নাজিবের বিদায় ছাড়া কোনো পথ নেই -‘ডিপ্লোম্যাট’কে বিশেষ সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ
মাহাথির
মোহাম্মদ। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন
চিকিৎসক হিসেবে। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২২ বছর (১৯৮১-২০০৩)
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই দেশটির সবচেয়ে বেশি সময় ওই
দায়িত্বে ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল
ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (আমনো) সভাপতিও ছিলেন।
সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে মালয়েশিয়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার আমল এবং বর্তমান সময়ের তুলনা করেছেন। তার আমলে নির্মিত মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় সাক্ষাৎকারটি ডিপ্লোম্যাটের পক্ষ থেকে নিয়েছেন জয়েস লি। ৭ অক্টোবর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। নয়া দিগন্তের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাসান শরীফ
প্রশ্ন : আমি শুরু করতে চাই আপনার প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ সময়ে আলোচিত মালয়েশিয়ার জাতিগত উত্তেজনা (রেসিক্যাল টেনশন) নিয়ে। ১৯৭০-এর দশকে আপনি জাতিসঙ্ঘে এক বক্তৃতায় মালয়েশিয়াকে ‘ঔপনিবেশিক সময় থেকে বহুজাতিক টাইম বোমা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আপনার মেয়াদ শেষকালে আপনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, জাতিগত উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। জাতিগত উত্তেজনার ব্যাপারে আপনার নীতি কী ছিল? বর্তমানে এর প্রভাব কী?
মাহাথির : মালয়েশিয়া মিশ্র জনসংখ্যার দেশ। এই দেশে যারা বাস করে, তারা একে অন্যের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন। জাতিগতভাবে ভিন্ন। সংস্কৃতি, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও ভিন্ন। পার্থক্য খুবই বড়। সাধারণত পার্থক্যের কারণে লোকজন একে অন্যের সাথে লড়াই করে, একে অন্যকে অপছন্দ করে, একে অন্যের বিরুদ্ধে এটাকে ব্যবহার করে। ফলে মালয়েশিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে জাতিগত যুদ্ধের আশঙ্কা খুবই সাধারণ ব্যাপার।
আমি যেটা মনে করি তা হলো, আমার ২২ বছরের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে জাতিগত সঙ্ঘাত এত মারাত্মক ছিল না, যা সংঘর্ষের পর্যায়ে উপনীত হয়। তখন কোনো সংঘর্ষ ছিল না। সব সম্প্রদায় আমাকে পছন্দ করত। আর এ কারণেই আমি নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতাম। এখনো জাতিগত উত্তেজনা রয়েছে। তবে আমি মনে করি, আমার প্রধানমন্ত্রিত্বের ২২ বছর সময়কালের চেয়ে তা কম।
তবে অন্যরা এ সমস্যাটি ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না। তারা মনে করে, উদার হয়ে তারা সব জাতিগোষ্ঠীকে খুশি করতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। আপনি উদার হলে চরমপন্থীরা সুযোগ নেবে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর চরমপন্থীরা জাতিগত ইস্যুকে সামনে আনার জন্য উদারবাদের সুযোগ গ্রহণ করেছে। কারণ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কারণে এখন আপনি আলোচনা করতে পারেন, আপনার পছন্দের কথা বলতে পারেন। ফলে তারা লোকজনকে তাদের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন করতে পারে, তারা এসব চরমপন্থী লোকদের পেছনে শামিল হতে শুরু করে। এ কারণেই আবারো জাতিগত উত্তেজনা সামনে এসে পড়েছে।
প্রশ্ন : জাতিগত উত্তেজনা প্রশমন যদি আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন হয়ে থাকে, তবে আপনার সবচেয়ে বড় অতৃপ্তি কী?
মাহাথির : এখন আমার অন্যতম অতৃপ্তি হলো প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে না পারা। আমি চেয়েছিলাম প্রত্যেকের জন্য সমান মর্যাদা সৃষ্টি করতে। অবশ্যই ধনী চীনা, ধনী ভারতীয়, ধনী মালয় থাকার পাশাপাশি গরিব চীনা, গরিব ভারতীয়, গরিব মালয় থাকবে। ফলে এমন কোনো ভাবাবেগ থাকবে না যে, মালয়রা গরিব আর পশ্চাৎপদ অথচ চীনারা ধনী ও উন্নত, তারা থাকে নগরীগুলোতে। এটা আসলেই একটা খারাপ পরিস্থিতি, এটা সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে। আমাদের উচিত হবে সবাইকে নগরীতে আনা, সুশিক্ষিত করা, আরো ভালো অবস্থায় নিয়ে আসা। তা ছাড়া মালয়রা ব্যবসায় বেশ দুর্বল হওয়ায় তাদেরকে বেশি সুযোগ দিতে হবে। নিতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপ।
প্রশ্ন : মালয়রা অলস বলে গত বছর আপনি যে মন্তব্য করেছিলেন, এটা কি তার সাথে সম্পর্কিত?
মাহাথির : এটা কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ২০০৯ সালে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায় ইংরেজি ভাষা বন্ধ করে দেয়ার বর্তমান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে।
আমি সত্য কথা বলেছিলাম। মালয়রা আসলেই অলস। আমরা তাদের সুযোগ দিয়েছিলাম। তারা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। তবে শিক্ষার ব্যাপারে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমি বিজ্ঞান আর গণিত শেখার জন্য ইংরেজি ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। বর্তমান প্রশাসন সেটা থেকে সরে এসেছে। তারা বিজ্ঞান আর ইংরেজি মালয় ভাষায় শেখাতে চায়। অথচ মালয় বিজ্ঞানের ভাষা নয়। অন্যান্য বিষয় স্থির, কিন্তু বিজ্ঞান গতিশীল।
প্রশ্ন : অর্থাৎ এতে মনে হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতিগত সম্পর্ক পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা আপনার অন্যতম কৃতিত্ব, ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াকে পুরোপুরি শিল্পোন্নত করার জন্য নীতিনির্ধারক ‘ভিশন ২০২০’-কে কি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে?
