ঢাকার তিন মুখেই ভোগান্তির আশঙ্কা
ঢাকার প্রবেশ পথ জট |
রাজধানীর
গাবতলী হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের ভোগান্তি শুরু হয়
আমিনবাজার সেতুর মুখে। আর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গন্তব্যের মানুষের
দুর্ভোগের কারণ মানিকনগর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত সড়কের বড় বড়
গর্ত। এখানে এক কিলোমিটারের কিছু বেশি পথ পাড়ি দিতে লাগছে প্রায় দেড় ঘণ্টা।
আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গী সেতু এলাকার অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তিতে পড়ছে
উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলার যাত্রীরা।
রাজধানীতে প্রবেশের ও বের হওয়ার মুখ হিসেবে পরিচিত এই স্থানগুলোর এমন অবস্থা আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের আনন্দযাত্রায় দুর্ভোগে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। ঈদ সামনে রেখে এই তিন মুখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছে। কিন্তু এখনই এই তিন মুখে যে যানজট হচ্ছে, ঈদের আগের তিন দিনেরমূল চাপে তা কেমন হবে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
গাবতলী হয়ে যেতে ঢাকার ভেতরই তিন বাধা: সড়কপথে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাত্রায় ঢাকার ভেতরেই তিন বাধা রয়েছে। এর মধ্যে মূল বাধা আমিনবাজার সেতুর মুখ। দ্বিতীয় বাধা কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত থাকা পেট্রলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনে জ্বালানি নিতে যাওয়া যানের কারণে সৃষ্ট জট। কলেজগেট থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়ক দখল করে বাস রেখে যাত্রী তোলা সর্বশেষ বাধা। এই তিন বাধা দূর করতে না পারলে ঈদযাত্রার শুরুতেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে মানুষকে।
ঢাকার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও গাবতলী টার্মিনাল পার হয়েই বিভিন্ন পথের বাস সিগন্যালে আটকে যায়। কারণ, এই দিক দিয়ে গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ ধরে চলা যানবাহন চলতে দিতে হয়। বেড়িবাঁধ ধরে চলা যানবাহন আমিনবাজার সেতুর নিচ দিয়ে বিকল্প সড়কপথে চলার ব্যবস্থা করলে সেখানে সিগন্যালই থাকার কথা নয়। কারণ, এতে আরিচা ও উত্তরবঙ্গ এবং সদরঘাট থেকে আসা ট্রাকগুলো
সহজেই বিকল্প পথ ধরে চলত পারত। মূল মহাসড়কের ওপর চাপ কমাতে ২০১০ সালে ৩৭ কোটি টাকা খরচ করে সেতুর নিচ দিয়ে বিকল্প পথ করা হয়। ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’-এর আকৃতি বলে এর নাম দেওয়া হয় ‘ইউ লুপ’। এটি এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল।
গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, ইউ লুপে এখন হাঁটু সমান গর্ত-কাদা। প্রায় ৩০ ফুট চওড়া এই সড়কের তিন ভাগের দুই ভাগ ট্রাক রেখে দখল করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইট-বালু ও লাকড়ি রেখে চলছে ব্যবসা।
ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, স্বাভাবিক সময়েও রাতে বেড়িবাঁধের যানবাহন পার করতে গিয়ে গাবতলী টার্মিনালের সামনে যানজট তৈরি হয়। আবার মূল সড়ক দিয়ে বেশিক্ষণ যানবাহন ছাড়লে একদিকে বেড়িবাঁধে এবং অন্যদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বলিয়ারপুর পর্যন্ত যানজট বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ঈদের আগের দুই-তিন দিন অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের হিসাবমতে, গাবতলী টার্মিনাল থেকে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার বাস চলে। ঈদে তা আরও বাড়ে। গাবতলী হয়ে বেড়িবাঁধ ধরে চলে প্রায় দেড় হাজার ট্রাক-বাস-কাভার্ড ভ্যানসহ অন্য যানবাহন।
তবে সরকার আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে ঈদের আগের ও পরের তিন দিন মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঢাকা ও এর আশপাশে তা পুরো কার্যকর করা যায় না।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্র বলেছে, এবার ‘ইউ লুপ’-এর সড়ক কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। এ লক্ষ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। তবে ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করতে দুই-তিন মাস লেগে যাবে।
