গল্প- মাকড়সা by মোহিত কামাল

ঘৃণা অর্থ জানো? মম কঠিন ভাষায় জিজ্ঞেস করল নুহাকে। নুহা জবাব দিল, জানব না কেন? ঘৃণা কুড়ানোর মতো কাজ করেছি। কাজ করে উপহার পাচ্ছি ধিক্কার। উপহার পাচ্ছি বিদ্বেষ আর বিরাগ। এখন যে প্রশ্নটি করেছ, প্রশ্নের মধ্য দিয়েও আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছ নিন্দা। তোমার চোখেও দেখতে পাচ্ছি বিষদৃষ্টি। তোমার প্রশ্নের ধরনই বলে দিচ্ছে আমাকে দেখে
পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে, গা ঘিনঘিন করছে তোমার। নাক সিঁটকানো দেখে মনে হচ্ছে, অসহ্য লাগছে আমাকে, বমি-বমি লাগছে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে হয়ত গা গুলিয়ে উঠবে তোমার, পেটের ভেতর থেকে বমিটা উগরে দেবে আমার ওপর। মম বলল, অফকোর্স। নিন্দিত, গর্হিত কাজ করে বিরাগভাজন হয়েছ তুমি। সত্যটা বুঝতে হবে। বুঝেশুনে চলতে হবে ভবিষ্যতে।
বুঝেশুনে চললে কি ঘৃণ্য কাজের দায় থেকে মুক্তি পাব?
না। মুক্তি পাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই তোমার। সারাজীবন আমার ঘৃণার আগুনে পুড়তে হবে তোমাকে।
তোমার তাচ্ছিল্য বরণ করেই বলছি, ঘৃণার আগুন জ্বলছে তোমারই মস্তিষ্কে_ওই আগুন কি আমাকে, নাকি তোমাকে পোড়াচ্ছে? অন্তরে ঘৃণা পুষে রাখলে ক্ষতি হবে কার ব্রেনে? আমার না তোমার? আমার দোষে তুমি কেন পুড়বে? নিজেকে কেন শেষ করবে?
আমার ক্ষতি নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার। আমার ক্ষতি হলে হোক। তবু সারাজীবন চিৎকার করে বলব, আই ডু হেট ইউ। আমি তোমাকে ধিক্কার জানাই।
তোমার অন্তরের ধিক্কার তোমারই নেতিবাচক সম্পদ। তবে জেনে রেখ, আমার মনে ক্ষোভ নেই, অপমান বোধ নেই। তোমাকে উপেক্ষা বা তোমার ছায়া না মাড়ানোর ইচ্ছা নেই। তোমার সানি্নধ্য না পেলেও, কাছে থাকার সুযোগ না থাকলেও, তোমার ভালো চাইব আমি। কারণ তোমার দেওয়া অসম্মান, তোমার সন্দেহ, তোমার নাক উঁচু স্বভাবের কারণেই নেহাল বাধ্য হয়েছে তোমাকে ছাড়তে। তোমার দেওয়া কষ্টের বান সইতে সইতে, রক্তাক্ত হতে হতে, উপেক্ষিত হতে হতেই আমার দিকে ঝুঁকেছে সে। এজন্য তোমাকে ঘৃণা করব না; ভালোই বাসব। তোমার দুর্ব্যবহারের কারণেই সে এসেছে আমার কাছে। এ কথা মনে রেখ।
অন্যের ফিঁয়াসেকে ছিনিয়ে নিয়ে, দখল করে, লুণ্ঠনের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছ? চিৎকার করে প্রশ্ন করল মম।
উত্তর দিল নুহা, যুক্তিতর্কের বিষয় না এটি। যা সত্য তাই বললাম।
আমি ঠেলে দিয়েছি, নাকি তুমি লুণ্ঠন করেছ নেহালকে?
ঠাণ্ডা গলায় নুহা জবাব দিল, যা বলার বলেছি আমি। তোমার অন্তরের বিতৃষ্ণার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার আর কোনো কথা নেই। তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো। বলতে পারো।
আবারও চিৎকার করে ওঠে মম। তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলতে থাকে, আই হ্যাড সেক্স উইথ হিম ফর থ্রি ইয়ার্স।
মম'র উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতল হতে থাকে নুহার গলা। শীতল স্বরে বলে, আমি জানি। বোথ অব ইউ হ্যাভ এনজয়েড অ্যা লট। হি হ্যাজ বিকাম মোর পারফেক্ট। আই হ্যাভ দ্য অনার অব হিজ পারফরমেন্স নাও।
ওঃ! তোমার সঙ্গেও পারফরম করেছে সে! ওর পারফরমেন্স টের পেয়ে গেছ? মম'র ঘৃণার মধ্যে জ্বলে ওঠে আগুন। ঘৃণা আর ক্রোধের মিশ্রণে মনের মধ্যে হঠাৎ তৈরি হয় ভয়ংকর ঘূর্ণি। ঘূর্ণি সামাল দেওয়ার শক্তি নেই তার। হাতের মোবাইল সেট ছুঁড়ে মারে নুহার দিকে। অল্পের জন্য বেঁচে যায় নুহা। সেট গিয়ে আঘাত হানে ওয়ারড্রোবের ওপর রাখা ফ্লাওয়ারভাসে। সেখানে ছিল কয়েকটি অর্কিডের স্টিক। কাচের ফ্লাওয়ারভাস ভেঙে গেছে; অর্কিডের স্টিক ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অক্ষত আছে দামি মোবাইল সেটটি ।
নুহার বেডরুমে বসে কথা বলছিল ওরা। নুহাকে চার্জ করতে ছুটে এসেছিল মম। মম'র কাণ্ড দেখে অবাক হলো না নুহা। খাট থেকে উঠে মোবাইল সেটটি হাতে তুলে নেয়, অর্কিডের স্টিকগুলো গুছিয়ে রাখে ওয়ারড্রোবের ওপর। ভাঙা কাচের টুকরোগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে নেয় হাতে। ফোনসেটটি মম'র হাতে তুলে দিতে গিয়ে বলল, বি কনট্রোলড। মাথা না সরালে তো ইনজুরড হয়ে যেতাম। পুলিশ অ্যারেস্ট করত তোমাকে। ব্যাপারটা কি শোভন হতো?
