বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ: ভবিষ্যতের বাংলা -সৌরভ সিকদার
বাংলা অভিধানে ‘ভবিষ্যৎ’ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে—ঘটতে পারে এমন, আগামী সময়, পরিণাম। এ লেখায় আমরা দুটি অর্থে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ দেখতে চেষ্টা করব। প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষা কোন দিকে যাচ্ছে বা তার পরিণতি কী এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভবিষ্যতে এ ভাষা কোন রূপ ধারণ করতে পারে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের আবেগ-ভালোবাসা তো থাকবেই, সেই সঙ্গে যে বাস্তবতার দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক আর্থরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে—তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভাষার ভবিষ্যত্ নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে প্রধান প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো—কতজন মানুষ এ ভাষায় কথা বলে, কত মানুষের মাতৃভাষা এটি (মাতৃভাষা নয় অথচ ইংরেজি এবং হিন্দি ব্যবহার করে এমন কয়েক কোটি মানুষ রয়েছে), নিজস্ব লিপি আছে কি না, ভাষার লিখিত সাহিত্যের অবস্থা, কোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা কি না, ওই ভাষাভাষী দেশে কোনো রাজনৈতিক উপনিবেশ বা ভিন্ন কোনো সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভাষার প্রভাব আছে কি না। সবশেষে সে ভাষাভাষী মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা। বাংলা ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি এগুলো বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাব, শেষ দুটি বিষয় ছাড়া অন্যগুলোর অবস্থা খুবই ইতিবাচক।
বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাদেশে চৌদ্দ কোটি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ত্রিপুরা মিলিয়ে নয় থেকে দশ কোটি, পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যাও কমবেশি এক কোটি—সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এটি। এ বিবেচনায় পৃথিবীতে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। অন্যদিক থেকে ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ। অন্তত বিশ্বের ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন সেসব সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে তা-ই। আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। আমাদের ভাষার সাহিত্য নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। বাংলা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এগুলো সবই বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উপাদান। কিন্তু আমরা থমকে আছি ভাষার ভবিষ্যতের প্রশ্নে শেষোক্ত দুটি বিষয়ে। প্রথমত এ দেশে এখন তুর্কি-মোগল-ইংরেজ শাসন নেই সত্য কিন্তু আমাদের মনোজগৎ থেকে সে উপনিবেশ এখনো উঠে যায়নি। বিশেষ করে ইংরেজির ভাষিক উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এ বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন—‘ঔপনিবেশিক ঘোর খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ভাষার ক্ষেত্রে; দেখা যায় ‘রাষ্ট্রভাষা’টি থাকে নামে মাত্র আর রাজনীতিক আমলা বিচারপতি আইনজীবী চিকিৎসক ব্যবসায়ী প্রকৌশলী শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা, অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলভোগীরা লিপ্ত থাকেন একদা প্রভুদের ভাষা চর্বণে—রোমন্থনে।’ এর বাইরে অর্থাৎ ‘ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার’ ছাড়াও আকাশ-সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রধানত সংস্কৃতি ও পণ্যের হাত ধরে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির প্রতাপ ছড়ানো ইংরেজির প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। বাইরে আমরা ভাষাপ্রেম যতই দেখাই কিন্তু আমাদের ‘এ হূদয় মাঙ্গে মোর’। এভাবে হিন্দি এবং ইংরেজি নব্য সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক উপনিবেশ হিসেবে আমাদের ভাষাকে বেশ কিছুটা হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে, অন্তত এর পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত ও প্রভাবিত করছে। আর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিতে আমরা যে পিছিয়ে আছি সে কারণেও আমাদের বাংলা ভাষা নিজে অন্যকে তো প্রভাবিত করতে পারছেই না বরং অন্যের পণ্য-প্রযুক্তি তার ভাষাসহ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেবাই শুধু দিচ্ছে না, ভাষাও দিচ্ছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাপানিজ, জার্মান কিংবা কোরিয়ান ভাষাকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।
বর্তমান পৃথিবী পরিবর্তনের পৃথিবী। পৃথিবীব্যাপী যে পরিবর্তন বা বদলের হাওয়া শুরু হয়েছে সেখানে ভাষার বদল ঘটাও স্বাভাবিক। কিন্তু যখন এ পরিবর্তন কোনো ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠন, গঠন-বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্যকে বিপন্ন করে নতুন এক আরোপিত পরিমণ্ডল তৈরি করে, তখন তা আর পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ থাকে না। ভাষার অস্তিত্ব তথা স্বাতন্ত্র্যকেও তা বিপন্ন করে তোলে। যদি সে ভাষিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পঁচিশ কোটি হয় তাহলেও। আমরা বাংলা ভাষার পরিণতি বা ভবিষ্যতের প্রসঙ্গে আসি। একসময় গ্রিক-ল্যাটিন-সংস্কৃত খুব দাপটের সঙ্গে পৃথিবীতে চর্চা হয়েছে। এ ভাষার সাহিত্যের সম্ভার পাঠ করে আজও আমরা আবেগাক্রান্ত হই কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ ভাষা এখন সংগ্রহশালা আর গবেষণার ভাষা। ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের মুখে, প্রতিদিনের জীবনে। বাংলা ভাষা তার পরিবর্তনের যে স্রোত বেয়ে ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে, সেখানে তাকালে আমরা বেশ কিছু লক্ষণ দেখব—সাধু বিদায় নিলেও সাধুর ক্রিয়াপদ আবার ঘরে ফেরার চেষ্টা ‘করতাছে’। ভাষাবিজ্ঞানে যাকে ‘ডায়ালেক্ট মিক্সিং’ বলে সেই আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে মান ভাষায়। ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষার শব্দ, বাক্যগঠন এবং উচ্চারণ ক্রমেই তার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম ‘র’ কে ‘ড়’ বলছে, একসেন্ট বা ঝোঁক প্রয়োগ করছে ইংরেজি অনুকরণে। শব্দ ও শব্দের অর্থ পরিবর্তন ঘটছে। আগে ‘কঠিন’ শব্দ ব্যবহার হতো শক্ত বা সহজ নয় এ অর্থে আর এখন ব্যবহূত হচ্ছে সুন্দর বা দারুণ অর্থে। সব মিলিয়ে এক ধরনের মিশ্র বা সংকর বাংলা ভাষা তৈরি করছি আমরা। ভাষাবিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম লিখেছেন—বাংলাদেশে যারা তথাকথিত শিক্ষিত তাদের মুখের ভাষায় এ বিচিত্র সংকর ভাষা ব্যবহার আমাদের মাতৃভাষার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আর ঔপনিবেশিক ইংরেজরা চলে গেছে কিন্তু নতুন উপনিবেশিক বাস্তবতায় প্রযুক্তি আর গণমাধ্যমের হাত ধরে ‘রোমান হরফ’ এসে হাজির হয়েছে।
১৯৫২ সালের আগে ফারসির ভয়ে আমাদের প্রিয় বর্ণমালা ছিল দুঃখিনীর বর্ণমালা, আজ একুশ শতকে রোমানের ভয়ে নতুন দুঃখ কি ভর করবে তাকে? আমরা কিন্তু ভাষার পরিণতির কথা ভাবছি না, পরিবর্তনের কথা ভাবছি। এমনকি পরিবর্তনগুলোকে সাধারণভাবে গ্রহণই করছি। একুশ শতকের এই গতিময় পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষা পৃথিবী থেকে হয়তো হারিয়ে যাবে না, কিন্তু দুই-তিন যুগ পর এর রূপ বা আকৃতি যা দাঁড়াবে তাকে কোনো ক্রমেই বাঙালির বাংলা ভাষা বলা যাবে না। ভাষার জন্য আমাদের এই আত্মত্যাগের ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব সব হারিয়ে আমাদের ভাষা আমাদের থাকবে না—যদি না আমরা সচেতন হই। সত্যিকারের মাতৃভাষা প্রেম গড়ে না উঠলে শুধু একুশ এলেই দীর্ঘশ্বাস—‘আমরি বাংলা ভাষা’য় আটকে না গিয়ে সারা বছর ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা কোন দিকে যাচ্ছে তা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে বিস্তর গবেষণা করা প্রয়োজন। এ লেখায় সে গবেষণার অবকাশ নেই। শুধু একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতার দুটি লাইন উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে দিলেই ভবিষ্যতের বাংলা ভাষার চিত্র কিছুটা হলেও ধরা পড়বে। এক শিক্ষার্থী লিখেছে: Total exam-এর মধ্যে হেব্বি একটা topic পাইছি—ডিজুস বাংলা। আহ! লেইখ্যা ফাটাইয়া দিছি...।
এই হলো এখন বাংলা ভাষার চলতি দশা।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাদেশে চৌদ্দ কোটি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ত্রিপুরা মিলিয়ে নয় থেকে দশ কোটি, পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যাও কমবেশি এক কোটি—সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এটি। এ বিবেচনায় পৃথিবীতে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। অন্যদিক থেকে ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ। অন্তত বিশ্বের ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন সেসব সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে তা-ই। আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। আমাদের ভাষার সাহিত্য নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। বাংলা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এগুলো সবই বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উপাদান। কিন্তু আমরা থমকে আছি ভাষার ভবিষ্যতের প্রশ্নে শেষোক্ত দুটি বিষয়ে। প্রথমত এ দেশে এখন তুর্কি-মোগল-ইংরেজ শাসন নেই সত্য কিন্তু আমাদের মনোজগৎ থেকে সে উপনিবেশ এখনো উঠে যায়নি। বিশেষ করে ইংরেজির ভাষিক উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এ বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন—‘ঔপনিবেশিক ঘোর খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ভাষার ক্ষেত্রে; দেখা যায় ‘রাষ্ট্রভাষা’টি থাকে নামে মাত্র আর রাজনীতিক আমলা বিচারপতি আইনজীবী চিকিৎসক ব্যবসায়ী প্রকৌশলী শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা, অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলভোগীরা লিপ্ত থাকেন একদা প্রভুদের ভাষা চর্বণে—রোমন্থনে।’ এর বাইরে অর্থাৎ ‘ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার’ ছাড়াও আকাশ-সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রধানত সংস্কৃতি ও পণ্যের হাত ধরে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির প্রতাপ ছড়ানো ইংরেজির প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। বাইরে আমরা ভাষাপ্রেম যতই দেখাই কিন্তু আমাদের ‘এ হূদয় মাঙ্গে মোর’। এভাবে হিন্দি এবং ইংরেজি নব্য সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক উপনিবেশ হিসেবে আমাদের ভাষাকে বেশ কিছুটা হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে, অন্তত এর পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত ও প্রভাবিত করছে। আর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিতে আমরা যে পিছিয়ে আছি সে কারণেও আমাদের বাংলা ভাষা নিজে অন্যকে তো প্রভাবিত করতে পারছেই না বরং অন্যের পণ্য-প্রযুক্তি তার ভাষাসহ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেবাই শুধু দিচ্ছে না, ভাষাও দিচ্ছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাপানিজ, জার্মান কিংবা কোরিয়ান ভাষাকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।
