আমেরিকার গভীর অসুখ by হাসান ফেরদৌস
অন্যের অসুখের দাওয়াই বাতলানোর আগে নিজের অসুখটাই আমেরিকার সারানো দরকার সবার আগে |
এক
বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। আমেরিকা, যে নিজেকে বিশ্বে সবকিছুতে সবার সেরা
ভাবতে ভালোবাসে, দীর্ঘদিন থেকে এক গভীর অসুখে সে ভুগছে। এই অসুখের নাম
বর্ণবাদ। কাগজ-কলমে এ দেশে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়েছে দেড় শ বছর আগে, কিন্তু
তার মনের ভেতর এই অসুখ এখনো জেঁকে বসে। দুই সপ্তাহ আগে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার
চার্লসটনে এক গির্জায় ঢুকে ২১ বছরের ডিলান রুফের ঠান্ডা মাথায় প্রার্থনারত
নয়জন কালো নারী-পুরুষকে হত্যা ছিল সেই অসুখের সর্বশেষ প্রমাণ।
কথাটা ভুল বললাম। হত্যার ঘটনা নয়, সেই অসুখের সর্বশেষ প্রমাণ মিলল তার দুই দিন পর, পুলিশের হাতে ডিলান ধরা পড়ার পর। নর্থ ক্যারোলাইনার শেলবিতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ডিলানকে ফেরত পাঠানো হয় চার্লসটনে। সেখানে জেলে এক রাত কাটানোর আগেই তাকে এক লাখ ডলার জামিন দিয়ে বের করে আনা হয়। টাকাটা আসে সেখানকার মস্ত ধনী ও বর্ণবাদী বলে সুপরিচিত রোনাল্ড উইলকিন্সনের পকেট থেকে। ডিলান যা করেছে ভালো করেছে, সে কথা সগর্বে ঘোষণা করে উইলকিন্সন জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে চার্লসটনের রাস্তা এখন সামান্য হলেও আগের চেয়ে অধিক নিরাপদ।
চার্লসটনের ঘটনার পর থেকে অবশ্য চারদিক থেকে নিন্দা প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দেড় শ বছর আগে দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে আমেরিকায় যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্য ছিল তার আসল ঘাঁটি। আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন কনফেডারেসি গঠন ছিল সে যুদ্ধের লক্ষ্য। যুদ্ধে দাস মালিকদের পরাজয় হলেও সে দাসপ্রথার প্রতীক, তাদের কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ, এই দেড় শ বছর সগর্বে দক্ষিণের রাজ্যসমূহে ঝোলানো হয়েছে। কয়েক বছর আগে সাউথ ক্যারোলাইনার উচ্চ আদালত থেকে সে পতাকা সরানো হয়, কিন্তু আইন পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সে পতাকার স্থান নির্ধারিত হয় সে রাজ্যের আইন পরিষদের মাথায়। যেমন তেমন নয়, ৪০ ফুট লম্বা সে পতাকা, অন্য সব পতাকার ঊর্ধ্বে সগর্বে সে ঝুলেছে। চার্লসটনের ঘটনার পর সে পতাকা সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এই পতাকা হয়তো নামানো হবে, কিন্তু এই প্রতীকের আড়ালে আমেরিকার বর্ণবাদী মানসিকতা যে রাতারাতি বদলে যাবে, তা ভাবা বাতুলতা। সে কথার প্রমাণও মিলেছে হাতেনাতে। বর্ণবাদী কু ক্লাক্স ক্ল্যানের একদল সমর্থক সাউথ ক্যারোলাইনার আইন পরিষদের সামনে বিক্ষোভ করে সে পতাকা নামানোর প্রতিবাদ করেছে। এই আইন পরিষদের সদস্য রিপাবলিকান দলের লি ব্রাইট বলেছেন, কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ নামানোর চেষ্টা স্ট্যালিনের নিগ্রহের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেকোনো মূল্যে এই পতাকা টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাবেন।
বলা বাহুল্য, লি-ই একমাত্র রিপাবলিকান নন, যিনি এই পতাকার পক্ষে। সিনেটর টেড ক্রুজ ও সিনেটর র্যান্ড পল, যাঁরা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁদের দলের মনোনয়ন চাচ্ছেন, তাঁরা দুজনেই এই সেদিন পর্যন্ত কনফেডারেসি ফ্ল্যাগের পক্ষে ছিলেন। বর্ণবাদী বলে পরিচিত একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে তাঁরা মোটা চাঁদা নিয়েছেন। রক্ষণশীল এসব রিপাবলিকানের সমর্থনেই দক্ষিণ ক্যারোলাইনাসহ দক্ষিণের মোট নয়টি অঙ্গরাজ্যে কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ এখনো সরকারি ভবনে সদর্পে উড়ছে।
