মনে হলো তার মা যেন বদলে গেছেন। আগে তো
ফ্ল্যাট বাড়ির সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিশ্চিন্তে খেলত সে। ইদানীং মা বলছেন,
অমুকের সঙ্গে খেলো না। আবার পোশাক-আশাকের বেলায়ও মতের অমিল। ঐশীর যে
পোশাক পছন্দ, মা বলছেন, ‘ওটা পরে তোমার মতো মেয়েরা বাইরে যায়?’ ঐশী
ভাবে, ‘আমার কি কোনো ইচ্ছারই মূল্য নেই। আমি কি বড় হচ্ছি না! আমার কি
স্বাধীনতা নেই! সবটাতেই মায়ের বাড়াবাড়ি। উফ্, অসহ্য!’
মায়ের সঙ্গে বড় হতে থাকা কিশোর মেয়ের এই মতের অমিল, এ তো প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিশোরী মেয়ে আর মায়ের এই সম্পর্ক প্যারাডক্স বা আপাতবিরোধী হলেও বাস্তবতা হলো মেয়ে তার মাকে ‘আদর্শ নারী’ হিসেবে ভাবে। অনুসরণও করে। অথচ কখনো সে তার মায়ের মতো হতে চায় না।
কিশোর বয়সে মেয়ে ভাবে, মা তার কথা শুনতে ও বুঝতে চান না। মা সব সময় তাঁর নিজের ছোটবেলার সঙ্গে তুলনা দেন। তাঁর মতো করেই চিন্তা করেন। মাকে সে বোঝাতে পারে না, ‘তোমার যুগ আর এই যুগ এক নয়।’ সব সময় বাঁকা কথা বলেন। সে তো কখনোই, তার মা যা চান, সে রকম হতে পারবে না। মায়ের সঙ্গে তাই কথা বলতেও যেন ইচ্ছা করে না তার।
অন্যদিকে, মা ভাবেন, এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে তিনিও কিশোরী ছিলেন। কী আর এমন সময় বদলেছে। তাঁর মা সে সময়ে যেমন তাঁকে শাসনে রেখেছিলেন, তাঁরও উচিত মেয়েকে সেভাবে দেখেশুনে বড় করে তোলা। নইলে নির্ঘাত মেয়ে তাঁর বখে যাবে।
এই দুই রকম ভাবনাতেই বাড়ে দূরত্ব। টিনএজ মেয়ে দুচোখে দেখতে পারে না মাকে। আর ভালোবাসায় ব্যাকুল মায়ের তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
টিনএজ মনস্তত্ব
কিশোরী মেয়ের টিনএজ বলতে আমরা ১৩ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বুঝি। ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের (পিউবার্টি) মধ্য দিয়ে যায়। প্রকৃতিগতভাবেই মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে শেখে। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, বিপদ-আপদ আন্দাজ করতে শেখে। যাদের ম্যাচুরিটি বেশি, তারা নিজেরাই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনটা কেমন হয়?
টিনএজ মেয়েরা উদ্দাম, উচ্ছল, চঞ্চল, মুডি, অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হয়। মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মায়েরাও এই বয়স পেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা জানেন কত বিধিনিষেধ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এই পর্যায়ে এসেছেন। টিনএজ মেয়েরা সমাজের এই বিধিনিষেধ ভাঙতে চায়, এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু প্রথম প্রথম বাদ সাধেন মা। তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধির আলোকে দেখতে চান মেয়ের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সময় বদলে গিয়েছে। প্রজন্ম ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপ এখানে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। আধুনিক পৃথিবীতে মেয়েদের জগৎ ও জীবনবোধ পাল্টাচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। যে কাজ কয়েক বছর আগেও মেয়েদের জন্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, সে কাজে নতুন দিনের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ফ্যাশন, সাজগোজ, পোশাক-আশাক, চালচলন, কথা বলাতেও লেগেছে নতুন দিনের হাওয়া। মা তো কোনো দিন ভাবতেই পারেননি রোড শোতে স্কুলের পক্ষে সামাজিক সচেতনতার কাজে অংশ নেওয়ার কথা। কিন্তু কিশোরী দিব্যি স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফ্লাশমবের স্ট্রিট ড্যান্সে অংশ নিতে উদ্গ্রীব। এ ক্ষেত্রে মায়ের মত ভিন্ন হলে দূরত্ব তো বাড়বেই। তাই যত রাগ-ক্ষোভ ঘৃণা ঝরে পড়ে মায়ের ওপর। মাও হতবিহ্বল। কীভাবে এই মেয়েকে বোঝাবেন? আর মেয়ের বাবাও তো এক পায়ে খাড়া। স্ত্রীর ক্ষেত্রে পুরুষেরা বিভিন্ন বিষয়ে রক্ষণশীল হলেও মেয়ের ব্যাপারে বেশ উদার। বাবার আশকারা আর মায়ের নানা ছুঁতমার্গে মেয়ে হয়ে ওঠে মায়ের প্রতি বৈরী।
এই বয়সটায় মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল পরিবর্তনগুলো শরীরে দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে হতে থাকে মানসিক পরিবর্তন। এই সময় মেয়েরা বেশ আতঙ্কে থাকে। কখন কোথায় কীভাবে প্যাড চেঞ্জ করবে অথবা কাপড়ে দাগ পড়ে যায় কি না—উৎকণ্ঠায় থাকে মা-মেয়ে দুজনেই। মায়ের উৎকণ্ঠা থাকে ভালোবাসাময়, তবে মেয়ের মধ্যে তখন নতুন পরিপূর্ণ নারী ক্রমেই বেড়ে উঠছে। সে সবকিছু একান্ত নিজের মতো করে মোকাবিলা করতে চায়। এসব সমবয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করতে যতটা তারা আগ্রহী, মায়ের সঙ্গে ততটা নয়। অনেক সময় কাছাকাছি বয়সের খালা, ফুপু, কাজিনদের সঙ্গে সে শেয়ার করে। কিন্তু পরম শুভাকাঙ্ক্ষী মাকে চলে এড়িয়ে। ব্রেস্ট আড়াল করা নিয়ে চলে মা-মেয়ের যুদ্ধ। ওড়না পরা, ঝালর দেওয়া জামা পরা, অন্তর্বাস পরা—সবটাতেই মা-মেয়ের মধ্যে একটু সংকোচ-লজ্জা-জড়তা কাজ করে। পা ঢেকে রাখার জন্য লেগিংস, পাজামা, সালোয়ার—সবই এ সময় পরানোর মহড়া চলে। অনেকে মেনে নেয় আবার কেউ নেয় না। ছেলেদের প্রতি টিনএজ মেয়েদের আগ্রহ ক্রমে বাড়তে থাকে। মায়েরা হয়ে পড়েন শঙ্কিত। কার সঙ্গে প্রেম হলো, কোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের অথবা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলো কি না, এসব দুশ্চিন্তা মায়ের মনে অজান্তেই বাসা বাঁধে।
বর্তমানের হাওয়া
মেয়েদের বর্তমানে ছোটবেলা থেকেই বেশ চটপটে দেখা যায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ইত্যাদির কারণে আগের কথিত লাজলজ্জা, জড়তা, রক্ষণশীলতার আদিখ্যেতা কিশোরীরা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারছে। মায়েরাও পাশাপাশি সহজ হয়ে উঠছেন।
কোনো কোনো মা হয়তো মেয়ের আধুনিক জীবনবোধের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। একটি মেয়ের কথা বলি। সিনেমা, নাটকে অভিনয় করবে। তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সে চায় উগ্রভাবে চলাফেরা করতে। মা-বাবা কারও শাসনই সে মানছে না। মেয়ের এই আবদার, উগ্র চালচলনে মা আগে থেকেই বারণ করছেন। তিনি স্বামীকে জানিয়েছেন অথচ বাবা মেয়েকে কখনো অবিশ্বাস করেননি।
আরেকটি মেয়ে দেখতে সুশ্রী, পড়াশোনায় ভালো। সমস্যা হলো তার অনেক ছেলেবন্ধু আছে। রাত করে বাসায় ফেরে। মা অকারণ তাদের নিয়ে সন্দেহ করলে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। একসঙ্গে অনেক ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলে।
সব দায় মায়ের?
মায়েরা মেয়েদের মনোজগৎ, চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনগুলো দ্রুত আঁচ করতে পারেন। বাবা বাসার বাইরে বেশি সময় দেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন, মেয়েরা থাকে বাবার চোখের মণি হিসেবে। অথচ মেয়ে পড়াশোনায় খারাপ ফলাফল করলে, কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সব দোষ মায়েরই। কেন সে দেখে রাখল না মেয়েকে?
মায়ের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক সন্তানের। নাড়ি কাটার পর সে আলাদা সত্তা হয়ে বাঁচে। কিন্তু লালনপালন, পড়াশোনা—সবকিছুতেই মায়ের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা। এই বন্ধন ছিন্ন করতে না পারলে যেন নিজেকে স্বাধীন ভাবা যাচ্ছে না। মনের মতো কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু মা হলেন এমন একটা নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে শত বৈরিতা সত্ত্বেও মা আবার বুকে টেনে নেবেন।
যা করণীয়
মা-মেয়ের সম্পর্ক দূরত্ব তৈরির মধ্য দিয়ে নয়, বরং পারস্পরিক সমঝোতা বন্ধুসুলভ সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠুক। মাকেও ধৈর্যসহকারে বুঝতে হবে সন্তানকে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মেয়ের সমকাল বিচার করলে চলবে না।
মেয়েকে অকারণ সন্দেহ করা যাবে না। অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা কখনোই সুফল বয়ে আনে না।
সামাজিক কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদ চিন্তা কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। মেয়ের জন্য পৃথিবী যেন মুক্ত আলোয় ভরা ভুবন হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
মেয়েরও আছে কর্তব্য। মা তার পরম বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষীও বটে। বেড়ে ওঠার বয়সটাতে যেসব সমস্যা মেয়েকে মোকাবিলা করতে হয়, সেসব জড়তা ছাড়াই মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত। এটা নিশ্চিত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মা সুপরামর্শ দেবেন।
মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি সহজ সম্পর্ক থাকলে তা মেয়ের জন্য আশীর্বাদ। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো মেয়ের জন্যই খারাপ মা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মায়ের সঙ্গে বড় হতে থাকা কিশোর মেয়ের এই মতের অমিল, এ তো প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিশোরী মেয়ে আর মায়ের এই সম্পর্ক প্যারাডক্স বা আপাতবিরোধী হলেও বাস্তবতা হলো মেয়ে তার মাকে ‘আদর্শ নারী’ হিসেবে ভাবে। অনুসরণও করে। অথচ কখনো সে তার মায়ের মতো হতে চায় না।
কিশোর বয়সে মেয়ে ভাবে, মা তার কথা শুনতে ও বুঝতে চান না। মা সব সময় তাঁর নিজের ছোটবেলার সঙ্গে তুলনা দেন। তাঁর মতো করেই চিন্তা করেন। মাকে সে বোঝাতে পারে না, ‘তোমার যুগ আর এই যুগ এক নয়।’ সব সময় বাঁকা কথা বলেন। সে তো কখনোই, তার মা যা চান, সে রকম হতে পারবে না। মায়ের সঙ্গে তাই কথা বলতেও যেন ইচ্ছা করে না তার।
অন্যদিকে, মা ভাবেন, এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে তিনিও কিশোরী ছিলেন। কী আর এমন সময় বদলেছে। তাঁর মা সে সময়ে যেমন তাঁকে শাসনে রেখেছিলেন, তাঁরও উচিত মেয়েকে সেভাবে দেখেশুনে বড় করে তোলা। নইলে নির্ঘাত মেয়ে তাঁর বখে যাবে।
এই দুই রকম ভাবনাতেই বাড়ে দূরত্ব। টিনএজ মেয়ে দুচোখে দেখতে পারে না মাকে। আর ভালোবাসায় ব্যাকুল মায়ের তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
টিনএজ মনস্তত্ব
কিশোরী মেয়ের টিনএজ বলতে আমরা ১৩ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বুঝি। ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের (পিউবার্টি) মধ্য দিয়ে যায়। প্রকৃতিগতভাবেই মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে শেখে। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, বিপদ-আপদ আন্দাজ করতে শেখে। যাদের ম্যাচুরিটি বেশি, তারা নিজেরাই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনটা কেমন হয়?
