নোয়াখালীতে গাড়ি পুকুরে সাতজনের মৃত্যু-আত্মীয়র লাশ দেখার আগে নিজেরাই লাশ

ত্মীয়র লাশ দেখতে যাওয়ার পথে নিজেরাই লাশ হলেন ঢাকার ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য ও গাড়িচালক। গতকাল রোববার ভোর সাড়ে চারটার দিকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাওতলা নামক স্থানে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন: মোস্তাফিজুর রহমান (৫০) ও তাঁর মেয়ে সোহাগী আক্তার (২২), শ্রাবণী আক্তার (১৬), ছেলে শাহদাব হোসেন (১০), সোহাগীর মেয়ে যুঁথি


(৩), মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রীর ভাইয়ের মেয়ে মিলি আক্তার (১৮) ও গাড়িচালক মোস্তাক আহম্মদ (২২)।নিহত শ্রাবণী আক্তার ঢাকার উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী এবং শাহদাব হোসেন একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
পুলিশ ও নিহত ব্যক্তিদের পারিবারিক সূত্রের ভাষ্যমতে, ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই আবদুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ শুনে শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ভাড়া করা একটি প্রাইভেট কার নিয়ে ঢাকার উত্তরার বাসা থেকে শ্বশুরবাড়ি নোয়াখালীর পৌর এলাকার পশ্চিম রাজারামপুরের উদ্দেশে রওনা হন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে সোনাইমুড়ী উপজেলার নাওতলা নামক স্থানে পৌঁছার পর গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে যায়। এর আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে পুকুরে প্রাইভেট কারটি পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দেন এবং মসজিদে গিয়ে মাইকে দুর্ঘটনার সংবাদ প্রচারের পর আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। এরপর স্থানীয় লোকজন ও সোনাইমুড়ী থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাচ ভেঙে গাড়ির ভেতর থেকে চালকসহ সাতজনের লাশ উদ্ধার করে। পরে লাশ থানা থেকে আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নিহত মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের সালেহপুর গ্রামে। তাঁর মেয়ে সোহাগীর স্বামীর বাড়ি একই উপজেলার পশ্চিম সাহাপুর গ্রামে। প্রাইভেট কারের চালক মোস্তাকের বাসা ঢাকার কদমতলীতে।
সোনাইমুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে জানান, সম্ভবত চালক ঘুমের ঘোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাইভেট কারটি পুকুরে পড়ে যায়। গাড়ির ভেতরে থাকা যাত্রীরাও হয়তো ঘুমিয়ে ছিল, এ কারণে তারাও বের হওয়ার চেষ্টাও করতে পারেনি। এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়েছে।
বেঁচে রইলেন শুধু পারুল: ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুরের স্ত্রী পারুল আক্তার (৪০) বড় ভাইয়ের অসুস্থতার খবর শুনে তিন দিন আগে ঢাকা থেকে বাবার বাড়িতে আসেন। শনিবার রাত নয়টার দিকে তাঁর ভাই মারা যান। মুঠোফোনে ঢাকার বাসায় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাঠান তিনি। খবর পেয়েই বাসায় থাকা সবাই নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হন। দুর্ঘটনায় সবার মৃত্যু হওয়ায় ওই পরিবারের বেঁচে রয়েছেন শুধু পারুল নিজে। দুর্ঘটনায় স্বামী-সন্তানদের হারিয়ে তিনি এখন নির্বাক প্রায়। কাঁদতে কাঁদতে বারবার অচেতন হয়ে পড়ছেন। মেয়ে সোহাগীর স্বামী জামরুল ইসলামও স্ত্রী-সন্তানের শোকে কাঁতর।
শোকে কাঁদছে দুই গ্রাম: মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং অসুস্থতায় একই দিনে সালেহপুর ও পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামের সাত ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় শোকে কাঁদছে দুই গ্রামের বাসিন্দারা। গতকাল রোববার সরেজমিন দুই গ্রামের দুই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের অগণিত মানুষ ভিড় করছে সেখানে। স্বজনদের আহাজারিতে প্রতিবেশীদেরও চোখের পানি ফেলতে দেখা গেছে।
লাশ দাফন: থানা থেকে একই পরিবারের ছয়জনের লাশ পশ্চিম রাজারামপুরে নিহত মোস্তাফিজুরের শ্বশুরবাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে সকাল ১০টায় তাঁর স্ত্রীর ভাইয়ের জানাজা শেষে একজনের (মিলির) লাশ রেখে বাকি পাঁচজনের লাশ নেওয়া হয় সালেহপুর গ্রামে। সেখানে দুপুর দুইটায় দুই নারী ও এক শিশুর এবং বিকেল চারটায় বাকি দুজনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.