এই পতাকা শুধু একটি প্রতীক মাত্র। তা নামিয়ে ফেলা হলেও যা আমেরিকায় বদলাবে না, তা হলো এ দেশের বর্ণভিত্তিক শাসনব্যবস্থা। ক্লিনটন আমলে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন রবার্ট রাইস। তিনি সম্প্রতি লিখেছেন, আজকের আমেরিকার যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার কোনো ফারাক নেই। এ দেশে দাসপ্রথার অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এক ভিন্ন দাসপ্রথা চালু হয়েছে এই দেশে। কালোরা এখনো আমেরিকার সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর জনসংখ্যা। সবচেয়ে অনুন্নত, অসুস্থ ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় তাদের বাস। সবচেয়ে দুর্বল স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় এ দেশের কৃষ্ণকায়দের সন্তান। অধিকাংশ কালো ছেলেমেয়ে শুধু সেই সব স্কুলের ছাত্র, যার ৯০ শতাংশেরও অধিক হয় কালো নয়তো অভিবাসী। শহুরে এলাকায়, যেখানে অধিকাংশ কালো মানুষের বাস, তাদের অধিকাংশই মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতায় আক্রান্ত। কালো বলেই তারা অপরাধী বা মাদকাসক্ত নয়। তাদের আসল অপরাধ দারিদ্র্য। যে বিষাক্ত চক্রে এরা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তা থেকে বেরোনোর কোনো উপায় নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড ব্যবস্থার সঙ্গে আমেরিকার আরেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় এ দেশের বিচারব্যবস্থায়। শুধু কালো এই অপরাধে এ দেশের পুলিশ আপনাকে—তা আপনি বিখ্যাত অভিনেতা বা রাজনীতিবিদ যে-ই হোন না কেন—যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে আটকাতে পারে, প্রতিবাদ করলে জেলে ঢোকাতে পারে। এ দেশের অনেক অঙ্গরাজ্যে এই ‘রেশিয়াল প্রোফাইলিং’ এখনো একটি বৈধ আইনি ব্যবস্থা।
এ দেশের বিচারব্যবস্থা কালোদের প্রতি কী রকম বৈষম্যপূর্ণ তা বুঝতে কিছু পরিসংখ্যান নেওয়া যাক। পৃথিবীর ৫ শতাংশ মানুষের বাস আমেরিকায়, অথচ পৃথিবীর কারাবন্দী এমন মানুষের ২৫ শতাংশ আমেরিকায়। আর এই যে ২৫ শতাংশ বা ২২ লাখ বন্দী, তার ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। কী এমন অপরাধে এত মানুষ জেলে? নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অধিকাংশই খুব সামান্য পরিমাণ মাদকদ্রব্য রাখার অভিযোগে জেলে পচে মরছে। এদের হিসাব অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে। অনেক ক্ষেত্রে জামিনের জন্য অর্থ না থাকায়, জেলই কালোদের একমাত্র আশ্রয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়।
কালো মানুষদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টারও কোনো কমতি নেই এ দেশে। এ দেশের আইন পরিষদ প্রতি ১০ বছর অন্তর কে কোন জেলা থেকে ভোট দেবে, নতুন জনগণনার ভিত্তিতে তার হিসাব ঠিক করে দেয়। যেহেতু এ দেশের অধিকাংশ রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে, তারা এমনভাবে ভোটের সীমানা নির্ধারণ করে, যাতে কৃষ্ণকায়দের ভোট নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব না ফেলতে পারে। এর ওপর রয়েছে নানা উপায়ে কালোদের ভোট দিতে যেতে না দেওয়ার পাঁয়তারা। দক্ষিণের অনেক রাজ্যেই আইন হয়েছে—ভোটার পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট দেওয়া যাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কালো মানুষদের সরকারি পরিচয়পত্র নেই। পরিচয়পত্র সংগ্রহে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, তার কোনোটাই তাদের নেই। ফলে এদের অনেকেই ভোট দিতে পারে না। কোনো কোনো রাজ্যে আগাম ভোট দেওয়ার সুযোগ কাটছাঁট করা হয়েছে শুধু কালোরা যাতে সে সুযোগ গ্রহণ না করতে পারে।
