যানজটে অচল ঢাকা by মোর্শেদ নোমান ও কমল জোহা খান
পথে নামলেই যানজটের এই নিত্য দুর্ভোগে ত্যক্ত-বিরক্ত রাজধানীবাসী। গত শনিবার বিকেলে ফার্মগেট এলাকার চিত্র এটি l ছবি: প্রথম আলো |
রাজধানী
ঢাকার যান চলাচলব্যবস্থা প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সমন্বিত
পরিকল্পনা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের পথ নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ ও ঢাকা মহানগর
পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা এমনটাই মনে করেন। রাজধানীর
দুই মেয়রও জানালেন, এ সমস্যা সমাধানে তাঁদের সরাসরি তেমন কিছু করার ক্ষমতা
নেই।
দুই মেয়রের মতে, রাজধানীতে এমনিতেই রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অযান্ত্রিক যানের অবাধ বিচরণ, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত দখল, পরিকল্পনাহীন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, শহরের ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল, চালক ও পথচারীদের নিয়ম না মানার সংস্কৃতি। আরও আছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাপনা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অসহ্য যানজটে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে রাজধানীর জীবনযাত্রা।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মতে, ঢাকার ট্রাফিক-ব্যবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই যানজট সমস্যার স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান সম্ভব। তারই অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
এক হিসাবে দেখা গেছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। দেড় কোটি মানুষের ‘মেগাসিটি’ ঢাকায় জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে যানবাহন। বাড়ছে না শুধু রাস্তা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় এই পরিমাণ মাত্র ৭-৮ শতাংশ। এর একটি বড় অংশ আবার পার্কিং ও হকারদের দখলে।
ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে, রাজধানীতে যে পরিমাণ রাস্তা আছে তাতে তিন লাখের মতো গাড়ি চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় নয় লাখ। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। অথচ ২০০৯ পর্যন্ত রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখের কিছু বেশি। এর পাশাপাশি ঢাকা মহানগরে ৭৯ হাজার লাইসেন্সধারী রিকশার বিপরীতে প্রায় ১০ লাখ রিকশা চলছে বলে ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি (প্রাইভেট কার)। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৮৯টি কার চলাচল করে। অথচ গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত বাসের সংখ্যা ২২ হাজার ৮১৪ এবং মিনিবাসের সংখ্যা ৯ হাজার ৯৯৫।
এ অবস্থায় পরিবেশবান্ধব যান হিসেবে বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশের বাইসাইকেল ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, বাংলাদেশে কয়েক বছরে সাইকেল বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। তবে সাইকেল চলাচলে সুবিধার জন্য আলাদা লেন করার কথা ভাবছে না ট্রাফিক বিভাগ। ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাইকেলের লেন হলে তো ভালোই হয়। তবে আমাদের এখানে তো রাস্তাই নেই, সাইকেলের লেন কীভাবে করবেন?’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান বলেন, যানজট কমাতে হলে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে। আর তা করতে হলে গণপরিবহন বাড়ানোরও বিকল্প নেই।
যানজটের কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও গাফিলতিকে। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া কোনোভাবেই ট্রাফিক-ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। তারা ঢাকার বুকে অনেকটা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার হয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ট্রাফিক বিভাগের সূত্রমতে, সোয়া তিন হাজার ট্রাফিক সদস্যের মধ্যে ২ হাজার ৮০০ কনস্টেবল তিন পালায় দিনরাত কাজ করেন ঢাকা শহরের প্রায় ৬০০ ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে। প্রথম পালায় প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কাজ করেন ১ হাজার ৩৫০ জন কনস্টেবল। বিকেলের পালার কাজ বেলা দুইটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন ১ হাজার ৪০০ কনস্টেবল। এ ছাড়া ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রাত ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত ১৫০ জন ট্রাফিক কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করেন।
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ছুটির কারণে মোট জনবলের মাত্র ৮০ ভাগ সদস্যকে প্রতিদিন কাজে পাওয়া যায়। সেই হিসাবে প্রতিদিন একেক পালায় ৯৫০ জন ট্রাফিক কনস্টেবল ঢাকার ৬০০ পয়েন্টে কাজ করেন। অর্থাৎ প্রতিটি পয়েন্ট দুজনেরও কম ট্রাফিক কনস্টেবল ঢাকার রাজপথ সামাল দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া ট্রাফিক সার্জেন্টের ৩৫০টি পদ শূন্য রয়েছে।
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, শুধু ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ালে যানজটের সমস্যা সমাধান হবে না। এতে হয়তো ট্রাফিক সদস্যদের ওপর চাপ কমবে। চাপ সামলাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ সারওয়ার জাহান বলেন, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হলে যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে গণপরিবহনকে অগ্রাধিকার না দিলে ছোট গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়াবে। যানজট নিরসনে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখবে না। এ ছাড়া সড়কে পার্কিং বন্ধ করা, গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তবে পুলিশের কর্মকর্তারা ট্রাফিক বিভাগের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেন, ট্রাফিক বিভাগের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা কাজ বুঝে ওঠার আগেই বদলি হয়ে যান। ফলে নীতিনির্ধারণে সমস্যা থেকেই যায়।
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যানবাহন চলাচলের সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক সিগন্যাল-পদ্ধতি, বাস বে ও বাস স্টপেজ সংখ্যা বাড়ানো, আন্ডারপাস ও পদচারী-সেতু স্থাপন, গণপরিবহন বাড়িয়ে ছোট গাড়ি কমানো, বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) মেয়র আনিসুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার, সড়ক সংস্কার ও ফুটপাত প্রশস্ত করে গাছ লাগানো, পথচারীদের জন্য জেব্রা ক্রসিংসহ আরও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জানতে চাইলে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় গাড়ি বেশি, রাস্তা কম। এটাই যানজটের অনেক বড় কারণ। এ ক্ষেত্রে মেয়রের সরাসরি কিছু করার ক্ষমতা নেই। তবে আমার এখতিয়ারের মধ্যে যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।’ তেজগাঁও থেকে ট্রাক টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া, কারওয়ান বাজার থেকে কাঁচাবাজার সরানো, আমিন বাজারে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করা, মোহাম্মদপুরের বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো এক বছরের মধ্যে সুরাহা করা গেলে যানজট কমার ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে যানজট নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কার ক্ষমতা কী, সেটার কথা চিন্তা না করে সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
যানজটের কারণ
* রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ
* অযান্ত্রিক যানবাহনের অবাধ বিচরণ
* ৭৯ হাজার লাইসেন্সধারী রিকশার বিপরীতে প্রায় ১০ লাখ রিকশার চলাচল
* যেখানে সেখানে পার্কিং এবং ফুটপাত ও রাস্তা দখল
* সেকেলে ট্রাফিক ব্যবস্থা
* অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাপনা
* অতিরিক্ত ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির উপস্থিতি
* অপর্যাপ্ত গণপরিবহন
* শহরের ভেতরে থাকা বাস টার্মিনাল
* রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকা
* ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও গাফিলতি
* প্রভাবশালীদের গাড়ির চলাচলে নিয়ম না মানার সংস্কৃতি
যানজটের প্রতিকার
* গণপরিবহনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া
* ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমানো
* ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন
* বাস বে ও বাস স্টপেজ সংখ্যা বাড়ানো
* আন্ডারপাস ও পদচারী-সেতু স্থাপন
* অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা
* ট্রাফিক বিভাগের দক্ষতা বাড়ানো
* মেট্রোরেল প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন
* ভিআইপি চলাচলের নামে রাস্তা বন্ধ না রাখা
* প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ
* রাজধানী থেকে শিল্পকারখানা সরিয়ে নেওয়া
দুই মেয়রের মতে, রাজধানীতে এমনিতেই রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অযান্ত্রিক যানের অবাধ বিচরণ, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত দখল, পরিকল্পনাহীন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, শহরের ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল, চালক ও পথচারীদের নিয়ম না মানার সংস্কৃতি। আরও আছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাপনা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অসহ্য যানজটে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে রাজধানীর জীবনযাত্রা।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মতে, ঢাকার ট্রাফিক-ব্যবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই যানজট সমস্যার স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান সম্ভব। তারই অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
এক হিসাবে দেখা গেছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। দেড় কোটি মানুষের ‘মেগাসিটি’ ঢাকায় জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে যানবাহন। বাড়ছে না শুধু রাস্তা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় এই পরিমাণ মাত্র ৭-৮ শতাংশ। এর একটি বড় অংশ আবার পার্কিং ও হকারদের দখলে।
ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে, রাজধানীতে যে পরিমাণ রাস্তা আছে তাতে তিন লাখের মতো গাড়ি চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় নয় লাখ। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। অথচ ২০০৯ পর্যন্ত রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখের কিছু বেশি। এর পাশাপাশি ঢাকা মহানগরে ৭৯ হাজার লাইসেন্সধারী রিকশার বিপরীতে প্রায় ১০ লাখ রিকশা চলছে বলে ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি (প্রাইভেট কার)। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৮৯টি কার চলাচল করে। অথচ গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত বাসের সংখ্যা ২২ হাজার ৮১৪ এবং মিনিবাসের সংখ্যা ৯ হাজার ৯৯৫।
এ অবস্থায় পরিবেশবান্ধব যান হিসেবে বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশের বাইসাইকেল ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, বাংলাদেশে কয়েক বছরে সাইকেল বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। তবে সাইকেল চলাচলে সুবিধার জন্য আলাদা লেন করার কথা ভাবছে না ট্রাফিক বিভাগ। ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাইকেলের লেন হলে তো ভালোই হয়। তবে আমাদের এখানে তো রাস্তাই নেই, সাইকেলের লেন কীভাবে করবেন?’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান বলেন, যানজট কমাতে হলে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে। আর তা করতে হলে গণপরিবহন বাড়ানোরও বিকল্প নেই।
যানজটের কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও গাফিলতিকে। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া কোনোভাবেই ট্রাফিক-ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। তারা ঢাকার বুকে অনেকটা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার হয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ট্রাফিক বিভাগের সূত্রমতে, সোয়া তিন হাজার ট্রাফিক সদস্যের মধ্যে ২ হাজার ৮০০ কনস্টেবল তিন পালায় দিনরাত কাজ করেন ঢাকা শহরের প্রায় ৬০০ ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে। প্রথম পালায় প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কাজ করেন ১ হাজার ৩৫০ জন কনস্টেবল। বিকেলের পালার কাজ বেলা দুইটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন ১ হাজার ৪০০ কনস্টেবল। এ ছাড়া ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রাত ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত ১৫০ জন ট্রাফিক কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করেন।
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ছুটির কারণে মোট জনবলের মাত্র ৮০ ভাগ সদস্যকে প্রতিদিন কাজে পাওয়া যায়। সেই হিসাবে প্রতিদিন একেক পালায় ৯৫০ জন ট্রাফিক কনস্টেবল ঢাকার ৬০০ পয়েন্টে কাজ করেন। অর্থাৎ প্রতিটি পয়েন্ট দুজনেরও কম ট্রাফিক কনস্টেবল ঢাকার রাজপথ সামাল দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া ট্রাফিক সার্জেন্টের ৩৫০টি পদ শূন্য রয়েছে।
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, শুধু ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ালে যানজটের সমস্যা সমাধান হবে না। এতে হয়তো ট্রাফিক সদস্যদের ওপর চাপ কমবে। চাপ সামলাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ সারওয়ার জাহান বলেন, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হলে যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে গণপরিবহনকে অগ্রাধিকার না দিলে ছোট গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়াবে। যানজট নিরসনে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখবে না। এ ছাড়া সড়কে পার্কিং বন্ধ করা, গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তবে পুলিশের কর্মকর্তারা ট্রাফিক বিভাগের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেন, ট্রাফিক বিভাগের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা কাজ বুঝে ওঠার আগেই বদলি হয়ে যান। ফলে নীতিনির্ধারণে সমস্যা থেকেই যায়।
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যানবাহন চলাচলের সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক সিগন্যাল-পদ্ধতি, বাস বে ও বাস স্টপেজ সংখ্যা বাড়ানো, আন্ডারপাস ও পদচারী-সেতু স্থাপন, গণপরিবহন বাড়িয়ে ছোট গাড়ি কমানো, বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) মেয়র আনিসুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার, সড়ক সংস্কার ও ফুটপাত প্রশস্ত করে গাছ লাগানো, পথচারীদের জন্য জেব্রা ক্রসিংসহ আরও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জানতে চাইলে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় গাড়ি বেশি, রাস্তা কম। এটাই যানজটের অনেক বড় কারণ। এ ক্ষেত্রে মেয়রের সরাসরি কিছু করার ক্ষমতা নেই। তবে আমার এখতিয়ারের মধ্যে যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।’ তেজগাঁও থেকে ট্রাক টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া, কারওয়ান বাজার থেকে কাঁচাবাজার সরানো, আমিন বাজারে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করা, মোহাম্মদপুরের বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো এক বছরের মধ্যে সুরাহা করা গেলে যানজট কমার ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে যানজট নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কার ক্ষমতা কী, সেটার কথা চিন্তা না করে সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
যানজটের কারণ
* রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ
* অযান্ত্রিক যানবাহনের অবাধ বিচরণ
* ৭৯ হাজার লাইসেন্সধারী রিকশার বিপরীতে প্রায় ১০ লাখ রিকশার চলাচল
* যেখানে সেখানে পার্কিং এবং ফুটপাত ও রাস্তা দখল
* সেকেলে ট্রাফিক ব্যবস্থা
* অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাপনা
* অতিরিক্ত ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির উপস্থিতি
* অপর্যাপ্ত গণপরিবহন
* শহরের ভেতরে থাকা বাস টার্মিনাল
* রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকা
* ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও গাফিলতি
* প্রভাবশালীদের গাড়ির চলাচলে নিয়ম না মানার সংস্কৃতি
যানজটের প্রতিকার
* গণপরিবহনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া
* ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমানো
* ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন
* বাস বে ও বাস স্টপেজ সংখ্যা বাড়ানো
* আন্ডারপাস ও পদচারী-সেতু স্থাপন
* অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা
* ট্রাফিক বিভাগের দক্ষতা বাড়ানো
* মেট্রোরেল প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন
* ভিআইপি চলাচলের নামে রাস্তা বন্ধ না রাখা
* প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ
* রাজধানী থেকে শিল্পকারখানা সরিয়ে নেওয়া
No comments