অভিবাসন ও প্রত্যাশা পূরণ by আতাউর রহমান
গল্প আছে, আমাদের দেশের এক প্রাইমারি পর্যায়ের ছাত্র ওর শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পদ্মলোচন’ শব্দের অর্থটা কী? পদ্মের মতো লোচন অর্থাৎ চক্ষু যার, তাকেই বলা হয় পদ্মলোচন। এটা ‘মহাপণ্ডিত’ শিক্ষকের জানা ছিল না। আর কাকতালীয়ভাবে ছেলেটির পিতার নাম ছিল লোচন। অতএব তিনি বললেন, ‘পদ্মলোচন বুঝলি না? পদ্ম তো পদ্ম ফুল; আর লোচন তো লোচন, তোর বাপের নাম।’ অনুরূপভাবে আরেক ‘মহাপণ্ডিত’ প্রাইমারি শিক্ষক, তাঁর ছাত্রদের ‘কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’ বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আশি আর বিশ, মোট এক শটা দংশন করলে তুমি বিষের কী যন্ত্রণা, তা বুঝতে পারবে।’ স্পষ্টতই ‘আশী’ ও ‘আশি’ শব্দের পার্থক্য তাঁর জানা ছিল না এবং আশীতে অর্থাৎ দাঁতে বিষ আছে যার সে হচ্ছে আশীবিষ তথা সাপ, এটাও তাঁর জানা ছিল না। সৌভাগ্যবশত এ দেশে এরূপ ‘মহাপণ্ডিত’ প্রাইমারি শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য হবে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলেকে নাকি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘অভিবাসন’ শব্দের অর্থ কী? প্রত্যুত্তরে ছেলেটি বলে, ‘অভি আর ওর বন্ধু বাসন, দুজনে মিলে হয়েছে অভি-বাসন; এর মধ্যে আবার অর্থ খোঁজাখুঁজির কী আছে?’ ছেলেটির বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়!
সে যাহোক, অভিবাসন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ইমিগ্রেশন’ এবং এখানেও বেশ গোলমেলে ব্যাপার আছে—নিজ দেশ ছেড়ে যখন কেউ পরদেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে যায়, তখন তাকে ইংরেজিতে বলে ‘এমিগ্র্যান্ট’ আর ওখানে গিয়ে সে হয়ে যায় ‘ইমিগ্র্যান্ট’ এবং বাংলা ভাষায় ‘অভিবাসী’ ও ‘শরণার্থী’ প্রায় সমার্থক হলেও সব শরণার্থীই অভিবাসনপ্রত্যাশী, কিন্তু সব অভিবাসীই শরণার্থী নয়। এসব ব্যাপার একটু চিন্তাভাবনার বিষয় বটে।
অন্তর্জাল অনুসারে অভিবাসন হচ্ছে সেই সমস্ত লোকের ‘মুভমেন্ট’ তথা চলাচল, যাঁরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাসের জন্য, বিশেষত স্থায়ী নিবাস অথবা অস্থায়ী ভিত্তিতে পরিযায়ী কর্মচারী হিসেবে কাজ করার জন্য গমন করে থাকেন। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের গণনা অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ২৫ কোটি লোক অর্থাৎ পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার প্রায় ৪ চার ভাগ হচ্ছে অভিবাসী। আর অভিবাসন-প্রক্রিয়াটা বোধ করি সেই আদিকাল থেকেই চলছে; নইলে কলম্বাস ১৪৯২ সালে যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন, তখন তিনি সেথায় মনুষ্য-বসতি পেতেন না। ধারণা করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে বেরিং প্রণালি, যেটা আমেরিকা ও রাশিয়াকে বিযুক্ত করেছে, তা একসময় বেরিং যোজক তথা জলভাগের পরিবর্তে স্থলভাগ ছিল এবং ওটার মধ্য দিয়েই আদমের সন্তানেরা এশিয়া থেকে আমেরিকায় মাইগ্রেট করে থাকবেন।
আর আমেরিকানদের তো বলাই হয় ‘আ নেশন অব ইমিগ্র্যান্টস’ তথা অভিবাসীদের জাতি; কেননা ওখানে সবাই ইমিগ্র্যান্টস ও তাদের বংশধর—কেউ আগে ওখানে পৌঁছেছেন আর কেউ পরে, তফাত শুধু এটুকুই। আমার বেশ কিছু আত্মীয় সাম্প্রতিক কালে ইমিগ্র্যান্টস হিসেবে দারা-পুত্র-পরিবারসহ সে দেশে গেছেন। গিয়ে তাঁরা অনেকেই লিঙ্গ-সমতার সে দেশে যে বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নের এই গল্পটি স্মর্তব্য:
তিনি নরকের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে যখন এসেছিলাম, তখন তো এখানকার অবস্থা এরূপ ছিল বলে নজরে আসেনি’
একটি অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি দম্পতি বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমেরিকায় বসবাস করছিলেন। তাঁদের একটাই স্বপ্ন—আমেরিকান সিটিজেন হওয়া। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও দেশেও আছে; অতএব ওদের ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে যেতে হচ্ছিল। অতঃপর একদিন স্বামীপ্রবর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সুসংবাদটি নিয়ে দৌড়ে পাকঘরে গিয়ে সেখানে কর্মরত স্ত্রীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘শাহানা, শাহানা! অবশেষে আমরা আমেরিকান হলাম।’
‘বেশ’, প্রত্যুত্তরে স্ত্রী তাঁর গা থেকে কাজের অ্যাপ্রোন খুলে স্বামীর গায়ে চড়াতে চড়াতে বললেন, ‘তাহলে এখন তুমি ডিশগুলো ধুয়ে দাও।’
তদুপরি দূর থেকে দেশটির প্রাচুর্যের কথা শুনে কিংবা পর্যটক হিসেবে বেড়াতে গিয়ে বাইরের চাকচিক্য দেখে বিমোহিত হলেও ইমিগ্রেশন-উত্তর রূঢ় বাস্তবতা কিন্তু প্রায়ই ভিন্ন হয়ে থাকে। আর এ সম্পর্কেও একটি মজার গল্প আছে:
একজন বৃদ্ধ ভালো মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটল। কিন্তু সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি একঘেয়েমিজনিত বিরক্তি বোধ করতে লাগলেন এবং নরক পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাঁর ইচ্ছা পূরণ করা হলো। সেখানে তাঁর ইচ্ছানুরূপ খাওয়াদাওয়া, সেবাযত্ন ও খাতির-তোয়াজ ইত্যাদি পাওয়ায় তিনি সন্তুষ্টচিত্তে স্বর্গে ফিরে এলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না-যেতেই তিনি স্বর্গের পরিবর্তে নরকে স্থানান্তরিত হতে চাইলেন। তাঁকে বারবার নিবৃত্ত করার চেষ্টা বিফলে গেল; তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। অবশেষে তাঁর অনুরোধ গৃহীত হলো এক শর্তে যে ওখানে যাওয়ার পর পরবর্তীকালে তিনি চাইলেও তাঁকে আর স্বর্গে নিয়ে আসা হবে না।
এবারে নরকে পৌঁছার অব্যবহিত পরেই তাঁর মোহমুক্তি ঘটল। তিনি দেখতে পেলেন, ওখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অহরহ ঘটছে, যে যাকে পারছে হত্যা করছে; চতুর্দিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান। তিনি নরকের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে যখন এসেছিলাম, তখন তো এখানকার অবস্থা এরূপ ছিল বলে নজরে আসেনি।’
উত্তর এল, ‘তখন তো আপনি এসেছিলেন টুরিস্ট ভিসায়, আর এখন এসেছেন ইমিগ্র্যান্ট ভিসায়।’
বিদগ্ধ পাঠককে গল্পটির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না। আর রসগল্প তো গল্পই; এর মধ্যে ছিদ্রান্বেষণের চেষ্টা করাটাও নেহাত বাতুলতা।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলেকে নাকি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘অভিবাসন’ শব্দের অর্থ কী? প্রত্যুত্তরে ছেলেটি বলে, ‘অভি আর ওর বন্ধু বাসন, দুজনে মিলে হয়েছে অভি-বাসন; এর মধ্যে আবার অর্থ খোঁজাখুঁজির কী আছে?’ ছেলেটির বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়!
সে যাহোক, অভিবাসন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ইমিগ্রেশন’ এবং এখানেও বেশ গোলমেলে ব্যাপার আছে—নিজ দেশ ছেড়ে যখন কেউ পরদেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে যায়, তখন তাকে ইংরেজিতে বলে ‘এমিগ্র্যান্ট’ আর ওখানে গিয়ে সে হয়ে যায় ‘ইমিগ্র্যান্ট’ এবং বাংলা ভাষায় ‘অভিবাসী’ ও ‘শরণার্থী’ প্রায় সমার্থক হলেও সব শরণার্থীই অভিবাসনপ্রত্যাশী, কিন্তু সব অভিবাসীই শরণার্থী নয়। এসব ব্যাপার একটু চিন্তাভাবনার বিষয় বটে।
অন্তর্জাল অনুসারে অভিবাসন হচ্ছে সেই সমস্ত লোকের ‘মুভমেন্ট’ তথা চলাচল, যাঁরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাসের জন্য, বিশেষত স্থায়ী নিবাস অথবা অস্থায়ী ভিত্তিতে পরিযায়ী কর্মচারী হিসেবে কাজ করার জন্য গমন করে থাকেন। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের গণনা অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ২৫ কোটি লোক অর্থাৎ পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার প্রায় ৪ চার ভাগ হচ্ছে অভিবাসী। আর অভিবাসন-প্রক্রিয়াটা বোধ করি সেই আদিকাল থেকেই চলছে; নইলে কলম্বাস ১৪৯২ সালে যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন, তখন তিনি সেথায় মনুষ্য-বসতি পেতেন না। ধারণা করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে বেরিং প্রণালি, যেটা আমেরিকা ও রাশিয়াকে বিযুক্ত করেছে, তা একসময় বেরিং যোজক তথা জলভাগের পরিবর্তে স্থলভাগ ছিল এবং ওটার মধ্য দিয়েই আদমের সন্তানেরা এশিয়া থেকে আমেরিকায় মাইগ্রেট করে থাকবেন।
আর আমেরিকানদের তো বলাই হয় ‘আ নেশন অব ইমিগ্র্যান্টস’ তথা অভিবাসীদের জাতি; কেননা ওখানে সবাই ইমিগ্র্যান্টস ও তাদের বংশধর—কেউ আগে ওখানে পৌঁছেছেন আর কেউ পরে, তফাত শুধু এটুকুই। আমার বেশ কিছু আত্মীয় সাম্প্রতিক কালে ইমিগ্র্যান্টস হিসেবে দারা-পুত্র-পরিবারসহ সে দেশে গেছেন। গিয়ে তাঁরা অনেকেই লিঙ্গ-সমতার সে দেশে যে বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নের এই গল্পটি স্মর্তব্য:
তিনি নরকের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে যখন এসেছিলাম, তখন তো এখানকার অবস্থা এরূপ ছিল বলে নজরে আসেনি’
একটি অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি দম্পতি বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমেরিকায় বসবাস করছিলেন। তাঁদের একটাই স্বপ্ন—আমেরিকান সিটিজেন হওয়া। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও দেশেও আছে; অতএব ওদের ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে যেতে হচ্ছিল। অতঃপর একদিন স্বামীপ্রবর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সুসংবাদটি নিয়ে দৌড়ে পাকঘরে গিয়ে সেখানে কর্মরত স্ত্রীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘শাহানা, শাহানা! অবশেষে আমরা আমেরিকান হলাম।’
‘বেশ’, প্রত্যুত্তরে স্ত্রী তাঁর গা থেকে কাজের অ্যাপ্রোন খুলে স্বামীর গায়ে চড়াতে চড়াতে বললেন, ‘তাহলে এখন তুমি ডিশগুলো ধুয়ে দাও।’
তদুপরি দূর থেকে দেশটির প্রাচুর্যের কথা শুনে কিংবা পর্যটক হিসেবে বেড়াতে গিয়ে বাইরের চাকচিক্য দেখে বিমোহিত হলেও ইমিগ্রেশন-উত্তর রূঢ় বাস্তবতা কিন্তু প্রায়ই ভিন্ন হয়ে থাকে। আর এ সম্পর্কেও একটি মজার গল্প আছে:
একজন বৃদ্ধ ভালো মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটল। কিন্তু সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি একঘেয়েমিজনিত বিরক্তি বোধ করতে লাগলেন এবং নরক পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাঁর ইচ্ছা পূরণ করা হলো। সেখানে তাঁর ইচ্ছানুরূপ খাওয়াদাওয়া, সেবাযত্ন ও খাতির-তোয়াজ ইত্যাদি পাওয়ায় তিনি সন্তুষ্টচিত্তে স্বর্গে ফিরে এলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না-যেতেই তিনি স্বর্গের পরিবর্তে নরকে স্থানান্তরিত হতে চাইলেন। তাঁকে বারবার নিবৃত্ত করার চেষ্টা বিফলে গেল; তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। অবশেষে তাঁর অনুরোধ গৃহীত হলো এক শর্তে যে ওখানে যাওয়ার পর পরবর্তীকালে তিনি চাইলেও তাঁকে আর স্বর্গে নিয়ে আসা হবে না।
এবারে নরকে পৌঁছার অব্যবহিত পরেই তাঁর মোহমুক্তি ঘটল। তিনি দেখতে পেলেন, ওখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অহরহ ঘটছে, যে যাকে পারছে হত্যা করছে; চতুর্দিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান। তিনি নরকের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে যখন এসেছিলাম, তখন তো এখানকার অবস্থা এরূপ ছিল বলে নজরে আসেনি।’
উত্তর এল, ‘তখন তো আপনি এসেছিলেন টুরিস্ট ভিসায়, আর এখন এসেছেন ইমিগ্র্যান্ট ভিসায়।’
বিদগ্ধ পাঠককে গল্পটির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না। আর রসগল্প তো গল্পই; এর মধ্যে ছিদ্রান্বেষণের চেষ্টা করাটাও নেহাত বাতুলতা।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷
No comments