এদিকে কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথে ১৮টি সিএনজি স্টেশন ও পেট্রলপাম্প রয়েছে। দূরপাল্লার ও নগর পরিবহনের বাসের একটা বড় অংশ ও ট্রাক এসব পাম্প থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে। ফলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে স্থাপন করা এসব পাম্পের সামনে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মাজার রোডের দুই দিকেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। কারণ, নগর পরিবহনের বাসগুলো মাজার রোড-সংলগ্ন পাম্প থেকে জ্বালানি নিয়ে উল্টো পথ ধরে পার হচ্ছিল। পুলিশ সামনে থাকলেও আটকায়নি।
গাবতলী এলাকার ট্রাফিক ফাঁড়ির সার্জেন্ট বেলায়েত হোসেন বলেন, অল্প স্থানের মধ্যে এত পাম্প বিষফোড়ার মতো হয়ে গেছে। রাতে বাস-ট্রাকগুলো জ্বালানি নিতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় আটকাতে গেলে পুলিশের জীবনও বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
দূরপাল্লার পথের বাসগুলো রাতে যাত্রী তোলা শুরু করে কলাবাগান থেকে। এরপর কলেজগেট, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মাজার রোড ও গাবতলী পর্যন্ত যাত্রী ওঠায়। ফলে এসব স্থানে সড়কের প্রায় অর্ধেক আটকে রাখা হয় বাস থামিয়ে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীতে সড়কে বড় গর্ত: গতকাল যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে বাস থেকে মহাসড়কে নেমে এক যাত্রীকে প্রশ্ন করে নিজেই জবাব দিলেন হানিফ পরিবহনের এক যাত্রী নাজিউর রহমান, ‘এবার ঈদের যাত্রা কেমন হবে, এটা দেখেই বোঝা যায়।’
দেখা গেল, কুতুবখালীর ওই সড়কে বড় বড় অন্তত ১০টি গর্ত। সায়েদাবাদ সেতুর কাছে সড়কেও এমন ১২টি গর্ত। এ কারণে গতি ধীর হওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু গর্তে ইটের টুকরা ফেলে দায় সেরেছে সিটি করপোরেশন।
বাসযাত্রী নাজিউর রহমান বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতাম, তখন মনকে বোঝাতাম, একসময় নির্বিঘ্ন যাত্রা হবে, কিন্তু দ্যাখেন তো কী অবস্থা? অন্য কোনো দেশে কোনো ব্যস্ত সড়কে এমন গর্ত থাকে?’
পরিবহন মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানিকনগর থেকে কুতুবখালীর দূরত্ব এক কিলোমিটারের কিছু বেশি। কদিন ধরে এই পথ পাড়ি দিতে একেকটি বাসের এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগছে।
ঢাকা-ফেনী-পরশুরাম পথে চলাচলকারী বাসের কোম্পানি স্টারলাইনের ব্যবস্থাপক নাসির আহমেদ বলেন, গর্তগুলোতে চাকা আটকে একটি বাসের গায়ে আরেকটি বাস লেগে থাকে। ঈদের আগে এসব গর্ত ভালোভাবে সারানো না হলে মানিকনগর থেকে কাঁচপুর যেতেই অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, রাস্তার গর্ত মেরামতের চেষ্টা হচ্ছে।
পরিবহনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকা ছাড়াও আরামবাগ, ফকিরেরপুল ও রাজারবাগ থেকে চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ৭০০-এর মতো বাস ছাড়ে। ঈদ উপলক্ষে বাসের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সড়ক ঠিক না হলে যানজট বাড়বে।
গতকাল সকাল থেকে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী প্রধান সড়কে যানজট। যানজটের বড় একটি কারণ সড়কের ওপর বিশৃঙ্খলভাবে বাস-ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-পূর্ব) মাইনুল হাসান বলেন, ঈদ সামনে রেখে অবৈধ পার্কিং ও সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধে প্রচার অভিযান জোরদার করা হচ্ছে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী থেকে বেশ কিছু বাস যায় মাওয়ার দিকে। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের এসব বাস যাওয়ার পথে যানজটে পড়ছে জুরাইন এলাকায়। সেখানে রেলের লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে যানজট বাড়াচ্ছে।
যত্রতত্র বাস আবদুল্লাহপুরে বিষফোড়া: বেলা তখন ১১টা ৫০ মিনিট। ঢাকা-টঙ্গীর সীমানারেখা টানা আবদুল্লাহপুরসংলগ্ন সেতুর ওপরের পশ্চিম পাশে দাঁড়াল মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া ভৈরবগামী বিআরটিসির একটি বাস। কিছুক্ষণের মধ্যে এর পেছনে দাঁড়াল নরসিংদীগামী পিপিএল সুপার বাস, তার পেছনে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটগামী শ্যামলী বাংলা বাস। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে বাসের সারি। সেতুর ওপর বাসের এই সারির কারণে পথটি সরু হয়ে গতি কমে যায়। পেছনে শুরু হয় জট।