মম'র উদ্ধত মেজাজের সামনে নুহার নিয়ন্ত্রিত আচরণ, কথাবার্তা হতবাক করে দেয় মমকে। ভাঙচুরের পর মেজাজ ঠাণ্ডা হতে থাকে। এক সময় কেঁদে ওঠে মম। কেঁদে বলে, জনমের মতো তুমি আমার বুক থেকে কেড়ে নিলে নেহালকে!
কোমল স্বরে নুহা জবাব দেয়, আমি জানি তুমি ভালোবাসো নেহালকে। আমি জানি তোমার অধিকৃত সম্পদ মনে করো তাকে। এ কারণেই তাকে সন্দেহ করতে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখলে চিৎকার চেঁচামেচি করতে। এতে ভালোবাসার বদলে ওর মনে বিতৃষ্ণা জমে গেছে। এজন্য সে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছে। জনমের জন্য সরে আসেনি। ইচ্ছা করলে আবার তাকে তোমার বুকে জড়িয়ে রাখতে পারো। আপত্তি করব না আমি।
নুহার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকে মম। মুখে কোনো কথা ফোটে না।
নুহা আবার বলল, ওর সব কথা শেয়ার করত আমার সঙ্গে। তোমার প্রতি অটুট আছে ওর ভালোবাসা। তবে তোমার সন্দেহ এখন ওর অন্তরে বিষ ঢেলে দিচ্ছে। বিষের ছোবল থেকে মুক্তি দাও তাকে। তোমারই আছে সে। তোমার কাছেই ফিরে যাবে। ফিরিয়ে দেব আমি।
সন্দেহ ছাড়া কীভাবে থাকব? তার পারফরমেন্স তোমারও দেখা শেষ! সে তো বিট্রেয়ার। বিট্রে করেছে আমার সঙ্গে!
এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না নুহা। কারণ গত এক মাস ধরে নুহার দখলে নেহাল। দখল করতে চায়নি প্রিয় বান্ধবীর ফিঁয়াসেকে। কীভাবে যে কী ঘটে গেছে বুঝতে পারেনি। নেহাল তাকে পটায়নি। নুহাও তাকে ইন্ধন জোগায়নি। তবু কী ঘটে যাচ্ছে বুঝতে পারে না নুহা। যাই ঘটুক না কেন, ব্যাপারটা বেশ এনজয় করেছে নুহা। নেহালের টোটাল পারফরমেন্সে মুগ্ধ সে। আর এই মুগ্ধতা টের পেয়ে গেছে মম। এজন্য ছুটে এসেছে তার বাসায়। একচোট নিচ্ছে নুহার ওপর। মম'র প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ধরে নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে নুহা। 'ঘৃণা অর্থ জানো?' মম'র তীব্র এ প্রশ্নটির শাব্দিক অর্থ জানা থাকলেও মর্মার্থ মোটেই অনুতাপ জাগায়নি মনে। মোটেই মনে করছে না ঘৃণিত কোনো কাজ করেছে সে। বরং মনে হচ্ছে নেহালের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। শৈল্পিকভাবে রঙিন চিত্র এঁকে দিয়েছে নেহাল; দেহের মধ্য থেকে বের করে দিয়েছে আরেকটা দেহ, দেহের ভাষার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরেকটি ভাষা। অচেনা-অজানা ভাষাটি হচ্ছে ঐশ্বর্যের, আনন্দের। আনন্দের ভাষা, শিল্পিত ভাষা অশস্নীল হবে কেন? ঘৃণার হবে কেন? বুঝতে পারছে না এ প্রশ্নের জবাব। তবে এক সময় বুঝত, নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে নৈতিকতা। কোন ফাঁকে ভেঙে গেছে নৈতিকতার বাঁধ, টের পায়নি সে। দক্ষ কারিগর নেহাল কি অতি দক্ষতায় তুঙ্গ স্পর্শ করে বদলে দিয়েছে মনোজগৎ, দেহ জগৎ? নৈতিক জগৎ? উত্তর খোঁজার প্রয়োজন মনে করে না। তবে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে বিট্রে করতে চায় না সে। মম'র কাছেই ফেরত দিতে চাইবে নেহালকে। যদি নেহাল ফিরে যেতে চায় বাধা দেবে না, কষ্ট পাবে না, কাঁদবে না। বান্ধবীর জন্য সব শর্ত মানতে রাজি। নুহা এবার উঠে দাঁড়ায়। মম'র মাথায় হাত রেখে বলে, আই'ম সরি মম!