এসব চেষ্টার মোদ্দা ফল হয়েছে এই যে অনেক ক্ষেত্রে কালোদের ভোটের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় সামান্য ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রার্থীরা জিতে গেছেন। ব্রেইন সেন্টারের গবেষণা থেকে শুধু একটি উদাহরণ দিই। নর্থ ক্যারোলাইনায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে সে রাজ্যের আইন পরিষদ নতুন আইন পাস করিয়ে নেয়, যার ফলে আগাম ভোটের দিন কমিয়ে দেওয়া হয়, ভোটের দিন ভোট প্রদানের জন্য নথিভুক্তির আইন বাতিল করা হয় এবং নতুন নিয়ম চালু করা হয় যে নিজের থানার বাইরে ভোট দেওয়া চলবে না। এই তিনটি নতুন আইন করা হয় শুধু কালোদের ভোট দিতে অনুৎসাহিত করতে। এর ফলে পূর্ববর্তী নির্বাচনে তুলনায় প্রায় এক লাখ লোক, যার দুই-তৃতীয়াংশই হয় কৃষ্ণকায় বা মহিলা—ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, রিপাবলিকান প্রার্থী তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রার্থীকে প্রায় ৪৮ হাজার ভোটে হারিয়েছেন।
প্রায় ২৪০ বছর আগে আমেরিকা যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবমতে আত্মপ্রকাশ করে, তখন এর শ্বেত সভ্যতার আধিপত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। দাস ব্যবসা নিয়েও কোনো মতভেদ ছিল না। মার্কিন শাসনতন্ত্রেই কালো মানুষদের সাদাদের তুলনায় তিন-পঞ্চমাংশ বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। সেই আইন এখন আর বলবৎ নেই, কিন্তু বাস্তবে এ দেশে সাদা-কালোর তফাত এখনো যোজন পরিমাণ। আইনের চোখে ব্যবধান কমেছে, বাস্তবেও কালোদের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এ দেশের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনো প্রস্তুত নয়। বারাক ওবামার নির্বাচনে শ্বেতকায়দের মধ্যে যে সহিংস প্রতিক্রিয়া হয়, তা থেকেই সে কথার প্রমাণ মেলে।
আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশের মানবাধিকারের অবস্থার ওপর এক সবিস্তার প্রতিবেদন পেশ করে থাকে। এবারও হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সে প্রতিবেদনে স্থান পেলেও তাতে থাকে না খোদ আমেরিকায়। সে ভুল শোধরাতে চীন সরকার যে পাল্টা মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে আমেরিকার এই বর্ণবাদী চেহারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, অন্যদের মানবাধিকার বিষয়ে ওয়াজ-নসিহত করার আগে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যদি আমেরিকা আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখে নেয়। অন্যের অসুখের দাওয়াই বাতলানোর আগে নিজের অসুখটাই আমেরিকার সারানো দরকার সবার আগে।
৩০ জুন ২০১৫, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
কথাটা ভুল বললাম। হত্যার ঘটনা নয়, সেই অসুখের সর্বশেষ প্রমাণ মিলল তার দুই দিন পর, পুলিশের হাতে ডিলান ধরা পড়ার পর। নর্থ ক্যারোলাইনার শেলবিতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ডিলানকে ফেরত পাঠানো হয় চার্লসটনে। সেখানে জেলে এক রাত কাটানোর আগেই তাকে এক লাখ ডলার জামিন দিয়ে বের করে আনা হয়। টাকাটা আসে সেখানকার মস্ত ধনী ও বর্ণবাদী বলে সুপরিচিত রোনাল্ড উইলকিন্সনের পকেট থেকে। ডিলান যা করেছে ভালো করেছে, সে কথা সগর্বে ঘোষণা করে উইলকিন্সন জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে চার্লসটনের রাস্তা এখন সামান্য হলেও আগের চেয়ে অধিক নিরাপদ।
চার্লসটনের ঘটনার পর থেকে অবশ্য চারদিক থেকে নিন্দা প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দেড় শ বছর আগে দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে আমেরিকায় যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্য ছিল তার আসল ঘাঁটি। আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন কনফেডারেসি গঠন ছিল সে যুদ্ধের লক্ষ্য। যুদ্ধে দাস মালিকদের পরাজয় হলেও সে দাসপ্রথার প্রতীক, তাদের কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ, এই দেড় শ বছর সগর্বে দক্ষিণের রাজ্যসমূহে ঝোলানো হয়েছে। কয়েক বছর আগে সাউথ ক্যারোলাইনার উচ্চ আদালত থেকে সে পতাকা সরানো হয়, কিন্তু আইন পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সে পতাকার স্থান নির্ধারিত হয় সে রাজ্যের আইন পরিষদের মাথায়। যেমন তেমন নয়, ৪০ ফুট লম্বা সে পতাকা, অন্য সব পতাকার ঊর্ধ্বে সগর্বে সে ঝুলেছে। চার্লসটনের ঘটনার পর সে পতাকা সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এই পতাকা হয়তো নামানো হবে, কিন্তু এই প্রতীকের আড়ালে আমেরিকার বর্ণবাদী মানসিকতা যে রাতারাতি বদলে যাবে, তা ভাবা বাতুলতা। সে কথার প্রমাণও মিলেছে হাতেনাতে। বর্ণবাদী কু ক্লাক্স ক্ল্যানের একদল সমর্থক সাউথ ক্যারোলাইনার আইন পরিষদের সামনে বিক্ষোভ করে সে পতাকা নামানোর প্রতিবাদ করেছে। এই আইন পরিষদের সদস্য রিপাবলিকান দলের লি ব্রাইট বলেছেন, কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ নামানোর চেষ্টা স্ট্যালিনের নিগ্রহের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেকোনো মূল্যে এই পতাকা টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাবেন।
বলা বাহুল্য, লি-ই একমাত্র রিপাবলিকান নন, যিনি এই পতাকার পক্ষে। সিনেটর টেড ক্রুজ ও সিনেটর র্যান্ড পল, যাঁরা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁদের দলের মনোনয়ন চাচ্ছেন, তাঁরা দুজনেই এই সেদিন পর্যন্ত কনফেডারেসি ফ্ল্যাগের পক্ষে ছিলেন। বর্ণবাদী বলে পরিচিত একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে তাঁরা মোটা চাঁদা নিয়েছেন। রক্ষণশীল এসব রিপাবলিকানের সমর্থনেই দক্ষিণ ক্যারোলাইনাসহ দক্ষিণের মোট নয়টি অঙ্গরাজ্যে কনফেডারেসি ফ্ল্যাগ এখনো সরকারি ভবনে সদর্পে উড়ছে।
এই পতাকা শুধু একটি প্রতীক মাত্র। তা নামিয়ে ফেলা হলেও যা আমেরিকায় বদলাবে না, তা হলো এ দেশের বর্ণভিত্তিক শাসনব্যবস্থা। ক্লিনটন আমলে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন রবার্ট রাইস। তিনি সম্প্রতি লিখেছেন, আজকের আমেরিকার যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার কোনো ফারাক নেই। এ দেশে দাসপ্রথার অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এক ভিন্ন দাসপ্রথা চালু হয়েছে এই দেশে। কালোরা এখনো আমেরিকার সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর জনসংখ্যা। সবচেয়ে অনুন্নত, অসুস্থ ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় তাদের বাস। সবচেয়ে দুর্বল স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় এ দেশের কৃষ্ণকায়দের সন্তান। অধিকাংশ কালো ছেলেমেয়ে শুধু সেই সব স্কুলের ছাত্র, যার ৯০ শতাংশেরও অধিক হয় কালো নয়তো অভিবাসী। শহুরে এলাকায়, যেখানে অধিকাংশ কালো মানুষের বাস, তাদের অধিকাংশই মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতায় আক্রান্ত। কালো বলেই তারা অপরাধী বা মাদকাসক্ত নয়। তাদের আসল অপরাধ দারিদ্র্য। যে বিষাক্ত চক্রে এরা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তা থেকে বেরোনোর কোনো উপায় নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড ব্যবস্থার সঙ্গে আমেরিকার আরেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় এ দেশের বিচারব্যবস্থায়। শুধু কালো এই অপরাধে এ দেশের পুলিশ আপনাকে—তা আপনি বিখ্যাত অভিনেতা বা রাজনীতিবিদ যে-ই হোন না কেন—যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে আটকাতে পারে, প্রতিবাদ করলে জেলে ঢোকাতে পারে। এ দেশের অনেক অঙ্গরাজ্যে এই ‘রেশিয়াল প্রোফাইলিং’ এখনো একটি বৈধ আইনি ব্যবস্থা।
এ দেশের বিচারব্যবস্থা কালোদের প্রতি কী রকম বৈষম্যপূর্ণ তা বুঝতে কিছু পরিসংখ্যান নেওয়া যাক। পৃথিবীর ৫ শতাংশ মানুষের বাস আমেরিকায়, অথচ পৃথিবীর কারাবন্দী এমন মানুষের ২৫ শতাংশ আমেরিকায়। আর এই যে ২৫ শতাংশ বা ২২ লাখ বন্দী, তার ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। কী এমন অপরাধে এত মানুষ জেলে? নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অধিকাংশই খুব সামান্য পরিমাণ মাদকদ্রব্য রাখার অভিযোগে জেলে পচে মরছে। এদের হিসাব অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে। অনেক ক্ষেত্রে জামিনের জন্য অর্থ না থাকায়, জেলই কালোদের একমাত্র আশ্রয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়।
কালো মানুষদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টারও কোনো কমতি নেই এ দেশে। এ দেশের আইন পরিষদ প্রতি ১০ বছর অন্তর কে কোন জেলা থেকে ভোট দেবে, নতুন জনগণনার ভিত্তিতে তার হিসাব ঠিক করে দেয়। যেহেতু এ দেশের অধিকাংশ রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে, তারা এমনভাবে ভোটের সীমানা নির্ধারণ করে, যাতে কৃষ্ণকায়দের ভোট নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব না ফেলতে পারে। এর ওপর রয়েছে নানা উপায়ে কালোদের ভোট দিতে যেতে না দেওয়ার পাঁয়তারা। দক্ষিণের অনেক রাজ্যেই আইন হয়েছে—ভোটার পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট দেওয়া যাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কালো মানুষদের সরকারি পরিচয়পত্র নেই। পরিচয়পত্র সংগ্রহে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, তার কোনোটাই তাদের নেই। ফলে এদের অনেকেই ভোট দিতে পারে না। কোনো কোনো রাজ্যে আগাম ভোট দেওয়ার সুযোগ কাটছাঁট করা হয়েছে শুধু কালোরা যাতে সে সুযোগ গ্রহণ না করতে পারে।
এসব চেষ্টার মোদ্দা ফল হয়েছে এই যে অনেক ক্ষেত্রে কালোদের ভোটের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় সামান্য ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রার্থীরা জিতে গেছেন। ব্রেইন সেন্টারের গবেষণা থেকে শুধু একটি উদাহরণ দিই। নর্থ ক্যারোলাইনায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে সে রাজ্যের আইন পরিষদ নতুন আইন পাস করিয়ে নেয়, যার ফলে আগাম ভোটের দিন কমিয়ে দেওয়া হয়, ভোটের দিন ভোট প্রদানের জন্য নথিভুক্তির আইন বাতিল করা হয় এবং নতুন নিয়ম চালু করা হয় যে নিজের থানার বাইরে ভোট দেওয়া চলবে না। এই তিনটি নতুন আইন করা হয় শুধু কালোদের ভোট দিতে অনুৎসাহিত করতে। এর ফলে পূর্ববর্তী নির্বাচনে তুলনায় প্রায় এক লাখ লোক, যার দুই-তৃতীয়াংশই হয় কৃষ্ণকায় বা মহিলা—ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, রিপাবলিকান প্রার্থী তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রার্থীকে প্রায় ৪৮ হাজার ভোটে হারিয়েছেন।
প্রায় ২৪০ বছর আগে আমেরিকা যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবমতে আত্মপ্রকাশ করে, তখন এর শ্বেত সভ্যতার আধিপত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। দাস ব্যবসা নিয়েও কোনো মতভেদ ছিল না। মার্কিন শাসনতন্ত্রেই কালো মানুষদের সাদাদের তুলনায় তিন-পঞ্চমাংশ বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। সেই আইন এখন আর বলবৎ নেই, কিন্তু বাস্তবে এ দেশে সাদা-কালোর তফাত এখনো যোজন পরিমাণ। আইনের চোখে ব্যবধান কমেছে, বাস্তবেও কালোদের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এ দেশের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনো প্রস্তুত নয়। বারাক ওবামার নির্বাচনে শ্বেতকায়দের মধ্যে যে সহিংস প্রতিক্রিয়া হয়, তা থেকেই সে কথার প্রমাণ মেলে।
আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশের মানবাধিকারের অবস্থার ওপর এক সবিস্তার প্রতিবেদন পেশ করে থাকে। এবারও হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সে প্রতিবেদনে স্থান পেলেও তাতে থাকে না খোদ আমেরিকায়। সে ভুল শোধরাতে চীন সরকার যে পাল্টা মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে আমেরিকার এই বর্ণবাদী চেহারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, অন্যদের মানবাধিকার বিষয়ে ওয়াজ-নসিহত করার আগে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যদি আমেরিকা আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখে নেয়। অন্যের অসুখের দাওয়াই বাতলানোর আগে নিজের অসুখটাই আমেরিকার সারানো দরকার সবার আগে।
৩০ জুন ২০১৫, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments