জলি আমন ধান বিষয়ক কিছু কথা by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

বাংলাদেশ বান-বর্ষার দেশ। একসময় জায়গাভেদে জলি আমন আমাদের অন্যতম ফসল ছিল। কিন্তু আধুনিক ধান প্রযুক্তি এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামোর (রাস্তাঘাট) কারণে এই ধান আমাদের দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেওয়ার পথে। তবু ভাতের স্বাদ, পানির বাড়ার সঙ্গে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা এবং উৎপাদন খরচের কথা মাথায় রেখে বৃহত্তর সিলেট, ফরিদপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, খুলনার কিছু কিছু চাষি এই ধানের এখনো আবাদ করে থাকে।


এসব জায়গায় শীতে হয়তো সরিষার আবাদ হয়। সরিষা অল্প সময়ের ফসল। এই ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে বোরো আবাদ করা হয়। বোরো তোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনোমতে পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি কিছুটা আলগা করে জলি আমনের বীজ বুনে দেওয়া হয়। আর যদি পানি চলে আসে তাহলে সুযোগ বুঝে জলি আমনের চারা তৈরি করে জমিতে রোপণ করা হয়। আমি যে শস্যক্রমের কথা বললাম, তা সব জায়গায় হয়তো এক রকম নয়। কারণ একসময় এই ধান বৈশাখ মাসে ধুল্যা বাইন (উৎু ফরৎবপঃ ংববফরহম) করা হতো। এখনো কোথাও কোথাও করা হয় বলে আমার বিশ্বাস। যা হোক, জলি আমন যাঁরা চাষ করছেন, তাঁদের ফসলক্রম মোটামুটি এই রকমই। জলি আমনের আবাদ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। কিন্তু এত কিছুর পরও ব্রি আজ পর্যন্ত একটাও জলি আমনের জাত অবমুক্ত করেনি বা করতে চায়নি। এটা ব্রির (ইজজও) ব্যর্থতাই বলা যায়। এর একটা কারণ হতে পারে যে এই জাতগুলো তাদের পানিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফলন দেওয়ার ক্ষমতা হারাতে থাকে। যা হোক, এটা জানার পর আমরা বোধ হয় আমাদের গবেষণার দ্বার আর উন্মুক্ত রাখতে চাইনি। অথচ ধান গবেষণার শুরু থেকেই জলি আমন ধান নিয়ে কাজ শুরু হয়। সে প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সে সময়ের অগ্রগতি খারাপ ছিল না। এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে।
তখন বাছাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে সংগৃহীত কোনো সম্ভাবনাময় জাত থেকে বিশুদ্ধ কৌলিক সারি সৃষ্টি করে আবার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। সে সময় জলি আমন ধানের মধ্যে বাইশ বিশ ও গাবুরা চাষিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আমাদের দেশে শাইল ও আউশ ধানের উন্নয়নের কাজ ১৯১১ সালে শুরু হলেও জলি আমন ধান নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ শুরু হয় ১৯১৭ সালে এবং তা ঢাকা ফার্মে। ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা ও সিলেট অঞ্চল থেকে ১৭০টি জাত সংগ্রহ করা হয়। ১৯৩৭ সালে ৭০০ বিশুদ্ধ সারি বিভিন্ন পানির গভীরতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ১.৫ মিটার পানি অবধি টিকে থাকতে পারে এমন জাতগুলো এবং ১.৫ মিটারের বেশি পানিতে টিকে থাকতে সক্ষম জাতগুলো। দ্বিতীয় গ্রুপ থেকে বন্যা প্রতিরোধ, পানি ভাঙার ক্ষমতা (ঊষড়হমধঃরড়হ ধনরষরঃু) এবং ভালো ফলনের ভিত্তিতে ৩১টি জাত বাছাই করা হয়। ঢাকা ফার্মের নিচু জমিতে সর্বনিম্ন পানির গভীরতা ২ থেকে ২.৫ মিটারের বেশি হতো না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সেখানেই জাত নির্বাচনের কাজগুলো করা হয়। সবচেয়ে ভালো জাতগুলো দিয়ে ১৯৩৮-৩৯ সাল থেকে আটটি জাত (বাইশ বাইশ, গাবুরা, শুটক, লালখানি, দুলিয়া, ঝুনি, নথপাশা ও বাগরাই) নিয়ে ফলন পারফরম্যান্স পরীক্ষা কার্যক্রম চালু হয়।
নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাইশ বিশ ও গাবুরা_এই দুটি জাতকে উন্নত জাত হিসেবে সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে এই দুটি জাতকে আদর্শ (ঈড়হঃৎড়ষ) হিসেবে বিবেচনা করে আরো কিছু সম্ভাব্য জাত দিয়ে ফলন পারফরম্যান্স পরীক্ষা চালানো হয়। সব দিক বিবেচনা করে বেগুনি রঙের মালিয়াভাঙ্গর জাত সুপারিশ করা হয়। এই জাতের ফলন আশাপ্রদ ছিল না। তবে জাতটির গাঢ় বেগুনি রঙের কারণে জলি আমন ধানের সবচেয়ে খারাপ আগাছা ঝরা-ধানকে শনাক্ত করা সহজ ছিল। তা ছাড়া এই জাতের পানি ভাঙার ক্ষমতা ছিল ভালো।
১৯৫১ সালে সংকরীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মালিয়াভাঙ্গর ী জংলি ধান এবং গাবুরা ী মলিয়াভাঙ্গরের মধ্যে সংকরীকরণ (ক্রস) করা হয়। মালিয়াভাঙ্গর ী জংলি ধানের ক্রস থেকে উদ্ভাবিত একটি জাতের রঙিন অঙ্গজ অংশ (ঠবমরঃধঃরাব ঢ়ধৎঃ) থাকায় সহজেই তা আগাছা ঝরা-ধান থেকে আলাদা করা যেত। এই জাতের পানি ভাঙার ক্ষমতাও ভালো ছিল। তবে চাষিদের কাছে এই জাত পেঁৗছেছিল কি না তা জানা যায় না। ১৯৩৪ সালে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের নাগুরা ফার্ম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে জলি আমনের আটটি জাত অনুমোদিত হয়। এগুলোর মধ্যে কাত্যাবাগদার, গদালাকি, গোয়াই, দুধলাকি, ধলা আমন এবং লাল আমন বাছাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়। এগুলো যথাক্রমে হবিগঞ্জ-১, ২, ৩, ৪, ৮ অনুক্রম হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। হবিগঞ্জ-৬ ও ৭ সংকরীকরণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন করা হয়। এই জাতগুলোর কোনোটি চার-পাঁচ ফুট গভীর পানিতে, কোনোটি ৯ থেকে ১২ ফুট গভীর পানিতে জন্মানোর উপযোগী ছিল। ফলনও সময়ের তুলনায় খারাপ ছিল বলা যাবে না।
ব্রি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যেন এই ধরনের জাত উন্নয়নের কথা আমরা ভুলে যেতে থাকি। তবু কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিজ্ঞানী তাঁদের কিছু কার্যক্রম নিয়ে এগোতে থাকেন। কিন্তু তা যে খুব পরিকল্পিত বা শক্তিশালী কার্যক্রম ছিল, তা মনে হয় না। এরই সূত্র ধরে বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ব্রি থেকে কয়েকটি জাত অবমুক্তির কথা শোনা যায়। কিন্তু তা আর হয় না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, মাঠপর্যায়ে প্রতিবছর প্রতিটি জায়গায় এই কৌলিক সারিগুলোর ফলন স্থিতিশীল থাকে না। এই অজুহাতেই হয়তো বীজ প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ কৌলিক সারিগুলোকে জাত হিসেবে স্বীকার করে নিতে চাইবে না। আমার কাছে তা খোঁড়া যুক্তি বলে মনে হয়। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল তা হলো, আধুনিক জাতের ধানের সঙ্গে জলি আমনের জাতের জাতবৈশিষ্ট্য আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। এখানে ফলনের চেয়ে পরিবেশের বিষয়ে জোর দিলে ভালো হতো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন কথা বলেছে বলে জানা যায় না।
যা হোক, জলি আমন নিয়ে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটও জাত উদ্ভাবনের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি। তারা সম্ভবত এ বিষয়ে খুব বেশি আন্তরিক ছিল না। পরে তারা জলি আমন ধানের (উববঢ় ডধঃবৎ জরপব) সংজ্ঞাও পাল্টে ফেলে। তার পরও এই আমরা চাই জলি আমন ধান নিয়ে নতুন করে কিছু কাজকর্ম শুরু হোক। কারণ জাতটি শুধু কৃষকবান্ধবই নয়, পরিবেশবান্ধবও। হয়তো এই কথাটি মনে করে আমাদের দু-একজন বিজ্ঞানী নীরবে-নিভৃতে কিছু কাজ করে যাচ্ছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁদের হাতে এখনো কিছু কৌলিক সারি আছে, যেগুলো জায়গাভেদে ভালো জাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
biswas.jiban@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.