আবারও অবাক হয়ে মম তাকায় নুহার মুখের দিকে।
সত্যি সত্যিই সরি তুমি?
হঁ্যা। সত্যিই সরি আমি। নেহাল যদি তোমার বুকে ফেরত যায়, আপত্তি নেই আমার।
আমাকে কি সস্তা মেয়ে পেয়েছ? ফেরত আসতে চাইলে কি জায়গা দেব আমি একটা বিট্রেয়ারকে?
নুহা বলল, নেহাল বিট্রেয়ার না। বিট্রেয়ার বলতে পারো আমাকেই। আমি তো সরি বললাম। ওকে ক্ষমা করে দাও।
নুহার কথা শুনে আবারও অবাক হয় মম। বোঝে, বান্ধবীর জন্য স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত নুহা কাঁধে তুলে নিচ্ছে নেহালের দোষ। নুহাকে আর ঘৃণা করতে পারছে না। মম'র অন্তরের ঘৃণা বদলে যেতে থাকে। বান্ধবীর জন্য মমতার জায়গাটুক আবার আলোকিত হতে থাকে। নুহার কাছে নিজেকে ছোট মনে হতে থাকে। নিজেকে ভেতরে ভেতরে বিশেস্নষণ করে লজ্জিত হতে থাকে। এত ঘৃণার পর মহত্ত্বের প্রমাণ রেখেছে নুহা। আর সে দেখিয়েছে স্থূলতা, ক্ষুদ্রতা। ছিঃ! 'ঘৃণা অর্থ জানো?' প্রশ্ন্ন করেছিল নুহাকে। প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে সে নুহার কাছ থেকে। কেবল উত্তর পায়নি, শিক্ষাও পেয়ে গেছে । এই নতুন শিক্ষার প্রতিদান কী হতে পারে? কতটুকু প্রতিদান দেওয়া উচিত? যে বাঁধন ছিঁড়ে যেতে পারে, তিন বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে পায়ে ঠেলে দিতে পারে, নিজের শত দোষ থাকলেও, নেহালের পাহাড় সমান দোষ ক্ষমার অযোগ্য। নেহালকে নয়, নুহাকেই ক্ষমা করার ভাবনা জেগে উঠে মনে। নতুন ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'ঘৃণার অর্থ জানো?' প্রশ্নের উত্তরটা ফিরিয়ে নিলাম। ক্ষমা করে দিলাম তোমাকে। নেহালকে ক্ষমা করতে পারব না। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছ। নিজেকে বিট্রেয়ার বলছ তুমি। স্বীকার করেছ। এজন্য ক্ষমা পেতে পারো তুমিই।
আমাকে ক্ষমা করে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা আরো বাড়বে। তোমার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাবে নেহাল। আরো বেশি মিস করবে তাকে। সে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাবে আমার। তখন কষ্টও বেড়ে যাবে তোমার। যাতনা বয়ে বেড়াতে হবে তোমাকে। আমার কাছে এলে নেহালকে তখন সরিয়ে রাখতে পারব না দূরে। বিষয়টি কি ভালো হবে? আর একবার ভেবে দেখ। ওকে ক্ষমা করে দাও। নইলে আমাকে আরো দুষবে তুমি। আমার-তোমার সম্পর্ক জটিলতর হতে থাকবে।
নুহার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে উঠে দাঁড়ায় মম। বোঝে যা বলেছে, ঠিক বলেছে নুহা। নুহাকে ক্ষমা করে লাভ নেই। নেহালকেও ক্ষমা করতে পারবে না মম। ওরা জড়িয়ে গেছে। যাক জড়িয়ে। যা খুশি করুক। নুহা যদি স্বার্থত্যাগের কথা বলতে পারে। সে কেন পারবে না? নতুন ভাবনায় ভিন্ন অবস্থানে নিজেকে তুলে মম বলল, মনে রেখ, আজ সে আমাকে ছেড়ে তোমার কাছে গেছে। তোমাকে দখল করেছে। জয় করেছে। কাল তোমাকে ছেড়ে আর একজনের কাছে যেতে মোটেও বুক কাঁপবে না তার। সহজেই বিসর্জন দিতে পারবে তোমার মমতার বাঁধন। সহজেই বিসর্জন দিতে পারবে নৈতিকতা। যে একবার পেরেছে, বারবার করবে একই কাজ।
শান্ত গলায় নুহা বলল, তুমি ফিরিয়ে দিলে তো নিজেকে ওর কাছ থেকে মুক্ত রাখতে পারব না আমি। তুমিই কি মেনে নিতে পারবে সব?
মম বলল, মেনে নিলাম। বিসর্জন দিলাম। বললামই তো।
এটা তোমার রাগের কথা। জেদের কথা। অন্তরে আর কি কথা লুকিয়ে আছে, এখনো টের পাচ্ছ না। মন শান্ত হলে টের পাবে। নিজের দোষ-ত্রুটি দেখার চোখ খুলে গেলে কষ্ট হবে তখন। প্রতিটি মুহূর্তে ওর সঙ্গ মনে পড়বে। তখন কী করবে? দিশেহারা হবে না? মস্তিষ্কের স্মৃতি কি দূরে তাড়িয়ে দিতে পারবে?
না। বিট্রেয়ারের জন্য আবার কী কষ্ট!
তোমার ভালোবাসায় খাদ নেই। তুমি শুদ্ধ। তুমি বিট্রে করোনি। চিৎকার চেঁচামেচি করলেও সব করতে নিজের অনুরাগের শুদ্ধতার জন্যই। সেই শুদ্ধতা থেকে বেরোতে পারবে তুমি?
মম বলল, পারব।
নুহা বলল, পারবে না।
মম বলল, সেই বিষয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। ক্ষমা করলেও বিসর্জন দিলাম তোমাকেও। তোমরা দুজন সুখে থেকো।
রুম থেকে বেরিয়ে হনহন করে এগিয়ে যায় করিডর দিয়ে। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না মম। মনের ভাষার সঙ্গে দেহের ভাষার যে সংযোগ হয়েছিল, তিন বছরে গড়ে ওঠা সেই ভাষা মুহূর্তেই বদলে গেল।
প্রিয় পাঠক, আপনি কি সঙ্গে আছেন? মম কোথায় গেল, কী করছে, জানতে চাইবেন না? নেহাল কি পাবে আর মমকে? পাওয়া উচিত? নুহা কি আগলে রাখবে নেহালকে? রাখা উচিত? কী জীবনযন্ত্রণার জালে জড়াল তিনটি জীবন? শুনতে চান?
নিজের বেডরুমে এখন নুহা একাকী বসে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা :হে সুন্দর-
সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
আঃ, থাক না, আর কিছু বলার কী দরকার, থাক!
হে সুন্দর, এই নাও, আমার সর্বস্ব, এক জীবনঃ
কবিতাটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবটি আবার ফুঁসে ওঠে মনে_মোটেই মনে করছে না ঘৃণিত কোনো কাজ করেছে সে। বরং মনে হচ্ছে, নেহালের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। বিমূর্ত শিল্প অশস্নীল হবে কেন? ঘৃণার হবে কেন? এটা সুন্দরের অস্ত্র। নির্মম হলেও এই অস্ত্রের আঘাত বুক পেতে নিতে চায় নুহা। সুন্দরের হাতে সঁপে দিতে চায় পুরো জীবন। আর কীইবা বলতে পারত মমকে। যা বলার বলে দিয়েছে। এখন দেখার পালা নেহালকে। সুন্দরের অস্ত্র কোথায় হানে নেহাল, বোঝার জন্য অধীর হয়ে ওঠে নুহা। মনে মনে প্রার্থনা করে নেহালের সঙ্গ। আরাধ্য সঙ্গ কি হবে নির্মম?
প্রার্থনা মঞ্জুর হলো না। নেহাল মেসেজ পাঠিয়েছে মুঠোফোনে_তুমি কি সব বলে দিয়েছ মমকে?
নির্মম সত্য হচ্ছে, মমই টের পেয়ে গেছে নেহালের সঙ্গ পাওয়ার খবর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সব বুঝে গেছে সে। নিজ থেকে কিছুই বলে দেয়নি, বরং নেহালকে ক্ষমা করার জন্য চাপ দিয়েছে। অথচ এসএমএসটা বোঝাতে চাচ্ছে স্বেচ্ছায় বলে দিয়েছে নুহা সব কথা। কী জবাব দেবে? সত্য জবাব কি মেনে নেবে নেহাল? মেনে না নেওয়াটা হবে নির্মমতা। এটাই কি তবে নেহালের সুন্দরের অস্ত্র? এই অস্ত্র কি তবে বুকে বসাবে নির্মমতার বান?
কী জবাব দেবে, ভাবছে নুহা। এমন সময় আবার মেসেজ আসে, ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস করেছ তোমার দেহকাব্য জানার কথা? মেসেজটা পড়ে উত্তর দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল নুহা। বুঝে গেছে নির্মমতা কী। সুন্দরের অস্ত্রের ভাষা ছোবল বসিয়ে দিয়েছে বুকে। এই সুন্দরের হাতে কি তুলে দেওয়া যায় নিজের সর্বস্ব, একজীবন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হতে পারছে না নুহা। সে তো চায়নি নেহালকে। ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে মম'র কাছে। তবুও কেন এ প্রশ্ন? দেহকাব্যের ভাষাও খুঁজতে চায়নি সে। নেহালকে সান্ত্বনা দেওয়ার এক মুহূর্তে নেহাল খুলে দেখেছে তার দেহের পঙক্তিমালা। বাধা দিতে পারেনি। কেন পারেনি। ভেবে অবাক হয় নুহা। এখন বেস্নম করা হচ্ছে তাকে! সেট বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সিএনজি অটোরিকশায় উঠে বলে, ড্রাইভার ভাই, শান্তিনগর চলেন। মমের উদ্ধত প্রশ্নের সামনে সে ছিল নিয়ন্ত্রিত। এখন নেহালের এসএমএস পেয়ে হয়ে গেছে উত্তেজিত। বিক্ষুব্ধ। একই দেহ, একই মন। অথচ প্রতিক্রিয়া একই ধরনের পরিস্থিতিতে দু'রকম। কেন? জানে না নুহা। একবার নিজেকে প্রশ্ন করে এত উত্তেজিত হচ্ছে কেন সে? উত্তর খুঁজে পেল না। সুনীলের পঙক্তিটি আবার নাড়া দেয়_' আঃ, থাক না, আর কিছু বলার কী দরকার, থাক!' সুন্দরের ধাওয়া খেলে এমন ভাবনা ঠিক আছে। ভাবনার পিঠে যে আবেগ ঘনীভূত হয়েছে, তাও ঠিক আছে। এখন পেছনে ধেয়ে আসছে অসুন্দর! অসুন্দর নিয়ে কেন প্রিয় কবি লিখে রাখেননি দুটো পঙক্তি। অসুন্দরের ধাওয়া খেয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, অসুন্দরের অস্ত্রটা কেবল নির্মমই নয়, ভয়ংকরও। এই অস্ত্র ছারখার করে দিতে পারে তুচ্ছ জীবন, জীবনবোধ।
নেহালের বাসার দিকে যতই এগোচ্ছে, ততই মনে হতে থাকে, কী অধিকারে যাবে সে নেহালের কাছে। নেহাল স্পষ্ট বলেছে, মমকেই ভালোবাসে সে। তবুও খুলে ফেলেছে তার দেহকাব্য। খোলার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবেনি। নুহাকেও দোষ দেয়নি। সত্য বলেছে, ভালোবাসে মমকে। তবে কি অধিকারে যাবে সে? ভালোবাসা ছাড়া কি অধিকার স্থাপিত হয় দেহকাব্যে? দেহছন্দে? কিংবা ছন্দের পঙক্তিতে?
প্রশ্নের উত্তর নাড়া দেয় আবার ভেতর থেকে। দুম করে বলল, ড্রাইভার সাহেব, শান্তিনগর নয়। ইউনিভার্সিটিতে চলুন। ঘুরিয়ে নিন অটো।
চট করে থেমে যায় অটোর গতি। ডানপাশের ডিভাইডার দিয়ে ঘুরিয়ে নেয় সিএনজি অটো। ঘোরানোর পর ড্রাইভার বলল, ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে।
ঠিক আছে, বাড়িয়ে দেব।
উত্তর দেওয়ার পরও ড্রাইভারের কথাটা কানে বাজতে থাকে। 'ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে' এটা অবিচার। অবিচার মেনে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। তবুও ভালো। ড্রাইভারের কথা কানে বাজছে। নেহালের এসএমএসের নির্মমতা কানে বাজছে না, মনে বাজছে। কান আর মন দু'ধরনের কথা নিয়ে মশগুল। তাই কোনো কথাই পাত্তা পাচ্ছে না চিন্তায়। যাতনা থেকে রেহাই পেলেও অস্থিরতা থেকে মুক্তি ঘটছে না। প্রশ্নে ঢোকে মনে, কোথায় যাচ্ছে সে? কার কাছে যাচ্ছে? কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে? কী লাভ গিয়ে? উত্তর জানা না থাকার কারণে প্রশ্নগুলো হতাশা বাড়িয়ে তোলে। ড্রাইভারের কথায় ভাবনা থেমে যায়। মনের ভেতর ফুঁসে ওঠা নেহালের মেসেজের প্রতিক্রিয়াও কমে আসে। হঠাৎ মনে পড়ে এখনো বন্ধ আছে সেলফোন। হ্যান্ডব্যাগ থেকে সেট বের করে অন করে অটোর বাইরে তাকায়। রাস্তা বেশ ফাঁকা। ঢাকা শহরের রাস্তা সাধারণত ফাঁকা থাকে না। জরুরি কাজে বের হলে যানজটের ধকল আরো বেড়ে যায়। আজ হাতে জরুরি কোনো কাজ নেই। উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরির সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায় রাস্তা। এখানে একই অবস্থা হয়েছে। অটো এসে হাজির হয়েছে টিএসসি সড়কদ্বীপের সামনে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের পাশে নামে সিএনজি অটোরিকশা থেকে। ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে চোখ যায় নুহার। শ্যাওলা জমেছে। ময়লার আস্তরণ বসে গেছে বেদিতে। কোথাও কোথাও উঠে গেছে টাইলস। রাজু ভাস্কর্যেরও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। এবড়ো-খেবড়ো দাঁত বের করে যেন তাকিয়ে আছে ভাস্কর্যটি। পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে যায় নুহা। এ সময় কেন যাচ্ছে ভাস্কর্যের দিকে? উত্তর জানা না থাকলেও ভাবে ওই ভাঙা বেদিতে বসে কল করবে অদিতিকে। হলে থাকে অদিতি। কল পেয়ে বাইরে আসতে পারে সে। কিছুক্ষণ এক সঙ্গে কাটালে মনের ঝড়-ঝাপটা কমে যেতে পারে ভেবে অদিতিকে কল করে নুহা।
কল ধরে অদিতি বলল, মিরাকল! তোমার কথাই আলাপ হচ্ছিল নেহালের সঙ্গে। এ সময় তোমার কল!
নেহালের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছ তুমি! কী আলাপ হচ্ছিল?
তুমি নাকি কষ্ট দিয়েছ নেহালকে?
এই অভিযোগ করল? একই কথা বলেছিল আমাকে মম'র ব্যাপারে। মম নাকি তাকে কষ্ট দিত। আমার কাছে কষ্টের কথা রিলিজ করে শান্তি খুঁজেছে সে!
সহজভাবে কথাগুলো বলেছে নুহা। কিন্তু সহজভাবে নিতে পারেনি অদিতি। অদিতিও মম'র মতো ক্লোজড ফ্রেন্ড। কথার স্বরে পরিবর্তন থাকায় অদিতি পাল্টা প্রশ্ন করে, কী বলছ এসব?
এ বিষয়ে পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে। তুমি এখন কোথায়? প্রশ্ন করে নুহা।
টিএসসির ভেতরে আছি। সঙ্গে আছে নেহালও।
ওকে ছেড়ে কি বাইরে আসতে পারবে?
হঁ্যা। পারব। তুমি কোথায়?
স্বোপার্জিত স্বাধীনতার বেদিতে বসে আছি আমি। খুব জরুরি, বেরিয়ে আস। না এলে আমার মতো বিপদ হতে পারে তোমারও।
তোমার কি কোনো বিপদ হয়েছে?
হয়েছে নয়। হয়ে গেছে। কমপিস্নকেটেড হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। আমার কথা না শুনলে তুমিও জড়িয়ে যেতে পারো জালে। দ্রুত বেরিয়ে আস। তোমার সঙ্গে যে কথা বলছে, এখন মনে হচ্ছে, নেহাল একটা বিষাক্ত মাকড়সা। মাকড়সা জাল তৈরি করছে। ওই জালে ধরা খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে, ঘোরের মধ্যে ডুবে যাবে। ওই ঘোর থেকে পা তোলার পূর্বেই শেষ হয়ে যাবে। দ্রুত বেরিয়ে আসো একা।
নুহাকে ভালোভাবে চেনে অদিতি। নুহার এখনকার স্বরের মধ্যে আছে জেনুইন বিপদের আশঙ্কা। এই আশঙ্কা বানোয়াট নয়। চট করে উঠে দাঁড়ায় সে বসা থেকে। নেহালকে বলে, তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হবে আমাকে। সরি। কথা শেষ করে দ্রুততার সঙ্গে টিএসসি থেকে বেরিয়ে আসে অদিতি। টিএসসি ভবনের বাইরে এসে দূর থেকে দেখতে পায় নুহাকে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে টিএসসির গেটের দিকে। হাত তুলে অদিতি বুঝিয়ে দেয় দেখেছে সে নুহাকে। নুহাও হাত তুলে সাড়া দেয়; কাছাকাছি আসার পর উঠে দাঁড়ায় স্বোপার্জিত স্বাধীনতার বেদি থেকে। টিএসসির দিকে না গিয়ে ব্যস্ত রাস্তার মোড় পেরিয়ে সে চলে আসে রোকেয়া হলের দিকে। ওকে অনুসরণ করে অদিতিও এগিয়ে যায়। হলের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় নুহা। অনেকটা ছুটতে ছুটতে অদিতি ধরতে পারে নুহাকে।
কী হয়েছে নুহা? খুলে বলো। এমন লাগছে কেন? প্রশ্ন করল অদিতি। এখানে বলা যাবে না। রিকশায় ওঠ। আমার বাসায় চল। আজ বাসায় থাকবে তুমি। হল থেকে মেয়েরা বেরোচ্ছে, ঢুকছে। সামনে রিকশাজট। গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগছে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না, বুঝতে পারে অদিতি। হলে গিয়েও নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে না। রুমমেটের দুই বোন এসেছে, ভর্তি ফরম তুলতে এসে উঠেছে ওরা রুমে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে অদিতি বলে, চল। রিকশায় উঠে বসে ওরা। রিকশা চলতে শুরু করেছে নুহাদের বাসার উদ্দেশে।
চলন্ত রিকশায় মেসেজ টোনের শব্দ হয়। সেটের দিকে তাকিয়ে নুহা বুঝতে পারে এটি নেহালের মেসেজ। ভাবছিল পড়বে না এসএমএসটি। তারপরও চোখ যায় মনিটরে_'মমকে যেভাবে খেপিয়ে দিয়েছ, অদিতিকেও সেভাবে লাগিয়ে দিয়ো না আমার বিরুদ্ধে।'
মেসেজটি পড়ে চকিতে কান গরম হয়ে ওঠে। মাথায় জট বেঁধে যায়। মেসেজ বোমায় আক্রান্ত হয়ে চুরমার হয়ে যায় নুহা। নিজের ভাঙচুর ঠেকিয়ে মুঠোফোনটি শক্ত করে চেপে ধরে ডানহাতের মুঠিতে। নির্বাক তাকিয়ে আছে সামনে। মাথার ভেতর ঘূর্ণির মতো ঘুরছে মেসেজের শব্দগুলো। মমকে খেপিয়ে দিয়েছে সে? এরকম অপবাদ দিতে পারল! অথচ মম'র কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে নেহালকে। সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে মম'র কাছে নত হয়েছে, সরি বলেছে। মম'ই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নিয়েছে সব কথা। কত আর মিথ্যা বলা যায়! যার জন্য চুরি করল, সেই বলছে চোর! প্রথমে মনে হয়েছিল ঘৃণিত কোনো কাজ করেনি নেহালের সঙ্গে, মনে হয়েছিল যা কিছু ঘটেছে, সেটা ছিল পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। মনে হয়েছিল দেহের মধ্যে আবিষ্কৃত ভাষাটি ঐশ্বর্যের, আনন্দের_অশস্নীল নয়। মনে হয়েছিল, ওই ভাষা হচ্ছে সুন্দরের অস্ত্রের আঘাতে সৃষ্ট নতুন স্বর, সুখের জানালা খুলে দিয়েছিল মনে। উপলব্ধি বদলে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হচ্ছে এখন মন। সুন্দরের অস্ত্রের আঘাতে নির্মমতার চিহ্ন বসে গেছে জীবনে।
অদিতি বলল, এমন চুপ করে থাকলে চলবে? খুলে বলো কী হয়েছে।
রিকশাওয়ালার দিকে চোখ উঁচিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এখানে বলা যাবে না সব কথা।
আচ্ছা, সহজ হও। এমন শক্ত হয়ে আছ কেন?
সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। সহজ হতে পারছে না। সহজ হতে গিয়ে আরো শক্ত হয়ে মোবাইল সেট অদিতির হাতে দিয়ে বলে, পড়।
চট করে পড়ে নিয়ে অদিতি বলল, তোমাকে দুষছে সে। নিশ্চয় তুমি মমকে খেপাওনি। নিশ্চয় আমাকেও খেপাবে না। নিশ্চয় ভুল বুঝেছে নেহাল।
ভুল বোঝেনি। সুচতুর সে। তার ধূর্ততা ধরা পড়ে যাবে ভেবে শঙ্কিত হচ্ছে। এজন্য ঢালাওভাবে দোষ দিচ্ছে আমাকে। নিজের দোষ ঢাকতে চাচ্ছে।
তুমি তো নিজের কাছে স্বচ্ছ। অন্যে দুষলেই হবে? রিকশাওয়ালার কথা ভুলে গিয়ে অজান্তেই ঢুকে যায় তারা আলাপে।
নুহা বলল, নিজে স্বচ্ছ নেই আমি। আমাকে অস্বচ্ছ করে ফেলেছে সে। আমাকে যেভাবে মোটিভেট করেছে, বদলে নিয়েছে নিজের মতো করে, মনে হচ্ছে একই উদ্দেশ্যে লেগেছে তোমার পেছনেও।
নুহার জবাব শুনে চুপ হয়ে যায় অদিতি। গত কয়েকদিনের বিভিন্ন ঘটনা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তখন ঘটনাগুলো সহজভাবে নিয়েছিল। ফান হিসেবে নিয়েছিল। ফান করতে করতে নেহাল তার উরুতে থাপ্পড় দিয়ে বলেছিল, 'তোমার স্বামী হবে খুবই ভাগ্যবান।'
'আলাদা এমন কী আছে আমার? স্বামী ভাগ্যবান হবে, ভাবছ কেন?'
'সেটা বলা যাবে না, গোপন কথা।' লজ্জা পেয়েই বলেছিল নেহাল।
গোপন কথার মোড়ক উন্মোচন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল অদিতি। গোপনীয়তা ফাঁস করেনি নেহাল। নেহালের ওই রহস্যময়তা ভাঙার জন্য বেপরোয়া অদিতি কেবল চাচ্ছিল নেহালের সঙ্গ। বুঝতে পেরেছিল গোপন রহস্যময়তা তৈরির গুরু নেহাল। এটাই কি গোপন চাল? এই চালে কি জড়িয়ে গেছে সে! নুহাও কি আটকে গেছে পাতানো মাকড়সার জালে? মম'র কথা তো ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে ওদের মধ্যে অ্যাফেয়ার চলছে। যা ইচ্ছা করে, করুক। একটা সম্পর্ক চলার মধ্যে থেকেও কি অন্য আরেকজনকেও ফাঁদে লটকাতে পারে কোনো ছেলে? বিশ্বাসযোগ্য? মনের মধ্যে প্রশ্ন এনেও নুহাকে দুষতে পারে না। বিশ্বাস করে নুহাকে। বোঝে, অযৌক্তিক কোনো কথা বলবে না নুহা। ভাবনা নিয়ে নুহার হাত চেপে ধরে বলল, বাসায় গিয়ে সব শুনব। পিস্নজ বি ইজি।
সহজ হতে পারছে না নুহা। নিজেকে ঘৃণিত মনে হচ্ছে। নিজের মনেই জাগছে বিরাগ। ধিক্কার দিচ্ছে সে নিজেকে। এত সহজে গলে গিয়েছিল! এত সহজে পা দিয়েছিল নেহালের জালে! বিবমিষা জাগছে; ঘৃণার তীর ছুটে আসছে নিজের দিকে। বুকের গহীন ভেতরের প্রতিধ্বনি বেরিয়ে আসছে বাইরে। আকস্মিক চিৎকার করে বলল, আমরা সবাই ফ্রেন্ড ছিলাম। ফ্রেন্ড ছাড়া কিছুই ভাবতাম না ওকে। একদিন সবার সামনে কলাভবনের চত্বরে বসে গল্প করার সময় আমার উরুতে টোকা দিয়ে বলেছিল, 'যে তোমাকে পাবে, সে হবে ভাগ্যবান!'
