মাতৃভাষা ও পরভাষা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মাতৃভাষা’ শব্দটি ইংরেজি ‘মাদার টাং’-এর তর্জমা। বাংলা ভাষা পরিচয়-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘এই-যে আমাদের দেশ আজ আমাদের মনকে টানছে, এর সঙ্গে সঙ্গেই জেগেছে আমাদের ভাষার প্রতি টান। মাতৃভাষা নামটা আজকাল আমরা ব্যবহার করে থাকি, এ নামও পেয়েছি আমাদের নতুন শিক্ষা থেকে। ইংরেজিতে আপন ভাষাকে বলে মাদার টাঙ্গ্, মাতৃভাষা তারই তর্জমা। এমন দিন ছিল যখন বাঙালি বিদেশে গিয়ে আপন ভাষাকে অনায়াসেই পুরোনো কাপড়ের মতো ছেড়ে ফেলতে পারত, বিলেতে গিয়ে ভাষাকে সে দিয়ে আসত সমুদ্রে জলাঞ্জলি, ইংরেজভাষিণী অনুচরীদের সঙ্গে রেখে ছেলেমেয়েদের মুখে বাংলা চাপা দিয়ে তার উপরে ইংরেজির জয়পতাকা দিত সগর্বে উড়িয়ে। আজ আমাদের ভাষা এই অপমান থেকে উদ্ধার পেয়েছে, তার গৌরব আজ সমস্ত বাংলাভাষীকে মাহাত্ম্য দিয়েছে।’
ভাষাবিদ লুই-জাঁ কালভে মাতৃভাষার পরিবর্তে প্রথম ভাষার কথা বললেও তিনি লক্ষ করেন, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে প্রথম ভাষাকে মাদার টাং (ইংরেজি), লাং মাতেরনেল (ফ্রান্স), লেঙ্গুয়া মাতের্না (স্পেন), ইদিওমা মাতের্না (ইতালি), মুটার্স্প্রাখে (জার্মানি) বলে থাকে। এই রেওয়াজের কারণে ধরে নেওয়া হয়, মায়ের কাছ থেকে আমরা ভাষা উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা রুশ ভাষায় বেশ পরিষ্কার—‘রাদনৈ ইজিক’ শব্দে রয়েছে জন্ম, মাতা-পিতা এবং উত্স বা মূল এই তিন ভাবের এক সমাহার। আফ্রিকান ভাষায় মাতৃভাষা সম্পর্কে, মাতৃদুগ্ধ, স্তন, স্তন্যপায়ী জাতীয় কথা রয়েছে। অনেক দেশে প্রথম ভাষা মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কল্পিত হয়। চীনা ভাষায় ‘পেন কুও ইয়ু ইয়েন’ মানে আক্ষরিক অর্থে ‘মূল জাতির ভাষা’। বাংলা ভাষায় নিরলংকার কেজো কথা হচ্ছে দেশি ভাষা।
মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের ভূমিকায় আমি বলি, ‘মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া মনীষার জন্ম হয় না, এমন কথা বলা যায় না। বিদগ্ধ মন কোন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে তৃপ্তি পাবে, সে মনই তা নির্বাচন করে। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস রাজকর্ম ল্যাটিনে চালাতেন, কিন্তু তাঁর দর্শনের কথা লিখতেন গ্রিকে। নিখিল জর্মন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন ফ্রেডারিক দি গ্রেট, কিন্তু তিনি লিখতেন পড়তেন ফরাসি ভাষায়। বহু কীর্তিমান লেখক নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে পরভাষায়, গ্রিক, রোমান, আরবি, ফারসি, ইংরেজি বা ফরাসিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। পরভাষায় কাজ চললে, মন টানলে মানুষ দ্বিধা করবে না তাকে বরণ করতে। আজ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অন্তর্দেশীয় ঐক্য রক্ষার খাতিরে ও আন্তর্জাতিক আদানপ্রদানের জন্য ইংরেজি ভাষাকে স্বীকার করে নিচ্ছে, স্বাজাত্যাভিমান ভুলে গিয়ে। ভাগ্য ভালো, এই ভঙ্গ বঙ্গদেশে আমরা এক ভাষা বলি। আজ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কোনো বিদেশি ভাষা আমাদের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে যে ভাষা শেখার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে আজ দারুণ কৌতূহল, যে ভাষার মারফতে আমরা আধুনিক যুগের সাথে কথা বলি, জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে যাতায়াত করি, যার সাথে আমাদের আগেরই, দু’শ বছরের পরিচয় সেই ভাষাকে পরিহার করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তাকে আমরা গ্রহণ করেই নিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয়ে তার জন্য একটা স্থানও করে দিয়েছে।
১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উত্সবে এই কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তাঁর সম্ভাষণে, ‘...আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার সম্মানের আসন বিচলিত হতে পারবে না। তার কারণ এ নয় যে, বর্তমান অবস্থায় আমাদের জীবনযাত্রায় তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আজকের দিনে য়ুরোপের জ্ঞানবিজ্ঞান সমস্ত মানবলোকের শ্রদ্ধা অধিকার করেছে, স্বাজাত্যের অভিমানে এ কথা অস্বীকার করলে অকল্যাণ। আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার পক্ষে এই শিক্ষার যেমন প্রয়োজন তেমনি মনকে ও ব্যবহারকে মূঢ়তামুক্ত করবার জন্য তার প্রভাব মূল্যবান। যে চিত্ত এই প্রভাবকে প্রতিরোধ করে, একে অঙ্গীকার করে নিতে অক্ষম হয়, সে আপন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ নিরালোক জীবনযাত্রায় ক্ষীণজীবী হয়ে থাকে। যে জ্ঞানের জ্যোতি চিরন্তন তা যে-কোনো দিগন্ত থেকেই বিকীর্ণ হোক, অপরিচিত বলে তাকে বাধা দেয় বর্বরতার অস্বচ্ছ মন। সত্যের প্রকাশমাত্রই জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকারগম্য; এই অধিকার মনুষ্যত্বের সহজাত অধিকারেরই অঙ্গ। রাষ্ট্রগত বা ব্যক্তিগত বিষয়সম্পদে মানুষের পার্থক্য অনিবার্য, কিন্তু চিত্তসম্পদের দানসূত্রে সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ এক। সেখানে দান করবার দাক্ষিণ্যেই দাতা ধন্য ও গ্রহণ করবার শক্তি দ্বারাই গ্রহীতার আত্মসম্মান। সকল দেশেই অর্থভাণ্ডারের দ্বারে কড়া পাহারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানভাণ্ডারে সর্বমানের ঐক্যের দ্বার অর্গলবিহীন। লক্ষ্মী কৃপণ; কারণ লক্ষ্মীর সঞ্চয় সংখ্যাগণিতের সীমায় আবদ্ধ, ব্যয়ের দ্বারা তার ক্ষয় হতে থাকে। সরস্বতী অকৃপণ; কেননা, সংখ্যার পরিমাপে তাঁর ঐশ্বর্যের পরিমাপ নয়, দানের দ্বারা তার বৃদ্ধিই ঘটে। বোধ করি, বিশেষভাবে বাংলাদেশের এই গৌরব করবার কারণ আছে যে, য়ুরোপীয় সংস্কৃতির কাছ থেকে সে আপন প্রাপ্য গ্রহণ করতে বিলম্ব করেনি। এই সংস্কৃতির বাধাহীন সংস্পর্শে অতি অল্পকালের মধ্যে তার সাহিত্য প্রচুর শক্তি ও সম্পদ লাভ করেছে, এ কথা সকলের স্বীকৃত। এই প্রভাবের প্রধান সার্থকতা এই দেখেছি যে, অনুকরণের দুর্বল প্রবৃত্তিকে কাটিয়ে ওঠবার উত্সাহ সে প্রথম থেকে দিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বলেন, ‘আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রথমযুগে যাঁরা বিদ্বান বলে গণ্য ছিলেন তাঁরা যদিচ পড়াশুনোয় চিঠিপত্রে কথাবার্তায় একান্তভাবেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, যদিচ তখনকার ইংরেজিশিক্ষিত চিত্তে চিন্তার ঐশ্বর্য ভাবরসের আয়োজন মুখ্যত ইংরেজি প্রেরণা থেকেই উদ্ভাবিত, তবু সেদিনকার বাঙালি লেখকেরা এই কথাটি অচিরে অনুভব করেছিলেন যে দূরদেশী ভাষার থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র, কিন্তু আত্মপ্রকাশের জন্য প্রভাত-আলো বিকীর্ণ হয় আপন ভাষায়।’
আমাদের বাংলা ভাষার এখনো যে অবস্থা তাতে দূরদেশি ভাষা থেকে বাতির আলো সংগ্রহ করা একান্ত দরকার। যারা উন্নয়নের বাস ঠিক সময়ে ধরতে পারেনি তাদের জন্য বেদ্রি রাহমি ইউবোগলু তিন ভাষার সুপারিশ করেছেন তাঁর তিন ভাষা কবিতায়:
তোমার কমপক্ষে তিনটি ভাষা জানা দরকার
নাবিকের মতো তোমার অন্তত তিন ভাষায় কিরে খেতে হবে
কারণ তুমি ইতিহাসও নও, ভূগোলও নও
না এই, না সেই
আমার ছোট্ট মারনুস,
তুমি এমন এক জাতের সন্তান যে বাস ধরতে পারেনি।
লন্ডন শহরের ছেলেমেয়েরা নাকি আজ ৩০৭টি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এই বাবেলের মিনার দেখে সেই শহরের মেয়র কিন্তু আতঙ্কিত হননি। দশ বছর আগে লর্ড মেয়র অল্ডারম্যান ক্লাইভ মার্টিন বরং এই বিভিন্ন ভাষার সেই সমাহারকে স্বাগত জানান। বহুভাষিতার পক্ষে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যখন লন্ডনে ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয় তখন যে ৩৮টি ভাষাভাষীর প্রয়োজন দেখা দেয়, তার সব কটি শূন্যপদ লন্ডনের অধিবাসীদের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হয়।
বিশ্বের সব জ্ঞানবিজ্ঞান এক ভাষার বইয়ে পাওয়া ভার। ভাষাবিদ ড. ডেভিড ড্যালবির মতে, একভাষিতা নিরক্ষরতার মতোই খারাপ, কারণ তা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। বাংলাদেশ বহুভাষার দেশ এবং আমাদের একাধিক ভাষার সঙ্গে পরিচয় আছে, সে পরিচয় তেমন পোক্ত না হলেও। আমাদের পরভাষা শিখতেই হবে, তবে সে ভাষা আমরা শিখব মাতৃভাষার সমভিব্যহারে। মাতৃভাষার ভিত্তি পাকাপোক্ত করে তার ওপরই পরভাষার কাঠামো স্থাপন করা উচিত। নিমজ্জন-প্রক্রিয়ায় ভাষাশিক্ষা তেমন ফলপ্রসূ নয় বলেই ভাষাবিদেরা এখন বলছেন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
ভাষাবিদ লুই-জাঁ কালভে মাতৃভাষার পরিবর্তে প্রথম ভাষার কথা বললেও তিনি লক্ষ করেন, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে প্রথম ভাষাকে মাদার টাং (ইংরেজি), লাং মাতেরনেল (ফ্রান্স), লেঙ্গুয়া মাতের্না (স্পেন), ইদিওমা মাতের্না (ইতালি), মুটার্স্প্রাখে (জার্মানি) বলে থাকে। এই রেওয়াজের কারণে ধরে নেওয়া হয়, মায়ের কাছ থেকে আমরা ভাষা উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা রুশ ভাষায় বেশ পরিষ্কার—‘রাদনৈ ইজিক’ শব্দে রয়েছে জন্ম, মাতা-পিতা এবং উত্স বা মূল এই তিন ভাবের এক সমাহার। আফ্রিকান ভাষায় মাতৃভাষা সম্পর্কে, মাতৃদুগ্ধ, স্তন, স্তন্যপায়ী জাতীয় কথা রয়েছে। অনেক দেশে প্রথম ভাষা মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কল্পিত হয়। চীনা ভাষায় ‘পেন কুও ইয়ু ইয়েন’ মানে আক্ষরিক অর্থে ‘মূল জাতির ভাষা’। বাংলা ভাষায় নিরলংকার কেজো কথা হচ্ছে দেশি ভাষা।
মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের ভূমিকায় আমি বলি, ‘মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া মনীষার জন্ম হয় না, এমন কথা বলা যায় না। বিদগ্ধ মন কোন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে তৃপ্তি পাবে, সে মনই তা নির্বাচন করে। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস রাজকর্ম ল্যাটিনে চালাতেন, কিন্তু তাঁর দর্শনের কথা লিখতেন গ্রিকে। নিখিল জর্মন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন ফ্রেডারিক দি গ্রেট, কিন্তু তিনি লিখতেন পড়তেন ফরাসি ভাষায়। বহু কীর্তিমান লেখক নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে পরভাষায়, গ্রিক, রোমান, আরবি, ফারসি, ইংরেজি বা ফরাসিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। পরভাষায় কাজ চললে, মন টানলে মানুষ দ্বিধা করবে না তাকে বরণ করতে। আজ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অন্তর্দেশীয় ঐক্য রক্ষার খাতিরে ও আন্তর্জাতিক আদানপ্রদানের জন্য ইংরেজি ভাষাকে স্বীকার করে নিচ্ছে, স্বাজাত্যাভিমান ভুলে গিয়ে। ভাগ্য ভালো, এই ভঙ্গ বঙ্গদেশে আমরা এক ভাষা বলি। আজ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কোনো বিদেশি ভাষা আমাদের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে যে ভাষা শেখার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে আজ দারুণ কৌতূহল, যে ভাষার মারফতে আমরা আধুনিক যুগের সাথে কথা বলি, জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে যাতায়াত করি, যার সাথে আমাদের আগেরই, দু’শ বছরের পরিচয় সেই ভাষাকে পরিহার করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তাকে আমরা গ্রহণ করেই নিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয়ে তার জন্য একটা স্থানও করে দিয়েছে।
১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উত্সবে এই কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তাঁর সম্ভাষণে, ‘...আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার সম্মানের আসন বিচলিত হতে পারবে না। তার কারণ এ নয় যে, বর্তমান অবস্থায় আমাদের জীবনযাত্রায় তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আজকের দিনে য়ুরোপের জ্ঞানবিজ্ঞান সমস্ত মানবলোকের শ্রদ্ধা অধিকার করেছে, স্বাজাত্যের অভিমানে এ কথা অস্বীকার করলে অকল্যাণ। আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার পক্ষে এই শিক্ষার যেমন প্রয়োজন তেমনি মনকে ও ব্যবহারকে মূঢ়তামুক্ত করবার জন্য তার প্রভাব মূল্যবান। যে চিত্ত এই প্রভাবকে প্রতিরোধ করে, একে অঙ্গীকার করে নিতে অক্ষম হয়, সে আপন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ নিরালোক জীবনযাত্রায় ক্ষীণজীবী হয়ে থাকে। যে জ্ঞানের জ্যোতি চিরন্তন তা যে-কোনো দিগন্ত থেকেই বিকীর্ণ হোক, অপরিচিত বলে তাকে বাধা দেয় বর্বরতার অস্বচ্ছ মন। সত্যের প্রকাশমাত্রই জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকারগম্য; এই অধিকার মনুষ্যত্বের সহজাত অধিকারেরই অঙ্গ। রাষ্ট্রগত বা ব্যক্তিগত বিষয়সম্পদে মানুষের পার্থক্য অনিবার্য, কিন্তু চিত্তসম্পদের দানসূত্রে সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ এক। সেখানে দান করবার দাক্ষিণ্যেই দাতা ধন্য ও গ্রহণ করবার শক্তি দ্বারাই গ্রহীতার আত্মসম্মান। সকল দেশেই অর্থভাণ্ডারের দ্বারে কড়া পাহারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানভাণ্ডারে সর্বমানের ঐক্যের দ্বার অর্গলবিহীন। লক্ষ্মী কৃপণ; কারণ লক্ষ্মীর সঞ্চয় সংখ্যাগণিতের সীমায় আবদ্ধ, ব্যয়ের দ্বারা তার ক্ষয় হতে থাকে। সরস্বতী অকৃপণ; কেননা, সংখ্যার পরিমাপে তাঁর ঐশ্বর্যের পরিমাপ নয়, দানের দ্বারা তার বৃদ্ধিই ঘটে। বোধ করি, বিশেষভাবে বাংলাদেশের এই গৌরব করবার কারণ আছে যে, য়ুরোপীয় সংস্কৃতির কাছ থেকে সে আপন প্রাপ্য গ্রহণ করতে বিলম্ব করেনি। এই সংস্কৃতির বাধাহীন সংস্পর্শে অতি অল্পকালের মধ্যে তার সাহিত্য প্রচুর শক্তি ও সম্পদ লাভ করেছে, এ কথা সকলের স্বীকৃত। এই প্রভাবের প্রধান সার্থকতা এই দেখেছি যে, অনুকরণের দুর্বল প্রবৃত্তিকে কাটিয়ে ওঠবার উত্সাহ সে প্রথম থেকে দিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বলেন, ‘আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রথমযুগে যাঁরা বিদ্বান বলে গণ্য ছিলেন তাঁরা যদিচ পড়াশুনোয় চিঠিপত্রে কথাবার্তায় একান্তভাবেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, যদিচ তখনকার ইংরেজিশিক্ষিত চিত্তে চিন্তার ঐশ্বর্য ভাবরসের আয়োজন মুখ্যত ইংরেজি প্রেরণা থেকেই উদ্ভাবিত, তবু সেদিনকার বাঙালি লেখকেরা এই কথাটি অচিরে অনুভব করেছিলেন যে দূরদেশী ভাষার থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র, কিন্তু আত্মপ্রকাশের জন্য প্রভাত-আলো বিকীর্ণ হয় আপন ভাষায়।’
আমাদের বাংলা ভাষার এখনো যে অবস্থা তাতে দূরদেশি ভাষা থেকে বাতির আলো সংগ্রহ করা একান্ত দরকার। যারা উন্নয়নের বাস ঠিক সময়ে ধরতে পারেনি তাদের জন্য বেদ্রি রাহমি ইউবোগলু তিন ভাষার সুপারিশ করেছেন তাঁর তিন ভাষা কবিতায়:
তোমার কমপক্ষে তিনটি ভাষা জানা দরকার
নাবিকের মতো তোমার অন্তত তিন ভাষায় কিরে খেতে হবে
কারণ তুমি ইতিহাসও নও, ভূগোলও নও
না এই, না সেই
আমার ছোট্ট মারনুস,
তুমি এমন এক জাতের সন্তান যে বাস ধরতে পারেনি।
লন্ডন শহরের ছেলেমেয়েরা নাকি আজ ৩০৭টি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এই বাবেলের মিনার দেখে সেই শহরের মেয়র কিন্তু আতঙ্কিত হননি। দশ বছর আগে লর্ড মেয়র অল্ডারম্যান ক্লাইভ মার্টিন বরং এই বিভিন্ন ভাষার সেই সমাহারকে স্বাগত জানান। বহুভাষিতার পক্ষে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যখন লন্ডনে ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয় তখন যে ৩৮টি ভাষাভাষীর প্রয়োজন দেখা দেয়, তার সব কটি শূন্যপদ লন্ডনের অধিবাসীদের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হয়।
বিশ্বের সব জ্ঞানবিজ্ঞান এক ভাষার বইয়ে পাওয়া ভার। ভাষাবিদ ড. ডেভিড ড্যালবির মতে, একভাষিতা নিরক্ষরতার মতোই খারাপ, কারণ তা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। বাংলাদেশ বহুভাষার দেশ এবং আমাদের একাধিক ভাষার সঙ্গে পরিচয় আছে, সে পরিচয় তেমন পোক্ত না হলেও। আমাদের পরভাষা শিখতেই হবে, তবে সে ভাষা আমরা শিখব মাতৃভাষার সমভিব্যহারে। মাতৃভাষার ভিত্তি পাকাপোক্ত করে তার ওপরই পরভাষার কাঠামো স্থাপন করা উচিত। নিমজ্জন-প্রক্রিয়ায় ভাষাশিক্ষা তেমন ফলপ্রসূ নয় বলেই ভাষাবিদেরা এখন বলছেন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
No comments