জাফনার মরমি অতীত ও বিখ্যাত হিন্দু সন্ন্যাসী যোগস্বামীর আশ্রম: ফিরে দেখা by ফ্রান্সিস বুলাতসিঙ্ঘালা
ব্যস্ত ক্রিসমাস সপ্তাহে এক রাতে আমি জাফনাগামী বাসে ওঠে বসলাম, কলম্বোর
চোখ ধাঁধানো আর জৌলুসময় উৎসবমুখর মওসুম পেছনে ফেলে যাওয়াটা আসলেই ছিলো
কঠিন ব্যাপার। শ্রীলঙ্কার উত্তরের ঐতিহাসিক প্রাচীন তামিল রাজ্যটি অসংখ্য হিন্দু
মন্দিরে পরিপূর্ণ। এখনকার লোকজনও বেশ উদ্দীপ্ত হিসেবে পরিচিত। ৩০ বছর ধরে
অবশ্য এলাকাটি তামিল টাইগারদের সাথে গৃহযুদ্ধ নিয়েই বেশি আলোচনায় এসেছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে সামরিক বাহিনীর
বিরুদ্ধে ওই লড়াইয়ে শত শত জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে।
১৯৮০-এর দশক থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা ওই গৃহযুদ্ধের ফলে যে জিনিসটি
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে তা হলো জাফনা ছিল অনেক সাধু পুরুষ আর মরমি
সাধকের আধ্যাত্মিক সাধনার আবাস, বাড়ি। বিশেষ করে তামিল রাজ্যের রাজধানী
জাফনা শহরের উপকণ্ঠে থাকা ন্যালুরের কথা বলা যেতে পারে। এখানেই রয়েছে এই
অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরটি। কার্থিকেয়া বা মরুগান নামে পরিচিত
সাধুর উদ্দেশ্যে ছিল এই মন্দিরটি। এছাড়া কলোম্বোবুথিুরাই ও ভেলভেতিথুরাইয়ের
মতো এলাকাগুলোও হিন্দু ও সুফি সাধকদের কাছে বিখ্যাত ছিল। এসব সাধক অবশ্য
কোনো একটি ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি। ১৯৫০, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে যারাই
আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হতে চাইতেন, তাদের জন্যই স্থানটি ছিল সান্ত্বনা
পাওয়ার স্থান।
বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া এই জাফনাতেই আমি ছুটলাম পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে,
ক্রিসমাসের উৎসবমুখর উন্মাদনাকে পেছনে ফেলে। জাফগান পৌঁছলাম ভোর ৫টায়।
তাড়াহুড়া করে নাস্তা সেরে নিলাম। আর কয়েকজন খ্রিস্টান পাদ্রির কাছে জানতে
পারলাম, অনেক হিন্দু মরমি সাধক ও সুফি ফকিরের আস্তানা এখন তাদের হয়ে গেছে।
সাধকেরা বাস করেন, এমন কয়েকটি আশ্রমের কথাও জানলেন।
আমি জাফনার রহস্যময় অতীত সম্পর্কে অগ্রহী ছিলাম। আমাকে বলা হলো, বিখ্যাত
যোগ সাধক যোগস্বামীর আশ্রমটি এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তিনি পরলোকগমন
করেছেন ১৯৬৪ সালে। কিন্তু জাফনার বেশির ভাগ লোক এখনো তাকে মনে রেখেছে। সব
ধর্মের লোকের কাছেই তিনি শ্রদ্ধাভাজন। তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন জাফনার
সুপরিচিত একটি খ্রিস্টান স্কুলে। তিনি বাইবেল ও পবিত্র কোরআন সম্পর্কেও
জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি মুসলিত উৎসব ও সুফিদের সমাবেশে আল্লাহর গুণগাণ
গাইতেন। তিনি ও তার মতো অন্যান্য সুফি সাধকের কোনো বাড়িঘর ছিল না। কথিত
আছে, বর্ষাকালেও তারা হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতেন। হাসতেন, গাইতেন। তাদের
