ভিন্নমত-আগামী বছর শেয়ারবাজার কেমন যাবে by আবু আহমেদ
শেয়ারবাজার আমাদের অর্থনীতিতে একটি আলোচিত বিষয়। ২০১১ সালে এই বাজার অর্থনীতির অন্য যেকোনো খাত থেকে বেশি আলোচিত হয়েছে। বেশি আলোচনায় আসার সুবিধা হয়েছে দুটি : এক. এই প্রথমবার বুঝল সরকারের নীতিনির্ধারকদের সবাই, এটাও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আগে পলিসি ডিসিশনগুলো হতো বিচ্ছিন্নভাবে, শেয়ারবাজারের স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে। এখন এবং সামনে অর্থমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের
গভর্নর তাঁদের পলিসি-নীতি ও সিদ্ধান্ত তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই শেয়ারবাজারের ভালো-খারাপের দিকটি মাথায় রাখবেন। দুই. এতে আরো উপকার হয়েছে এই যে অনেক উদ্যোক্তাই আগে অতি-উৎসাহী ছিলেন শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করার ক্ষেত্রে। এখন তাঁরাও মজা পেয়েছেন যে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এই পুঁজির ভারও অতি হালকা। ফলে এ দেশের অর্থনীতিতে যদি আশাবাদ শক্ত হয়ে গড়ে ওঠে, তাহলে শেয়ারবাজার হবে পুঁজি জোগানোর মূল উৎস। শেয়ারবাজার উদ্যোক্তাদের অনেক বেশি দিয়েছে। বরং তাঁরা শেয়ারবাজারকে দিয়েছেন কম।
আজকে যে কোনো কোনো উদ্যোক্তা শত শত কোটি টাকার মালিক, তা শেয়ারবাজারের কারণেই সম্ভব হয়েছে। ২০১০ সালে লাখ লাখ শেয়ার বিনিয়োগকারী মূল্য কারসাজি এবং বড়দের কেলেঙ্কারির শিকার হয়ে তাঁদের অতি কষ্টের পুঁজির বিরাট অংশ হারিয়েছেন। কিন্তু কোনো উদ্যোক্তা শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে পুঁজি হারাননি। শেয়ারবাজারে বাস অনেকবার এসে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকার প্রতিবারই বাস মিস করেছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে দস্তুরমতো শেয়ারের সরবরাহের ক্রাইসিস চলছিল। আমরা সরকারকে অনেক বললাম, দয়া করে সরকারি শেয়ারগুলো বেচুন। সরকার শুনল বটে, তবে কার্যকর করতে পারল না! কার্যকর করতে না পারা সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা নয় কি? যাঁদের কারণে সরকার তার নিজের শেয়ারগুলো সময়মতো বেচতে পারল না, তাঁদের কারো শাস্তি হয়েছে কি? তাঁরা কেউ কি ওএসডি হয়েছেন? অথচ শক্তভাবে জবাবটা এখানেই চাওয়া উচিত ছিল।
সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ করতে পটু, অথচ শেয়ার বেচে অর্থের ঘাটতি মেটাতে একেবারেই ব্যর্থ। সরকার নতুন প্রকল্প অর্থায়নের জন্যও এই বাজার থেকে ওই দুই বছর হাজার হাজার কোটি টাকা নিতে পারত। কিন্তু নেয়নি। সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক মোবাইল ফোন কম্পানি কি ২০০৯ সালে এই বাজার থেকে শত শত কোটি টাকার ইক্যুইটি ক্যাপিটাল তথা পুঁজি নিতে পারল না? আজকে সেই কম্পানি পুঁজির অভাবে প্রায় মৃত। ভবিষ্যতে এই কম্পানি প্রতিযোগিতায় টিকবে, এটা বোকারা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতে পারে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও ২০০৯-২০১০ সালে এই শেয়ারবাজার থেকে পুঁজির আংশিক নিতে পারত। কিন্তু সেই সংস্থা সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি। আজকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের শেয়ার কেনার জন্য কারো আগ্রহ হবে না। বোকা বাংলাদেশ সরকার জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা ব্যয় করে এই সংস্থাকে নতুন এয়ারক্রাফট কিনে দিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মতলববাজ আর বোকারা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করে না যে এই এয়ারলাইনস আদৌ কোনো দিন লাভে চলতে পারবে। এই সংস্থা হলো জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা হজম করার জন্য একটা হাতি। কাজ বাদে বাংলাদেশই কেবল হাতি পুষতে পারে।
আজকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিকল্পভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবেন। পারলে ভালো কথা। তবে ব্যক্তি খাত_সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক, নতুন করে সমীক্ষা চালাবে এই ব্রিজে বিনিয়োগ তাদের জন্য লাভজনক হবে কি না। কিন্তু এটা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ ছিল, যেটা সরকার এই ক্ষেত্রেও মিস করেছে, সেটা হলো_যমুনা, মেঘনা, দাউদকান্দি ব্রিজকে লিমিটেড কম্পানি করে ওই কম্পানির শেয়ার শেয়ারবাজারে বেচে অনায়াসেই কয়েক হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু অর্থায়নের জন্য সংগ্রহ করা যেত। আমাদের মতো কিছু লোক ওই বুদ্ধিটা সরকারকে দিয়েওছিলাম। কিন্তু সরকারের মধ্যে যে শোনার লোকের বড়ই অভাব। আমলারা শুনবেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। দুটি কারণে তাঁরা এভাবে অর্থায়নে আগ্রহ দেখাবেন না। এক. তাঁরা এই সব কনসেপ্ট বা ধারণা সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে জ্ঞানের ঘাটতি আছে। তাঁরা ওস্তাদ প্রজেক্ট ডিরেক্টর হতে এবং সাহায্য সংস্থা বা বাংলাদেশ সরকারের দেয় অর্থ খরচ করতে। দুই. শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুললে তাঁদের ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। অনেকে বলেন, সে কারণেই তাঁদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহ কম। কিন্তু আমি অবাক হই, আমাদের রাজনীতিবিদরা এবং সংসদ সদস্যরা যাঁরা সরকারের সঙ্গে আছেন, তাঁরাও এই কনসেপ্টকে সরকারের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। দেশে শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। সরকার চাইলে তাঁদেরও মতামত নিতে পারত।
২০১২ সালে শেয়ারবাজার কেমন যাবে। অপেক্ষাকৃত ভালো যেতে পারে, যদি ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটা হুবহু বাস্তবায়ন করা হয়। তবে সেই সঙ্গে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে চাই, তা হলো, আমাদের অর্থনীতি ভালো গেলে শেয়ারবাজার ভালো যাবে। আমাদের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে কি? সামনে আশাবাদে আঘাত হানতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতও। রাজনৈতিক সুস্থতা অর্থনীতি ভালো যাবে কি না, সেটা অনেকটা প্রভাবিত করবে। রাজনৈতিক সংঘাত গভীর হলে সেটা অর্থনীতিকে যেমন সুনামির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, তেমনি শেয়ারবাজারকেও।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আজকে যে কোনো কোনো উদ্যোক্তা শত শত কোটি টাকার মালিক, তা শেয়ারবাজারের কারণেই সম্ভব হয়েছে। ২০১০ সালে লাখ লাখ শেয়ার বিনিয়োগকারী মূল্য কারসাজি এবং বড়দের কেলেঙ্কারির শিকার হয়ে তাঁদের অতি কষ্টের পুঁজির বিরাট অংশ হারিয়েছেন। কিন্তু কোনো উদ্যোক্তা শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে পুঁজি হারাননি। শেয়ারবাজারে বাস অনেকবার এসে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকার প্রতিবারই বাস মিস করেছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে দস্তুরমতো শেয়ারের সরবরাহের ক্রাইসিস চলছিল। আমরা সরকারকে অনেক বললাম, দয়া করে সরকারি শেয়ারগুলো বেচুন। সরকার শুনল বটে, তবে কার্যকর করতে পারল না! কার্যকর করতে না পারা সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা নয় কি? যাঁদের কারণে সরকার তার নিজের শেয়ারগুলো সময়মতো বেচতে পারল না, তাঁদের কারো শাস্তি হয়েছে কি? তাঁরা কেউ কি ওএসডি হয়েছেন? অথচ শক্তভাবে জবাবটা এখানেই চাওয়া উচিত ছিল।
সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ করতে পটু, অথচ শেয়ার বেচে অর্থের ঘাটতি মেটাতে একেবারেই ব্যর্থ। সরকার নতুন প্রকল্প অর্থায়নের জন্যও এই বাজার থেকে ওই দুই বছর হাজার হাজার কোটি টাকা নিতে পারত। কিন্তু নেয়নি। সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক মোবাইল ফোন কম্পানি কি ২০০৯ সালে এই বাজার থেকে শত শত কোটি টাকার ইক্যুইটি ক্যাপিটাল তথা পুঁজি নিতে পারল না? আজকে সেই কম্পানি পুঁজির অভাবে প্রায় মৃত। ভবিষ্যতে এই কম্পানি প্রতিযোগিতায় টিকবে, এটা বোকারা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতে পারে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও ২০০৯-২০১০ সালে এই শেয়ারবাজার থেকে পুঁজির আংশিক নিতে পারত। কিন্তু সেই সংস্থা সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি। আজকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের শেয়ার কেনার জন্য কারো আগ্রহ হবে না। বোকা বাংলাদেশ সরকার জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা ব্যয় করে এই সংস্থাকে নতুন এয়ারক্রাফট কিনে দিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মতলববাজ আর বোকারা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করে না যে এই এয়ারলাইনস আদৌ কোনো দিন লাভে চলতে পারবে। এই সংস্থা হলো জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা হজম করার জন্য একটা হাতি। কাজ বাদে বাংলাদেশই কেবল হাতি পুষতে পারে।
আজকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিকল্পভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবেন। পারলে ভালো কথা। তবে ব্যক্তি খাত_সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক, নতুন করে সমীক্ষা চালাবে এই ব্রিজে বিনিয়োগ তাদের জন্য লাভজনক হবে কি না। কিন্তু এটা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ ছিল, যেটা সরকার এই ক্ষেত্রেও মিস করেছে, সেটা হলো_যমুনা, মেঘনা, দাউদকান্দি ব্রিজকে লিমিটেড কম্পানি করে ওই কম্পানির শেয়ার শেয়ারবাজারে বেচে অনায়াসেই কয়েক হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু অর্থায়নের জন্য সংগ্রহ করা যেত। আমাদের মতো কিছু লোক ওই বুদ্ধিটা সরকারকে দিয়েওছিলাম। কিন্তু সরকারের মধ্যে যে শোনার লোকের বড়ই অভাব। আমলারা শুনবেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। দুটি কারণে তাঁরা এভাবে অর্থায়নে আগ্রহ দেখাবেন না। এক. তাঁরা এই সব কনসেপ্ট বা ধারণা সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে জ্ঞানের ঘাটতি আছে। তাঁরা ওস্তাদ প্রজেক্ট ডিরেক্টর হতে এবং সাহায্য সংস্থা বা বাংলাদেশ সরকারের দেয় অর্থ খরচ করতে। দুই. শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুললে তাঁদের ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। অনেকে বলেন, সে কারণেই তাঁদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহ কম। কিন্তু আমি অবাক হই, আমাদের রাজনীতিবিদরা এবং সংসদ সদস্যরা যাঁরা সরকারের সঙ্গে আছেন, তাঁরাও এই কনসেপ্টকে সরকারের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। দেশে শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। সরকার চাইলে তাঁদেরও মতামত নিতে পারত।
২০১২ সালে শেয়ারবাজার কেমন যাবে। অপেক্ষাকৃত ভালো যেতে পারে, যদি ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটা হুবহু বাস্তবায়ন করা হয়। তবে সেই সঙ্গে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে চাই, তা হলো, আমাদের অর্থনীতি ভালো গেলে শেয়ারবাজার ভালো যাবে। আমাদের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে কি? সামনে আশাবাদে আঘাত হানতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতও। রাজনৈতিক সুস্থতা অর্থনীতি ভালো যাবে কি না, সেটা অনেকটা প্রভাবিত করবে। রাজনৈতিক সংঘাত গভীর হলে সেটা অর্থনীতিকে যেমন সুনামির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, তেমনি শেয়ারবাজারকেও।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments