অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি ও জালিয়াত চক্র by মইনুল ইসলাম
কুখ্যাত
হল-মার্ক কেলেঙ্কারি-সম্পর্কিত সংসদের আলোচনায় অভিযুক্ত জালিয়াতদের
বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সে
সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে
‘নিজেদের লোকের কারণেই ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’ তাঁর এই স্বীকারোক্তি
সরকারের সব মহলে সাধুবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতার
কিছুটা স্বীকৃতি এতে রয়েছে বলে তাঁকে ধন্যবাদ। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক
কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি এবং সর্বশেষ বেসিক
ব্যাংকের চেয়ারম্যানের যোগসাজশে ব্যাপক লুটপাট এই রাষ্ট্রমালিকানাধীন
ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিগ্রস্ততা ও সামগ্রিক পরিচালনার গুণগত
মানের ধস নামার প্রমাণ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার
বিপর্যস্ত অবস্থার নেহাত খণ্ডচিত্র এই কয়েকটি কেলেঙ্কারি, ‘টিপ অব দ্য
আইসবার্গ’।
প্রকৃতপক্ষে সবগুলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকেই ব্যবস্থাপনার সংকট ক্রমে বেড়ে চলেছে, দুর্নীতির বিস্তারও ঘটছে হু হু করে। এই ব্যাংকগুলোর এহেন শোচনীয় অবস্থার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় সরকার মনোনীত ‘রাজনৈতিক’ চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও ট্রেড ইউনিয়নের দাপটকেই বেশি দায়ী মনে করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত হলেও এই চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের মনোনয়ন যে প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই হয়ে থাকে, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। রাজনৈতিক হালুয়া-রুটি বিতরণের এই বহুল-ব্যবহৃত বন্দোবস্ত ক্ষমতাসীন পূর্বাপর সব সরকারের আমলেই সরকারপ্রধানের নিয়ন্ত্রণাধীন মেকানিজমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। (ফাইলগুলো প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ঘুরে আসাটাই নিয়ম!) অর্থমন্ত্রী কদাচিৎ তাঁর পছন্দসই দু-চারজনকে এসব ‘রাজনৈতিক প্রসাদের’ ভাগ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন হয়তোবা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জেনারেল ম্যানেজার থেকে শুরু করে উচ্চতর সব পদের ব্যাংকারদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু হয়ে গেছে ক্রমে ক্রমে। অতএব, উল্লিখিত কেলেঙ্কারিগুলোতে যেসব রাজনৈতিকভাবে বাছাই করা চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং উঁচু পদের ব্যাংক-আমলার যোগসাজশ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের মাথার ওপর ক্ষমতাসীন সরকারের মহাশক্তিধর ছত্রচ্ছায়া থাকাতেই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ আটকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। অর্থমন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তি তাঁর দলের অনেককেই যে নাখোশ করবে, সেটা আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়।
আসলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হোক আর ব্যক্তি খাতের ব্যাংক হোক, ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা যে মোটেও স্বস্তিকর নয়, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয়। প্রধানত প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের কারণে ব্যাংক আমানতের প্রবাহের যে অব্যাহত স্ফীতি, সেটা ব্যাংকঋণের আদায়-সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতাকে আড়াল করে চলেছে। ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি উদ্বৃত্ত তারল্য এবং বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতের স্থবিরতা নিয়েই যেহেতু শঙ্কা বেশি দেখা যাচ্ছে, তাই পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রটা যতখানি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না। কিছুদিন পরপর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ক্লাসিফাইড ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করা হয়, সেটাকে আমি বরাবর প্রতারণামূলক আখ্যায়িত করে আসছি, কারণ ওই প্রকাশিত হিসাবে খেলাপি ঋণের যে অংশটা অবলোপন (রাইট-অফ) করা হয়েছে, তার সুদাসলে স্থিতি কত হয়েছে, সে পরিমাণটা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে অবলোপনকৃত ঋণের সুদাসলে পরিমাণ ক্লাসিফাইড ঋণের সঙ্গে যোগ করে মোট খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত, তা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। ২০০২ সালে রাইট-অফ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০০৪ সাল পর্যন্ত অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা নিয়মিতভাবে প্রতি তিন মাস পরপর প্রকাশ করা হতো, কিন্তু যখন ওই হিসাব পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছিল যে কোনো ব্যাংকই অবলোপনকৃত মন্দঋণ তেমন আদায় করতে পারছে না, তখন হঠাৎ করে ওই হিসাবটা আর প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এরপর থেকে আমি বেশ কয়েকবার রাইট-অফ করা ঋণের হালনাগাদ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশের দাবি জানিয়েছি, কোনো ফল পাইনি।
অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, কোনো সাংসদ লিখিতভাবে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের অনুরোধ জানালে তা প্রকাশ করা হবে। সাংসদদের মধ্যে কেউ কি এগিয়ে আসবেন? এলে জানতে চাওয়া উচিত, ২০০২ সাল থেকে যে ৩৬ হাজার কোটি টাকা অবলোপন বা রাইট-অফ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, ওই অবলোপনকৃত মন্দঋণ কারা নিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা। তাহলে ফাঁস হয়ে যাবে যে এ দেশের রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের একটা বিশাল অংশ শুধু পাঁচ বছর নয়, দশ-পনেরো-কুড়ি-ত্রিশ বছরের পুরোনো রাইট-অফ করা মন্দঋণ পরিশোধ না করেও দিব্যি আছে এবং তাদের অনেকেই সাধু সেজে যত্রতত্র কথার ফুলঝুরি ছড়াতে সিদ্ধহস্ত! সম্প্রতি যেসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিকে তাঁদের ‘ঋণ পুনর্গঠন’ বা ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’-এর সুযোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এঁদের অনেকেই ওই তালিকায় ধরা পড়বে—এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ৪০ বছর ধরে যেসব ব্যাংক-ঋণ জালিয়াত ও পুঁজি-লুটেরা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে পুঁজি লুণ্ঠনের প্রধান রথী-মহারথীর ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’ সুবিধা দিয়ে তাঁদের খেলাপি ঋণের রিশিডিউলিং বা পুনঃতফসিলীকরণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার দৃঢ় অভিমত হলো: এই সুবিধা ভোগের পূর্বশর্ত হওয়া উচিত, যাঁদের নামে অবলোপনকৃত মন্দঋণ রয়েছে, প্রথমে সেটা সুদাসলে সম্পূর্ণ শোধ করে তারপর ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’ সুবিধা গ্রহণের জন্য আবেদন জানানো যাবে। তাহলেই এঁদের প্রকৃত জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের বিষয়টি সত্যিই খুব দুঃখজনক। এই ব্যাংকটিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হতো কয়েক বছর আগেও। শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক নয়, প্রায় সব প্রাইভেট ব্যাংকের তুলনায়ও এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল কম—৫ শতাংশের মতো। ছোট ব্যাংক হলেও প্রতিবছর সরকারকে মুনাফা জোগান দিয়ে আসছিল ব্যাংকটি। অথচ শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর চেয়ারম্যান পদ লাভের কয়েক বছরেই ভোজবাজির মতো ব্যাংকটি লুটপাটের আখড়া হয়ে উঠল। এখন ব্যাংকটির ক্লাসিফাইড ঋণ ৫৭ শতাংশ। অবশ্য ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মজিদ ব্যাংকটিতে বহুদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন, এবারও হয়তো তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ব্যাংকটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর গায়ে টোকাও দেওয়া যাচ্ছে না, রহস্য কী?
২০০৯ থেকে ২০১৫—এই সাড়ে ছয় বছরের ক্ষমতাসীন মহলের এই দুরারোগ্য ব্যাধিটা কি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির নয়? কারও ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয় না, কিন্তু এ ধরনের ক্রোনি ক্যাপিটালিজম দেশের যে চিরস্থায়ী ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে, তা থেকে আমাদের পরিত্রাণ কি মিলবে না?
প্রধানমন্ত্রী কয়েকবারই বলেছেন, তাঁকে কেনা যায় না। কিন্তু এসব কি দুর্নীতি নয়? ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পালাবদলের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই জাতির। প্রতি নির্বাচনেই ধরাশায়ী হয়ে যেত ক্ষমতাসীন দল বা জোট। ক্ষমতাসীন হয়েই নতুন সরকার পুরোনো রেকর্ডটাই বারবার বাজানো শুরু করত যে তাদের আগেরবারের সব সুকৃতি প্রতিপক্ষ দল বা জোট নস্যাৎ করে দিয়েছে। এবার কিন্তু শেখ হাসিনা সাড়ে ছয় বছর ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আরও অনেক দিন তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সরকারের আমলের দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন, স্বজন-তোষণ, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির দায়ভার তাঁর ওপরেই বর্তাচ্ছে। জনগণের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে চলেছে। সময় থাকতে সুশাসন প্রদানে ব্রতী হওয়ার জন্য তাঁর প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।
সবশেষে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করার অনুরোধ করছি: রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের কেলেঙ্কারি এবং খেলাপি ঋণের খবরগুলো পত্রিকায় ফলাও করে আসতে শুরু করলে ব্যাংকগুলো প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে অনেককে নতুন করে ওকালতি শুরু করতে দেখা যায়। সবগুলো ব্যাংক প্রাইভেটাইজ করা আমার মতে কোনো ভালো সমাধান দেবে না। আমাদের অর্থনীতির জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু সরকারের ব্যাংক জাতীয়করণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল, তা যেন আমরা বিস্মৃত না হই। ব্যাংক জাতীয়করণের কোনো সুফল জনগণ পায়নি, তা তো ডাহা মিথ্যা কথা। অন্যদিকে, জাতীয়করণ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সেটা বলাও যৌক্তিক হবে না, যদিও এর ব্যর্থতাগুলোকে ফলাও করে প্রচার করাটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে গত সাড়ে তিন দশকের মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে।
৩৩ বছর ধরে গড়ে ওঠা দেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে অন্য ধরনের পুঁজি-লুণ্ঠনের সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলোর চেহারা ভিন্ন হলেও প্রাইভেট ব্যাংকের মালিকেরা এবং ওই ব্যাংকগুলোর ঋণ-সুবিধা ভোগকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পুঁজি লুণ্ঠনে অনেক বেশি কামেলিয়ত প্রদর্শন করে চলেছেন, এটুকুই শুধু বলব এক্ষণে। ওই লুটপাটের চেহারাটা উন্মোচন করা যাবে আরেকবার। তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক এখন যতগুলো রয়েছে, অতগুলো না রাখলেও চলবে। সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানাধীন খাতে রেখে অন্যগুলোকে পর্যায়ক্রমে এগুলোর সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। নানাবিধ বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলা যায় ক্রমান্বয়ে। আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রাইভেট ব্যাংকের ক্ষেত্রে তাদের যে ক্ষমতা, তার সমস্তরে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন সমুন্নত করা একই সঙ্গে গুরুত্ববহ। মাঝখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগটিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটা আবার পুনর্বহাল করেছে ক্ষমতার প্রসাদ বিতরণের সুযোগ লাভের জন্য। ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দক্ষতায় যে ধস নেমেছে, সেটা তারা দেখেও দেখছে না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ‘ব্যাংকিং সেক্টর রিফর্মস কমিশন’ গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
মইনুল ইসলাম: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি৷
প্রকৃতপক্ষে সবগুলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকেই ব্যবস্থাপনার সংকট ক্রমে বেড়ে চলেছে, দুর্নীতির বিস্তারও ঘটছে হু হু করে। এই ব্যাংকগুলোর এহেন শোচনীয় অবস্থার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় সরকার মনোনীত ‘রাজনৈতিক’ চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও ট্রেড ইউনিয়নের দাপটকেই বেশি দায়ী মনে করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত হলেও এই চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের মনোনয়ন যে প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই হয়ে থাকে, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। রাজনৈতিক হালুয়া-রুটি বিতরণের এই বহুল-ব্যবহৃত বন্দোবস্ত ক্ষমতাসীন পূর্বাপর সব সরকারের আমলেই সরকারপ্রধানের নিয়ন্ত্রণাধীন মেকানিজমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। (ফাইলগুলো প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ঘুরে আসাটাই নিয়ম!) অর্থমন্ত্রী কদাচিৎ তাঁর পছন্দসই দু-চারজনকে এসব ‘রাজনৈতিক প্রসাদের’ ভাগ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন হয়তোবা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জেনারেল ম্যানেজার থেকে শুরু করে উচ্চতর সব পদের ব্যাংকারদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু হয়ে গেছে ক্রমে ক্রমে। অতএব, উল্লিখিত কেলেঙ্কারিগুলোতে যেসব রাজনৈতিকভাবে বাছাই করা চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং উঁচু পদের ব্যাংক-আমলার যোগসাজশ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের মাথার ওপর ক্ষমতাসীন সরকারের মহাশক্তিধর ছত্রচ্ছায়া থাকাতেই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ আটকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। অর্থমন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তি তাঁর দলের অনেককেই যে নাখোশ করবে, সেটা আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়।
আসলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হোক আর ব্যক্তি খাতের ব্যাংক হোক, ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা যে মোটেও স্বস্তিকর নয়, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয়। প্রধানত প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের কারণে ব্যাংক আমানতের প্রবাহের যে অব্যাহত স্ফীতি, সেটা ব্যাংকঋণের আদায়-সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতাকে আড়াল করে চলেছে। ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি উদ্বৃত্ত তারল্য এবং বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতের স্থবিরতা নিয়েই যেহেতু শঙ্কা বেশি দেখা যাচ্ছে, তাই পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রটা যতখানি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না। কিছুদিন পরপর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ক্লাসিফাইড ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করা হয়, সেটাকে আমি বরাবর প্রতারণামূলক আখ্যায়িত করে আসছি, কারণ ওই প্রকাশিত হিসাবে খেলাপি ঋণের যে অংশটা অবলোপন (রাইট-অফ) করা হয়েছে, তার সুদাসলে স্থিতি কত হয়েছে, সে পরিমাণটা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে অবলোপনকৃত ঋণের সুদাসলে পরিমাণ ক্লাসিফাইড ঋণের সঙ্গে যোগ করে মোট খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত, তা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। ২০০২ সালে রাইট-অফ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০০৪ সাল পর্যন্ত অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা নিয়মিতভাবে প্রতি তিন মাস পরপর প্রকাশ করা হতো, কিন্তু যখন ওই হিসাব পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছিল যে কোনো ব্যাংকই অবলোপনকৃত মন্দঋণ তেমন আদায় করতে পারছে না, তখন হঠাৎ করে ওই হিসাবটা আর প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এরপর থেকে আমি বেশ কয়েকবার রাইট-অফ করা ঋণের হালনাগাদ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশের দাবি জানিয়েছি, কোনো ফল পাইনি।
অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, কোনো সাংসদ লিখিতভাবে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের অনুরোধ জানালে তা প্রকাশ করা হবে। সাংসদদের মধ্যে কেউ কি এগিয়ে আসবেন? এলে জানতে চাওয়া উচিত, ২০০২ সাল থেকে যে ৩৬ হাজার কোটি টাকা অবলোপন বা রাইট-অফ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, ওই অবলোপনকৃত মন্দঋণ কারা নিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা। তাহলে ফাঁস হয়ে যাবে যে এ দেশের রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের একটা বিশাল অংশ শুধু পাঁচ বছর নয়, দশ-পনেরো-কুড়ি-ত্রিশ বছরের পুরোনো রাইট-অফ করা মন্দঋণ পরিশোধ না করেও দিব্যি আছে এবং তাদের অনেকেই সাধু সেজে যত্রতত্র কথার ফুলঝুরি ছড়াতে সিদ্ধহস্ত! সম্প্রতি যেসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিকে তাঁদের ‘ঋণ পুনর্গঠন’ বা ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’-এর সুযোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এঁদের অনেকেই ওই তালিকায় ধরা পড়বে—এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ৪০ বছর ধরে যেসব ব্যাংক-ঋণ জালিয়াত ও পুঁজি-লুটেরা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে পুঁজি লুণ্ঠনের প্রধান রথী-মহারথীর ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’ সুবিধা দিয়ে তাঁদের খেলাপি ঋণের রিশিডিউলিং বা পুনঃতফসিলীকরণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার দৃঢ় অভিমত হলো: এই সুবিধা ভোগের পূর্বশর্ত হওয়া উচিত, যাঁদের নামে অবলোপনকৃত মন্দঋণ রয়েছে, প্রথমে সেটা সুদাসলে সম্পূর্ণ শোধ করে তারপর ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং’ সুবিধা গ্রহণের জন্য আবেদন জানানো যাবে। তাহলেই এঁদের প্রকৃত জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের বিষয়টি সত্যিই খুব দুঃখজনক। এই ব্যাংকটিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হতো কয়েক বছর আগেও। শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক নয়, প্রায় সব প্রাইভেট ব্যাংকের তুলনায়ও এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল কম—৫ শতাংশের মতো। ছোট ব্যাংক হলেও প্রতিবছর সরকারকে মুনাফা জোগান দিয়ে আসছিল ব্যাংকটি। অথচ শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর চেয়ারম্যান পদ লাভের কয়েক বছরেই ভোজবাজির মতো ব্যাংকটি লুটপাটের আখড়া হয়ে উঠল। এখন ব্যাংকটির ক্লাসিফাইড ঋণ ৫৭ শতাংশ। অবশ্য ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মজিদ ব্যাংকটিতে বহুদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন, এবারও হয়তো তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ব্যাংকটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর গায়ে টোকাও দেওয়া যাচ্ছে না, রহস্য কী?
২০০৯ থেকে ২০১৫—এই সাড়ে ছয় বছরের ক্ষমতাসীন মহলের এই দুরারোগ্য ব্যাধিটা কি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির নয়? কারও ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয় না, কিন্তু এ ধরনের ক্রোনি ক্যাপিটালিজম দেশের যে চিরস্থায়ী ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে, তা থেকে আমাদের পরিত্রাণ কি মিলবে না?
প্রধানমন্ত্রী কয়েকবারই বলেছেন, তাঁকে কেনা যায় না। কিন্তু এসব কি দুর্নীতি নয়? ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পালাবদলের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই জাতির। প্রতি নির্বাচনেই ধরাশায়ী হয়ে যেত ক্ষমতাসীন দল বা জোট। ক্ষমতাসীন হয়েই নতুন সরকার পুরোনো রেকর্ডটাই বারবার বাজানো শুরু করত যে তাদের আগেরবারের সব সুকৃতি প্রতিপক্ষ দল বা জোট নস্যাৎ করে দিয়েছে। এবার কিন্তু শেখ হাসিনা সাড়ে ছয় বছর ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আরও অনেক দিন তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সরকারের আমলের দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন, স্বজন-তোষণ, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির দায়ভার তাঁর ওপরেই বর্তাচ্ছে। জনগণের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে চলেছে। সময় থাকতে সুশাসন প্রদানে ব্রতী হওয়ার জন্য তাঁর প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।
সবশেষে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করার অনুরোধ করছি: রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের কেলেঙ্কারি এবং খেলাপি ঋণের খবরগুলো পত্রিকায় ফলাও করে আসতে শুরু করলে ব্যাংকগুলো প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে অনেককে নতুন করে ওকালতি শুরু করতে দেখা যায়। সবগুলো ব্যাংক প্রাইভেটাইজ করা আমার মতে কোনো ভালো সমাধান দেবে না। আমাদের অর্থনীতির জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু সরকারের ব্যাংক জাতীয়করণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল, তা যেন আমরা বিস্মৃত না হই। ব্যাংক জাতীয়করণের কোনো সুফল জনগণ পায়নি, তা তো ডাহা মিথ্যা কথা। অন্যদিকে, জাতীয়করণ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সেটা বলাও যৌক্তিক হবে না, যদিও এর ব্যর্থতাগুলোকে ফলাও করে প্রচার করাটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে গত সাড়ে তিন দশকের মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে।
৩৩ বছর ধরে গড়ে ওঠা দেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে অন্য ধরনের পুঁজি-লুণ্ঠনের সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলোর চেহারা ভিন্ন হলেও প্রাইভেট ব্যাংকের মালিকেরা এবং ওই ব্যাংকগুলোর ঋণ-সুবিধা ভোগকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পুঁজি লুণ্ঠনে অনেক বেশি কামেলিয়ত প্রদর্শন করে চলেছেন, এটুকুই শুধু বলব এক্ষণে। ওই লুটপাটের চেহারাটা উন্মোচন করা যাবে আরেকবার। তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক এখন যতগুলো রয়েছে, অতগুলো না রাখলেও চলবে। সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানাধীন খাতে রেখে অন্যগুলোকে পর্যায়ক্রমে এগুলোর সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। নানাবিধ বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলা যায় ক্রমান্বয়ে। আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রাইভেট ব্যাংকের ক্ষেত্রে তাদের যে ক্ষমতা, তার সমস্তরে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন সমুন্নত করা একই সঙ্গে গুরুত্ববহ। মাঝখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগটিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটা আবার পুনর্বহাল করেছে ক্ষমতার প্রসাদ বিতরণের সুযোগ লাভের জন্য। ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দক্ষতায় যে ধস নেমেছে, সেটা তারা দেখেও দেখছে না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ‘ব্যাংকিং সেক্টর রিফর্মস কমিশন’ গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
মইনুল ইসলাম: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি৷
No comments