নিজস্ব বাড়িঘর না থাকায় তারা পুরো জাফনাকেই তাদের বাড়িঘরে পরিণত করেছিলেন।
এরকম আরো অনেক ঋষি ছিলো যেমন: কাদাইত সামিয়ার, ভারিদাপাপ্পারা দেসিয়ার ও
তুত্থুকুদি সামিয়ার।
এসব লোক শান্তির কথা প্রচার করতেন। এরকম কল্পনা করা এখনো কঠিন কিছু নয়।
কারণ উন্নয়নের নামে কলম্বোর বিশাল বিশাল ভবনের জঞ্জাল যেখানে গজিয়ে ওঠছে,
সেখানে জাফনা এখনো সহজ-সরল আর মন্ত্রমুগ্ধকর হয়ে আছে। যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত
বাড়িঘরগুলো নতুন করে তৈরি করেছে জাফনার পরিশ্রমী মানুষ। রাস্তায় বাইসাইকেল ও
মটরসাইকেল বেশি। চলছে গবাধিপশু, মানুষের জন্য পথ করে দিতে যাদের কোন তাড়া
নেই।
জাফনার উপকণ্ঠগুলোতে সরু সরু রাস্তাগুলো স্নিগ্ধতা আর সবুজের
স্বর্গরাজ্য। বাইরের লোকজন এই দৃশ্য দেখে আশ্চর্য না হয়ে যাবে না। তবে আমার
লক্ষ্য ছিল যোগস্বামীর আশ্রম। এটি ছিল জাফনা টাউন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে
কে কে এস রোডে।
যোগস্বামীর আশ্রমটি সিবাথনদাম নামে পরিচিত। এটি সাদামাটা, তবে
সু-ব্যবস্থায় থাকা ভবন। ভেতর থেকে যে তরুণটি বের হয়ে এলেন, তার মুখ
ছাইমাখা, হিন্দু মন্দিরের সাথে জড়িত লোকজন যেমন পোশাক পরে, তিনিও তেমন কিছু
পরে আছেন। তার নাম মুরালিধারান। তার জ্ঞানী বাবা বাত্তিকালোয় যোগস্বামীকে
নিবেদন করা একটি আশ্রম পরিচালনা করেন। মুরালিধারান যোগ সাধনার ওপর কয়েকটি
বই দেখালেন। এতে যোগস্বামীর গান আর বাণী রয়েছে।
মুরালিধারন ব্যাখ্যা করলেন যে যোগস্বামীর কয়েকজন শিষ্য রয়েছেন। সবচেয়ে
ঘনিষ্ঠ শিষ্য হলেন সেলাথুরাই স্বামী। তিনি জাফনা আর বাত্তিকালোয় গুরুর বাণী
প্রচার করেছেন।এছাড়া সান্থস্বামীও বিখ্যাত। তার জন্মনাম ছিল জেমস
র্যামবোথাম। তিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কার শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড
সলবুরির ছেলে। জন্মসূত্রে খ্রিস্টান সান্থস্বামী গভীর ধ্যানে
‘রিক্যাপচুলেশন অব দি লর্ডস প্রেয়ার’ রচনা করেছিলেন।
আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন জাফনা হাসপাতালের এক চিকিৎসক দৈনন্দিন যোগ
করছিলেন। মুরালিধারান আমাকে ডাকলো আশ্রমটি ঘুরিয়ে দেখাবে বলে। সেখানে
যোগস্বামীর প্রবীণ বয়সের ছবি রয়েছে। রূপালি চুলগুলো গিটবাধা এবং ধ্যানের
ভঙ্গিতে নুয়ে থাকা ছবি।
মুরালিধারানের দেয়া বইগুলো থেকে একটির কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে আমি একটি
রুমে প্রবেশ করলাম। এই রুমেই যোগস্বামীর ব্যবহার করা সামগ্রী রাখা হতো।
আরো কয়েকটি হাসিমাখা মুখ আমাকে স্বাগত জানাল। পরে আমি মুরালিধারানকে নিয়ে
আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। তিনি আমাকে সয়া কফি পরিবেশন করলেন। খ্রিস্টান ও
সিংহলি হিসেবে আমি খুশি হলাম এই জেনে যে এই আশ্রমের কারোরই ধর্ম, বর্ণ
কিংবা মতবাদের ব্যাপারে আগ্রহ নেই। অবশ্য আশ্রমটি পরিচালিত হয় শৈবমতে।
কফি পান করতে করতে আমি সুসানাগা বিরাপেরুনার লেখা ছোট্ট একটি চটি বইয়ের
ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। জন্মসূত্রে সিংহলি ও বৌদ্ধ হিসেবে এই লোকটি
আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে লেখালেখি করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। জাফনা যাওয়ার
ট্রেন ভাড়া পর্যন্ত ছিলো না এমন এক তরুণ কিভাবে কলম্বো থেকে সেখানে
পৌছেছিলো, বিস্ময়করভাবে তার মনে যোগস্বামীর সঙ্গে দেখা করার গোপন ইচ্ছাটি
জেগেছিলো।
গল্পের শুরুটা এভাবে, কলম্বোর উপকণ্ঠে সৈকতের পাশে পাথরের উপর বসে কোন
এক সন্ধ্যায় জাফনা থেকে আসা এক তামিল ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। অনেক
চিরন্তন সত্য উচ্চারিত হচ্ছিল সেখানে। বুড়ো লোকটি তাকে জাফনা সফরের
আমন্ত্রণ জানায়। তামিল সংখ্যাগুরু জাফনায় ওই সিনহলা বৌদ্ধ লোকটির কোন বন্ধু
বা স্বজন ছিলো না। এরপরও সেখানে মাসাধিকাল পার করে দেয় সে। যখন আশ্রয়দাতার
মনে হলো যোগস্বামীর সঙ্গে তার দেখা করার সময় হয়েছে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো।
ঋষি সুসুনাগাকে তাকে হাতাওয়ালা এক লম্বা ঝাঁটা নিয়ে স্বাগত জানান। বলেন,
আমি কুলির কাজ করছি। তুমি কেন এক কুলিকে দেখতে এসেছো? অতিথিকে সকালের
নাস্তা পরিবেশনের পর এক ঘন্টা বা তার কিছু বেশি সময় পার হয়েছে। তিনি বলে
উঠেন, ‘গাছের দিকে তাকাও। গাছ কিন্তু ধ্যান করে। ধ্যান হলো নীরবতা। যখন
বুঝতে পারবে যে সত্যিই তুমি কিছু জানো না, তখন তুমি সত্যিকারের ধ্যান করতে
পারবে। এই সত্যবাদিতাই নীরবতার সত্যিকারের ক্ষেত্র। নীরবতাই ধ্যান।’ এ কথা
বলে ঋষি ধ্যানমগ্ন হয়ে যান।
এছাড়া ‘যোগস্বামী: লাইফ অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল গাইডেন্স’ নামের বড় আকারের
একটি বইয়ে অনেক ধর্মের লোকজন যোগস্বামী সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা
করেছেন। যোগস্বামীর ভক্তদের একজন ছিলেন সু্প্রিম কোর্টের খ্যাতনামা
বিচারপতি ও সিলনের সলিসিটর জেনারেল, মুসলিম ব্যক্তিত্ব এম টি আকবর। তিনি
আত্মশুদ্ধির জন্য ইসলামের মানবিক শিক্ষাগুলো প্রচার করতেন। কোন মৃত্যুদণ্ড
দেয়ার পর তিনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গিয়ে আল্লার কাছে ক্ষমা প্রার্থণার জন্য
বসে পড়তেন।
যোগস্বামী জীবনের একটি বড় সময় গাছের নিচে, গাছের পরার্থপরতার আশ্রয়ে
কাটিয়েছেন। বলা হয় যে, একদা তিনি এক সদাশয় বৃদ্ধার পীড়াপীড়িতে একটি ছোট
খালি কুঁড়ে ঘরে থাকতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই প্রথম তার ভক্তদের সমাবেশ ঘটে।
যোগস্বামীর ওপর লেখা বইগুলোতে তার অনেক অলৌকিক কীর্তি তুলে ধরা হয়েছ।, যার
কিছু কিছু সত্যিই বিষ্ময়কর। জীবনের অন্তিম সময়ে তিনি ১৯৮০’র দশক থেকে ২০০৯
পর্যন্ত জাফনার মর্মান্তিক ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন: ‘মন্দিরগুলো ধূলায় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
No comments