আব্বা, তুমি শুনতে পাচ্ছ
আব্বা,
আজ ৪০ বছর আগের সেই ১৯৭১-এর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। আমাদের স্কুল বন্ধ। পড়াশোনার বালাই নেই। আম্মা (বেগম মুশতারী শফী) ও তাঁর বান্ধবী সংঘের সবাই খুব ব্যস্ত মিটিং-মিছিল নিয়ে। গণসংগীতের রিহার্সাল হচ্ছে কখনো আমাদের বাসায়, কখনো বা ‘জেম সেন’ হলে। আমি ওই গণসংগীতে অংশগ্রহণ করতাম। খুব ভালো লাগত। তবে বড়দের মুখে চিন্তার ছাপ—তাঁদের মনোযোগ দিয়ে রেডিও ছেড়ে খবর শোনা ও আলাপ-আলোচনা করা, যা কখনোই আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
২৪ মার্চ বিকেলেই কাকু (স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ), খোকন ভাই (আবদুল্লাহ-আল-ফারুক, স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম ১০ জনের একজন সক্রিয় কর্মী), মনি ভাই (কাজি হাবিবউদ্দীন আহমেদ, স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম ১০ জনের একজন সক্রিয় কর্মী) ও সন্দ্বীপ কাকা (আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, তিনিও স্বাধীন বাংলা বেতারের ১০ জনের একজন সক্রিয় কর্মী), তাঁরা সবাই রয়ে গেলেন আমাদের বাসায়। রাতে খাওয়ার পর আমরা ছোটরা নিয়মমাফিক শুয়ে পড়ি। রাত খানিকটা গভীর হতেই ঠা ঠা ঠা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি আম্মা, মামা (শহীদ খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, আমার একমাত্র মামা) ও তোমরা সবাই ড্রয়িংরুমে আধো আলোতে চাপাস্বরে বলছ, ‘ওটা গুলির শব্দ!’ গুলি!! এই প্রথম জীবনে গুলির শব্দ শুনলাম। গা কেঁপে উঠল। কেন গুলি?
কীসের জন্য এই গোলাগুলি! কে কাকে মারছে?
আব্বা (শহীদ ডাক্তার মোহাম্মদ শফী) তোমার একটা কথা আমার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল, ‘অনেক রক্ত দিতে হবে, তবেই বাঙালির স্বাধীনতা আসবে।’
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছিলে। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। সেই ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে তোমাকে ও মামাকে (যিনি সেই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন) এভাবে হারাতে হবে তখন তা বুঝিনি!
৭ এপ্রিল ১৯৭১। দুপুর ছুঁই ছুঁই। তুমি ও আম্মা কী যেন কথা বলছিলে, আমি কাছে আসতেই আমার কাছে এক গ্লাস পানি চাইলে। আমি দৌড়ে তোমাকে পানি এনে দিলাম। ওই তোমার শেষ পানি খাওয়া। তার পরপরই আমাদের বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে ফেলল পাকিস্তানি মিলিটারিরা। দরজায় করাঘাত করতেই তুমি ও আম্মা ড্রয়িংরুমে চলে গেলে দরজা খোলার জন্য। এয়ার খালু আমাদের ছোটদের ড্রেসিংরুমে লুকিয়ে রাখলেন। বেশ খানিক পর জিপের আওয়াজ শুনলাম। মনে হলো আর্মিরা চলে গেছে। আম্মা সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের ঘরে এসে কেঁদে বসে পড়লেন। বললেন, ‘ওরা আমার সব নিয়ে গেছে।’ প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারিনি। পরে বুঝলাম, তোমাকে ও মামাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সে সময় ব্রিগেডিয়ার বেগ (যিনি পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের চিফ অব আর্মি স্টাফ হয়েছিলেন) ছিলেন তোমারই রোগী। মনে পড়ে আমরা ভাইবোন একসঙ্গে পড়তে বসে খাতা-কলম নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া করতাম, তুমি তখন আমাকে মাঝে মাঝে তোমার চেম্বারের এক কোণার টেবিলে পড়তে বসাতে। সেই সময় কখনো কখনো ব্রিগেডিয়ার বেগ চট্টগ্রাম ক্লাব থেকে টেনিস খেলে সোজা তোমার চেম্বারে চলে আসতেন দাঁতের চিকিৎসার জন্য। আমাকে দেখে বলতেন, ‘ইয়োর ডটার গুড গুড...’। তাই হয়তো একটা ক্ষীণ আশা ছিল, এই বুঝি ব্রিগেডিয়ার বেগ তোমাদের ছেড়ে দেবে। তোমরা ফিরে আসবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি।
আম্মা সেই সময় অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত থাকায় তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বের হয়েছিল। তাই আম্মা আমাকে ছোট খালার কাছে রেখে বাকি ছয় ভাইবোনকে নিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে গেলেন বহু কষ্টে। পুরো এই নয়টি মাস আমি স্বপ্ন দেখতাম, এই বুঝি তুমি ও মামা ফিরে আসছ।
তারপর আমি তোমাদের হাত ধরে চলে যাব আম্মার কাছে সেই কলকাতায়। কিন্তু তুমি ফিরে আসনি। মাঝে মাঝে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আম্মার কণ্ঠস্বর শুনতে পেতাম আর চোখের পানি মুছতাম।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের পর পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ মুক্ত হলো। কিন্তু এই দেশকে কলুষিত করে রেখেছে সেই ১৯৭১-এর বেইমান ঘাতক-দালাল রাজাকার, আল বদর ও শান্তিবাহিনীর লোকেরা। যারা সময়-অসময় ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টে এখনো শকুনের মতো ছোবল দেওয়ার চেষ্টায় থাকে।
আব্বা, আমরা সাত ভাইবোন তোমার উপযুক্ত সন্তান হতে পারিনি। এমন বড় কিছু হইনি। এখনো যেন জীবনযুদ্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছি মাত্র। কিন্তু হ্যাঁ, আমরা কেউ অমানুষ হইনি। আম্মা আমাদের শত কষ্টের মধ্যেও নিজে চাকরি করেছেন। প্রকৃত দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হূদয়ে লালন করতে শিখিয়েছেন। এই ৪০ বছরেও আমরা (শহীদ পরিবারের সন্তানেরা) তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমরা অসহায়, আমরা অপারগ। এই মুক্ত স্বাধীন দেশে থেকেও সব সময় প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের চলতে হয়েছে।
আজ এত বছর পর আমাদের অনুকূলে বাতাস বইছে। বলছে, ‘এই সুযোগ একটা কিছু করো!’ তোমরা আমাদের পথ চেয়ে আছো। হ্যাঁ আব্বা, এখন এই আশায় বুক বেঁধেছি। এবার নিশ্চয়ই একাত্তরের ঘাতক রাজাকার, আলবদরসহ সব যুদ্ধাপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হবেই হবে। হ্যাঁ, আজ আমি সেই স্বপ্নই দেখছি। যে সত্তরোর্ধ্ব মা তোমাবিহীন দীর্ঘ ৪০ বছর এই চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, কোনো কিছুর কাছে মাথা নত না করে, জীবনকে বাজি রেখে আমাদের মানুষ করেছেন, অন্তত সেই মা তাঁর জীবদ্দশায় এই একাত্তরের ঘাতকদের শাস্তি দেখে যেতে পারেন—এটাই আমার কামনা। নইলে আমাদের চোখের জল ও দীর্ঘশ্বাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
ফারজানা নজরুল
No comments