নুহার উরুতে নেহালের টোকা দেওয়ার কথা শুনে চকিতে বদলে যায় অদিতি। ভুলে যায় রিকশাওয়ালা শুনছে সব কথাঃ। নুহার কথা ঠেকানোর চেষ্টা থেমে যায়। দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে থাকে নুহার মুখের দিকে। একই ধরনের কথা নেহাল বলেছিল তাকে। এভাবে কি তবে ছেলেরা মেয়েদের দেহের গোপন ভাষা জাগিয়ে তোলে? বের করে আনে অন্তরধ্বনি? ইচ্ছামতো তখন কি এভাবেই তারা ব্যবহার করে সেই ভাষা! সেই ধ্বনি! অনভিজ্ঞ অদিতির চোখ খুলে যায়। খোলা চোখে বুঝতে পারে নুহাকে ছেড়ে দেয়নি; নুহার ভেতরের শুদ্ধতা বের করে নিজেকে পূর্ণ করে নিয়েছে নেহাল। বুঝতে পারে প্রতারণার শিকার হয়েছে নুহা। মম'র সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মধ্যে থেকেও আড়ালে গোপনে নেহাল মণি-মুক্তো খুঁজে বেড়িয়েছে অন্যের মাঝে। এটা কী ধরনের বৈশিষ্ট্য? কেন দৃঢ়তা নেই নেহালের? অনেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই কি তার ভেতর থেকে টেনে বের করে দিয়েছে পুরুষ-সত্তা? সেই সত্তা কি নিয়ন্ত্রণে নেই নেহালের? এজন্য কি নারী-পুরুষের মেলামেশায় নিয়ন্ত্রণের কথা বলে থাকেন অভিভাবকরা? নতুন প্রশ্নগুলো অন্তর্জগৎ আলোকিত করতে থাকে। নিজের ভরাডুবির পূর্বেই অদিতি দেখতে পায় নিজের দেহের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শতসহস্র গোপন ঢেউয়ের দুরন্ত গতি। বুঝতে পারে থামিয়ে দিতে হবে ওই ঢেউ; ওই গতি। নুহার হাত চেপে ধরে এবার বলল, নুহা থামো। আর কথা বলো না। বাসায় গিয়ে সব শুনব। সব শুনব বললেও শোনার আগ্রহ থেমে যায়। নুহার উরুতে নেহালের টোকা দেওয়ার কথা শুনে পূর্ণ হয়ে যায় অচেনা, অজানা কৌতূহল। খুলে পড়ে নেহালের তৈরি মাকড়সা-জাল, রহস্যময়তার খোলস।
অদিতির হাতের চাপ খেয়ে এবার থেমে যায় নুহা। রিকশা ছুটছে সামনে। পৌষের মাঝামাঝি সময়ে দিনের প্রায় মধ্যভাগেও রোদের দেখা নেই। সূর্যকে আড়াল করেছে প্রগাঢ় কুয়াশা। ঢাকায় শীতের প্রভাব দেশের উত্তরাঞ্চলের চেয়েও তীব্র না হলেও দিনভর আবছায়া আর কনকনে হাওয়ার ঝাপটা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত করেছে জীবনযাত্রা। ফাঁকা রাস্তায় প্রায় উড়ন্ত গতিতে ছুটছে রিকশা। চলমান রিকশার গতির সঙ্গে পালস্না দিয়ে ছুটতে পারছে না মনের গতি। জীবন-কুজ্ঝটিকায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মনের আলো। আবছায়া কি দূর হবে? আবার ফুটবে কি জীবন-আলো? প্রশ্ন থাকলেও উত্তর জানা নেই নুহার। প্রগাঢ় শূন্যতা বুকে নিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে সামনে। অদিতির ধরা হাত ছাড়তে চায় না নুহা; বন্ধুত্বের শুদ্ধতা নিয়ে অাঁকড়ে ধরে বসে থাকে পরম নির্ভরতায় ।
==============================
দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোহিত কামাল


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.