বর্তমান পৃথিবী পরিবর্তনের পৃথিবী। পৃথিবীব্যাপী যে পরিবর্তন বা বদলের হাওয়া শুরু হয়েছে সেখানে ভাষার বদল ঘটাও স্বাভাবিক। কিন্তু যখন এ পরিবর্তন কোনো ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠন, গঠন-বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্যকে বিপন্ন করে নতুন এক আরোপিত পরিমণ্ডল তৈরি করে, তখন তা আর পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ থাকে না। ভাষার অস্তিত্ব তথা স্বাতন্ত্র্যকেও তা বিপন্ন করে তোলে। যদি সে ভাষিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পঁচিশ কোটি হয় তাহলেও। আমরা বাংলা ভাষার পরিণতি বা ভবিষ্যতের প্রসঙ্গে আসি। একসময় গ্রিক-ল্যাটিন-সংস্কৃত খুব দাপটের সঙ্গে পৃথিবীতে চর্চা হয়েছে। এ ভাষার সাহিত্যের সম্ভার পাঠ করে আজও আমরা আবেগাক্রান্ত হই কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ ভাষা এখন সংগ্রহশালা আর গবেষণার ভাষা। ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের মুখে, প্রতিদিনের জীবনে। বাংলা ভাষা তার পরিবর্তনের যে স্রোত বেয়ে ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে, সেখানে তাকালে আমরা বেশ কিছু লক্ষণ দেখব—সাধু বিদায় নিলেও সাধুর ক্রিয়াপদ আবার ঘরে ফেরার চেষ্টা ‘করতাছে’। ভাষাবিজ্ঞানে যাকে ‘ডায়ালেক্ট মিক্সিং’ বলে সেই আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে মান ভাষায়। ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষার শব্দ, বাক্যগঠন এবং উচ্চারণ ক্রমেই তার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম ‘র’ কে ‘ড়’ বলছে, একসেন্ট বা ঝোঁক প্রয়োগ করছে ইংরেজি অনুকরণে। শব্দ ও শব্দের অর্থ পরিবর্তন ঘটছে। আগে ‘কঠিন’ শব্দ ব্যবহার হতো শক্ত বা সহজ নয় এ অর্থে আর এখন ব্যবহূত হচ্ছে সুন্দর বা দারুণ অর্থে। সব মিলিয়ে এক ধরনের মিশ্র বা সংকর বাংলা ভাষা তৈরি করছি আমরা। ভাষাবিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম লিখেছেন—বাংলাদেশে যারা তথাকথিত শিক্ষিত তাদের মুখের ভাষায় এ বিচিত্র সংকর ভাষা ব্যবহার আমাদের মাতৃভাষার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আর ঔপনিবেশিক ইংরেজরা চলে গেছে কিন্তু নতুন উপনিবেশিক বাস্তবতায় প্রযুক্তি আর গণমাধ্যমের হাত ধরে ‘রোমান হরফ’ এসে হাজির হয়েছে।
১৯৫২ সালের আগে ফারসির ভয়ে আমাদের প্রিয় বর্ণমালা ছিল দুঃখিনীর বর্ণমালা, আজ একুশ শতকে রোমানের ভয়ে নতুন দুঃখ কি ভর করবে তাকে? আমরা কিন্তু ভাষার পরিণতির কথা ভাবছি না, পরিবর্তনের কথা ভাবছি। এমনকি পরিবর্তনগুলোকে সাধারণভাবে গ্রহণই করছি। একুশ শতকের এই গতিময় পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষা পৃথিবী থেকে হয়তো হারিয়ে যাবে না, কিন্তু দুই-তিন যুগ পর এর রূপ বা আকৃতি যা দাঁড়াবে তাকে কোনো ক্রমেই বাঙালির বাংলা ভাষা বলা যাবে না। ভাষার জন্য আমাদের এই আত্মত্যাগের ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব সব হারিয়ে আমাদের ভাষা আমাদের থাকবে না—যদি না আমরা সচেতন হই। সত্যিকারের মাতৃভাষা প্রেম গড়ে না উঠলে শুধু একুশ এলেই দীর্ঘশ্বাস—‘আমরি বাংলা ভাষা’য় আটকে না গিয়ে সারা বছর ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা কোন দিকে যাচ্ছে তা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে বিস্তর গবেষণা করা প্রয়োজন। এ লেখায় সে গবেষণার অবকাশ নেই। শুধু একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতার দুটি লাইন উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে দিলেই ভবিষ্যতের বাংলা ভাষার চিত্র কিছুটা হলেও ধরা পড়বে। এক শিক্ষার্থী লিখেছে: Total exam-এর মধ্যে হেব্বি একটা topic পাইছি—ডিজুস বাংলা। আহ! লেইখ্যা ফাটাইয়া দিছি...।
এই হলো এখন বাংলা ভাষার চলতি দশা।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments