একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... by কামাল লোহানী
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ছাত্রমিছিলে গুলি চালানোর প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়েছিল কবিতাটি।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের ছাত্ররা একটি লিফলেট প্রকাশ করে। সেখানে কবিতাটি ছাপা হয়। এরপর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে ‘একুশের গান’ হিসেবে ছাপা হয় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। শহীদের রক্তে যে প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল সেদিন, সেই ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার নিয়ে আমরা চলেছি আজও, আন্দোলনের ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও। তবে এই উচ্চারিত শোকগাথা আর সুর সৃষ্টি আজ গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, কারণ আমাদের বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যে বিশ্ব সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। মাতৃভাষা দিবসে আমাদের দূতাবাসগুলোতে অনুরণিত হচ্ছে গানটি।
এই কবিতাটির যে সুরের সংগীত মাধুর্য বিশ্বকে আজ চমৎকৃত করছে, তার স্রষ্টা শিল্পী সংগ্রামী আলতাফ মাহমুদ। কী অনন্য-সাধারণ প্রতিভায় প্রদীপ্ত স্বাক্ষরেই না সৃষ্টি হয়েছে এই কালজয়ী সুর।
তবে এই অপূর্ব কবিতাখানি লিখিত হওয়ার পর সেদিনের আরেক তরুণ সচেতন ছাত্র রফিকুল ইসলাম একে তুলে দিয়েছিলেন দেশের বরেণ্য এক কণ্ঠশিল্পী আবদুল লতিফের হাতে। প্রলুব্ধ অথচ শোকার্ত শিল্পীর আবেগ-মথিত সুর একদিন ঢাকা কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ব্যথা আর বেদনার পাশাপাশি নবীন সমাবেশে ভাষার দাবিতে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
ইতিমধ্যে বরিশালের সচেতন যুবকর্মী, শিল্পী-সংগঠক আলতাফ মাহমুদ এই কবিতাটি পড়ে প্রলুব্ধ হন এবং তিনিও সুরারোপ করেন। লতিফ ভাইকে সুরটি শোনাতে চাইলে তিনি শুনেছিলেন তো বটেই, সেই সঙ্গে এক শৈল্পিক মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আবদুল লতিফ উদারচিত্তে আলতাফ মাহমুদকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সেদিন এবং অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমার সুরেই এই গানটি গাইবে সবাই। আমার দেওয়া সুর স্থগিত রইল।’ এ যে কত বড় মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত, তা বলে শেষ করা যাবে না। এর কোনো উদাহরণ আর মিলবে না। সেই থেকে আবদুল লতিফের সুরটি স্থগিত হলেও তাঁর শিল্পীসুলভ ঔদার্য ঘটনাটিকে মহিমান্বিত করেছে। আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরটিই আজ বাজে প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামেগঞ্জে, নগরে-বন্দরে, ঘরে ঘরে।
একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাণ বলিদানের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালি হিসেবে যে অধিকার অর্জন করেছিলাম, তারই প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যখন একুশের অনুষ্ঠানে এই গানটি পরিবেশন করেছি, তখন দেখেছি আলতাফ মাহমুদকে প্রচণ্ড হূদয়ানুভূতি দিয়ে তাঁর সুরকে বাঙ্ময় করে তুলছেন সমবেত মানুষের মধ্যে। ছড়িয়ে দিচ্ছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করে। একুশের চেতনা আমাদের জাতিসত্তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আমরা শক্তি সঞ্চয় করেছি একুশ থেকে, এই ভাষার আন্দোলন আমাদের যে গতি দিয়েছিল, যে পথনির্দেশ করেছিল, তাকেই লক্ষ করে আমরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলাম। আমরা ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিলাম। এই লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের কানে যেন বেজেছে এই শহীদের গান। প্রভাতফেরির জন্য বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে যে দলগুলো বের হতো, তাদের কণ্ঠে উঠে আসত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। এখনো একই ধারায় একই সুর-মূর্ছনায় বাঙালি জাতি কেবল নয়, আমাদের দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষও জেগে ওঠে, আপন সত্তাকে বিকশিত করার জন্য তারাও প্রাণময় সংঘবদ্ধতায় অভিসিক্ত হয়। এই একুশের গান, এই একুশে আমাদের শিখিয়েছে, মানুষের শক্তি কী অপ্রতিরোধ্য।
এ ছাড়া সে গানগুলো তাৎক্ষণিক এবং পাকিস্তানি শাসনামলে ভাষা সংগ্রামের ওপর রচিত হয়েছে, তার মধ্যে আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা গ্রাম্য কবি শামসুদ্দিনের লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা মোশারেফ উদ্দিন আহমদের লেখা ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে’ অন্যতম। বদরুল হাসান লিখলেন ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা’, ছাত্রনেতা গাজীউল হক রচনা করলেন ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারী’। প্রখ্যাত লোককবি রমেশ শীল গাইলেন, ‘ভাষার জন্য জীবন হারালি বাঙালি ভাইরে রমনার মাটি রক্তে ভাসালি’। চারণকবি-লোকগায়ক হাকিম ভাই গেয়েছিলেন, ‘বাংলা মোদের মাতৃভাষা বাংলা মোদের বুলি’, হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন ‘মিলিত প্রাণের কলরবে যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’, ছাত্র ও সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন লিখেছিলেন, ‘অনেক একুশ দেখেছি, দেখেছি তোমায় নাগরিকবেশে’। ফজলে লোহানীর একুশে কবিতা খান আতার সুরে প্রাণ পেল ‘শীতল পৃথিবী অবশনগর’, এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, যাত্রা রচিত হয়েছে।
এসবই তো নানা সংগ্রামে আমাদের প্রেরণার উৎস। লড়াইয়ের সাহস।
এই কবিতাটির যে সুরের সংগীত মাধুর্য বিশ্বকে আজ চমৎকৃত করছে, তার স্রষ্টা শিল্পী সংগ্রামী আলতাফ মাহমুদ। কী অনন্য-সাধারণ প্রতিভায় প্রদীপ্ত স্বাক্ষরেই না সৃষ্টি হয়েছে এই কালজয়ী সুর।
তবে এই অপূর্ব কবিতাখানি লিখিত হওয়ার পর সেদিনের আরেক তরুণ সচেতন ছাত্র রফিকুল ইসলাম একে তুলে দিয়েছিলেন দেশের বরেণ্য এক কণ্ঠশিল্পী আবদুল লতিফের হাতে। প্রলুব্ধ অথচ শোকার্ত শিল্পীর আবেগ-মথিত সুর একদিন ঢাকা কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ব্যথা আর বেদনার পাশাপাশি নবীন সমাবেশে ভাষার দাবিতে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
ইতিমধ্যে বরিশালের সচেতন যুবকর্মী, শিল্পী-সংগঠক আলতাফ মাহমুদ এই কবিতাটি পড়ে প্রলুব্ধ হন এবং তিনিও সুরারোপ করেন। লতিফ ভাইকে সুরটি শোনাতে চাইলে তিনি শুনেছিলেন তো বটেই, সেই সঙ্গে এক শৈল্পিক মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আবদুল লতিফ উদারচিত্তে আলতাফ মাহমুদকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সেদিন এবং অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমার সুরেই এই গানটি গাইবে সবাই। আমার দেওয়া সুর স্থগিত রইল।’ এ যে কত বড় মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত, তা বলে শেষ করা যাবে না। এর কোনো উদাহরণ আর মিলবে না। সেই থেকে আবদুল লতিফের সুরটি স্থগিত হলেও তাঁর শিল্পীসুলভ ঔদার্য ঘটনাটিকে মহিমান্বিত করেছে। আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরটিই আজ বাজে প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামেগঞ্জে, নগরে-বন্দরে, ঘরে ঘরে।
একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাণ বলিদানের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালি হিসেবে যে অধিকার অর্জন করেছিলাম, তারই প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যখন একুশের অনুষ্ঠানে এই গানটি পরিবেশন করেছি, তখন দেখেছি আলতাফ মাহমুদকে প্রচণ্ড হূদয়ানুভূতি দিয়ে তাঁর সুরকে বাঙ্ময় করে তুলছেন সমবেত মানুষের মধ্যে। ছড়িয়ে দিচ্ছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করে। একুশের চেতনা আমাদের জাতিসত্তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আমরা শক্তি সঞ্চয় করেছি একুশ থেকে, এই ভাষার আন্দোলন আমাদের যে গতি দিয়েছিল, যে পথনির্দেশ করেছিল, তাকেই লক্ষ করে আমরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলাম। আমরা ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিলাম। এই লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের কানে যেন বেজেছে এই শহীদের গান। প্রভাতফেরির জন্য বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে যে দলগুলো বের হতো, তাদের কণ্ঠে উঠে আসত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। এখনো একই ধারায় একই সুর-মূর্ছনায় বাঙালি জাতি কেবল নয়, আমাদের দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষও জেগে ওঠে, আপন সত্তাকে বিকশিত করার জন্য তারাও প্রাণময় সংঘবদ্ধতায় অভিসিক্ত হয়। এই একুশের গান, এই একুশে আমাদের শিখিয়েছে, মানুষের শক্তি কী অপ্রতিরোধ্য।
এ ছাড়া সে গানগুলো তাৎক্ষণিক এবং পাকিস্তানি শাসনামলে ভাষা সংগ্রামের ওপর রচিত হয়েছে, তার মধ্যে আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা গ্রাম্য কবি শামসুদ্দিনের লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা মোশারেফ উদ্দিন আহমদের লেখা ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে’ অন্যতম। বদরুল হাসান লিখলেন ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা’, ছাত্রনেতা গাজীউল হক রচনা করলেন ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারী’। প্রখ্যাত লোককবি রমেশ শীল গাইলেন, ‘ভাষার জন্য জীবন হারালি বাঙালি ভাইরে রমনার মাটি রক্তে ভাসালি’। চারণকবি-লোকগায়ক হাকিম ভাই গেয়েছিলেন, ‘বাংলা মোদের মাতৃভাষা বাংলা মোদের বুলি’, হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন ‘মিলিত প্রাণের কলরবে যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’, ছাত্র ও সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন লিখেছিলেন, ‘অনেক একুশ দেখেছি, দেখেছি তোমায় নাগরিকবেশে’। ফজলে লোহানীর একুশে কবিতা খান আতার সুরে প্রাণ পেল ‘শীতল পৃথিবী অবশনগর’, এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, যাত্রা রচিত হয়েছে।
এসবই তো নানা সংগ্রামে আমাদের প্রেরণার উৎস। লড়াইয়ের সাহস।
No comments