গোলটেবিল by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
একটা চৌকোনা টেবিলকে গোল টেবিল বানিয়ে কিছু বিষয়-বিশেষজ্ঞ যেদিন নানা বিষয়ে তাঁদের বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত জানাতে থাকলেন, গোল বাধল সেদিন থেকেই। টেবিলের ভূগোল বদলে ফেলার বিভ্রমে পড়ল তাঁদের আলোচনা-পর্যালোচনা। শুরুতে সুশীল সমাজের সংগঠন এবং সংবাদপত্র থেকে গোলটেবিল উঠল গিয়ে টিভি চ্যানেলের গোলাঘরে, বিপত্তি আরও বাড়ল। টক শোর বৈঠকি মেজাজে গোলটেবিলে চলল সব সমস্যাহরি জ্ঞান বিতরণ। গোলটেবিলের বিষয়সূচি অতিশয় স্ফীত হলো। যেমন—দুই নেত্রীর এক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে নিয়ে দাঁতের মাজন হিসেবে নিমের ডালের পুনঃপ্রসারের প্রয়োজনীয়তা; বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের একই সঙ্গে বাঘ ও বিড়াল হওয়ার রহস্য থেকে নিয়ে নারীনীতি বাতিলের পক্ষে কিছু নারীর মিছিলের রহস্য। কিন্তু গোলটেবিলের শক্তি যদি হয় এর বিশাল বক্তাবাহিনী, যারা একই সঙ্গে স্ব স্ব (এবং অপরস্ব) বিষয়ে জ্ঞানী এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষা অথবা প্রায়শই একই বাক্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী—এর দুর্বলতা হচ্ছে এর নানা সুপারিশ-সিদ্ধান্তের ইথার-সর্বস্বতা। অর্থাৎ চিরতরে ইথারে হারিয়ে যাওয়া। একেকটা গোলটেবিল চলে অন্তত তিন ঘণ্টা। বক্তা থাকেন এক থেকে দেড় ডজন। এঁদের কজন আবার হন অতি-বক্তাও। তিন ঘণ্টার যে ব্যাবেল তাঁরা রচনা করেন, তার একটা সারাংশ নিয়ে হয় সুপারিশ-প্রস্তাব। সেগুলো তৈরি হয় নীতিনির্ধারকদের জন্য; সরকার বাহাদুর ও সরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য; এনজিও ও বেসরকারি খাতের কর্তাব্যক্তিদের জন্য। কিন্তু করুণ সত্যটি হলো, যত তথ্যসমৃদ্ধ, যত অব্যর্থই হোক, তাঁদের সুপারিশ, ওই সুপার-ব্যক্তিদের কাছে সেগুলোর কোনো মূল্যই থাকে না। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত গোলটেবিল আলোচনা-টক শো হয়েছে, সেগুলোর একটি ইতিহাস রচনা করলে দেখা যাবে, তাদের সুপারিশমালার ১ শতাংশও গলায় পরেননি কর্তাব্যক্তিরা। গোলটেবিলের অমোঘ নিয়তি হচ্ছে যেন শুধু প্রস্তাবায়ন; বাস্তবায়নটা তার অদৃষ্টে নেই। সেটি অদৃষ্টই রয়ে যায়।
তাহলে এত গোলটেবিল কেন? এত কথার ব্যবহার, এত জ্ঞানের বাহার, এত ক্ষুরধার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সমাহার, তা কি শুধু এই ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গোলটেবিলওয়ালা এবং টক শো-মক শোকারী হিসেবে আমার ধারণা, গোলটেবিল আমাদের কথাসভ্যতার এক অনিবার্য পরিণতির নাম, যার কথা-খরচার চর্চার অবশ্যম্ভাব্যতা আছে, বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। গ্রিক পুরাণের সেই ভবিষ্যদ্বক্তাদের মতো—যথা কাসান্দ্রা—যাঁদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করাটা ছিল এক মনোজৈবিক বাধ্যবাধকতা, কিন্তু যাঁদের কথায় কারও বিশ্বাস স্থাপন না করাটাও ছিল এক স্বতঃসিদ্ধতা। আমাদের গোলটেবিলওয়ালাদের অবস্থান কাসান্দ্রার মতোই—জোর গলায় বলে যাচ্ছেন, সময় থাকতে রসুন ফলান, বিশ্ববাজারে রসুনের দাম বাড়ছে; অথবা কদুর তেলশিল্পকে ভর্তুকি দিন, কারণ আর এক দশকে কদুর তেল হবে বিশ্বের এক নম্বর বায়ো-ফ্রেন্ডলি তেল, সুপার সেলিব্রেটিদের কাঙ্ক্ষিত কসমেটিকসামগ্রী। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একদিন কেঁদেও আমরা রসুন পাব না, আর কদুর তেলের পয়সায় একদিন ভাসবে হয়তো আজাইরাভাইজানের মতো কোনো দূরদর্শী দেশ। যে দেশে গোলটেবিল এখনো চার কোনা।