মাহাথির : আমার সময়ে বেশির ভাগ সময় দেশ এগিয়ে চলেছিল। পশ্চাৎযাত্রাও ছিল। কিন্তু অনুপযুক্ত নেতৃত্বের কারণে এখন দেশ স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণ, এখনকার ফোকাস আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা। প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীই টিকে থাকতে চান। তারা মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়ার বদলে অন্যান্য ইস্যু কাজে লাগিয়ে টিকে থাকতে পারবেন। এ কারণে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। সেই সাথে যদি জাতিগত উত্তেজনা, মন্দ প্রশাসন, দুর্নীতি ইত্যাদি থাকে; তবে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ফলে পুরোপুরি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ভিশন ২০২০ আমরা অর্জন করতে পারব না। আমরা কোনোভাবেই তা পারব না। আপনি দেখছেন, মুদ্রার মান পড়ে গেছে, স্টক মার্কেটের অবস্থা খারাপ, লোকজন সাধারণভাবে অখুশি।
প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিদায় দেখার ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে আপনি রাখঢাক করেননি। গত আগস্টে আপনার ব্লগে লিখেছিলেন, গণতন্ত্র মরে গেছে। এতে গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভা পরিবর্তন, মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ উন্নয়ন ব্যাংক (এটা সাধারণভাবে ১এমডিবি নামে পরিচিত) থেকে বিপুল অর্থ খোয়া যাওয়া তথা তহবিল তসফপের বিষয়টি তদন্ত করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের ঢিলেমি, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সদস্য মনোনয়ন নেয়ার মতো বিষয়ে বিশ্লেষণ ছিল। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর আপনি প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করে বারসি ৪.০ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। গণতন্ত্র মারা গেছে, আপনার এই মন্তব্যের আলোকে বিক্ষোভে শামিল হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
মাহাথির : হ্যাঁ, এটাই ছিল শেষ পথ। আমার মনে হয়েছে, আমার মতটি প্রকাশ করা দরকার। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের ব্যাপারে আমি বারসির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। তাই আমি গিয়েছিলাম। এটা কোনো জাতিগত ব্যাপার ছিল না। বারসির সদস্যরা সব সম্প্রদায় থেকে এসেছে। এটা মালয় সরকারের বিরুদ্ধে চীনা বিক্ষোভ ছিল না। এটা কোনোভাবেই জাতিগত বিষয় নয়। তারা যা দাবি করেছিল, আমি সে ব্যাপারে আমার সমর্থন প্রকাশ করেছি।
প্রশ্ন : এর মধ্যে বারসির অন্যান্য দাবি; যেমনÑ নির্বাচন সংস্কার, বিক্ষোভের অধিকার, আরো স্বচ্ছতা ইত্যাদিও কি অন্তর্ভুক্ত ছিল?
মাহাথির : আমি এসবের বিরুদ্ধে নই। আমার সময়কালে কোনো বিক্ষোভ ছিল না। তখন কোনো বারসি ছিল না। লোকজন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে খুশি ছিল। তারা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক করেনি। আমার সরে যাওয়ার পরই কেবল বারসির সমর্থকেরা বিক্ষোভ করছে, এসব দাবি তুলছে। আমার পদত্যাগ করার পর এসব কিছু ঘটছে। আমার আমলে জনগণ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ তোলেনি। সব সময় অভিযোগ জানায়, এমন বহিরাগত লোক থাকতে পারে। তবে এ ধরনের ব্যাপক বিক্ষোভ তখন ছিলই না।
প্রশ্ন : বারসি ৪.০-এর পর পাল্টা সমাবেশের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী, যেটা সেপ্টেম্বরে ‘রেড-শার্ট র্যালি’ নামে পরিচিত?
মাহাথির : সেটা সরকার আয়োজন করেছিল। সেটা বারসি বিক্ষোভকে জাতিগত তথা মালয়দের বিরুদ্ধে চীনা বিক্ষোভ হিসেবে তুলে ধরেছে, যা আদৌ তা নয়। তারা এমনটি করেছে ব্যাংক থেকে খোয়া যাওয়া অর্থ নিয়ে বারসি যে অভিযোগ করেছে, তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। তারা জাতিগত উত্তেজনাকে ইস্যুতে পরিণত করেছে। এটা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু সরকার নিজের প্রতি সমর্থন দেখাতে লোকজনকে সমবেত করতে চাচ্ছে।
প্রশ্ন : মুডিতে মালয়েশিয়ার ক্রেডিট রেটিং এখনো এ৩। কিন্তু আপনি উল্লেখ করেছেন, রিঙ্গিতের মান দ্রুত পড়ে যাচ্ছে, ঋণের পরিমাণ অত্যন্ত উচ্চ। আর ১এমডিবি কেলেঙ্কারি দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। আপনি কি ক্রেডিট রেটিংয়ে বড় ধরনের পতন আশঙ্কা করছেন?
মাহাথির : হতে পারে। যেভাবে চলছে, তেমনটি ঘটতেই পারে। কারণ, এখন ঋণ শোধ করতে বিশেষ করে মার্কিন ডলারে আরো বেশি রিঙ্গিত দিতে হবে। আবার বেশি রিঙ্গিত পেতে হলে অর্থনীতিকে আরো ভালো করতে হবে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। আমরা দ্রুত এগোতে পারছি না। আমরা আরো ধনী হচ্ছি না। আমরা আসলে আরো গরিব হচ্ছি।
প্রশ্ন : মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করতে হলে কী করতে হবে?
মাহাথির : এই মুহূর্তে আমি মনে করি, নাজিব প্রধানমন্ত্রী না থাকলে আস্থা ফিরে আসবে।
প্রশ্ন : এটা কি এতই সহজ হবে? তিনি যদি পদত্যাগ করেন, তবে আইনি জটিলতার সুরাহা কিভাবে হবে? আর ভবিষ্যতে এ ধরনের কেলেঙ্কারি যাতে না ঘটে, সেটা কিভাবে করা যেতে পারে?
মাহাথির : সব কিছুই করা সম্ভব হবে যদি নাজিব প্রধানমন্ত্রী না থাকেন।
প্রশ্ন : এ ধরনের ফলাফল হবে বলে কি আপনি মনে করেন, নাকি মনে করেন হবে না?
মাহাথির : আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আর কোনো গণবিক্ষোভ হওয়ার অশঙ্কা নেই। অনাস্থা ভোটের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। তবে এর সবটাই নির্ভর করে পার্লামেন্ট সদস্যরা তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন কি না তার ওপর। পার্লামেন্ট সদস্যরা কোনো না কোনো কারণে এবং কোনো না কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দায়বদ্ধ, অনুগত। ফলে তারা তা করতে পারছেন না।
প্রশ্ন : এর পর জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা আছে?
মাহাথির : পরবর্তী নির্বাচন। পরবর্তী নির্বাচন হতে তিন বছর বাকি আছে। কিন্তু তখনো যে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, জনগণের মন বদলানোর জন্য টাকাকড়ি অনেক পথ পাড়ি দেবে। আর প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের হাতে টাকা নেই, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তিনি নিজেও তেমনটি স্বীকার করেছেন।
প্রতিটি নাগরিক চায়, তার দেশ সমৃদ্ধ হোক, যাতে সে নিজে তার জীবনকে উপভোগ করতে পারে। কেউ কেউ কিছু করতে সক্ষম হয়, অন্যরা কিছুই করতে পারে না। তবে আমি নিজে কিছু করার মতো অবস্থায় ছিলাম। আর সে কারণে আমি বিখ্যাত হয়েছি। তারপর থেকে আমি যা বলি সেগুলোর অনেক কিছু লোকজন গ্রহণ করে বলে মনে হয়। এ জন্যই বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের চেয়ে আমার বেশি কিছু করার সুযোগ রয়েছে। আমি সাধারণ নাগরিক, তবে কিছু করার জন্য আমার কাছে সুযোগ অনেক বেশি আছে।
প্রশ্ন : কেমন ধরনের নেতৃত্ব আপনি দেখতে চান?
মাহাথির : নেতাকে অবশ্যই তার দেশ নিয়ে ভাবতে হবে, নিজেকে নিয়ে নয়। একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আপনাকে আপনার অবস্থান ধরে রাখতে হবে, তবে সেটা এ জন্য যে- আপনি দেশের জন্য যাতে ভালো কিছু করতে সক্ষম হন।
প্রশ্ন : পরবর্তী নেতা হিসেবে কারো কথা কি আপনার মনে রয়েছে?
মাহাথির : হ্যাঁ, আমি সাধারণভাবে মনে করি, তিনি হতে পারেন আমনোর সাবেক সহসভাপতি। তবে এখন অবশ্যই বিষয়টি খুবই উন্মুক্ত।
প্রশ্ন : আর তাই বিশেষ কারো নাম বলবেন না?
মাহাথির : হয়তো সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী।
প্রশ্ন : আপনি যদি ১৯৮৬ সালে আপনার লেখা দি চ্যালেঞ্জ মালয়েশিয়ার বর্তমান সমস্যাবলি সমাধানের জন্য নতুন করে প্রকাশ করতে চান, তবে তাতে কী বলা হবে?
মাহাথির : আমি সব সময়ই ভাবি, নেতৃত্বের প্রধান কাজই হবে নেতার দায়িত্ব পালন করা। তবে আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, কেবল নেতা হওয়াই যথেষ্ট নয়। নেতার দায়িত্ব হবে নিজের দিকে নয়, দেশের দিকে নজর দেয়া। এখন আমি দেখছি, যে কেউই নেতা হতে পারে না। এমন কাউকে দরকার, যিনি দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ার অবস্থান নিয়ে কিছু জানতে চাচ্ছি। বিশেষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) এবং চীনা সমর্থিত রিজিওনাল কমপ্রেহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ নিয়ে। এসব ব্যাপারে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মালয়েশিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকা নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনা কী?
মাহাথির : আমার সময়ে পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা ছিল সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা। আমরা সাউথ সাউথ সংস্থা সূচনা করি। মার্কিন নীতির কারণে আমি সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমালোচনামুখর ছিলাম। প্রতিটি দেশের ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। তারা এলেই সমস্যা হবে। আপনি মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য স্থানের দিকে দেখুন। তারা মালয়েশিয়ায়ও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
এখন তারা টিপিপি প্রস্তাব করেছে। টিপিপি হলো তাদের একটা হাতিয়ার, তাদের মঙ্গলের জন্যই এর উদ্ভাবন। তারা সব জায়গায় উন্মুক্ত বাজার চায়, যাতে তারা প্রবেশ করতে পারে। এর বিপরীত কথাটা হলো, ‘তুমি আমাদের দেশে আসতে পারো,’ তবে তোমাদের দেশে যাওয়ার মতো শক্তি আমাদের নেই। সেখানে বিক্রির মতো পণ্য আমাদের নেই, অথচ তাদের হাতে সব কিছুই আছে। তাদের আছে মূলধন, তাদের আছে জানাশোনা, তারা এখানকার ছোট-বড় কোম্পানি কিনে নিতে পারে। আর এসবের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তারা সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। এর অর্থ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও।
প্রশ্ন : অনেকে মনে করেন, নাজিবের প্রশাসন টিপিপি অনুমোদন করবে। আপনি কি এর সাথে একমত?
মাহাথির : তিনি এর লাভ-ক্ষতি ভালোভাবে খতিয়ে দেখেননি। তিনি তা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ক হতো বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব এবং আমেরিকার আদর্শ অনুসারে কাজ করতে আগ্রহী।
প্রশ্ন : চীনা প্রসঙ্গে আমি মনে করি, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে আপনার দেয়া ইস্ট এশিয়ান ইকনোমিক ককাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা স্নায়ুযুদ্ধকালের সাউথইস্ট এশিয়া এবং নর্থইস্ট এশিয়ার ধারণা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ইস্ট এশিয়া ধারণার জন্ম দিয়েছে। এখন এশিয়ার ধারণায় চীন প্রাধান্য পাচ্ছে। চীনের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
মাহাথির : দেখুন, ইএইসি (ইস্ট এশিয়ান ইকনোমিক ককাস বা কমিউনিটি) ধারণাটি এসেছিল গ্যাটের (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন টেরিফস অ্যান্ড ট্রেড) ব্যর্থতা থেকে। ওই ব্যর্থতার কারণে আমরা অন্যান্য দেশ, পাশ্চাত্যের অর্থনীতির সাথে সঙ্ঘাতময় অবস্থায় নিজেদের দেখতে পাই। তবে ইউরোপ একত্র হয়ে, উত্তর আমেরিকা একত্র হয়ে তাদের শক্তি বাড়িয়ে নেয়। মালয়েশিয়াকে তাদের মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরও শক্তিশালী হতে হবে। আমাদের দরকার বৃহত্তর ব্লক। আর সেই বৃহত্তর ব্লক হতে পারে পূর্ব এশিয়া। কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে হবে না, কারণ সেটা খুবই ছোট, খুবই দুর্বল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সেই সাথে পূর্ব এশিয়া খুবই শক্তিশালী। তখন আমরা যেকোনো সভায় গিয়ে একবাক্যে জোরালোভাবে আমাদের কথা বলতে পারব। কিন্তু আমেরিকা এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াকে কাজে লাগায়। আমেরিকা চায় না অন্য কেউ তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামুক। ফলে আমরা ওই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি।
তারপর চীন খুবই শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। আমাদের নীতি হলোÑ আমরা সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ থাকব, তবে আমেরিকার মোকাবেলায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীনের কথা আমরা ভাবতে পারি। এ কারণে চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ একটা নীতি আমাদের তৈরি করতে হবে। চীন ও মালয়েশিয়ার মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন : দক্ষিণ চীন সাগর সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
মাহাথির : জি, ওটা একটা সমস্যা। আমরা সেটার সুরাহা করার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন : আপনি কি ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং এখন ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর নতুন ‘টাইগার অর্থনীতি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন?
মাহাথির : না। আমাদের নীতিতে বলা হয়েছেÑ আমরা ‘প্রতিবেশীর সমৃদ্ধি’ চাই। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবেশী সমৃদ্ধ হলে আমাদের সমস্যা কম হবে। তারা গরিব হলে তারা আমাদের দেশে আসতে চাইবে, নানা ধরনের সমস্যা, সঙ্ঘাত সৃষ্টি করবে। তারা সমৃদ্ধ হলে আমরা সেখানে রফতানি করে, বাণিজ্য করে লাভবান হবো। আমি মনে করি, আমাদের কিছু সুবিধা আছে। কারণ আমরা শুরু করেছি আগে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি শিল্পায়িত।
তবে প্রশাসন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী না হওয়ায় আমরা পেছনে পড়ে যাচ্ছি। আমরা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা ভিয়েতনামের মতো এত দ্রুতগতিতে এগোতে পারছি না। এটাই সরকারের ভুল। কারণ তারা মোটেই জানে না বা দেশের কী হচ্ছে সে সম্পর্কে বেপরোয়া। ফলে আমাদের প্রতিবেশীরা যখন সমৃদ্ধ হয়ে যাবে, তখন আমরা আমাদের প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্যরে অভাবে সুবিধা নিতে ব্যর্থ হবো।
প্রশ্ন : মালয়েশিয়ার সুনাম, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আপনাকে আজ বেশ হতাশ মনে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার সামনে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে কি?
মাহাথির : জনগণ খুবই ভালো। মালয়েশিয়ানরা খ্বুই সহিষ্ণু। এখানকার মতো জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও অর্থনীতিগত বিভাজন অন্য কোনো দেশে থাকলে সেখানে সঙ্ঘাত, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হতো। কিন্তু এখানে আমাদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা থাকলেও তা সহিংসতা বাড়ার কারণ নয়।
প্রশ্ন : আপনার কি এই বিশ্বাস আছে যে জাতিগত উত্তেজনা থাকলেও সহিংসতা হবে না?
মাহাথির : যদি না কেউ ভুল কিছু করে বসে। মনে রাখতে হবে, অতীতে সহিংসতার মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের জন্য একটা কমিউনিস্ট আন্দোলন হয়েছিল। এটা আগে ঘটেছে। ১৯৬৯ সালে জাতিগত সহিংসতা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে মালয়েশিয়ার জনগণ বেশ শান্তিপ্রিয়।
সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে মালয়েশিয়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার আমল এবং বর্তমান সময়ের তুলনা করেছেন। তার আমলে নির্মিত মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় সাক্ষাৎকারটি ডিপ্লোম্যাটের পক্ষ থেকে নিয়েছেন জয়েস লি। ৭ অক্টোবর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। নয়া দিগন্তের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাসান শরীফ
প্রশ্ন : আমি শুরু করতে চাই আপনার প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ সময়ে আলোচিত মালয়েশিয়ার জাতিগত উত্তেজনা (রেসিক্যাল টেনশন) নিয়ে। ১৯৭০-এর দশকে আপনি জাতিসঙ্ঘে এক বক্তৃতায় মালয়েশিয়াকে ‘ঔপনিবেশিক সময় থেকে বহুজাতিক টাইম বোমা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আপনার মেয়াদ শেষকালে আপনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, জাতিগত উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। জাতিগত উত্তেজনার ব্যাপারে আপনার নীতি কী ছিল? বর্তমানে এর প্রভাব কী?
মাহাথির : মালয়েশিয়া মিশ্র জনসংখ্যার দেশ। এই দেশে যারা বাস করে, তারা একে অন্যের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন। জাতিগতভাবে ভিন্ন। সংস্কৃতি, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও ভিন্ন। পার্থক্য খুবই বড়। সাধারণত পার্থক্যের কারণে লোকজন একে অন্যের সাথে লড়াই করে, একে অন্যকে অপছন্দ করে, একে অন্যের বিরুদ্ধে এটাকে ব্যবহার করে। ফলে মালয়েশিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে জাতিগত যুদ্ধের আশঙ্কা খুবই সাধারণ ব্যাপার।
আমি যেটা মনে করি তা হলো, আমার ২২ বছরের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে জাতিগত সঙ্ঘাত এত মারাত্মক ছিল না, যা সংঘর্ষের পর্যায়ে উপনীত হয়। তখন কোনো সংঘর্ষ ছিল না। সব সম্প্রদায় আমাকে পছন্দ করত। আর এ কারণেই আমি নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতাম। এখনো জাতিগত উত্তেজনা রয়েছে। তবে আমি মনে করি, আমার প্রধানমন্ত্রিত্বের ২২ বছর সময়কালের চেয়ে তা কম।
তবে অন্যরা এ সমস্যাটি ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না। তারা মনে করে, উদার হয়ে তারা সব জাতিগোষ্ঠীকে খুশি করতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। আপনি উদার হলে চরমপন্থীরা সুযোগ নেবে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর চরমপন্থীরা জাতিগত ইস্যুকে সামনে আনার জন্য উদারবাদের সুযোগ গ্রহণ করেছে। কারণ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কারণে এখন আপনি আলোচনা করতে পারেন, আপনার পছন্দের কথা বলতে পারেন। ফলে তারা লোকজনকে তাদের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন করতে পারে, তারা এসব চরমপন্থী লোকদের পেছনে শামিল হতে শুরু করে। এ কারণেই আবারো জাতিগত উত্তেজনা সামনে এসে পড়েছে।
প্রশ্ন : জাতিগত উত্তেজনা প্রশমন যদি আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন হয়ে থাকে, তবে আপনার সবচেয়ে বড় অতৃপ্তি কী?
মাহাথির : এখন আমার অন্যতম অতৃপ্তি হলো প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে না পারা। আমি চেয়েছিলাম প্রত্যেকের জন্য সমান মর্যাদা সৃষ্টি করতে। অবশ্যই ধনী চীনা, ধনী ভারতীয়, ধনী মালয় থাকার পাশাপাশি গরিব চীনা, গরিব ভারতীয়, গরিব মালয় থাকবে। ফলে এমন কোনো ভাবাবেগ থাকবে না যে, মালয়রা গরিব আর পশ্চাৎপদ অথচ চীনারা ধনী ও উন্নত, তারা থাকে নগরীগুলোতে। এটা আসলেই একটা খারাপ পরিস্থিতি, এটা সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে। আমাদের উচিত হবে সবাইকে নগরীতে আনা, সুশিক্ষিত করা, আরো ভালো অবস্থায় নিয়ে আসা। তা ছাড়া মালয়রা ব্যবসায় বেশ দুর্বল হওয়ায় তাদেরকে বেশি সুযোগ দিতে হবে। নিতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপ।
প্রশ্ন : মালয়রা অলস বলে গত বছর আপনি যে মন্তব্য করেছিলেন, এটা কি তার সাথে সম্পর্কিত?
মাহাথির : এটা কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ২০০৯ সালে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায় ইংরেজি ভাষা বন্ধ করে দেয়ার বর্তমান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে।
আমি সত্য কথা বলেছিলাম। মালয়রা আসলেই অলস। আমরা তাদের সুযোগ দিয়েছিলাম। তারা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। তবে শিক্ষার ব্যাপারে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমি বিজ্ঞান আর গণিত শেখার জন্য ইংরেজি ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। বর্তমান প্রশাসন সেটা থেকে সরে এসেছে। তারা বিজ্ঞান আর ইংরেজি মালয় ভাষায় শেখাতে চায়। অথচ মালয় বিজ্ঞানের ভাষা নয়। অন্যান্য বিষয় স্থির, কিন্তু বিজ্ঞান গতিশীল।
প্রশ্ন : অর্থাৎ এতে মনে হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতিগত সম্পর্ক পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা আপনার অন্যতম কৃতিত্ব, ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াকে পুরোপুরি শিল্পোন্নত করার জন্য নীতিনির্ধারক ‘ভিশন ২০২০’-কে কি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে?
মাহাথির : আমার সময়ে বেশির ভাগ সময় দেশ এগিয়ে চলেছিল। পশ্চাৎযাত্রাও ছিল। কিন্তু অনুপযুক্ত নেতৃত্বের কারণে এখন দেশ স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণ, এখনকার ফোকাস আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা। প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীই টিকে থাকতে চান। তারা মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়ার বদলে অন্যান্য ইস্যু কাজে লাগিয়ে টিকে থাকতে পারবেন। এ কারণে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। সেই সাথে যদি জাতিগত উত্তেজনা, মন্দ প্রশাসন, দুর্নীতি ইত্যাদি থাকে; তবে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ফলে পুরোপুরি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ভিশন ২০২০ আমরা অর্জন করতে পারব না। আমরা কোনোভাবেই তা পারব না। আপনি দেখছেন, মুদ্রার মান পড়ে গেছে, স্টক মার্কেটের অবস্থা খারাপ, লোকজন সাধারণভাবে অখুশি।
প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিদায় দেখার ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে আপনি রাখঢাক করেননি। গত আগস্টে আপনার ব্লগে লিখেছিলেন, গণতন্ত্র মরে গেছে। এতে গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভা পরিবর্তন, মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ উন্নয়ন ব্যাংক (এটা সাধারণভাবে ১এমডিবি নামে পরিচিত) থেকে বিপুল অর্থ খোয়া যাওয়া তথা তহবিল তসফপের বিষয়টি তদন্ত করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের ঢিলেমি, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সদস্য মনোনয়ন নেয়ার মতো বিষয়ে বিশ্লেষণ ছিল। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর আপনি প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করে বারসি ৪.০ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। গণতন্ত্র মারা গেছে, আপনার এই মন্তব্যের আলোকে বিক্ষোভে শামিল হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
মাহাথির : হ্যাঁ, এটাই ছিল শেষ পথ। আমার মনে হয়েছে, আমার মতটি প্রকাশ করা দরকার। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের ব্যাপারে আমি বারসির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। তাই আমি গিয়েছিলাম। এটা কোনো জাতিগত ব্যাপার ছিল না। বারসির সদস্যরা সব সম্প্রদায় থেকে এসেছে। এটা মালয় সরকারের বিরুদ্ধে চীনা বিক্ষোভ ছিল না। এটা কোনোভাবেই জাতিগত বিষয় নয়। তারা যা দাবি করেছিল, আমি সে ব্যাপারে আমার সমর্থন প্রকাশ করেছি।
প্রশ্ন : এর মধ্যে বারসির অন্যান্য দাবি; যেমনÑ নির্বাচন সংস্কার, বিক্ষোভের অধিকার, আরো স্বচ্ছতা ইত্যাদিও কি অন্তর্ভুক্ত ছিল?
মাহাথির : আমি এসবের বিরুদ্ধে নই। আমার সময়কালে কোনো বিক্ষোভ ছিল না। তখন কোনো বারসি ছিল না। লোকজন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে খুশি ছিল। তারা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক করেনি। আমার সরে যাওয়ার পরই কেবল বারসির সমর্থকেরা বিক্ষোভ করছে, এসব দাবি তুলছে। আমার পদত্যাগ করার পর এসব কিছু ঘটছে। আমার আমলে জনগণ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ তোলেনি। সব সময় অভিযোগ জানায়, এমন বহিরাগত লোক থাকতে পারে। তবে এ ধরনের ব্যাপক বিক্ষোভ তখন ছিলই না।
প্রশ্ন : বারসি ৪.০-এর পর পাল্টা সমাবেশের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী, যেটা সেপ্টেম্বরে ‘রেড-শার্ট র্যালি’ নামে পরিচিত?
মাহাথির : সেটা সরকার আয়োজন করেছিল। সেটা বারসি বিক্ষোভকে জাতিগত তথা মালয়দের বিরুদ্ধে চীনা বিক্ষোভ হিসেবে তুলে ধরেছে, যা আদৌ তা নয়। তারা এমনটি করেছে ব্যাংক থেকে খোয়া যাওয়া অর্থ নিয়ে বারসি যে অভিযোগ করেছে, তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। তারা জাতিগত উত্তেজনাকে ইস্যুতে পরিণত করেছে। এটা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু সরকার নিজের প্রতি সমর্থন দেখাতে লোকজনকে সমবেত করতে চাচ্ছে।
প্রশ্ন : মুডিতে মালয়েশিয়ার ক্রেডিট রেটিং এখনো এ৩। কিন্তু আপনি উল্লেখ করেছেন, রিঙ্গিতের মান দ্রুত পড়ে যাচ্ছে, ঋণের পরিমাণ অত্যন্ত উচ্চ। আর ১এমডিবি কেলেঙ্কারি দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। আপনি কি ক্রেডিট রেটিংয়ে বড় ধরনের পতন আশঙ্কা করছেন?
মাহাথির : হতে পারে। যেভাবে চলছে, তেমনটি ঘটতেই পারে। কারণ, এখন ঋণ শোধ করতে বিশেষ করে মার্কিন ডলারে আরো বেশি রিঙ্গিত দিতে হবে। আবার বেশি রিঙ্গিত পেতে হলে অর্থনীতিকে আরো ভালো করতে হবে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। আমরা দ্রুত এগোতে পারছি না। আমরা আরো ধনী হচ্ছি না। আমরা আসলে আরো গরিব হচ্ছি।
প্রশ্ন : মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করতে হলে কী করতে হবে?
মাহাথির : এই মুহূর্তে আমি মনে করি, নাজিব প্রধানমন্ত্রী না থাকলে আস্থা ফিরে আসবে।
প্রশ্ন : এটা কি এতই সহজ হবে? তিনি যদি পদত্যাগ করেন, তবে আইনি জটিলতার সুরাহা কিভাবে হবে? আর ভবিষ্যতে এ ধরনের কেলেঙ্কারি যাতে না ঘটে, সেটা কিভাবে করা যেতে পারে?
মাহাথির : সব কিছুই করা সম্ভব হবে যদি নাজিব প্রধানমন্ত্রী না থাকেন।
প্রশ্ন : এ ধরনের ফলাফল হবে বলে কি আপনি মনে করেন, নাকি মনে করেন হবে না?
মাহাথির : আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আর কোনো গণবিক্ষোভ হওয়ার অশঙ্কা নেই। অনাস্থা ভোটের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। তবে এর সবটাই নির্ভর করে পার্লামেন্ট সদস্যরা তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন কি না তার ওপর। পার্লামেন্ট সদস্যরা কোনো না কোনো কারণে এবং কোনো না কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দায়বদ্ধ, অনুগত। ফলে তারা তা করতে পারছেন না।
প্রশ্ন : এর পর জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা আছে?
মাহাথির : পরবর্তী নির্বাচন। পরবর্তী নির্বাচন হতে তিন বছর বাকি আছে। কিন্তু তখনো যে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, জনগণের মন বদলানোর জন্য টাকাকড়ি অনেক পথ পাড়ি দেবে। আর প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের হাতে টাকা নেই, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তিনি নিজেও তেমনটি স্বীকার করেছেন।
প্রতিটি নাগরিক চায়, তার দেশ সমৃদ্ধ হোক, যাতে সে নিজে তার জীবনকে উপভোগ করতে পারে। কেউ কেউ কিছু করতে সক্ষম হয়, অন্যরা কিছুই করতে পারে না। তবে আমি নিজে কিছু করার মতো অবস্থায় ছিলাম। আর সে কারণে আমি বিখ্যাত হয়েছি। তারপর থেকে আমি যা বলি সেগুলোর অনেক কিছু লোকজন গ্রহণ করে বলে মনে হয়। এ জন্যই বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের চেয়ে আমার বেশি কিছু করার সুযোগ রয়েছে। আমি সাধারণ নাগরিক, তবে কিছু করার জন্য আমার কাছে সুযোগ অনেক বেশি আছে।
প্রশ্ন : কেমন ধরনের নেতৃত্ব আপনি দেখতে চান?
মাহাথির : নেতাকে অবশ্যই তার দেশ নিয়ে ভাবতে হবে, নিজেকে নিয়ে নয়। একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আপনাকে আপনার অবস্থান ধরে রাখতে হবে, তবে সেটা এ জন্য যে- আপনি দেশের জন্য যাতে ভালো কিছু করতে সক্ষম হন।
প্রশ্ন : পরবর্তী নেতা হিসেবে কারো কথা কি আপনার মনে রয়েছে?
মাহাথির : হ্যাঁ, আমি সাধারণভাবে মনে করি, তিনি হতে পারেন আমনোর সাবেক সহসভাপতি। তবে এখন অবশ্যই বিষয়টি খুবই উন্মুক্ত।
প্রশ্ন : আর তাই বিশেষ কারো নাম বলবেন না?
মাহাথির : হয়তো সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী।
প্রশ্ন : আপনি যদি ১৯৮৬ সালে আপনার লেখা দি চ্যালেঞ্জ মালয়েশিয়ার বর্তমান সমস্যাবলি সমাধানের জন্য নতুন করে প্রকাশ করতে চান, তবে তাতে কী বলা হবে?
মাহাথির : আমি সব সময়ই ভাবি, নেতৃত্বের প্রধান কাজই হবে নেতার দায়িত্ব পালন করা। তবে আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, কেবল নেতা হওয়াই যথেষ্ট নয়। নেতার দায়িত্ব হবে নিজের দিকে নয়, দেশের দিকে নজর দেয়া। এখন আমি দেখছি, যে কেউই নেতা হতে পারে না। এমন কাউকে দরকার, যিনি দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ার অবস্থান নিয়ে কিছু জানতে চাচ্ছি। বিশেষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) এবং চীনা সমর্থিত রিজিওনাল কমপ্রেহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ নিয়ে। এসব ব্যাপারে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মালয়েশিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকা নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনা কী?
মাহাথির : আমার সময়ে পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা ছিল সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা। আমরা সাউথ সাউথ সংস্থা সূচনা করি। মার্কিন নীতির কারণে আমি সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমালোচনামুখর ছিলাম। প্রতিটি দেশের ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। তারা এলেই সমস্যা হবে। আপনি মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য স্থানের দিকে দেখুন। তারা মালয়েশিয়ায়ও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
এখন তারা টিপিপি প্রস্তাব করেছে। টিপিপি হলো তাদের একটা হাতিয়ার, তাদের মঙ্গলের জন্যই এর উদ্ভাবন। তারা সব জায়গায় উন্মুক্ত বাজার চায়, যাতে তারা প্রবেশ করতে পারে। এর বিপরীত কথাটা হলো, ‘তুমি আমাদের দেশে আসতে পারো,’ তবে তোমাদের দেশে যাওয়ার মতো শক্তি আমাদের নেই। সেখানে বিক্রির মতো পণ্য আমাদের নেই, অথচ তাদের হাতে সব কিছুই আছে। তাদের আছে মূলধন, তাদের আছে জানাশোনা, তারা এখানকার ছোট-বড় কোম্পানি কিনে নিতে পারে। আর এসবের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তারা সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। এর অর্থ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও।
প্রশ্ন : অনেকে মনে করেন, নাজিবের প্রশাসন টিপিপি অনুমোদন করবে। আপনি কি এর সাথে একমত?
মাহাথির : তিনি এর লাভ-ক্ষতি ভালোভাবে খতিয়ে দেখেননি। তিনি তা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ক হতো বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব এবং আমেরিকার আদর্শ অনুসারে কাজ করতে আগ্রহী।
প্রশ্ন : চীনা প্রসঙ্গে আমি মনে করি, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে আপনার দেয়া ইস্ট এশিয়ান ইকনোমিক ককাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা স্নায়ুযুদ্ধকালের সাউথইস্ট এশিয়া এবং নর্থইস্ট এশিয়ার ধারণা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ইস্ট এশিয়া ধারণার জন্ম দিয়েছে। এখন এশিয়ার ধারণায় চীন প্রাধান্য পাচ্ছে। চীনের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
মাহাথির : দেখুন, ইএইসি (ইস্ট এশিয়ান ইকনোমিক ককাস বা কমিউনিটি) ধারণাটি এসেছিল গ্যাটের (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন টেরিফস অ্যান্ড ট্রেড) ব্যর্থতা থেকে। ওই ব্যর্থতার কারণে আমরা অন্যান্য দেশ, পাশ্চাত্যের অর্থনীতির সাথে সঙ্ঘাতময় অবস্থায় নিজেদের দেখতে পাই। তবে ইউরোপ একত্র হয়ে, উত্তর আমেরিকা একত্র হয়ে তাদের শক্তি বাড়িয়ে নেয়। মালয়েশিয়াকে তাদের মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরও শক্তিশালী হতে হবে। আমাদের দরকার বৃহত্তর ব্লক। আর সেই বৃহত্তর ব্লক হতে পারে পূর্ব এশিয়া। কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে হবে না, কারণ সেটা খুবই ছোট, খুবই দুর্বল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সেই সাথে পূর্ব এশিয়া খুবই শক্তিশালী। তখন আমরা যেকোনো সভায় গিয়ে একবাক্যে জোরালোভাবে আমাদের কথা বলতে পারব। কিন্তু আমেরিকা এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াকে কাজে লাগায়। আমেরিকা চায় না অন্য কেউ তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামুক। ফলে আমরা ওই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি।
তারপর চীন খুবই শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। আমাদের নীতি হলোÑ আমরা সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ থাকব, তবে আমেরিকার মোকাবেলায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীনের কথা আমরা ভাবতে পারি। এ কারণে চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ একটা নীতি আমাদের তৈরি করতে হবে। চীন ও মালয়েশিয়ার মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন : দক্ষিণ চীন সাগর সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
মাহাথির : জি, ওটা একটা সমস্যা। আমরা সেটার সুরাহা করার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন : আপনি কি ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং এখন ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর নতুন ‘টাইগার অর্থনীতি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন?
মাহাথির : না। আমাদের নীতিতে বলা হয়েছেÑ আমরা ‘প্রতিবেশীর সমৃদ্ধি’ চাই। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবেশী সমৃদ্ধ হলে আমাদের সমস্যা কম হবে। তারা গরিব হলে তারা আমাদের দেশে আসতে চাইবে, নানা ধরনের সমস্যা, সঙ্ঘাত সৃষ্টি করবে। তারা সমৃদ্ধ হলে আমরা সেখানে রফতানি করে, বাণিজ্য করে লাভবান হবো। আমি মনে করি, আমাদের কিছু সুবিধা আছে। কারণ আমরা শুরু করেছি আগে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি শিল্পায়িত।
তবে প্রশাসন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী না হওয়ায় আমরা পেছনে পড়ে যাচ্ছি। আমরা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা ভিয়েতনামের মতো এত দ্রুতগতিতে এগোতে পারছি না। এটাই সরকারের ভুল। কারণ তারা মোটেই জানে না বা দেশের কী হচ্ছে সে সম্পর্কে বেপরোয়া। ফলে আমাদের প্রতিবেশীরা যখন সমৃদ্ধ হয়ে যাবে, তখন আমরা আমাদের প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্যরে অভাবে সুবিধা নিতে ব্যর্থ হবো।
প্রশ্ন : মালয়েশিয়ার সুনাম, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আপনাকে আজ বেশ হতাশ মনে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার সামনে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে কি?
মাহাথির : জনগণ খুবই ভালো। মালয়েশিয়ানরা খ্বুই সহিষ্ণু। এখানকার মতো জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও অর্থনীতিগত বিভাজন অন্য কোনো দেশে থাকলে সেখানে সঙ্ঘাত, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হতো। কিন্তু এখানে আমাদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা থাকলেও তা সহিংসতা বাড়ার কারণ নয়।
প্রশ্ন : আপনার কি এই বিশ্বাস আছে যে জাতিগত উত্তেজনা থাকলেও সহিংসতা হবে না?
মাহাথির : যদি না কেউ ভুল কিছু করে বসে। মনে রাখতে হবে, অতীতে সহিংসতার মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের জন্য একটা কমিউনিস্ট আন্দোলন হয়েছিল। এটা আগে ঘটেছে। ১৯৬৯ সালে জাতিগত সহিংসতা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে মালয়েশিয়ার জনগণ বেশ শান্তিপ্রিয়।
No comments