কাছাকাছি সময়ে ওই এলাকার পশ্চিম দিকে আশুলিয়াগামী সড়কেও বাসের দীর্ঘ সারি। যাত্রী বেশি না থাকলেও বাসগুলো পুরো সড়কজুড়ে যত্রতত্রভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী হাঁকতে থাকে। ফলে পুরো সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ওই এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য ও একাধিক বাসচালক বলেন, এখানে যানজটের মূল কারণ যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো। সেতুর পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা ও পূর্ব পাশে ফলমূলসহ বিভিন্ন ধরনের ভাসমান দোকানের কারণেও গাড়ির গতি কমে যানজট হয়। আবদুল্লাহপুরের প্রবেশমুখে কয়েকটি সিএনজি ও তেলের পাম্প স্টেশন থাকায় গাড়ির চাপ পড়ে। পশ্চিম পাশে মাছের বাজার হওয়ায় সকালে রিকশা ও ভ্যানের চাপে যানজট হয়।
এই যানজটের জেরে ঢাকার ভেতর উত্তরা, বিপরীত দিকে টঙ্গী ও আশুলিয়া রোডে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে ঈদে ঘরমুখী মানুষকে যানজটের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে এসব স্থানে। এই পথ দিয়ে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনার মানুষ চলাচল করে। কিশোরগঞ্জগামী কিছু বাসও চলে এই পথে। আশুলিয়া দিয়ে যায় মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া টাঙ্গাইল, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু বাস।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, মূল সেতুতে ওঠার পথের পশ্চিম পাশে টেবিল পেতে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। আবদুল্লাহপুরের ঢাকার দিকের পশ্চিম পাশে উত্তরবঙ্গগামী কয়েকটি বাস কাউন্টার গড়ে উঠেছে। লোকাল বাসগুলোও এখানে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠায়-নামায়।
একটি লোকাল বাসের চালক আহমদ আলী বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যদি ঠিকমতো বাস সরিয়ে দিতে পারত, তাহলে এখানে যানজট হতো না।
জানতে চাইলে ওই এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সাজেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি সড়কের প্রবেশমুখ থাকায় এখানে অসংখ্য বাস ও গাড়ি থাকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টার থাকায় এবং অনেক বাস দাঁড়িয়ে লোক উঠানোয় সমস্যা হয়। তবে তাঁরা এই সমস্যা সমাধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দুই পালায় তিনজন করে পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। তবে ঈদ সামনে রেখে এখানে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণকক্ষ বসানো হয়েছে।
রাজধানীতে প্রবেশের ও বের হওয়ার মুখ হিসেবে পরিচিত এই স্থানগুলোর এমন অবস্থা আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের আনন্দযাত্রায় দুর্ভোগে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। ঈদ সামনে রেখে এই তিন মুখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছে। কিন্তু এখনই এই তিন মুখে যে যানজট হচ্ছে, ঈদের আগের তিন দিনেরমূল চাপে তা কেমন হবে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
গাবতলী হয়ে যেতে ঢাকার ভেতরই তিন বাধা: সড়কপথে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাত্রায় ঢাকার ভেতরেই তিন বাধা রয়েছে। এর মধ্যে মূল বাধা আমিনবাজার সেতুর মুখ। দ্বিতীয় বাধা কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত থাকা পেট্রলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনে জ্বালানি নিতে যাওয়া যানের কারণে সৃষ্ট জট। কলেজগেট থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়ক দখল করে বাস রেখে যাত্রী তোলা সর্বশেষ বাধা। এই তিন বাধা দূর করতে না পারলে ঈদযাত্রার শুরুতেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে মানুষকে।
ঢাকার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও গাবতলী টার্মিনাল পার হয়েই বিভিন্ন পথের বাস সিগন্যালে আটকে যায়। কারণ, এই দিক দিয়ে গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ ধরে চলা যানবাহন চলতে দিতে হয়। বেড়িবাঁধ ধরে চলা যানবাহন আমিনবাজার সেতুর নিচ দিয়ে বিকল্প সড়কপথে চলার ব্যবস্থা করলে সেখানে সিগন্যালই থাকার কথা নয়। কারণ, এতে আরিচা ও উত্তরবঙ্গ এবং সদরঘাট থেকে আসা ট্রাকগুলো
সহজেই বিকল্প পথ ধরে চলত পারত। মূল মহাসড়কের ওপর চাপ কমাতে ২০১০ সালে ৩৭ কোটি টাকা খরচ করে সেতুর নিচ দিয়ে বিকল্প পথ করা হয়। ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’-এর আকৃতি বলে এর নাম দেওয়া হয় ‘ইউ লুপ’। এটি এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল।
গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, ইউ লুপে এখন হাঁটু সমান গর্ত-কাদা। প্রায় ৩০ ফুট চওড়া এই সড়কের তিন ভাগের দুই ভাগ ট্রাক রেখে দখল করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইট-বালু ও লাকড়ি রেখে চলছে ব্যবসা।
ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, স্বাভাবিক সময়েও রাতে বেড়িবাঁধের যানবাহন পার করতে গিয়ে গাবতলী টার্মিনালের সামনে যানজট তৈরি হয়। আবার মূল সড়ক দিয়ে বেশিক্ষণ যানবাহন ছাড়লে একদিকে বেড়িবাঁধে এবং অন্যদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বলিয়ারপুর পর্যন্ত যানজট বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ঈদের আগের দুই-তিন দিন অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের হিসাবমতে, গাবতলী টার্মিনাল থেকে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার বাস চলে। ঈদে তা আরও বাড়ে। গাবতলী হয়ে বেড়িবাঁধ ধরে চলে প্রায় দেড় হাজার ট্রাক-বাস-কাভার্ড ভ্যানসহ অন্য যানবাহন।
তবে সরকার আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে ঈদের আগের ও পরের তিন দিন মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঢাকা ও এর আশপাশে তা পুরো কার্যকর করা যায় না।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্র বলেছে, এবার ‘ইউ লুপ’-এর সড়ক কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। এ লক্ষ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। তবে ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করতে দুই-তিন মাস লেগে যাবে।
এদিকে কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথে ১৮টি সিএনজি স্টেশন ও পেট্রলপাম্প রয়েছে। দূরপাল্লার ও নগর পরিবহনের বাসের একটা বড় অংশ ও ট্রাক এসব পাম্প থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে। ফলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে স্থাপন করা এসব পাম্পের সামনে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মাজার রোডের দুই দিকেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। কারণ, নগর পরিবহনের বাসগুলো মাজার রোড-সংলগ্ন পাম্প থেকে জ্বালানি নিয়ে উল্টো পথ ধরে পার হচ্ছিল। পুলিশ সামনে থাকলেও আটকায়নি।
গাবতলী এলাকার ট্রাফিক ফাঁড়ির সার্জেন্ট বেলায়েত হোসেন বলেন, অল্প স্থানের মধ্যে এত পাম্প বিষফোড়ার মতো হয়ে গেছে। রাতে বাস-ট্রাকগুলো জ্বালানি নিতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় আটকাতে গেলে পুলিশের জীবনও বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
দূরপাল্লার পথের বাসগুলো রাতে যাত্রী তোলা শুরু করে কলাবাগান থেকে। এরপর কলেজগেট, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মাজার রোড ও গাবতলী পর্যন্ত যাত্রী ওঠায়। ফলে এসব স্থানে সড়কের প্রায় অর্ধেক আটকে রাখা হয় বাস থামিয়ে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীতে সড়কে বড় গর্ত: গতকাল যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে বাস থেকে মহাসড়কে নেমে এক যাত্রীকে প্রশ্ন করে নিজেই জবাব দিলেন হানিফ পরিবহনের এক যাত্রী নাজিউর রহমান, ‘এবার ঈদের যাত্রা কেমন হবে, এটা দেখেই বোঝা যায়।’
দেখা গেল, কুতুবখালীর ওই সড়কে বড় বড় অন্তত ১০টি গর্ত। সায়েদাবাদ সেতুর কাছে সড়কেও এমন ১২টি গর্ত। এ কারণে গতি ধীর হওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু গর্তে ইটের টুকরা ফেলে দায় সেরেছে সিটি করপোরেশন।
বাসযাত্রী নাজিউর রহমান বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতাম, তখন মনকে বোঝাতাম, একসময় নির্বিঘ্ন যাত্রা হবে, কিন্তু দ্যাখেন তো কী অবস্থা? অন্য কোনো দেশে কোনো ব্যস্ত সড়কে এমন গর্ত থাকে?’
পরিবহন মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানিকনগর থেকে কুতুবখালীর দূরত্ব এক কিলোমিটারের কিছু বেশি। কদিন ধরে এই পথ পাড়ি দিতে একেকটি বাসের এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগছে।
ঢাকা-ফেনী-পরশুরাম পথে চলাচলকারী বাসের কোম্পানি স্টারলাইনের ব্যবস্থাপক নাসির আহমেদ বলেন, গর্তগুলোতে চাকা আটকে একটি বাসের গায়ে আরেকটি বাস লেগে থাকে। ঈদের আগে এসব গর্ত ভালোভাবে সারানো না হলে মানিকনগর থেকে কাঁচপুর যেতেই অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, রাস্তার গর্ত মেরামতের চেষ্টা হচ্ছে।
পরিবহনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকা ছাড়াও আরামবাগ, ফকিরেরপুল ও রাজারবাগ থেকে চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ৭০০-এর মতো বাস ছাড়ে। ঈদ উপলক্ষে বাসের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সড়ক ঠিক না হলে যানজট বাড়বে।
গতকাল সকাল থেকে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী প্রধান সড়কে যানজট। যানজটের বড় একটি কারণ সড়কের ওপর বিশৃঙ্খলভাবে বাস-ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-পূর্ব) মাইনুল হাসান বলেন, ঈদ সামনে রেখে অবৈধ পার্কিং ও সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধে প্রচার অভিযান জোরদার করা হচ্ছে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী থেকে বেশ কিছু বাস যায় মাওয়ার দিকে। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের এসব বাস যাওয়ার পথে যানজটে পড়ছে জুরাইন এলাকায়। সেখানে রেলের লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে যানজট বাড়াচ্ছে।
যত্রতত্র বাস আবদুল্লাহপুরে বিষফোড়া: বেলা তখন ১১টা ৫০ মিনিট। ঢাকা-টঙ্গীর সীমানারেখা টানা আবদুল্লাহপুরসংলগ্ন সেতুর ওপরের পশ্চিম পাশে দাঁড়াল মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া ভৈরবগামী বিআরটিসির একটি বাস। কিছুক্ষণের মধ্যে এর পেছনে দাঁড়াল নরসিংদীগামী পিপিএল সুপার বাস, তার পেছনে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটগামী শ্যামলী বাংলা বাস। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে বাসের সারি। সেতুর ওপর বাসের এই সারির কারণে পথটি সরু হয়ে গতি কমে যায়। পেছনে শুরু হয় জট।
কাছাকাছি সময়ে ওই এলাকার পশ্চিম দিকে আশুলিয়াগামী সড়কেও বাসের দীর্ঘ সারি। যাত্রী বেশি না থাকলেও বাসগুলো পুরো সড়কজুড়ে যত্রতত্রভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী হাঁকতে থাকে। ফলে পুরো সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ওই এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য ও একাধিক বাসচালক বলেন, এখানে যানজটের মূল কারণ যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো। সেতুর পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা ও পূর্ব পাশে ফলমূলসহ বিভিন্ন ধরনের ভাসমান দোকানের কারণেও গাড়ির গতি কমে যানজট হয়। আবদুল্লাহপুরের প্রবেশমুখে কয়েকটি সিএনজি ও তেলের পাম্প স্টেশন থাকায় গাড়ির চাপ পড়ে। পশ্চিম পাশে মাছের বাজার হওয়ায় সকালে রিকশা ও ভ্যানের চাপে যানজট হয়।
এই যানজটের জেরে ঢাকার ভেতর উত্তরা, বিপরীত দিকে টঙ্গী ও আশুলিয়া রোডে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে ঈদে ঘরমুখী মানুষকে যানজটের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে এসব স্থানে। এই পথ দিয়ে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনার মানুষ চলাচল করে। কিশোরগঞ্জগামী কিছু বাসও চলে এই পথে। আশুলিয়া দিয়ে যায় মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া টাঙ্গাইল, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু বাস।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, মূল সেতুতে ওঠার পথের পশ্চিম পাশে টেবিল পেতে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। আবদুল্লাহপুরের ঢাকার দিকের পশ্চিম পাশে উত্তরবঙ্গগামী কয়েকটি বাস কাউন্টার গড়ে উঠেছে। লোকাল বাসগুলোও এখানে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠায়-নামায়।
একটি লোকাল বাসের চালক আহমদ আলী বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যদি ঠিকমতো বাস সরিয়ে দিতে পারত, তাহলে এখানে যানজট হতো না।
জানতে চাইলে ওই এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সাজেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি সড়কের প্রবেশমুখ থাকায় এখানে অসংখ্য বাস ও গাড়ি থাকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টার থাকায় এবং অনেক বাস দাঁড়িয়ে লোক উঠানোয় সমস্যা হয়। তবে তাঁরা এই সমস্যা সমাধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দুই পালায় তিনজন করে পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। তবে ঈদ সামনে রেখে এখানে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণকক্ষ বসানো হয়েছে।
No comments