টিনএজ মেয়েরা উদ্দাম, উচ্ছল, চঞ্চল, মুডি, অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হয়। মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মায়েরাও এই বয়স পেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা জানেন কত বিধিনিষেধ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এই পর্যায়ে এসেছেন। টিনএজ মেয়েরা সমাজের এই বিধিনিষেধ ভাঙতে চায়, এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু প্রথম প্রথম বাদ সাধেন মা। তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধির আলোকে দেখতে চান মেয়ের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সময় বদলে গিয়েছে। প্রজন্ম ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপ এখানে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। আধুনিক পৃথিবীতে মেয়েদের জগৎ ও জীবনবোধ পাল্টাচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। যে কাজ কয়েক বছর আগেও মেয়েদের জন্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, সে কাজে নতুন দিনের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ফ্যাশন, সাজগোজ, পোশাক-আশাক, চালচলন, কথা বলাতেও লেগেছে নতুন দিনের হাওয়া। মা তো কোনো দিন ভাবতেই পারেননি রোড শোতে স্কুলের পক্ষে সামাজিক সচেতনতার কাজে অংশ নেওয়ার কথা। কিন্তু কিশোরী দিব্যি স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফ্লাশমবের স্ট্রিট ড্যান্সে অংশ নিতে উদ্গ্রীব। এ ক্ষেত্রে মায়ের মত ভিন্ন হলে দূরত্ব তো বাড়বেই। তাই যত রাগ-ক্ষোভ ঘৃণা ঝরে পড়ে মায়ের ওপর। মাও হতবিহ্বল। কীভাবে এই মেয়েকে বোঝাবেন? আর মেয়ের বাবাও তো এক পায়ে খাড়া। স্ত্রীর ক্ষেত্রে পুরুষেরা বিভিন্ন বিষয়ে রক্ষণশীল হলেও মেয়ের ব্যাপারে বেশ উদার। বাবার আশকারা আর মায়ের নানা ছুঁতমার্গে মেয়ে হয়ে ওঠে মায়ের প্রতি বৈরী।
এই বয়সটায় মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল পরিবর্তনগুলো শরীরে দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে হতে থাকে মানসিক পরিবর্তন। এই সময় মেয়েরা বেশ আতঙ্কে থাকে। কখন কোথায় কীভাবে প্যাড চেঞ্জ করবে অথবা কাপড়ে দাগ পড়ে যায় কি না—উৎকণ্ঠায় থাকে মা-মেয়ে দুজনেই। মায়ের উৎকণ্ঠা থাকে ভালোবাসাময়, তবে মেয়ের মধ্যে তখন নতুন পরিপূর্ণ নারী ক্রমেই বেড়ে উঠছে। সে সবকিছু একান্ত নিজের মতো করে মোকাবিলা করতে চায়। এসব সমবয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করতে যতটা তারা আগ্রহী, মায়ের সঙ্গে ততটা নয়। অনেক সময় কাছাকাছি বয়সের খালা, ফুপু, কাজিনদের সঙ্গে সে শেয়ার করে। কিন্তু পরম শুভাকাঙ্ক্ষী মাকে চলে এড়িয়ে। ব্রেস্ট আড়াল করা নিয়ে চলে মা-মেয়ের যুদ্ধ। ওড়না পরা, ঝালর দেওয়া জামা পরা, অন্তর্বাস পরা—সবটাতেই মা-মেয়ের মধ্যে একটু সংকোচ-লজ্জা-জড়তা কাজ করে। পা ঢেকে রাখার জন্য লেগিংস, পাজামা, সালোয়ার—সবই এ সময় পরানোর মহড়া চলে। অনেকে মেনে নেয় আবার কেউ নেয় না। ছেলেদের প্রতি টিনএজ মেয়েদের আগ্রহ ক্রমে বাড়তে থাকে। মায়েরা হয়ে পড়েন শঙ্কিত। কার সঙ্গে প্রেম হলো, কোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের অথবা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলো কি না, এসব দুশ্চিন্তা মায়ের মনে অজান্তেই বাসা বাঁধে।
বর্তমানের হাওয়া
মেয়েদের বর্তমানে ছোটবেলা থেকেই বেশ চটপটে দেখা যায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ইত্যাদির কারণে আগের কথিত লাজলজ্জা, জড়তা, রক্ষণশীলতার আদিখ্যেতা কিশোরীরা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারছে। মায়েরাও পাশাপাশি সহজ হয়ে উঠছেন।
কোনো কোনো মা হয়তো মেয়ের আধুনিক জীবনবোধের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। একটি মেয়ের কথা বলি। সিনেমা, নাটকে অভিনয় করবে। তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সে চায় উগ্রভাবে চলাফেরা করতে। মা-বাবা কারও শাসনই সে মানছে না। মেয়ের এই আবদার, উগ্র চালচলনে মা আগে থেকেই বারণ করছেন। তিনি স্বামীকে জানিয়েছেন অথচ বাবা মেয়েকে কখনো অবিশ্বাস করেননি।
আরেকটি মেয়ে দেখতে সুশ্রী, পড়াশোনায় ভালো। সমস্যা হলো তার অনেক ছেলেবন্ধু আছে। রাত করে বাসায় ফেরে। মা অকারণ তাদের নিয়ে সন্দেহ করলে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। একসঙ্গে অনেক ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলে।
সব দায় মায়ের?
মায়েরা মেয়েদের মনোজগৎ, চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনগুলো দ্রুত আঁচ করতে পারেন। বাবা বাসার বাইরে বেশি সময় দেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন, মেয়েরা থাকে বাবার চোখের মণি হিসেবে। অথচ মেয়ে পড়াশোনায় খারাপ ফলাফল করলে, কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সব দোষ মায়েরই। কেন সে দেখে রাখল না মেয়েকে?
মায়ের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক সন্তানের। নাড়ি কাটার পর সে আলাদা সত্তা হয়ে বাঁচে। কিন্তু লালনপালন, পড়াশোনা—সবকিছুতেই মায়ের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা। এই বন্ধন ছিন্ন করতে না পারলে যেন নিজেকে স্বাধীন ভাবা যাচ্ছে না। মনের মতো কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু মা হলেন এমন একটা নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে শত বৈরিতা সত্ত্বেও মা আবার বুকে টেনে নেবেন।
যা করণীয়
মা-মেয়ের সম্পর্ক দূরত্ব তৈরির মধ্য দিয়ে নয়, বরং পারস্পরিক সমঝোতা বন্ধুসুলভ সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠুক। মাকেও ধৈর্যসহকারে বুঝতে হবে সন্তানকে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মেয়ের সমকাল বিচার করলে চলবে না।
মেয়েকে অকারণ সন্দেহ করা যাবে না। অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা কখনোই সুফল বয়ে আনে না।
সামাজিক কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদ চিন্তা কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। মেয়ের জন্য পৃথিবী যেন মুক্ত আলোয় ভরা ভুবন হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
মেয়েরও আছে কর্তব্য। মা তার পরম বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষীও বটে। বেড়ে ওঠার বয়সটাতে যেসব সমস্যা মেয়েকে মোকাবিলা করতে হয়, সেসব জড়তা ছাড়াই মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত। এটা নিশ্চিত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মা সুপরামর্শ দেবেন।
মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি সহজ সম্পর্ক থাকলে তা মেয়ের জন্য আশীর্বাদ। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো মেয়ের জন্যই খারাপ মা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
No comments