তবে তাও না। গোলটেবিলের ভূমিকাটা আরও হূদয়বিদারক। আমি দেখেছি, গোলটেবিলে যা বলা হয়, যেসব প্রস্তাব রাখা হয়, বাস্তবে হয় তার উল্টো। সুজন নামের সুশাসনকামী সুশীল সংগঠনটি দুর্নীতি নিয়ে অনেক গোলটেবিল করেছে। টিআইবিও করেছে। দুর্নীতি, দুদক, মাদক—বিষয়বস্তুর অভাব হয়নি কখনো। কিন্তু সুজনের এত কুজন, টিআইবির এত কেন এবং কী—তার ফল হলো কী? দুর্নীতি না কমে বাড়ল বরং, দুদক নেমে গেল সিকি-দুদকে। এন্তার গোলটেবিল হলো ঢাকার যানজট নিয়ে—যানজটের ঝঞ্ঝাট কমল? না বাড়ল? এখন যানজটে বসে জানে জট লেগে যায় না? উড়াল পুল নিয়ে, মেট্রো রেল নিয়ে কত গোলটেবিল হলো। যদি সেগুলোর একটা ভগ্নাংশও ফলত! আজ আমি টিএসসির মোড় থেকে মেট্রো রেলে চড়ে ১৫ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌঁছে যেতাম। অবশ্য বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪০ মিনিট উড়ালের জন্য চার ঘণ্টা বসে থাকতাম। তবে সে ভিন্ন কথা। না, ভিন্ন কথাও নয়। সেখানেও সমস্যাটা তৈরি করেছে গোলটেবিল। আমার মনে আছে, বিমান যখন ১০-১৫ মিনিট বিলম্বে গন্তব্যের পথে পাখা মেলতে শুরু করল, তখন এক গোলটেবিল হয়েছিল। বিষয় ছিল, ‘বিমানের নিয়মানুবর্তিতা এবং যাত্রীসেবা উন্নত করা’। অনেক প্রস্তাবও জমা পড়েছিল বিমান মন্ত্রণালয়ের বক্সে। তার পরদিন থেকেই অভিমান করে বিমান মাটিতে নামতে থাকল।
গোলটেবিলের সর্বশেষ কর্মফল হচ্ছে ঢাকার নাগরিকদের রিকশা বিপত্তি। জানুয়ারি মাসে এক গোলটেবিল হয়েছিল, ‘ঢাকার রাস্তায় রিকশা চলাচল যৌক্তিকীকরণ’ শিরোনামে। প্রমাদ গুনেছিলাম শিরোনাম শুনেই। পরশু দিন ফুলার রোডের বাসা থেকে রিকশায় নিউমার্কেটে যাব বলে উঠেছি, রিকশাওয়ালা নীলক্ষেতের মোড়ে নামিয়ে দিলেন। বাকি রাস্তায় রিকশা নাস্তি। যৌক্তিকীকরণ। যদিও যুক্তিটা এত সূক্ষ্ম, না আমি, না আমার সেই রিকশাওয়ালা, তা বুঝতে পারলাম।
গোলটেবিল অবশ্য বেঁচেবর্তেই থাকবে। সে জন্য এর কাসান্দ্রাভাগ্যও ফেরাতে হবে। এ রকম কী করা যায়, যে শিরোনামটা উল্টো করে দেওয়া যায়, যেমন, ‘ঢাকার মশার অপরিহার্যতা’ অথবা ‘যানজটের সামাজিক ঐতিহাসিক এবং রোমান্টিক প্রয়োজনীয়তা’ নিয়ে কি এগিয়ে আসবেন সুশীল সমাজের কুশীলবেরা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তাহলে এত গোলটেবিল কেন? এত কথার ব্যবহার, এত জ্ঞানের বাহার, এত ক্ষুরধার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সমাহার, তা কি শুধু এই ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গোলটেবিলওয়ালা এবং টক শো-মক শোকারী হিসেবে আমার ধারণা, গোলটেবিল আমাদের কথাসভ্যতার এক অনিবার্য পরিণতির নাম, যার কথা-খরচার চর্চার অবশ্যম্ভাব্যতা