হঠাৎ কেন ই–মেইল তদন্ত, ব্যাখ্যা চান হিলারি
হঠাৎ ফাটানো এফবিআইয়ের বোমায় কিছুটা হলেও বেকায়দায় পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। সংস্থাটি তাঁর ই-মেইল বিতর্ক নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আত্মবিশ্বাসী হিলারি জানিয়েছেন, যতই তদন্ত করা হোক, খারাপ কিছুই পাওয়া যাবে না। বরং ভোটের মাত্র ১০ দিন আগে এমন একটি সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো, তার ব্যাখ্যা চেয়েছেন এফবিআইয়ের কাছে। হিলারির বিরুদ্ধে অভিযোগ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভারে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান করেন। ভোটের প্রচারে নামার পর এ পর্যন্ত হিলারিকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে তাঁর একসময়কার এই ভুল।
প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও এফবিআইয়ের এই ঘোষণা হিলারিকে আবার বেশ বিপাকে ফেলবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। যদিও তিনি বলেছেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি, সেটা দেশের মানুষ জানে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে কাকে ভোট দেবে। তবে একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগের মুখে ডুবতে থাকা ট্রাম্প এফবিআইয়ের সরবরাহ করা নতুন রসদ লুফে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগে না পারলেও এবার সাহস করে ঠিক কাজটিই করেছে এফবিআই। মার্কিন কেন্দ্রেীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের প্রধান জেমস কোমি গত শুক্রবার বলেন, হিলারি সরকারি সার্ভারের বদলে ব্যক্তিগত সার্ভার ব্যবহারের সময় কোনো ‘গোপনীয়’ তথ্য চালাচালি করেছিলেন কি না, তা নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছেন। এ বছরের জুলাই মাসে তিনি কংগ্রেসকে জানিয়েছিলেন, এ নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে কোনো বেআইনি কাজের প্রমাণ মেলেনি, সে কারণে তিনি তদন্ত শেষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন মার্কিন কংগ্রেসের নেতাদের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি তদন্তকাজ পরিচালনার সময় তাঁরা এমন তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন, যা ক্লিনটনের ই-মেইল তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। সে কারণে এই তদন্ত নতুন করে শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গণামধ্যমের খবর অনুযায়ী,
যৌন কেলেঙ্কারির জন্য অভিযুক্ত সাবেক কংগ্রেসম্যান এন্থনি উইনারের ঘরে কম্পিউটারে তল্লাশি চালানোর সময় এফবিআই এসব সন্দেহজনক ই-মেইলের খোঁজ পায়। উইনারের সাবেক স্ত্রী হুমা আবেদিন হিলারি ক্লিনটনের দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী। মাস খানেক আগে তদন্তের সময় এফবিআই উইনারের কম্পিউটারে হুমা আবেদিনের কয়েক হাজার ই-মেইলের সন্ধান পায়। এফবিআইয়ের অনুসন্ধান এখন এসব ই-মেইলের ওপরেই নিবদ্ধ। এসব ই-মেইলে ‘গোপনীয়’ কোনো তথ্য রয়েছে, কোমির চিঠিতে সে কথা বলা হয়নি। নতুন ই-মেইল পাওয়া গেছে, সে কথা তিনি না জানালে তথ্যমাধ্যম তা ফাঁস করে দেবে, তখন অভিযোগ উঠবে তিনি সত্য গোপন করছেন। এই অভিযোগ এড়াতেই তিনি কংগ্রেসের সদস্যদের কাছে তাঁর তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এফবিআই প্রধানের এমন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—হিলারির প্রচার শিবির থেকে এ অভিযোগ তোলা হয়েছে। তারা বলেছে, অধিকাংশ জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা হিলারিকে ঠেকানোর জন্য এবং ট্রাম্পকে সাহায্য করার লক্ষ্যেই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোমি। হিলারি নিজেও কঠোর ভাষায় এফবিআইয়ের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। আইওয়াতে নির্বাচনী সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এ কথা জানানো হলো এমন এক সময়ে, যখন সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আগাম ভোট গ্রহণ চলছে। এফবিআইয়ের তাই উচিত হবে অবিলম্বে এ-সংক্রান্ত সব তথ্য দেশবাসীকে জানানো। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো সব তথ্য জানতে পারিনি। এফবিআইয়ের প্রধান নিজেও বলেছেন, এসব তথ্য অর্থপূর্ণ হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। সে জন্য আমরা দাবি করছি, সব তথ্য পরিষ্কার করে জানানো হোক।’ হিলারি অবশ্য এ আস্থা ব্যক্ত করেন যে অধিকাংশ মানুষ ই-মেইলের বিষয়টি পুরোপুরি জানে,
সে বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা ইতিমধ্যে কাকে ভোট দেবে, সে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে। হিলারির প্রচার ব্যবস্থাপক জন পডেস্টা বলেছেন, নির্বাচনের এত কাছে এসে হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। সব তথ্য অবিলম্বে প্রকাশের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জুলাই মাসে এফবিআই তার তদন্ত শেষে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, এবারও তা থেকে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না, সে ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ আস্থাবান। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান নেতৃত্ব কোমির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। হিলারির বিরুদ্ধে এই তদন্ত জুলাইতে বন্ধ ঘোষণার পর ট্রাম্প কঠোর ভাষায় এফবিআইয়ের সমালোচনা করেছিলেন। তবে কোমির নতুন ঘোষণার পর ট্রাম্পের সুর বদলে গেছে। শুক্রবার নিউ হ্যাম্পশায়ারে এক নির্বাচনী সভার আগে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এফবিআই একসময় যে ভুল করেছিল, এখন তা শোধরানোর সুযোগ পেয়েছে। এবার তারা যথাযথভাবে তদন্ত পরিচালনা করবে, এ ব্যাপারে তাঁর আস্থা আছে। ট্রাম্প এ ঘটনাকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির চেয়েও বড় বলে বর্ণনা করেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্য অভিযুক্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭৪ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন। সন্দেহ নেই, তদন্ত নতুন করে শুরুর ঘোষণা ক্লিনটন শিবিরে বিস্ময় ও উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। মার্কিন ভোটারদের চোখে হিলারির বিশ্বাসযোগ্যতা এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। উইকিলিকস যেভাবে প্রায় প্রতিদিন ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ব্যাপারে একের পর এক এ-মেইল ফাঁস করছে, তাতে হিলারির প্রতি মানুষের আস্থায় আরও চিড় ধরেছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হলো এফবিআইয়ের নতুন তদন্তের ঘোষণা। তবে হিলারি শিবির আশা করছে, জাতীয় পর্যায়ে ও ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ অঙ্গরাজ্যগুলোতে যেখানে দুই দলের কারোরই একচেটিয়া সমর্থন নেই,
সেই সব জায়গায় জনমতে তারা এতটা এগিয়ে রয়েছে যে ট্রাম্পের পক্ষে তাদের ধরে ফেলা অসম্ভব হবে। অবশ্য এই মূল্যায়নের সঙ্গে সবাই একমত নয়। রাজনীতিবিষয়ক পত্রিকা পলিটিকো মনে করে, রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির ঊর্ধ্বে থেকে ইতিবাচক সুরে প্রচারণা শেষ করার যে আশা হিলারি করেছিলেন, এখন তা অলীক মনে হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে ই-মেইল নিয়ে লুকোচুরির জন্য হিলারিকেই দায়ী করেছে। ব্যক্তিগত সার্ভারে সরকারি ই-মেইল চালাচালির বিষয়ে সব কথা খোলামেলাভাবে প্রকাশ না করার দায়ভার এখন তাঁকেই বহন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা গভীর হবে, তা অনিশ্চিত। তবে অধিকাংশ ভাষ্যকার মনে করেন, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে এর প্রভাব অনিবার্য। কংগ্রেসে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য রিপাবলিকান নেতৃত্ব ইতিমধ্যে ট্রাম্পের ওপর থেকে নজর সরিয়ে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে তাঁদের সব পুঁজি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ই-মেইল তদন্ত শুরু হওয়ায় তাঁরা হিলারির ওপর আক্রমণ হানার নতুন রসদ পেয়ে গেছেন। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পল রায়ান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ই-মেইল নিয়ে কেলেঙ্কারির সব দায়-দায়িত্ব হিলারির একার। তিনি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে হিলারি যে উচ্চপর্যায়ের গোপনীয় ‘ব্রিফিং’ পেয়ে থাকেন, তা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।
No comments