আছে, বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। গ্রিক পুরাণের সেই ভবিষ্যদ্বক্তাদের মতো—যথা কাসান্দ্রা—যাঁদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করাটা ছিল এক মনোজৈবিক বাধ্যবাধকতা, কিন্তু যাঁদের কথায় কারও বিশ্বাস স্থাপন না করাটাও ছিল এক স্বতঃসিদ্ধতা। আমাদের গোলটেবিলওয়ালাদের অবস্থান কাসান্দ্রার মতোই—জোর গলায় বলে যাচ্ছেন, সময় থাকতে রসুন ফলান, বিশ্ববাজারে রসুনের দাম বাড়ছে; অথবা কদুর তেলশিল্পকে ভর্তুকি দিন, কারণ আর এক দশকে কদুর তেল হবে বিশ্বের এক নম্বর বায়ো-ফ্রেন্ডলি তেল, সুপার সেলিব্রেটিদের কাঙ্ক্ষিত কসমেটিকসামগ্রী। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একদিন কেঁদেও আমরা রসুন পাব না, আর কদুর তেলের পয়সায় একদিন ভাসবে হয়তো আজাইরাভাইজানের মতো কোনো দূরদর্শী দেশ। যে দেশে গোলটেবিল এখনো চার কোনা।
তবে তাও না। গোলটেবিলের ভূমিকাটা আরও হূদয়বিদারক। আমি দেখেছি, গোলটেবিলে যা বলা হয়, যেসব প্রস্তাব রাখা হয়, বাস্তবে হয় তার উল্টো। সুজন নামের সুশাসনকামী সুশীল সংগঠনটি দুর্নীতি নিয়ে অনেক গোলটেবিল করেছে। টিআইবিও করেছে। দুর্নীতি, দুদক, মাদক—বিষয়বস্তুর অভাব হয়নি কখনো। কিন্তু সুজনের এত কুজন, টিআইবির এত কেন এবং কী—তার ফল হলো কী? দুর্নীতি না কমে বাড়ল বরং, দুদক নেমে গেল সিকি-দুদকে। এন্তার গোলটেবিল হলো ঢাকার যানজট নিয়ে—যানজটের ঝঞ্ঝাট কমল? না বাড়ল? এখন যানজটে বসে জানে জট লেগে যায় না? উড়াল পুল নিয়ে, মেট্রো রেল নিয়ে কত গোলটেবিল হলো। যদি সেগুলোর একটা ভগ্নাংশও ফলত! আজ আমি টিএসসির মোড় থেকে মেট্রো রেলে চড়ে ১৫ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌঁছে যেতাম। অবশ্য বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪০ মিনিট উড়ালের জন্য চার ঘণ্টা বসে থাকতাম। তবে সে ভিন্ন কথা। না, ভিন্ন কথাও নয়। সেখানেও সমস্যাটা তৈরি করেছে গোলটেবিল। আমার মনে আছে, বিমান যখন ১০-১৫ মিনিট বিলম্বে গন্তব্যের পথে পাখা মেলতে শুরু করল, তখন এক গোলটেবিল হয়েছিল। বিষয় ছিল, ‘বিমানের নিয়মানুবর্তিতা এবং যাত্রীসেবা উন্নত করা’। অনেক প্রস্তাবও জমা পড়েছিল বিমান মন্ত্রণালয়ের বক্সে। তার পরদিন থেকেই অভিমান করে বিমান মাটিতে নামতে থাকল।
গোলটেবিলের সর্বশেষ কর্মফল হচ্ছে ঢাকার নাগরিকদের রিকশা বিপত্তি। জানুয়ারি মাসে এক গোলটেবিল হয়েছিল, ‘ঢাকার রাস্তায় রিকশা চলাচল যৌক্তিকীকরণ’ শিরোনামে। প্রমাদ গুনেছিলাম শিরোনাম শুনেই। পরশু দিন ফুলার রোডের বাসা থেকে রিকশায় নিউমার্কেটে যাব বলে উঠেছি, রিকশাওয়ালা নীলক্ষেতের মোড়ে নামিয়ে দিলেন। বাকি রাস্তায় রিকশা নাস্তি। যৌক্তিকীকরণ। যদিও যুক্তিটা এত সূক্ষ্ম, না আমি, না আমার সেই রিকশাওয়ালা, তা বুঝতে পারলাম।
গোলটেবিল অবশ্য বেঁচেবর্তেই থাকবে। সে জন্য এর কাসান্দ্রাভাগ্যও ফেরাতে হবে। এ রকম কী করা যায়, যে শিরোনামটা উল্টো করে দেওয়া যায়, যেমন, ‘ঢাকার মশার অপরিহার্যতা’ অথবা ‘যানজটের সামাজিক ঐতিহাসিক এবং রোমান্টিক প্রয়োজনীয়তা’ নিয়ে কি এগিয়ে আসবেন সুশীল সমাজের কুশীলবেরা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments